আত্মার বন্ধন — আমার রেয়াংশ
আমার এক আলোকিত সকাল
২০১৮ সালের ২৪শে অক্টোবর।
লক্ষ্মীপূজার দিন।
ভোরের আলো তখন ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিচ্ছে আকাশের কোল।
ঘরের কোণে প্রদীপের দপদপে আলো, ধূপের ধোঁয়ায় ভেসে আসছে দেবীর নাম, আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে আশীর্বাদের গন্ধ।
শান্ত, পবিত্র, অথচ অদ্ভুত এক আলোয় ভরা সকাল সেটা।
ঠিক সেই সময় হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।
ওপাশ থেকে এক উত্তেজিত কণ্ঠ—
“তোর দিদি পুত্রসন্তানের মা হয়েছে!”
এক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থেমে গেল।
তারপর বুকের ভেতর এমন এক আনন্দের ঢেউ উঠল, যা শব্দে বোঝানো যায় না।
চোখের কোণে জল এসে গেল— আনন্দের জল, ভালোবাসার জল।
মনে হচ্ছিল, আজ যেন সত্যিই ভগবান তাঁর আশীর্বাদ বর্ষণ করেছেন।
লক্ষ্মীপূজার দিনে এমন উপহার— এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কী হতে পারে?
চোখের সামনে ভেসে উঠল এক দৃশ্য—
ছোট্ট একটা মুখ, নরম ত্বক, মিষ্টি হাসি,
আর এক আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন যেন জেগে উঠল মনে।
আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।
ছুটে গেলাম নার্সিংহোমে।
সেই ঠান্ডা, সাদা দেওয়ালঘেরা জায়গাটাও যেন আজ অন্যরকম।
রিসেপশনে বসা নার্সের মুখেও হালকা হাসি।
মনে হচ্ছিল, গোটা হাসপাতালটাই আজ এক উৎসবের মন্দির।
প্রতিটি করিডোরে, প্রতিটি ঘরে যেন আশীর্বাদের আলো ছড়িয়ে আছে।
সিঁড়ি বেয়ে একতলায় উঠতেই দেখি— দিদির পাশে কেউ নেই।
মুহূর্তেই বুকটা ধক করে উঠল।
মাথায় হাজারটা প্রশ্ন— “সব ঠিক তো? ও আর বাচ্চা দুজনেই ঠিক আছে তো?”
দিদি মৃদু হেসে শুধু ইশারায় বলল,
“ওই দিকে দেখ।”
আমি পায়ের আওয়াজ কমিয়ে করিডোরে এগিয়ে গেলাম।
দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম—
একটা বড় আলোয় মোড়ানো জায়গার নিচে,
শুয়ে আছে এক টুকরো রোদ্দুর।
তার চারপাশে যেন সময় থমকে গেছে।
চোখে হালকা আলো, ঠোঁটে অচেনা কিন্তু মায়াময় হাসি।
তার ছোট্ট হাতদুটো যেন হাওয়ায় ভাসছে—
যেন বলছে, “আমি এসেছি, তোমাদের জীবনে নতুন আলো আনতে।”
সেই মুহূর্তে আমার সমস্ত ক্লান্তি, ভয়, উদ্বেগ গলে গেল ভালোবাসার উষ্ণতায়।
আমার মনে হল—
এই ছোট্ট প্রাণটাই যেন ঘরের দেবতা।
যে আলোর মতো নেমে এসেছে আমাদের জীবনে।
আমি আস্তে করে ওর মুখের দিকে তাকালাম।
এমন শান্ত, কোমল মুখ আমি জীবনে দেখিনি।
ভেতরটা কেমন যেন নরম হয়ে এল।
চোখের পলক ফেলতেও ভয় লাগছিল,
যেন চোখ ফিরিয়েই ফেললে এই অপার্থিব দৃশ্য হারিয়ে যাবে।
দিদি আস্তে করে বলল,
“দেখ, তোর ভাগ্নে।”
আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
