“ভুলুর গণেশ চতুর্থীর কাণ্ড”
ভুলুর শপথ
গণেশ চতুর্থী আসছে। সারা গ্রামে সাজসজ্জার তোড়জোড় চলছে। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল উঠছে, আলো টাঙানো হচ্ছে, ঢাক-ঢোল বাজছে। সবাই ব্যস্ত নিজের নিজের দায়িত্ব নিয়ে।
ভুলু দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। হঠাৎ বুক ফুলিয়ে বলল—
—“শোনো সবাই! এ বছর গণেশ চতুর্থীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমি নেব।”
গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে তাকাল। কেউ মুচকি হেসে বলল—
—“তুই আবার কোন দায়িত্ব সামলাতে পারবি?”
ভুলু চোখ পাকিয়ে উত্তর দিল—
—“আমি শপথ করছি, এ বছর গণেশ উৎসবটা গ্রামে স্মরণীয় করে রাখব।”
সে শপথ নিল—
- মূর্তি আনার দায়িত্ব তার।
- প্যান্ডেল সাজানোও সে সামলাবে।
- প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থাও সে করবে।
- আর সবচেয়ে বড়ো কথা, বিসর্জন পর্যন্ত সবকিছু তার নজরদারিতে চলবে।
লোকজন মাথা নেড়ে হেসে ফেলল। একজন বলল—
—“ঠিক আছে, ভুলু। তুই যদি সব সামলাতে পারিস, তবে গ্রামে তোর নাম হবে ‘ভুলু কমিটি প্রেসিডেন্ট।’”
ভুলু আরও গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল—
—“আমি শুধু প্রেসিডেন্ট নই, আমি হব ভুলু মহারাজ!”
এমন ঘোষণায় চারদিকে হাসির রোল পড়ে গেল।
মূর্তি আনার কাণ্ড
শপথ নেওয়ার পর ভুলু খুব গম্ভীরভাবে ঘোষণা দিল—
—“আমি নিজেই মূর্তি কিনে আনব। এইবার গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর গণেশ মূর্তি হবে।”
সকালে একটা পুরনো সাইকেল নিয়ে সে বাজারের দিকে রওনা দিল। মাথায় গামছা, চোখে চশমা, আর মুখে গুনগুন করে গান—
“ভুলু আনছে গণপতি, সবাই হবে খুশি খুশি।”
কিন্তু বাজারে গিয়ে গণ্ডগোল বাধল।
ভুলু আর হাতির খেলনা
গণেশ মূর্তির দোকান আর খেলনার দোকান পাশাপাশি ছিল। ভুলু ঢুকে পড়ল খেলনার দোকানে। সেখানে বড় বড় রঙিন হাতির খেলনা সাজানো ছিল। একটা দেখে তার চোখ চকচক করে উঠল।
—“বাহ! একদম আসল হাতির মতো! এটাই তো আসল গণপতি!”
সে খুশিতে লাফ দিয়ে বলল দোকানদারকে—
—“ভাই, এই হাতিটার দাম কত?”
দোকানদারও ভেবে নিল ভুলু হয়তো বাচ্চাদের জন্য কিনছে। দাম বলতেই ভুলু গর্বভরে খেলনাটা কিনে সাইকেলের সামনে বেঁধে নিল।
দূর থেকে মানুষ দেখল—ভুলু সাইকেলে হাতির খেলনা বেঁধে আনছে। সবাই অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল—
—“অরে এ কী আনলি? এটা তো গণেশ মূর্তি নয়!”
ভুলু দাঁত বের করে বলল—
—“তোমরা বোঝ না! হাতি মানেই তো গণেশ। মূর্তি কেনার দরকার কী, আমি একেবারে আধুনিক গণপতি এনেছি।”
গ্রামবাসী হেসে লুটোপুটি খেল। কেউ বলল—
—“এবার ভুলুর নামে প্যান্ডেল বানাতে হবে।”
আরেকজন যোগ করল—
—“হাতির খেলনা দিয়ে গণেশ পূজা হবে, এও নতুন ইতিহাস।”
অবশেষে পুজো কমিটির মোড়ল এসে খেলনাটা সরিয়ে দিয়ে আসল গণেশ মূর্তি আনার ব্যবস্থা করলেন।
কিন্তু গ্রামে সেই দিন থেকে সবাই ভুলুকে নতুন নাম দিল—
“হাতি-গণপতি ভুলু।”
প্যান্ডেল সাজানো কাণ্ড
ভুলুর মহা পরিকল্পনা
মূর্তি আনার কাণ্ডের পরেও ভুলু দমে যায়নি। সে গর্বভরে ঘোষণা দিল—
—“এবার প্যান্ডেল সাজানোর দায়িত্ব আমার। গ্রামে এমন সাজসজ্জা হবে যে, পাশের গ্রামের লোকজন হিংসায় জ্বলবে!”
গ্রামবাসী আবার হেসে বলল—
—“ঠিক আছে, দেখি তোর জাদু।”
ভুলু শুরু করল অদ্ভুত সব কাজ।
- গাঁদা ফুল না পেয়ে মাঠের ঘাস জড়ো করে মালা বানাল।
- রঙিন আলো না পেয়ে কেরোসিন লণ্ঠনে লাল-নীল কাগজ জড়িয়ে দিল।
- প্যান্ডেলের ছাদ ঢাকার কথা বাদ দিয়ে পুরোটা খোলা রাখল, বলল—
—“এভাবে আকাশটাই হবে ছাদ!”
সবচেয়ে বড় কাণ্ড ঘটল যখন ভুলু প্যান্ডেলের মাঝখানে একটা বড় বাঁশ গেড়ে তাতে নিজের পুরোনো জামা ঝুলিয়ে দিল।
—“এটাই হবে গণপতির পতাকা। সবার নজর এখানেই যাবে।”
লোকজন অবাক হয়ে বলল—
—“এটা আবার কী!”
ভুলু গম্ভীর মুখে বলল—
—“আধুনিক শিল্পকলার নাম শোনোনি? এটাই আমার আর্ট!”
প্যান্ডেলের ভাঙন
সন্ধ্যায় ঢাকঢোল বাজিয়ে মানুষ যখন আসতে শুরু করল, হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় ঘাসের মালা উড়ে গেল, লণ্ঠনের কাগজে আগুন ধরে গেল আর বাঁশের পতাকা ভেঙে সোজা ভুলুর মাথায় পড়ল।
ভুলু চিৎকার করে দৌড়াতে লাগল—
—“বাঁচাও! আমার আধুনিক শিল্পকলা ভেঙে গেল!”
হাসির রোল
পুরো গ্রাম হেসে লুটোপুটি। সবাই বলল—
—“যেখানে ভুলু, সেখানেই গোলমাল।”
কেউ আবার ঠাট্টা করে বলল—
—“এ বছর প্যান্ডেলের নাম হবে—‘ভুলু শিল্প মহোৎসব।’”
ভুলু মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল—
—“হুঁ, তোমরা হাসো, কিন্তু একদিন আমার সাজসজ্জা পুরো জেলা কাঁপাবে।”
“ভুলুর গণেশ সাজা”
নতুন আইডিয়া
ভুলুর মাথায় আবার খটকা—
—“শুধু মূর্তি, প্যান্ডেল এসব দিয়ে হবে না। যদি আমি নিজেই গণেশ সাজি? তাহলেই সবাই অবাক হয়ে যাবে!”
গ্রামের লোকজন আতঙ্কিত—
—“আবার শুরু হলো! এ বারের কাণ্ড কী রে ভুলু?”
