“বিদায়ের রঙ লাল”
|

“বিদায়ের রঙ লাল”

শরতের আকাশে শিউলির গন্ধ

শরৎকাল এলেই আকাশ যেন অন্য রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। দিনের বেলা রোদের ঝিলিক থাকে উজ্জ্বল, কিন্তু ভোরের আলোয় চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এক অন্যরকম শান্তি। গাছের ডাল ভেদ করে সূর্যের প্রথম রশ্মি যেন মাটির বুকে সোনালি সুতার মতো বিছিয়ে পড়ে। রাস্তার ধারে সাদা-কমলা শিউলি ফুল ছড়িয়ে আছে, বাতাসে মিশে আছে তাদের মিষ্টি গন্ধ। দূর থেকে ভেসে আসছে শাঁখধ্বনি আর ঢাকির মৃদু তাল, যেন প্রকৃতি নিজেই বলে দিচ্ছে—এ সময়টা বিশেষ।

মল্লিকা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে ভেসে উঠছে ভোরের দৃশ্য, কিন্তু মন যেন অন্য কোথাও। আকাশের রঙ, ফুলের গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ—সবই চারপাশে উৎসবের আবহ তৈরি করছে, অথচ তার ভেতরে কেমন শূন্যতা। আজ অষ্টমী পেরিয়ে নবমীর সকাল। পাড়ার মাঠে ইতিমধ্যেই প্যান্ডেলের সামনে লাইন পড়ে গেছে। মহিলারা নতুন শাড়ি পরে সিঁদুর দিয়ে কপাল রাঙিয়েছে, ছোটরা খেলায় মেতে উঠেছে। সবকিছু যেন আনন্দে ভরপুর।

কিন্তু মল্লিকার বুকের ভেতর অন্য অনুভূতি। এ বছরই প্রথম বাবাকে ছাড়া দুর্গাপুজো। বাবার সেই প্রিয় সকালগুলো আর ফিরে আসবে না। ছোটবেলা থেকে বাবার একটা অভ্যাস ছিল—অষ্টমী আর নবমীর সকালে হাঁটতে বেরিয়ে রাস্তার ধারে ঝরে পড়া শিউলি কুড়িয়ে আনা। তারপর বাড়ি ফিরে এসে স্নান সেরে সেই ফুল তামার থালায় সাজিয়ে মা দুর্গার সামনে রাখতেন। মল্লিকা বাবার পাশে বসে থাকত। দু’জনের মধ্যে কত গল্প—কলেজের পড়াশোনা, জীবনের স্বপ্ন, আর ভবিষ্যৎ নিয়ে নানান আলাপ। সেই স্মৃতিগুলোই আজ তাকে যেন আরও ভারী করে তুলেছে।

“বিদায়ের রঙ লাল”

হঠাৎ পাশের বাড়ির উঠোন থেকে শোনা গেল কচি গলার আওয়াজ—
“দিদি, তুমি প্যান্ডেলে যাচ্ছ না?”
এটা বলেই পাশের বাড়ির ছোট্ট পিউ জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে লাল রঙের একটা ছোট ঢাক বাজানোর চেষ্টা করছে। মল্লিকা একটু হাসল, তবে হাসিটা ছিল নিস্তেজ।
—“যাবো তো পিউ, একটু পরেই। তুমি আগে যাও।”
পিউ দৌড়ে চলে গেল, কিন্তু তার চঞ্চলতা মল্লিকার মনে হালকা একটা আলো জ্বালিয়ে দিল।

বাইরে তখন কোলাহল আরও বাড়ছে। ঢাকিরা কাঁধে ঢাক ঝুলিয়ে বাজাচ্ছে তাল মিলিয়ে। ঢাকির কপালে ঘাম জমে গেছে, কিন্তু চোখেমুখে ক্লান্তি নেই—বরং উৎসবের উচ্ছ্বাসে ভরে আছে। মহিলারা প্যান্ডেলের পাশে বসে পুজোর আয়োজন করছে, ছোটরা বাতাসে ফুঁ দিয়ে শাঁখ বাজানোর চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে যেন আনন্দের এক রঙিন ছবি।

কিন্তু সেই আনন্দ মল্লিকার ঘরে পৌঁছাচ্ছে না। ঘরের এক কোণে রাখা আছে বাবার পুরোনো গামছা, টেবিলে এখনও আছে সেই তামার থালা। কিন্তু আজ থালাটা ফাঁকা। মল্লিকা তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে মনে ফিসফিস করে বলল,
“বাবা, তুমি থাকলে এই আনন্দটা কত আলাদা হতো। আজও তুমি যদি হাঁটতে বেরিয়ে শিউলি কুড়িয়ে আনতে…”

