চুপিচুপি তোমায় দেখি
করিডোরের কোণে বসে থাকা মেয়েটি
শীতের হালকা রোদ জানলার ফাঁক গলে মেঝেতে পড়ে আছে।
স্কুলের পুরনো ভবনের করিডোরটা সবসময় একটু অন্ধকারচেরা গন্ধে ভরা — চকচকে টাইলস, পুরোনো দেয়ালে ঝুলে থাকা পোষ্টার, আর ভাঙা জানলার কাচে আটকে থাকা ধুলোর স্তর।
দুপুরের ঘণ্টা বাজলেই এই করিডোর হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
মাঠের দিক থেকে ভেসে আসে ছেলেমেয়েদের হাসির আওয়াজ, খেলার চিৎকার, আর ঘণ্টার ধ্বনি।
কিন্তু সেই করিডোরে একটা জায়গা আছে, যেখানে সময় থেমে থাকে।
সেখানেই প্রতিদিন বসে থাকে এক চুপিচুপি মেয়ে।
লাল রঙের বেঞ্চ, পাশে এক পুরনো জানলা — তার নিচে ছড়িয়ে থাকে রোদে ঝলমলে ধুলোবালি।
মেয়েটির চুল খোলা, কাঁধ ছুঁয়ে নামছে।
সে খাতা খুলে কিছু আঁকে, হয়তো ফুল, হয়তো কেউ জানে না এমন এক পৃথিবী।
কখনও চোখ তুলে তাকায় জানলার বাইরে, আবার মাথা নিচু করে চুপিচুপি কিছু লিখে যায়।
তার মুখে হাসি নেই, কিন্তু সেই স্থির মুখে যেন হাজারো কথা লুকিয়ে আছে।
একটা গভীর নীরবতা, যা শব্দের থেকেও বেশি উচ্চারণ করে।

সায়ন প্রতিদিন টিফিনে ওর বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে যেত।
কিন্তু মাঠে যাওয়ার আগে চুপিচুপি সে ঠিক ওই করিডোরের পাশ দিয়েই যেত।
কেন যায়, তা সে নিজেও জানে না।
হয়তো একটুখানি দেখার লোভে।
হয়তো মনে হয়, আজ যদি মেয়েটা একবার তাকায়!
বন্ধুরা ছুটে যায়, হাসে, ধাক্কাধাক্কি করে নিচে নামে।
কিন্তু সায়নের পা যেন থেমে যায়।
সে দূর থেকে তাকায়, চুপিচুপি, এক অদ্ভুত মুগ্ধতায়।
মেয়েটার চোখে কিছু একটা আছে — একা থাকার স্বপ্ন, নীরব জেদ, আর হয়তো অজান্তে জমে থাকা কথারা।
রণ, সায়নের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একদিন হঠাৎ খেয়াল করল ব্যাপারটা।
সে মুচকি হেসে বলল,
“দেখি, প্রতিদিন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকিস কেন রে? মেয়েটার প্রেমে পড়েছিস নাকি?”
সায়ন লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল, তবু চোখে হাসি লুকাতে পারল না।
“না রে, কিচ্ছু না। শুধু ভালো লাগে ওকে দেখতে। ওর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা না দেখলে দিনটা ফাঁকা লাগে।”
রণ খিলখিলিয়ে হেসে বলল,
“ভালো লাগলে গিয়ে কথা বল না! নামটা পর্যন্ত জানিস না। এত  লুকোচুরি কিসের?”