সাজগোজের প্রস্তুতি
ভুলু বাড়ি থেকে নিয়ে এল—
- ঠাকুমার পুরনো লাল শাড়ি (গণেশের ধুতি ভেবে)
- দাদুর পুরনো গামছা (পাগড়ি বানানোর জন্য)
- বাঁশের ঝুড়ি (মোদকের পাত্র হিসেবে)
তারপর কাদামাটির মুখে সে গোঁফ এঁকে নিলো, নাকে বাঁশের নল গুঁজে দিল। আয়নায় দেখে নিজেরাই বলল—
—“বাহ! একেবারে আসল গণপতি।”
গ্রামে শো–স্টপার ভুলু
প্যান্ডেলে যখন সবাই মূর্তির সামনে ভিড় করেছে, ভুলু হঠাৎ পিছন থেকে ঢুকে পড়ল—
—“গণপতি বাপ্পা মোরিয়া!”
সবাই চমকে তাকিয়ে দেখল, মূর্তির পাশে আরেকটা মোটা–মোটা কানওয়ালা গণেশ দাঁড়িয়ে আছে!

কেউ হাসছে, কেউ ভয় পাচ্ছে। এক বুড়ো দাদু তো বলেই ফেলল—
—“আরে বাবা, গণেশ মূর্তি জীবন্ত হয়ে নেমে এসেছে নাকি?”
বিপদে ভুলু
ভুলু ভক্তদের আশীর্বাদ করতে গিয়ে সবার মাথায় হাত চাপড়ে দিল। কেউ ঠাট্টা করে তার সামনে লুচি আর লাড্ডু রাখতেই ভুলু সত্যি সত্যি খেতে শুরু করল।
ভিড় চেঁচিয়ে উঠল—
—“এই যে! আসল গণেশ তো খায় না!”
ভুলু মুখ ভরে বলে উঠল—
—“আমি আধুনিক গণেশ, খাওয়া-দাওয়াও করি!”
শেষের হাসির কাণ্ড
কিন্তু বিপদ হলো যখন বাঁশের নল (যেটা সে শুঁড় বানিয়েছিল) হঠাৎ কাশির সময় গলায় ঢুকে গেল। ভুলু কাশতে কাশতে ছুটে বেরোল প্যান্ডেল থেকে।
লোকজন হেসে কাহিল—
—“ভুলুর গণেশ সাজাই এবার উৎসবের আসল আকর্ষণ।”
প্রসাদের কাণ্ড
ভুলুর নতুন দায়িত্ব
প্যান্ডেলের কাণ্ডে সবাই বুঝে গিয়েছিল ভুলুকে দিয়ে কাজ করানো মানে ঝামেলা। তবুও সে এত জেদ ধরল যে কমিটি শেষে একটা দায়িত্ব দিয়ে দিল—
—“ঠিক আছে ভুলু, তুই প্রসাদ সামলাবি।”
ভুলু বুক ফুলিয়ে বলল—
—“হুঁহ! এবার তোমরা দেখবে আমার আসল প্রতিভা।”
রান্নাঘরে বিপত্তি
ভুলু ঢুকল রান্নাঘরে। তার হাতে বিশাল লম্বা খুন্তি।
- সে ভাতের হাঁড়িতে লবণের বদলে চিনি ঢেলে দিল।
- ডাল ফোটাতে গিয়ে হাঁড়ি উল্টে ফেলল।
- পায়েসে দুধ না দিয়ে হাফ লিটার দই ঢেলে দিল, ভেবে যে এটাই “নতুন রেসিপি।”
সে খুশি মনে চেঁচিয়ে বলল—
—“আজ থেকে এই পায়েসের নাম হবে ভুলুর বিশেষ—দইপায়েস!”
প্রসাদ বিতরণ
সন্ধ্যায় সবাই ভক্তিভরে প্রসাদ নিতে এল। প্রথমে ভাত খেয়ে লোকজন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কেউ বলল—
—“ভাত মিষ্টি কেন?”
তারপর ডাল মুখে দিতেই সবাই হেসে কাশতে লাগল—
—“এই ডাল তো জলে ভাসছে!”