শব্দ বেরোল না, শুধু মনে মনে বললাম—
“রেয়াংশ…”
এই নামটাই যেন নিজের অজান্তে ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল।
হয়তো ভগবানই ফিসফিস করে বলেছিলেন।
সেদিনই বুঝেছিলাম—
জীবনের সব সম্পর্কের ভিড়েও কিছু বন্ধন হয় আত্মার,
যার কোনও ব্যাখ্যা নেই, কোনও সীমানা নেই।
ওই করিডোরে দাঁড়িয়ে, আলো-ছায়ার মাঝে আমি প্রথমবার অনুভব করলাম,
আমার জীবনে এক নতুন আলো এসেছে—
আমার নিজের প্রাণের টুকরো, রেয়াংশ।
প্রথম ছোঁয়া, প্রথম ভালোবাসা
নার্সিংহোমের সেই সকালটা আজও যেন আমার চোখে অমলিন।
সাদা পর্দার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসছিল সূর্যের এক টুকরো আলো,
যেন নতুন প্রাণের জন্মকে স্বাগত জানাতে এসেছে নিজে ভোর।
আমি নিঃশব্দে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ওর নিঃশ্বাসের হালকা ওঠানামা,
ওর ছোট্ট বুকের তালে তালে চলা জীবনের সুর শুনে মনে হচ্ছিল—
এই বুকে যেন এক বিশ্বজগত স্পন্দিত হচ্ছে।

নরম তুলোর মতো হাতের ওপর
ওর ছোট্ট আঙুল ছুঁয়ে গেল আমার আঙুল।
সেই স্পর্শে শরীরটা কেঁপে উঠল —
কিন্তু সেটা ভয় নয়,
এক অবর্ণনীয় ভালোবাসার কম্পন।
দিদি হাসতে হাসতে বলল,
“এই তোর ভাগ্নে, একদম তোকে চিনে ফেলেছে মনে হয়!”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমাকেই চিনবে না তো কাকে চিনবে?”
সেই প্রথম ছোঁয়াতেই মনে হল,
আমার জীবনটা যেন নতুন রঙে রাঙিয়ে উঠল।
আজ থেকে আমি আর শুধু দিদির ভাই নই,
আজ আমি এক মামা —
যার পৃথিবী জুড়ে এখন একটাই নাম — রেয়াংশ।
দিন কেটে যাচ্ছিল।
নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফেরার দিনটা যেন আরও এক উৎসব।
দরজার বাইরে দোলনা, টবে লাগানো নতুন ফুল,
আর ঘরে ঘরে রঙিন ফিতা—
সবাই অপেক্ষায় “বাড়ির নতুন সদস্যের”।
ওর প্রথম রাতের ঘুম,
প্রথম কান্না,
প্রথম চাহনি—
সবকিছুই যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত।
আমি বারবার ওর মুখের ওপর হাত রাখতাম,
দিদি বলত,
“এত বার ছোঁয়াস কেন?”
আমি মৃদু হেসে বলতাম,
“ভয় লাগে রে, মনে হয় এই অলৌকিক স্বপ্নটা যদি হঠাৎ ভেঙে যায়!”
রেয়াংশের চোখদুটো ছিল অদ্ভুত মায়াময়।
ওর দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল,
যা ভাষায় বোঝানো যায় না—
একটা নরম বিশ্বাস,
যেন জন্মের প্রথম দিন থেকেই ও জানে,
এই মানুষটা ওর পাশে চিরকাল থাকবে।
রাতের পর রাত আমি ওর পাশে বসে থাকতাম,
ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতাম,
আর মনে মনে ভাবতাম—
এই শিশুটার জন্য আমি যদি একটুখানি আলো হতে পারি,
তাহলেই জীবনটা সার্থক হবে।
একদিন সকালে, ওর মুখে প্রথম হাসি ফুটল।
দিদি অবাক হয়ে বলল,
“দেখ না, কেমন হাসছে!”
