“তুমি ফিরবে বলে”
অভিমানী হৃদয়
“তুমি ফিরবে বলেছিলে… অথচ আমার বারান্দার বাতাস শুধু শূন্যতার গল্প শোনায়।”
রূপসী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের হাওয়া ধীরে ধীরে তার খোলা চুল উড়িয়ে দিচ্ছে। দূরে হালকা মেঘে ঢাকা আকাশটা যেন তার বুকের ভেতরের শূন্যতার প্রতিচ্ছবি। নিচে গাড়ির হর্ন, লোকজনের হাঁটাহাঁটি—সবই স্বাভাবিক শহুরে শব্দ, কিন্তু তার কানে কেমন যেন নিস্তব্ধ শোনায়।
আজও সৌরভ ফিরতে পারল না।
আসলে, বেশ কয়েক মাস হলো সৌরভ বিদেশে অফিসের কাজে গেছে। একটার পর একটা প্রোজেক্ট, মিটিং, ট্যুর—সবই তার দায়িত্ব।
রূপসী ফিসফিস করে বলল,
—“কতদিন হলো তোমার মুখটা সামনাসামনি দেখিনি, সৌরভ…”
চেয়ারে বসে ফোনটা হাতে নিল সে। হোয়াটসঅ্যাপে সৌরভের নাম খোলা। একের পর এক মেসেজ টাইপ করছে আবার মুছে দিচ্ছে।
“তুমি কবে ফিরবে?”
“আমাকে মিস করছো?”
“আমি তোমাকে খুব চাই…”

সবই বুকের ভিতর জমে থাকা কথা, কিন্তু আঙুলগুলো হিম হয়ে যায়। হঠাৎ মনে হয়, সৌরভ ব্যস্ত, তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
তবুও একটা অভিমান ভর করে বুকের ভেতর।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। সৌরভের নাম ভেসে উঠতেই বুকটা ধক করে উঠল।
—“হ্যালো রূপসী, কেমন আছো?”
—“ভালো। তুমি?”
—“আমি তো কাজ নিয়েই আছি, মিটিং শেষ করতে পারলেই একটু নিঃশ্বাস পাই।”
রূপসী একটু থেমে বলল,
—“আমার সাথে কথা বলার মতো সময়ই তো তোমার আর থাকে না।”
ওপাশে কিছুক্ষণ চুপ। তারপর সৌরভ বলল,
—“আমি তো চাই, কিন্তু সত্যিই কাজের চাপ অসহ্য। তুমি রাগ কোরো না, রূপসী।”
দু’জনের কথোপকথন মাত্র পাঁচ মিনিটও টিকল না। লাইন কেটে যাওয়ার পর রূপসীর মনে হলো, এই কি তবে সংসার? এত ভালোবাসা, অথচ এত অদূরত্ব!
রূপসী আসলে সৌরভকে প্রাণভরে ভালোবাসে। তার হাসি, তার ভরসা দেওয়ার ভঙ্গি, তার চোখের গভীরতা—সবই আজও মনে পড়ে যায়।
তুমি ছাড়া এ ঘর ফাঁকা লাগে
বিয়ের প্রথম বছরটা যেন স্বপ্নের মতো কেটেছিল। তখন সৌরভ কলকাতাতেই ছিল।
রবিবার সকালে একসাথে বাজারে যাওয়া, দুপুরে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রূপসীর পাশে দাঁড়িয়ে কাটা-ছেঁড়া করা, আর সন্ধ্যায় সিনেমা দেখে ফেরার পথে ফুচকা খাওয়া—সবই ছিল নিখাদ আনন্দ।
সেই সময় রূপসী ভেবেছিল—এ জীবন চিরকাল এমনই থাকবে।
কিন্তু চাকরির সূত্রে সৌরভের একের পর এক বদলি পোস্টিং সব পাল্টে দিল।
একদিন রাতে রূপসী ঘুমোতে পারছিল না। বিছানায় শুয়ে ফোনে পুরনো ছবিগুলো দেখতে লাগল। কোথায় সেই দু’জনের হাসি-আনন্দে ভরা মুখ!
চোখে জল এসে গেল।
—“তুমি কি আমায় সত্যিই এতটা মিস করো, সৌরভ?”