তার চোখ ভিজে উঠল। তবে সে চোখের জল মুছে ফেলল তৎক্ষণাৎ। বাইরে থেকে শিউলির গন্ধ এসে ভরে দিল তার বুক। মনে হলো, বাবার ছায়া এখনও ঘিরে রেখেছে তাকে। হয়তো এই ফুলগুলোর মধ্যেই মিশে আছে বাবার আশীর্বাদ, বাবার স্নেহ।

আকাশে তখন সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভোরের সেই আলো ক্রমশ সকাল হয়ে উঠছে। মল্লিকা জানালাটা খুলে দিল আরও বড় করে। দূরে ভেসে আসছে ঢাকের জোরালো আওয়াজ—“বলো দুর্গা মাই কি জয়!”। মল্লিকা এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল। বুকের ভেতরে জমাট বেঁধে থাকা শূন্যতা একটু হলেও হালকা হয়ে এলো।

হয়তো বিদায়ের দিন আসছে, কিন্তু উৎসবের এই রঙিন আবহাওয়ায় বাবার স্মৃতিই তাকে শক্তি দিচ্ছে। তার মনে হলো, প্রতিটি শিউলি ফুলের সুবাসে যেন বাবার হাতের স্পর্শ লুকিয়ে আছে।

বন্ধুত্বের হঠাৎ ফেরা

নবমীর রাত।
পাড়ার মাঠে বিশাল প্যান্ডেল আলোয় ঝলমল করছে। রঙিন লাইটের ঝিলিক, মাইকে বাজছে পুরোনো পুজোর গান, আর ঢাকির তালে ভিড়ের উচ্ছ্বাস আরও বাড়ছে। ধূপের ধোঁয়ায় চারদিক যেন আবছা হয়ে গেছে। ছোটরা কেউ ফুচকার লাইনে দাঁড়িয়ে, কেউ খেলায় মেতেছে। যুবকেরা আড্ডা দিচ্ছে, হাসাহাসি করছে, কেউ আবার সেলফি তুলছে দেবীমূর্তির সামনে।

মল্লিকা লাজুকভাবে এক কোণে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। মা তাকে অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়েছিল আসতে। সত্যি বলতে, বাবাকে ছাড়া পুজোর মাঠে আসার ইচ্ছে তার ছিল না। তবুও মানুষের ভিড়ে ভেসে যাওয়ার লোভ সে সামলাতে পারেনি।

ঠিক তখনই, হঠাৎ এক গলা ভেসে এলো—
“মল্লি?”

মল্লিকা থমকে দাঁড়াল। এই ডাক! অনেক দিন বাদে কেউ তাকে এভাবে ডাকল। সে ঘুরে তাকাতেই ভিড়ের মাঝখান থেকে এক চেনা মুখ ধীরে ধীরে কাছে এলো।

অনির্বাণ।

চোখে সেই আগের মতোই উজ্জ্বলতা, কপালে হালকা ঘাম, হাতে একটা ক্যামেরা। মল্লিকার মনে হলো যেন সময় পেছনে ফিরে গেছে। কত বছর হয়ে গেল! কলেজ শেষ হওয়ার পর থেকে প্রায় যোগাযোগই হারিয়ে গিয়েছিল। মাঝেমাঝে ফেসবুকে লাইক, খুব হলে জন্মদিনে একটা “হ্যাপি বার্থডে”—এর বাইরে আর কিছু না। অথচ আজ, এই উৎসবের ভিড়ে হঠাৎ সামনাসামনি দেখা।

bidayer raang laal 2

“তুই… অনির্বাণ?”—মল্লিকা কাঁপা গলায় বলল।
“হ্যাঁ রে, আমি-ই।” সে মৃদু হেসে বলল, “বিশ্বাসই হচ্ছে না তুই এতটা বদলেছিস। তবে চশমা ছাড়া চিনতে কষ্ট হচ্ছিল।”

দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশে কোলাহল, আলো, ঢাকের বাজনা—তবুও তাদের মনে হলো যেন মুহূর্তটা একেবারে থেমে গেছে।

অনির্বাণ বলল,
“অনেকদিন তো হলো। ভাবিসনি একবার খোঁজ নিই?”
মল্লিকা একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
“আমি-ই বা কতটা খোঁজ নিয়েছি! জীবন তো আর আগের মতো নেই।”