শেষে পায়েস খেয়ে সবাই একসাথে চেঁচাল—
—“আরে! এটা তো টক!”
ভুলু গর্ব করে বলল—
—“ওই যে, আধুনিক ফিউশন ফুড। তোমরা বোঝ না।”
চূড়ান্ত বিপদ
কিন্তু বিপদ হল যখন গ্রামের পণ্ডিতমশায়ও সেই পায়েস খেয়ে মুখ বাঁকা করে বললেন—
—“হে ভগবান! এই প্রসাদ তো পেটে গেলেই কাণ্ড ঘটবে।”
ফলাফল? পুরো গ্রামে হাসির রোল। কেউ বলল—
—“প্রসাদ নয়, এটা তো শাস্তি।”
আর ভুলু তখনো দাঁত বের করে বলছে—
—“হুঁ, আমি না থাকলে গ্রামে এমন বৈচিত্র্যই আসত না।”
“বিসর্জনের কাণ্ড”
ভুলুর ফাইনাল প্ল্যান
মূর্তি আনা, প্যান্ডেল সাজানো আর প্রসাদের কাণ্ডে সে হিট–ফ্লপ দুটোই হয়েছে। এবার সে ঘোষণা দিল—
—“শেষ দিন! মূর্তির বিসর্জনটা আমি লিড করব। তোমরা শুধু দেখো।”
গ্রামের লোকজন একসাথে বলে উঠল—
—“ওরে বাবা! আবার শুরু হল ভুলু মহারাজের কাণ্ড।”
ভুলু ঠিক করল মূর্তি নিয়ে যাবে একেবারে নদীর মাঝখানে। কিন্তু বড় নৌকা কোথায়?
সে এক ভ্যানওয়ালা কাকুকে ধরে এনে বলল—
—“এই ভ্যানে মূর্তি বসিয়ে দিলেই হবে। ভ্যানটাই আমার জাহাজ!”
লোকজন হেসে কুটিপাটি—
—“আরে বাপু, ভ্যানে করে বিসর্জন?”
ভ্যানের সামনে ভুলু হাতে বাঁশি নিয়ে চেঁচাচ্ছে—
—“গণপতি বাপ্পা মোরিয়া!”
কিন্তু বাঁশি বাজাতে গিয়ে হঠাৎ ফুসফুসে বাতাস আটকে সে হেঁচকি তুলতে লাগল। মিছিল থেমে গেল, সবাই আবার হেসে কাত।
নদীতে ঢোকার কাণ্ড
ভুলু ভ্যানটা নামাতে গিয়ে পিছলে সরাসরি কাদায় পড়ল।
মূর্তিটা বাঁচাতে সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে, আর ভুলু কাদার ভেতরে গলা অব্দি আটকে চেঁচাচ্ছে—
—“আমাকেও বিসর্জন দিয়ে দাও!”
মাছের আক্রমণ
কষ্ট করে যখন মূর্তি নদীতে নামানো হল, ভুলু ততক্ষণে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওর গায়ে প্রসাদের টক পায়েসের গন্ধ লেগে থাকায় মাছগুলো ওকে ঘিরে ঘুরতে লাগল।
ভুলু হাপুস-হুপুস করে বলছে—
—“এই মাছগুলো আমাকেই প্রসাদ ভেবে ফেলেছে।”
হাসির রোলের বিসর্জন
শেষে গ্রামবাসী কোনোরকমে ভুলুকে টেনে তুলল। মূর্তির বিসর্জন শান্তভাবে হলো, কিন্তু ভুলু দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিল—
—“গণপতি বাপ্পা মোরিয়া! এ বছর থেকে বিসর্জনের নতুন নাম—ভুলু বিশেষ জলক্রীড়া!”
পুরো গ্রাম আবার হেসে কাহিল, কেউ বলল—
—“ভুলু থাকলেই উৎসব মানে হাসির বন্যা।”