সায়ন মৃদু স্বরে বলেছিল,
“চুপিচুপি দেখলেই ভালো লাগে, কথা বললে হয়তো জাদুটা নষ্ট হয়ে যাবে।”
সেদিন থেকেই এই কথাটা রণের মুখে রয়ে গেল ঠাট্টা করার জন্য,
আর সায়নের মনে রয়ে গেল এক নরম সত্য হিসেবে।
দিন কেটে যায়।
একদিন বৃষ্টি এল হঠাৎ।
টিফিনের সময় পুরো স্কুলে ছাতা মেলার হিড়িক।
সবাই দৌড়ে মাঠ থেকে ছুটে আসে।
সায়ন জানলার পাশে চুপিচুপি গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে মেয়েটি আজও বসে।
জানলার ওপারে ঝরছে বৃষ্টি, সে চুপচাপ দেখছে —
বৃষ্টির ভেতর দিয়ে সায়ন দেখতে পেল মেয়েটির ঠোঁটে একটুখানি হাসি, যেন নিজের মনে কথা বলছে।
তার আঙুলে খাতার পৃষ্ঠায় ঝরে পড়া বৃষ্টির জল শুকিয়ে নিচ্ছে।
সেই মুহূর্তটা সায়নের কাছে অমর হয়ে গেল।
হৃদয়টা কেমন করে উঠল, বুকের ভেতর হালকা কম্পন।
সে জানে, এ কোনও সাধারণ অনুভূতি নয়।
কিন্তু আবার ভয়ও আছে— সে জানে না মেয়েটা কে, নামও না, শ্রেণিও না।
শুধু জানে, জানলার নিচে বসে থাকা সেই মেয়ে যেন ওর দিনের সবচেয়ে শান্ত দৃশ্য।
পরের সপ্তাহে সায়ন একদিন সাহস করে কাছে গেল।
মেয়েটি খাতা খুলে আঁকছিল— সাদা পাতায় নীল কালি দিয়ে এক ছেলেকে আঁকছে, হয়তো কাল্পনিক।
সায়ন থেমে দাঁড়াল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না।
হঠাৎ মেয়েটি তাকাল, চোখাচোখি হলো এক মুহূর্তের জন্য।
দুজনের চোখে এক অচেনা চিনে নেওয়া।
সায়নের গলা শুকিয়ে গেল, মনে হলো, ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
মেয়েটি আবার চোখ নামিয়ে লিখতে লাগল।
সায়ন আস্তে করে পা টিপে সরে গেল— বুকের ভেতর কেমন এক আনন্দের ঢেউ।
এর পর থেকে প্রতিদিনই সে তাকায়, কিন্তু আর এগোয় না।
কথা বলে না।
শুধু দেখে, আর মনে মনে ভাবে—
একদিন হয়তো কথা হবে, হয়তো নামটা জানবে।
কিন্তু সেদিন কখনও আসে না।
তবু প্রতিদিনই, সায়নের দিনের শুরু হয় সেই মেয়েটার নীরব মুখ দিয়ে,
আর শেষ হয় সেই চোখ দুটো ভাবতে ভাবতে।
ওরা দুজন হয়তো জানেও না,
তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক নীরব গল্প—
যার নাম কেউ রাখেনি তখনও,
কিন্তু একদিন সেটাই হয়ে উঠবে—
“চুপিচুপি তোমায় দেখি।”
নীরব প্রেমের সূচনা
শীত পেরিয়ে বসন্ত এসে গেছে।
স্কুলের মাঠে কচি ঘাস, জানলার পাশে গাছের ডালে পাখির ডাক।
সবকিছুতেই এক নতুন ছোঁয়া — শুধু সায়নের ভেতরটা যেন আগের মতোই চুপচাপ।
বাইরে যত হইচই, ওর মনে প্রতিদিন একটা স্থির ছায়া ঘুরে বেড়ায় —
জানলার নিচে বসে থাকা মেয়েটির মুখ।
এখন ওর দেখা এক অভ্যাস হয়ে গেছে।
দিন না দেখলে অদ্ভুত এক শূন্যতা তৈরি হয় মনে।
বইয়ের পাতা খুললেও অক্ষর গুলিয়ে যায়, বন্ধুর হাসির মাঝেও কানে বাজে অন্য সুর।
মনে হয়, ও যেন সেই মেয়েটির আঁকার পাতার একটা চরিত্র—
যে শুধু দূর থেকে দেখে যায়, স্পর্শ করতে জানে না।
একদিন বিকেলে স্কুলে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সবাই ব্যস্ত সাজগোজে, সায়নও একটা কবিতা আবৃত্তি করবে।
বড় হলে গানের মহড়া চলছে, হাসি-ঠাট্টায় ভরা পরিবেশ।
কিন্তু সায়নের চোখ সবসময় খুঁজে বেড়ায় একটিই মুখ।
অবশেষে করিডোরে গিয়ে ওর দেখা পেল।
আজ মেয়েটির চুল খোঁপায় বাঁধা, পরনে নীল ফ্রক।
খাতার বদলে হাতে একটা স্কেচবুক —
সে হয়তো কারও ছবি আঁকছে, মনোযোগে হারিয়ে গেছে নিজের জগতে।
সায়ন কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল,
তারপর সাহস করে এগিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“তুমি… প্রতিদিন কিছু না কিছু আঁকো, তাই না?”