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
ওর ছোট্ট ঠোঁটে যে হাসিটা ফুটেছিল,
সেটা যেন সমস্ত অন্ধকার মুছে দিল আমার মনের ভেতর থেকে।
সেই মুহূর্তে আমি বুঝলাম—
ভালোবাসা আসলে কোনও সম্পর্কের নাম নয়,
ভালোবাসা এক আত্মিক প্রতিজ্ঞা।
রেয়াংশ যেন ধীরে ধীরে শিখিয়ে দিচ্ছিল—
কীভাবে ভালোবাসতে হয়,
কীভাবে নিঃস্বার্থভাবে যত্ন নিতে হয়,
কীভাবে ছোট্ট এক প্রাণ আমাদের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে।
সেদিন বিকেলে, দিদি বলল,
“চল, আজ ওর মুখে প্রথম ভাত দেব।”
রীতি মেনে চালের পায়েস রাঁধা হল।
বাটিতে ছোট্ট চামচে পায়েস তুলে আমি ওর মুখের দিকে এগোলাম।
ওর চোখে তখন কৌতূহল, ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
চামচটা মুখে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই
ওর চোখ দুটো গোল হয়ে গেল, তারপর হেসে উঠল।
দিদি বলল,
“এই তো, মামার হাতে প্রথম ভাত খাওয়া!”
আমার বুকটা যেন ভরে গেল গর্বে আর ভালোবাসায়।
মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কের জন্ম আমি আজ প্রত্যক্ষ করছি।
রেয়াংশের প্রতিটি ছোট্ট হাসি, প্রতিটি কান্না,
আমার জীবনের প্রতিটি দিনকে নতুন করে অর্থ দিত।
আমি তখন বুঝতাম,
ভালোবাসা মানে শুধু থাকা নয় — অনুভব করা।

সেই প্রথম ছোঁয়া,
সেই প্রথম চোখাচোখি,
সেই প্রথম হাসির দিনগুলো—
আজও আমার হৃদয়ের পাতায় চিরকাল অমলিন হয়ে আছে।
রেয়াংশ শুধু আমার ভাগ্নে নয়,
ও যেন আমার নিজের আত্মার প্রতিচ্ছবি,
যে আমাকে প্রতিদিন শেখায়—
নির্ভেজাল ভালোবাসা কীভাবে অনুভব করতে হয়।
লকডাউনের দিনগুলো – আমাদের পৃথিবী
২০২০ সালের মার্চ।
হঠাৎ করেই পুরো দুনিয়া থমকে গেল।
করোনা, লকডাউন, ভয়— সব মিলিয়ে চারদিক অচেনা হয়ে গেল।
কিন্তু সেই সময়টাই আমাদের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় হয়ে রইল।
কারণ তখন আমরা দুজন— মামা আর ভাগ্না, একসঙ্গে বন্দি হলেও, একসঙ্গে মুক্ত ছিলাম।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু ওর হাসি, খেলা, ছোট্ট দুষ্টুমি,
আর আমার endless গল্প বলা।
আমি ওর জন্য গল্প বানাতাম—
“রেয়াংশ নামের এক বীর যোদ্ধা, যে অন্ধকারের রাজাকে হারিয়ে আলো ফিরিয়ে আনে।”
ও খিলখিল করে হাসত, বলত—
“মামা, আমি কি সত্যিই বীর?”
ওর সেই নিষ্পাপ চোখে আমি যেন নিজের শৈশবকে আবার খুঁজে পেলাম।
কখনও আঁকা শিখলাম, কখনও গান গাইলাম, কখনও স্রেফ একসাথে বসে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখলাম।
ওর যত্নে ও ভালোবাসায় আমি বুঝেছিলাম—
রক্তের সম্পর্কের বাইরেও আত্মার বন্ধন বলে কিছু আছে।
সাত বছরের সূর্য
আজ, সেই রেয়াংশের বয়স সাত।
সময় কেমন উড়ে যায়!
মনে হয়, যেন ঠিক কালই ও প্রথম আমার আঙুলটা শক্ত করে ধরেছিল—
চোখে এক অচেনা কৌতূহল, মুখে অজানা হাসি।
আজ সে স্কুলে যায়, নিজের ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয়,
বন্ধুদের সঙ্গে হাসে, ছুটে বেড়ায় মাঠে,
আর কখনো কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে—
“মামা, আমি একদিন উড়ব!”
আমি হেসে বলি,
“তুই তো আগেই উড়ছিস রে, আমার মনের আকাশে।”
তবু একটা জিনিস বদলায়নি—
আমাদের সম্পর্কের গভীরতা, সেই আত্মিক বন্ধন।
যা সময়, দূরত্ব, কিংবা বয়স—
কিছুতেই মুছতে পারেনি।
আজও যখন আমি ওদের বাড়ির নিচে যাই,
বাইকে ব্রেকের শব্দ হতেই,
দরজা খুলে ছুটে আসে ছোট্ট পায়ের শব্দ,
আর সেই মিষ্টি ডাক—
“মামা! তুমি এসেছো!”
পরের মুহূর্তেই ওর দুটি ছোট্ট হাত আমার গলায় জড়িয়ে যায়,
এমনভাবে—
যেন কোনো দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর
প্রাণ একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।
সেই আলিঙ্গনে থাকে এক অলৌকিক উষ্ণতা,
যা সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেয়,
মনে হয়, আমি যেন নিজের ঘরে ফিরে এসেছি—
রেয়াংশের সেই নির্ভেজাল ভালোবাসার কোলে।
ওর চোখে আমি দেখি আমার শৈশব,
আমার নির্ভেজাল ভালোবাসা,
যা এই কোলাহলময় পৃথিবীতে কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল।
রেয়াংশ যেন আমার সেই হারানো সরলতাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
যখন আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি,
ওর একটা হাসিই যথেষ্ট—
সব অন্ধকার মিলিয়ে যায়,
চারপাশে যেন আলোর নদী বয়ে যায়।
ভগবানের কাছে আমার একটাই প্রার্থনা—
রেয়াংশ যেন এমনই হাসতে থাকে,
তার চোখের ঝিলিক যেন কখনও না ম্লান হয়।
জীবনের প্রতিটি সকাল যেন
ওর মতোই আলোকিত হয়।
ওর পথ যেন হয় ভালোবাসায় ভরা,
ওর মন যেন থাকে স্বচ্ছ, নিষ্পাপ, আনন্দে পূর্ণ।
কোনও অন্ধকার, কোনও দুঃখ যেন ওর হাসির আড়ালে এসে দাঁড়াতে না পারে।
আর আমি?
আমার জীবনের একমাত্র চাওয়া—
এই সম্পর্ক, এই মামা-ভাগ্নার আত্মিক বন্ধন,
চিরদিন এমনই অটুট থাকুক।
সময় বদলাবে, মানুষ বদলাবে, পৃথিবী বদলাবে,
কিন্তু এই ভালোবাসা যেন কখনও না বদলায়।
যতদিন সূর্য ওঠে, যতদিন আকাশে আলো থাকে,
ততদিন তুই থাকবি আমার হৃদয়ের এক কোণে—
রোদ্দুর হয়ে, হাসি হয়ে, আলো হয়ে।
আজ তোর জন্মদিন, রেয়াংশ।
শুভ জন্মদিন, প্রিয় প্রাণের টুকরো ❤️
তুই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়,
যে গল্পটা লিখেছে ভগবান নিজে।
তোর জন্মের দিনটা আমার কাছে শুধু তোর নয়,
আমারও এক নতুন জন্মের দিন—
কারণ তুই এসেছিলি,
আর আমার পৃথিবীটা আলোকিত হয়ে উঠেছিল।
আজও আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি—
“ভগবান, তোমার আশীর্বাদ যেন এই ছোট্ট প্রাণের ওপর সর্বদা থাকে।”
রেয়াংশ, তুই আমার আত্মার হাসি,
আমার জীবনের আলো।
যতদিন আমি থাকবো,
ততদিন তুই থাকবি আমার প্রতিটি শ্বাসে,
আমার প্রতিটি প্রার্থনায়।
তুই আমার সূর্য — সাত বছরের, অথচ অনন্ত আলোর।
রেয়াংশ, তুই থাকিস এমনই ভালো, এমনই প্রাণবন্ত।
তোর মামা তো আছেই— সবসময়, তোর ছায়ার মতো পাশে।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			