বন্ধুরা অনেক সময় জিজ্ঞেস করে—
“তোদের মধ্যে কি সমস্যা চলছে? দেখছি তোদের একসাথে কোথাও ঘুরতেও যাচ্ছো না।”
রূপসী কেবল হেসে এড়িয়ে যায়। মনে মনে ভাবে—
ভালোবাসা আছে, কিন্তু সময় নেই। দূরত্ব আছে, কিন্তু অভিমান জমে জমে পাহাড় হয়ে গেছে।
এক সন্ধ্যায় হঠাৎ রূপসী মায়ের বাড়ি চলে গেল। মায়ের কোলে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল।
মা ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—“বাবা, সংসার মানেই তো শুধু একসাথে থাকা নয়। কখনো কখনো দূর থেকেও সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তবে, তুমি নিজের মনের কথাটা ওকে বলছো তো?”
রূপসী চুপ করে রইল। হ্যাঁ, এটাই তো সমস্যা—সে কখনো স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারে না। শুধু নিজের ভেতরেই চাপা রাখে।
সেই রাতে ফিরে এসে সে এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিল। ফোনে লম্বা একটা মেসেজ লিখল—
“তুমি আমার সাথে সময় কাটাও না বলে আমি অভিমান করি না, কিন্তু আমি তোমাকে ভীষণ মিস করি। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমরা কি একটু চেষ্টা করতে পারি আবার নতুন করে শুরু করার?”
মেসেজটা পাঠানোর পর বুকটা কেঁপে উঠল। অনেকক্ষণ কোনো উত্তর এলো না।
রাত দশটার দিকে হঠাৎ ফোন এল। সৌরভের কণ্ঠ ভেজা।
—“রূপসী, আমি জানতাম না তুমি এতটা কষ্ট পাচ্ছো। আমি ভেবেছিলাম, তুমি অভ্যস্ত হয়ে গেছো একা থাকার। কিন্তু আজ বুঝলাম, তোমার এই অপেক্ষা আমাকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমি ভুল করেছি।”
রূপসীর চোখ ভিজে উঠল। সে কেবল বলল,
—“আমি তোমাকে চাই, শুধু আমার পাশে।”
এরপর সৌরভ নিজের ভেতরে লড়াই শুরু করল। চাকরি আর সংসারের টানাপোড়েন।
পরের সপ্তাহেই অফিসে গিয়ে সে বসকে জানাল,
—“আমি আর বাইরে থাকতে পারব না। আমার পরিবার আমার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।”
প্রথমে অফিস রাজি হয়নি। কিন্তু সৌরভের অনড় ইচ্ছার কাছে শেষ পর্যন্ত তারা কলকাতায় ট্রান্সফার দিল।
সেই খবর রূপসীকে জানিয়ে সৌরভ ফোনে বলল,
—“রূপসী, এবার থেকে তুমি আর একা থাকবে না। আমি ফিরছি, তোমার কাছে।”
সেই দিন রূপসীর চোখে আনন্দের জল গড়িয়ে পড়ল। কতদিনের শূন্যতা, অপেক্ষা—সব ভরে উঠল।
যেদিন সৌরভ বাড়ি ফিরল, রূপসী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক যেমন প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকত। তবে এবার তার চোখে আর খালি প্রতীক্ষা নেই, আছে উচ্ছ্বাস।
দরজা খুলতেই রূপসী ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।
—“এবার আর আমাকে একা রেখো না।”

সৌরভের চোখও ভিজে উঠল।
—“কখনো না। এ আমার প্রতিশ্রুতি।”
সময় বয়ে চলে। ব্যস্ততা আবার আসে, কিন্তু তারা শিখে গেছে—ভালোবাসা শুধু পাশে থাকলেই পূর্ণ হয় না, প্রকাশ করলেও পূর্ণ হয়।
সন্ধ্যায় সৌরভ অফিস থেকে ফিরে রূপসীর হাত ধরে বলে,
—“আজ সিনেমা দেখতে যাই?”
অথবা
—“চলো, ছাদে বসে গল্প করি।”
রূপসীর মনে হয়, যেন প্রথম দিনের দাম্পত্য আবার ফিরে এসেছে।
ভালোবাসা মানেই শুধু একসাথে থাকা নয়, বরং একে অপরকে বুঝতে শেখা।
রূপসী আর সৌরভ এখন জানে—যত দূরত্বই আসুক, কথার সেতু, অনুভবের প্রকাশ আর প্রতিশ্রুতির হাত ধরে সেই দূরত্ব মিলিয়ে দেওয়া যায়।