মেয়েটি একটু চমকে তাকাল।
চোখের দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু তাতে এক অচেনা বিস্ময়।
মৃদু হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে।
“হ্যাঁ… আঁকি। যা দেখি না, তাই আঁকি।”
সায়ন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
ওর কণ্ঠ শুকিয়ে গেল, যেন সব শব্দ হারিয়ে ফেলেছে।
মেয়েটি আবার খাতার দিকে তাকাল, বলল,
“তুমি কবিতা লেখো?”
সায়ন বিস্মিত হয়ে বলল, “তুমি জানলে কী করে?”
“দু’দিন আগে দেখেছিলাম, তুমি লাইব্রেরির কোণে কিছু লিখছিলে। মনে হলো, কবিতা ছাড়া এমন ভাবে কেউ কিছু লেখে না।”
এই ছোট্ট কথাগুলোই যেন একটা দরজা খুলে দিল।
দু’জনের মধ্যে নীরবতার ভেতর একটা হালকা আলাপ জমে উঠল।
সেদিন ওরা প্রথম কথা বলেছিল—
না, প্রেমের নয়, কিন্তু এক অদ্ভুত শান্তির।
যেন দু’জনেই অনেকদিন ধরে একে অপরকে চিনত, শুধু ভাষা খুঁজে পায়নি।
তারপর থেকে টিফিনের সময় মাঝে মাঝে দু’জনের দেখা হতো।
কথা কম, হাসি বেশি।
সায়ন জানল, মেয়েটির নাম ঈশা।
ওর বাবা ট্রান্সফারে শহরে এসেছে সম্প্রতি, তাই স্কুলটাও নতুন।
চুপচাপ মেয়ে, কিন্তু ওর নোটবুকে আছে হাজারো রঙের পৃথিবী।
একদিন ঈশা সায়নকে ওর স্কেচবুক দেখাল।
পাতা পাতায় মিশে আছে ছায়া, বৃষ্টি, একা বেঞ্চ, আর এক ছেলের অবয়ব—
যে ছেলেটা অনেকটা সায়নের মতো।
সায়নের বুকটা হঠাৎ থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য।
কিন্তু কিছু না বলে শুধু হাসল।
ঈশা বলল,
“তুমি জানো, আমি তোমার মতো মানুষদের ভালোবাসি— যারা চুপচাপ দেখে যায়, কিন্তু কিছু বলে না। ওরা সবচেয়ে সত্যি।”
সায়নের চোখে যেন আলো জ্বলে উঠল।
সে বলল,
“তুমি জানো, আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখতাম করিডোরের জানলার পাশে বসে। ভাবতাম, তুমি কী ভাবো এত?”
ঈশা মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“তুমি কি আজও দেখো?”
সায়ন কিছু বলল না— শুধু মাথা নিচু করল, যেন উত্তরটা তার চোখেই লেখা।
তারপর থেকে ওদের মধ্যে আর কোনও কথার প্রয়োজন পড়ত না।
বৃষ্টি পড়ুক, রোদ হোক বা পরীক্ষার চাপ—
যখনই দেখা হতো, চোখে চোখে কথা চলত।
স্কুলের শেষ ঘণ্টা বাজলেও সেই দৃষ্টি থামত না।
একটা নীরব প্রেম তৈরি হচ্ছিল,
যেখানে ভাষা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে, আর সময় থেমে যাচ্ছে এক জানলার পাশে।
একদিন হঠাৎ ঈশা বলল,
“জানিস, আমি একদিন তোমার গল্পে থাকতে চাই।”
সায়ন অবাক হয়ে তাকাল,
“গল্পে?”
ঈশা হেসে বলল,
“তুমি যেভাবে পৃথিবী দেখো, তাতে আমি থাকতে চাই— তোমার চোখের ভেতর দিয়ে।”
সেদিন সায়ন আর কিছু বলতে পারেনি।
মনে মনে ভাবল,
একদিন যদি সত্যিই সে গল্প লেখে, তবে সেই গল্পের নাম হবে—
“চুপিচুপি তোমায় দেখি।”
কিন্তু সেই মুহূর্তে ও জানত না,
সময় কত নিষ্ঠুরভাবে এই শান্ত পৃথিবীটাকে বদলে দেবে।
জানত না, কিছু গল্প অসমাপ্ত থেকে যায়,
আর কিছু প্রেম নিজের ভাষা খুঁজে পায় বহু বছর পর।
বারো বছর পরে
সময় বড় অদ্ভুত জিনিস।
সে চুপিচুপি সবকিছু বদলে দেয় — মুখ, শহর, সম্পর্ক, এমনকি স্বপ্নও।
কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি থাকে অপরিবর্তিত, ঠিক আগের মতো,
যেভাবে এক পুরোনো ছবির কোণায় লেগে থাকা ধুলোকণাও মুছে যায় না।
বারো বছর কেটে গেছে সায়ন আর ঈশার দেখা হয়নি।
স্কুল শেষের পরই ঈশার বাবা আবার ট্রান্সফারে চলে যান অন্য শহরে।
সেদিন বিদায়ের সকালে ঈশা এসে বলেছিল,
“তুমি গল্প লিখবে, তাই না? প্রতিশ্রুতি দাও, আমায় লিখবে একদিন।”
সায়ন বলেছিল,
“তুমি যদি থাকো, আমি প্রতিটি গল্পেই তোমাকে খুঁজব।”
তারপর ভিজে চোখে ঈশা চলে গেল, আর সায়নের জীবনে নেমে এল এক দীর্ঘ নিস্তব্ধতা।
প্রথমে চিঠি ছিল।
কিছুদিন যোগাযোগও হয়েছিল, কিন্তু সময়ের ভিড়ে সেই বন্ধন হারিয়ে গেল।
মোবাইল এল, ফেসবুক এল, নতুন মানুষ এল জীবনে—
তবু সায়নের মনে প্রতিদিন একটা জানলার কোণে কেউ বসে থাকে,
খাতা খুলে কিছু আঁকে, নীরবে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
এই দৃশ্যটাই ওর লেখার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠল।
আজ সায়ন একজন জনপ্রিয় গল্পলেখক।
বয়স তিরিশ পেরিয়েছে, কিন্তু চোখে সেই একই মুগ্ধ নরম দৃষ্টি।
ওর গল্পে প্রেম আসে, কিন্তু কখনও সরাসরি নয়—
সব সময় সেখানে একটা “অদেখা মুখ”, একটা “চুপচাপ মেয়ের ছায়া” থাকে।
পাঠকরা বলে,
“তোমার গল্পে মেয়েরা সবসময় কেমন নীরব, কিন্তু গভীর!”
সায়ন হেসে বলে,
“কারণ নীরবতার মধ্যেই সবচেয়ে বড় ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।”

আজ তার নতুন বই “চুপিচুপি তোমায় দেখি” প্রকাশ পাচ্ছে।
একটা সাহিত্য উৎসবে ভিড় লেগেছে।
পোস্টার, আলো, ক্যামেরা— চারদিক গুঞ্জনে ভরা।
মঞ্চে সায়ন বসে আছে, পাশে প্রকাশক, সামনে সাংবাদিকরা।
হোস্ট বলছে,
“এই বইয়ে লেখক নিজের জীবনের বাস্তব ও কল্পনার মিশেল দিয়েছেন।
প্রেম, নীরবতা আর পুনর্মিলনের গল্প— যা পাঠকের হৃদয়ে ছোঁয়া দেবে।”
সায়ন মৃদু হাসল।
তার মনে পড়ছে করিডোরের সেই বিকেলগুলো,
ঈশার হালকা হাসি, আর সেই শেষ দিনের প্রতিশ্রুতি—
“তুমি গল্পে আমায় রাখবে।”
সে আজ সেই প্রতিশ্রুতি রাখছে।
বই প্রকাশের পর সবাই বইতে সই নিচ্ছে, ছবি তুলছে।
এই ভিড়ের মাঝেই সায়নের চোখে পড়ল এক অচেনা মেয়েকে।
হালকা সাদা শাড়ি, চোখে চশমা, চুল খোলা।
সে হাতে একটা ফুল ধরে এগিয়ে আসছে— ধীরে, শান্তভাবে।
সায়ন প্রথমে চিনতে পারল না।
কিন্তু যখন মেয়েটি মঞ্চের কাছে এসে বলল,
“তুমি যাকে গল্পে লিখেছিলে, সেই আমি,”
তখন সায়নের বুকের ভেতরটা হঠাৎ থেমে গেল।
সে তাকিয়ে রইল।
চোখের সামনে যেন সময়ের কুয়াশা সরে গেল—
বারো বছর আগের সেই চোখ, সেই নীরবতা, সেই অদ্ভুত হাসি।
সায়নের ঠোঁট কাঁপছে, সে বলল,
“ঈশা… তুমি?”
ঈশা মাথা নেড়ে হেসে বলল,
“হ্যাঁ, আমি। তুমি রেখেছিলে প্রতিশ্রুতি, তাই আমিও রেখেছি।”

ভিড়ের মধ্যে সব আওয়াজ যেন মিলিয়ে গেল।
দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, সময়ের দুই প্রান্তে—
একজন গল্প লিখেছে, আরেকজন গল্প হয়ে বেঁচে ছিল।
ঈশা বলল,
“আমি তোমার বই পড়েছি। তুমি এখনো জানলার পাশে বসা মেয়েটাকেই লেখো।”
সায়ন হেসে বলল,
“কারণ আমি জানি না, তাকে ছাড়া অন্য কেউ আমাকে লেখায়।”
ঈশা মৃদু স্বরে বলল,
“আমি তো সব সময় তোমার গল্পেই ছিলাম, শুধু তুমি জাননি।”
সায়ন অনুভব করল, তার চোখে জল এসে গেছে।
বারো বছর আগের সেই অনুচ্চারিত ভালোবাসা আজ ভাষা পেয়েছে।
দু’জনের মাঝের নীরবতা ভরছে আবেগে,
যেন পুরো পৃথিবী এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেছে।
ক্যামেরার ফ্ল্যাশে মুহূর্তটা বন্দী হলো—
এক লেখক ও তার প্রেরণা,
এক নীরব প্রেম, যা সময়ও মুছে দিতে পারেনি।
সেদিন রাতে, বাড়ি ফিরে সায়ন লিখল বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা—
“কিছু প্রেম কখনও উচ্চারণ পায় না।
কিন্তু তারা গল্প হয়ে বেঁচে থাকে,
প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি নীরবতায়, প্রতিটি দৃষ্টিতে।”
জানলার বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল।
সায়ন মনে মনে বলল,
“আমি আজও তোমায় দেখি, ঈশা—
চুপিচুপি।”
অচেনা পরিচয়
রাতের শহর তখন নিস্তব্ধ।
বই প্রকাশের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগে, তবু সায়নের মন যেন সেই ভিড় থেকে এখনো বেরিয়ে আসেনি।
ঈশার মুখটা এখনো ভাসছে চোখের সামনে —
একটা মুখ, যেটাকে সে প্রতিদিন কল্পনায় দেখেছে,
কিন্তু ভাবেনি, বাস্তবে একদিন এমনভাবে ফিরে আসবে।
ভেতরে কেমন এক অদ্ভুত ভয় আর আনন্দ মিশে গেছে।
সে জানে না কী বলবে, কীভাবে আচরণ করবে।
কত কথা জমে আছে তার ভিতরে —
বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা প্রশ্ন, অভিমান, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা।
তবুও যখন ঈশা তার সামনে দাঁড়াল, সব শব্দ হারিয়ে গেল।
হঠাৎ ফোনে মেসেজ এল —
ঈশা লিখেছে,
“তুমি যদি সময় পাও, কাল কফি খেতে যাবে? কিছু কথা আছে।”
সায়নের হাত কেঁপে উঠল।
একটা হাসি ফুটল মুখে।
সে উত্তর দিল, “অবশ্যই। বারো বছর দেরি হয়েছে, এবার আর না।”
পরের দিন সকাল।
ছোট্ট এক কফিশপে সায়ন অপেক্ষা করছে।
টেবিলে রাখা কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, জানলার বাইরে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি।
একটা হালকা সুর বাজছে দোকানের ভেতরে — পুরোনো দিনের বাংলা গান।
ঈশা ঢুকল।
সাদা শার্ট, নীল ওড়না, চুল খোলা।
মুখে সেই চেনা নরম হাসি।
সায়নের চোখে আবার বারো বছর আগের সেই করিডোর ফিরে এল।
দুজনের চোখে চোখ পড়ল, কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলল না।
তারপর ঈশা মৃদু স্বরে বলল,
“বিশ্বাস করো, আমি কখনোই তোমাকে ভুলিনি।”
সায়ন একটু চুপ থেকে বলল,
“আমিও পারিনি। শুধু ভাবতাম, যদি একদিন দেখা হয়… তাহলে কী বলব। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, কিছু বলার দরকার নেই।”
ঈশা হাসল।
“তবু কিছু কথা থেকে যায়, না বললেই যে বোঝা কমে যায়, এমন নয়।”
সে কফির কাপটা হাতে নিয়ে ধীরে বলল,
“জানিস, আমি সবসময় ভয় পেতাম। ভাবতাম, তুমি হয়তো বদলে গেছো, হয়তো আর মনে রাখোনি। কিন্তু গতরাতে তোমার বইটা যখন পড়লাম, মনে হলো তুমি এখনো আগের মতোই… সেই করিডোরের ছেলেটা।”
সায়ন নিচু গলায় বলল,
“আমি বদলাইনি। কেবল বছরগুলো পেরিয়েছে।
আমি গল্প লিখেছি, কিন্তু প্রতিটি গল্পেই তোমাকেই খুঁজেছি।”
ঈশার চোখে জল চিকচিক করে উঠল।
সে বলল,
“তুমি জানো, আমি তখন থেকে প্রতিদিন তোমার জন্য কিছু আঁকতাম— একটা মুখ, একটা জানলা, একটা ছায়া।
বাবা যখন ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল, সেই খাতাটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আজও রেখেছি।
তুমি যেভাবে গল্পে আমাকে রেখেছ, আমিও তোমাকে রেখেছিলাম রঙের ভেতর।”
সায়নের বুকের ভেতর কেমন এক গরম ঢেউ উঠল।
সে বলল,
“তুমি যদি না থাকতে, আমি লেখক হতাম না।”
ঈশা হেসে বলল,
“আর তুমি না থাকলে আমি কখনো আঁকতে পারতাম না। আমরা একে অপরের নীরব প্রেরণা।”
বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে নামছে।
জানলার কাচে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে।
দুজনেই চুপ করে বসে রইল — কিন্তু সেই চুপচাপ সময়েও যেন হাজারটা কথা বয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
সায়ন মৃদু স্বরে বলল,
“তুমি আজও জানলার পাশে বসো?”
ঈশা হাসল,
“হ্যাঁ, এখনো। শুধু স্কুলের জায়গাটা বদলেছে, কিন্তু জানলার পাশে বসে থাকা অভ্যাসটা যায়নি।
আর তুমি? আজও কি চুপিচুপি কাউকে দেখো?”
সায়ন হেসে বলল,
“হ্যাঁ, দেখি — গল্পের পাতায়।”
ঈশা তাকিয়ে রইল তার দিকে।
চোখে এক অদ্ভুত শান্তি, যেন বছরের পর বছর অপেক্ষার শেষ হয়েছে।
সে বলল,
“তুমি জানো, আমি ভাবিনি আমরা আবার দেখা পাব। কিন্তু তোমার গল্প আমায় টেনে এনেছে। যেন ওই শব্দগুলো ডাকছিল।”
সায়ন বলল,
“গল্প কখনও শুধু কল্পনা নয়, অনেক সময় সে বাস্তবকেও ফেরায়।”
ঈশা মৃদু হেসে বলল,
“তাহলে আজ থেকে আমি আবার তোমার গল্পে আছি?”
সায়ন একটু ঝুঁকে উত্তর দিল,
“না, তুমি এখন আমার জীবনে আছো।”
দুজনেই হেসে উঠল।
বৃষ্টির শব্দটা যেন তাদের হাসির সঙ্গে মিশে এক নরম সুর তৈরি করল।
বাইরে রাস্তায় লোকজন ছাতা নিয়ে হাঁটছে, দোকানের আলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়।
ভেতরে দুই মানুষ বসে আছে —
যারা একসময় ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল,
আজ আবার নীরবতার ভেতর ভাষা খুঁজে পেয়েছে।
ঈশা টেবিল থেকে একটা ছোট স্কেচবুক বের করল।
পাতা খুলে দেখাল —
সেখানে আঁকা, এক জানলার পাশে বসা মেয়ে আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছেলে।
নীচে লেখা,
“চুপিচুপি তোমায় দেখি।”
সায়ন কিছু বলল না, শুধু পৃষ্ঠাটা স্পর্শ করল।
তার চোখে জল চিকচিক করছিল,
কিন্তু ঠোঁটে একটুখানি হাসি —
যা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না,
শুধু অনুভব করা যায়… নীরবে।
“সব প্রেম প্রকাশ পায় না। কিছু প্রেম শুধু গল্প হয়ে বেঁচে থাকে—
আর কিছু প্রেম গল্পের ভেতর থেকেই ফিরে আসে।”

 
		 
			 
			 
			 
			 
			