তাদের কথার মাঝেই পাশ থেকে এক ঢাকি এসে ঢাকের তালে বাজাতে শুরু করল। ভিড়ের সবাই চিৎকার করে উঠল, “বলো দুর্গা মাই কি জয়!”। সেই আওয়াজে মল্লিকার বুকের ভেতর জমে থাকা ভারী ভাবটা যেন একটু হালকা হলো।

অনির্বাণ মল্লিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“জানি, তোর বাবাকে হারানোর পর সবকিছু বদলে গেছে। খবরটা পেয়েছিলাম, কিন্তু তোর সঙ্গে কথা বলার সাহস পাইনি। মনে হচ্ছিল হয়তো কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দেব।”

মল্লিকার চোখে জল এসে গেল। সে কিছু বলল না, শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়ের মাঝেই অনির্বাণ চুপচাপ তার পাশে দাঁড়াল। যেন নিঃশব্দে বলল—“আমি আছি।”

একটু পর দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে প্যান্ডেলের বাইরে বেরোল। বাতাসে তখন ভেসে আসছে ভুট্টা পোড়ার গন্ধ। ছোট ছোট দোকানে জমে উঠেছে ভিড়। অনির্বাণ হেসে বলল,
“চল, এক কাপ চা খাই। পুরোনো দিনের মতো।”

চায়ের দোকানে বসে তাদের আড্ডা শুরু হলো। কত পুরোনো স্মৃতি ফিরে এলো—স্কুলের দিন, পরীক্ষার ভয়ের গল্প, বইমেলায় আড্ডা, একসঙ্গে পড়তে বসা। মনে হচ্ছিল এতগুলো বছর যেন কখনও কেটেই যায়নি।

মল্লিকা হাসতে হাসতে বলল,
“তুই এখনও ক্যামেরা হাতে ঘুরিস?”
অনির্বাণ গর্বের সঙ্গে ক্যামেরাটা দেখাল,
“এটাই তো আমার প্রাণ। ভাবছি, এবার ফটোগ্রাফির একটা প্রদর্শনী করব।”

মল্লিকার মনে হলো, পুরোনো বন্ধুত্বের সেতুটা আবার জোড়া লাগছে। তার ভেতরের শূন্যতা ধীরে ধীরে ভরে উঠছে এই অচেনা হলেও পরিচিত উপস্থিতিতে।

সেদিন নবমীর রাতে, হাজার মানুষের ভিড়ের মাঝেও মল্লিকার কাছে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ ছিল অনির্বাণের ফিরে আসা।

সিঁদুরের লাল রঙ

দশমীর সকাল।
আকাশে হালকা রোদ, তবে ভোরের হিমেল বাতাসে শরতের ছোঁয়া স্পষ্ট। পাড়ার রাস্তায় তখন থেকেই ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। ঢাকিরা প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাতে শুরু করেছে ধীর লয়ে—যেন বিদায়ের সুর বেজে উঠছে প্রতিটি তালে।

মল্লিকা সাদা শাড়ি পরেছে লাল পাড়ে, চুল খোঁপায় গুঁজে দিয়েছে একটা লাল গাঁদা ফুল। আয়নায় নিজেকে দেখে তার মনে হচ্ছিল, আজকের দিনটাও সে যেন এক অদ্ভুত দায়িত্ব নিয়ে কাটাবে। বিদায় দেবেন তিনি, কিন্তু চোখের জল লুকিয়ে রাখতে হবে।

প্যান্ডেলের সামনে তখন মহিলাদের ভিড়। কারও হাতে থালা ভর্তি সিঁদুর, কারও হাতে মিষ্টি আর ধূপকাঠি। দেবীর মুখে আলোর ঝলকানি, তার সিঁদুরে রাঙা ঠোঁট যেন হাসছে, অথচ চোখে যেন লুকিয়ে আছে বিদায়ের ছায়া। ঢাকের তালে ধীরে ধীরে শুরু হলো সিঁদুর খেলা

মল্লিকা এক কোণে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। অন্যরা হাসছে, ঠাট্টা করছে, সিঁদুর মেখে দিচ্ছে একে অপরের গালে। কিন্তু তার চোখে যেন শুধু একটাই ছবি ভেসে উঠছিল—বাবার সেই প্রফুল্ল মুখ, যিনি প্রতি বছর দশমীর সকালে মাকে নিয়ে এসে দেবীর পায়ে সিঁদুর দিতেন, তারপর মল্লিকার কপালেও রাঙিয়ে দিতেন। আজ সেই হাত নেই, সেই হাসি নেই।

ঠিক তখনই অনির্বাণ এসে দাঁড়াল তার পাশে।
“এমন দিনে কান্না করলে চলে?”—সে মৃদু হাসি দিয়ে বলল।
মল্লিকা চমকে উঠল।
“আমি কাঁদছি না…”—কথাটা বলতে বলতে তার চোখ আবার ভিজে উঠল।

অনির্বাণ হাত বাড়িয়ে থালা থেকে একটু সিঁদুর নিল। তারপর আলতো করে মল্লিকার কপালে টিপ দিল।
“দেখ, এ সিঁদুর শুধু বিদায়ের নয়। এ আশীর্বাদের রঙ। মা তো আবার আসবেন, নতুন করে আনন্দ নিয়ে। তুই কেন ভাবছিস এ শুধু শেষ?”

মল্লিকার বুকটা হালকা হয়ে এলো। মনে হলো, বাবার শূন্যতা একটু হলেও কমে গেছে। চারপাশে তখন মহিলারা একে অপরের গালে সিঁদুর মাখাচ্ছে, হাসছে, উলুধ্বনি দিচ্ছে। লাল রঙে ভরে উঠেছে প্যান্ডেলের পরিবেশ।

এক বৃদ্ধা এসে মল্লিকার হাতে সিঁদুর তুলে দিলেন। তিনি বললেন,
“মা দুর্গা যেমন অশুভ শক্তিকে দমন করেন, তেমনই তোর জীবনের দুঃখও তিনি দূর করবেন।”

মল্লিকা এবার নিজের আঙুলে সিঁদুর নিয়ে অনির্বাণের গালে লাগিয়ে দিল। অনির্বাণ চমকে হেসে ফেলল। চারপাশের আলো, ধোঁয়া আর ঢাকের তালে মুহূর্তটা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল।

সেদিন মল্লিকার মনে হলো, সিঁদুরের রঙ আসলে শুধু বিদায়ের প্রতীক নয়। এটা এক নতুন আশার প্রতিশ্রুতি, এক নতুন সম্পর্কের শেকড়। বাবার স্মৃতির শূন্যতায় যে জায়গা খালি হয়ে গিয়েছিল, সেখানে আজ ভরে উঠল বন্ধুত্বের রঙ, স্নেহের রঙ, আর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির রঙ।

“বিদায়ের রঙ লাল”

ঢাকের তালে তালে ভেসে উঠল উলুধ্বনি, সিঁদুরে রাঙা হাসি আর চোখের অশ্রুর মিলন। মল্লিকার মনে হলো, বিদায়ের মাঝেও জীবন নতুন করে জন্ম নেয়।

বিদায়ের ঢাকের সুর

দশমীর বিকেল।
আকাশে তখনো হালকা নীল, কিন্তু সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। পাড়ার মাঠে মানুষ ভিড় জমিয়েছে শেষবারের মতো দেবীর মুখ দেখতে। চারদিনের উল্লাস, হাসি-আনন্দ, জমজমাট পরিবেশের শেষে আজ সবার মুখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা।

ঢাকিরা তখন প্রাণপণ বাজাচ্ছে। প্রতিটি ঢাকের তালে যেন বিদায়ের আভাস। মাঝে মাঝে ঢাক থেমে গেলে ভিড় থেকে গর্জে ওঠে—
“বলো দুর্গা মাই কি জয়!”
ধূপের ধোঁয়ায় আবছা হয়ে গেছে চারপাশ। ছোটরা কাঁদছে, মহিলারা চোখের জল লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করছে। সবাই জানে, দেবী যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর বিদায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আগামী বছরে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি।

মল্লিকা ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশের সেই আবেগময় পরিবেশ তাকে আরও ভারী করে তুলছিল। মনে হচ্ছিল, বাবার হাত ধরে যদি আজকে একবার মূর্তির সামনে দাঁড়ানো যেত! বাবার সেই স্নেহভরা চোখে তাকানো, বিদায়ের সময় মায়ের হাত শক্ত করে ধরা—এসবই যেন মল্লিকার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

ঠিক তখনই অনির্বাণ তার পাশে এসে দাঁড়াল। সে চুপচাপ, কোনো কথা না বলে শুধু মল্লিকার দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিতে এমন এক আশ্বাস ছিল, যা কোনো শব্দ ছাড়াই মল্লিকার মনকে ছুঁয়ে গেল।

“বিদায়টা বড় কষ্টের, তাই না?”—মল্লিকা ফিসফিস করে বলল।
অনির্বাণ মৃদু হাসল,
“হ্যাঁ, কিন্তু এটা তো শেষ নয়। প্রতি বছর যেমন মা আসেন, তেমনই জীবনেও বিদায়ের পর নতুন শুরুর সুযোগ আসে। বিজয়া আসলে বিদায় নয়, নতুন ভোরের আহ্বান।”

মল্লিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখ ভিজে উঠল, তবে এবার আর অশ্রু গড়িয়ে পড়ল না। মনে হলো, চোখের জলকে আটকে রাখাই হয়তো সত্যিকারের শক্তি।

এরপর শুরু হলো প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি। ঢাকের আওয়াজ আরও জোরে বেজে উঠল। কয়েকজন তরুণ মূর্তির সামনে নেচে উঠল, তাদের উল্লাসের ভেতরেও লুকিয়ে ছিল বিষণ্ণতা। মহিলারা উলুধ্বনি দিয়ে দেবীর বিদায় জানাল। আকাশে আতশবাজির রঙ ছড়িয়ে পড়ল, নদীর ধারে মিছিল ধীরে ধীরে এগোতে লাগল।

মল্লিকা হাত জোড় করে দাঁড়াল। চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল—
“মা, আগামী বছর আবার এসো। এই আলো, এই আনন্দ ফিরিয়ে আনো। বাবার আশীর্বাদও সঙ্গে নিয়ে এসো।”

তার গলা কেঁপে উঠল, কিন্তু মনে হলো ভেতরে একটা শক্তি তৈরি হচ্ছে। পাশে অনির্বাণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আবারও বলল,
“মল্লি, মনে রাখিস, বিজয়া মানেই আশার নতুন পথ।”

সেদিন ঢাকের প্রতিটি সুরে, প্রতিটি উলুধ্বনিতে, প্রতিটি চোখের জলে মিশে ছিল বিদায় আর প্রতীক্ষার এক অদ্ভুত সমন্বয়। আর মল্লিকার মনে হয়েছিল, বাবাকে হারানোর শূন্যতার ভেতরেও জীবন এখনও তাকে নতুন রঙে বাঁচার আহ্বান জানাচ্ছে।

বিজয়ার মিষ্টি প্রতিশ্রুতি

বিজয়ার আগের রাত। চারদিকেই যেন এক ধরনের হালকা বিষণ্নতা ছড়িয়ে আছে। ঢাকের বাজনা ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসছে, প্যান্ডেলে আলো জ্বলছে বটে, কিন্তু সবার চোখেমুখে এক অদ্ভুত শূন্যতা।

মল্লিকা বারান্দায় বসে আছে। তার হাতে রাখা আছে বাবার পুরোনো চশমা। প্রতি বিজয়ার দিনেই বাবা আশীর্বাদ করতেন—“যেখানেই থাকো, মিষ্টি করে কথা বলবে, মানুষকে আপন করে নেবে।” আজ সেই বাবার অনুপস্থিতিতে মিষ্টির থালা সাজাতে গিয়েও বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে।

হঠাৎই পাশের বাসার বন্ধু অনীক এসে বলল—
“চলো, মিষ্টি বিলোতে যাই। আজ বিজয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়—যেন আগামী বছরে আবার সবাই একসাথে মিলিত হতে পারি।”

মল্লিকা প্রথমে দ্বিধায় ছিল, কিন্তু শেষে হাসিমুখে রাজি হল। সে বুঝল—বাবার দেওয়া মিষ্টি প্রতিশ্রুতি মানে শুধু মিষ্টির স্বাদ নয়, বরং মানুষের সাথে সম্পর্ককে আরও মধুর করে তোলা।

প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে, মিষ্টি বিলোতে গিয়ে, শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে তার মন যেন হালকা হয়ে এল। প্রত্যেকটা প্রণাম, প্রত্যেকটা আশীর্বাদ যেন বাবার শূন্যতা ভরিয়ে দিল এক মিষ্টি আবেশে।

দিনের শেষে মল্লিকা বুঝল, বিজয়ার প্রতিশ্রুতি শুধু আগামী বছরের পুজো দেখার নয়, বরং প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার, ভালোবাসার, আর আলো ছড়ানোর।

রাতের আকাশে দীপশিখার মতো জ্বলজ্বল করছিল পূর্ণিমার চাঁদ। মল্লিকা আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল—
“বাবা, আমি ঠিক আলোয় বাঁচব। এটাই আমার বিজয়ার প্রতিশ্রুতি।”

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *