জীবনের ট্রেন

“জীবনের ট্রেন – হকার থেকে সফল উদ্যোক্তা ”

ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফুটেনি। স্টেশনের চারপাশে হালকা কুয়াশা, দূরে ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসছে। ট্রেন আসার আগেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে স্টেশন চত্বর—কারও হাতে চায়ের কেতলি, কারও ঝোলায় বিস্কুট বা বাদাম। এর মাঝেই এক ক্ষুদ্রাকৃতি বালক ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে।

তার নাম রাহুল। বয়স মাত্র ১২ বছর, কিন্তু চোখেমুখে যেন দায়িত্বের ভারে এক অদ্ভুত প্রাপ্তবয়স্কতার ছাপ। বাবাকে হারিয়েছে অনেক আগে, মা অসুস্থ, সংসারে আয়ের আর কোনো উৎস নেই। তাই ছোট্ট কাঁধেই এসে পড়েছে পরিবারের বোঝা।

হাতে বাঁশের ঝোলা, তাতে রাখা গ্লাস, বিস্কুটের প্যাকেট আর সেদ্ধ ডিম। কণ্ঠে টান—

“চা-চা-চা! গরম গরম চা, বিস্কুট নিন, ডিম নিন!”

ট্রেনের কামরায় কামরায় ছুটে চলেছে সে। যাত্রীরা অনেক সময় বিরক্ত হয়, কেউ কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, আবার কেউ সহানুভূতিতে এক কাপ চা কিনে নেয়।

রাহুল জানে—দিন শেষে এটাই তার জীবনের রুটি-রুজি।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে বিশ্বাস করে, এই স্টেশনই তার স্বপ্নের শুরু, শেষ নয়।

সংগ্রামের দিনগুলো

রাহুলের প্রতিটি সকাল শুরু হতো ভোরের অন্ধকারে। অন্য বাচ্চারা তখনো ঘুমিয়ে, কেউ বা স্কুলের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে—কিন্তু রাহুলের হাতে ছিল কেতলি আর ঝোলা।

স্টেশনে পৌঁছেই তার প্রথম কাজ ছিল ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম ঘুরে বেড়ানো।
ঠান্ডা কুয়াশায় চায়ের ধোঁয়া মিশে যেত বাতাসে।
ব্যস্ত লোকজনের ভিড়ে তার ক্ষুদ্র কণ্ঠ হারিয়ে যেত।
মাঝে মাঝে পুলিশ তাড়া করত—“এখানে বেচাকেনা করা নিষেধ!”

কিন্তু রাহুলের মুখে একটাই কথা—
“না বিক্রি করলে আজ বাড়িতে মা কী খাবে?”

প্রতিদিন অগণিত যাত্রীদের ভিড়ে ছোট্ট শরীরটা লড়াই করত। কখনো ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেত, কখনো লোকজনের ঠাট্টা-তামাশার শিকার হতো। কেউ বলত—
“এই বাচ্চাটা বড় হয়ে কী করবে?”
রাহুল চুপচাপ শুনে যেত। কিন্তু তার ভেতরে একটা অদম্য আগুন জ্বলত।

মাঝে মাঝে প্ল্যাটফর্মের কোণে দাঁড়িয়ে স্কুলব্যাগ কাঁধে ছুটে যাওয়া ছেলেমেয়েদের দেখত। বুকের ভেতরে কেমন হাহাকার হতো। সে-ও তো পড়তে চাইত, সে-ও তো বই হাতে নিতে চাইত। কিন্তু দারিদ্র্য যেন তার স্বপ্নকে বারবার আটকে রাখত।

রাতে বাড়ি ফিরলে মায়ের কাশি শোনার পরই সে বুঝত—হাল ছাড়ার সময় তার নেই।
মা-ই তার একমাত্র ভরসা।
মা-কে বাঁচাতে, সংসার চালাতে তাকে লড়তেই হবে।

এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল—
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হকারি,
অনিশ্চয়তার অন্ধকার,
আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন শুধু মনের ভেতরে আটকে থাকা।

তবুও রাহুল জানত—
“আজকের কষ্ট একদিন সাফল্যের পথ তৈরি করবে।”

আশার আলো

রাহুলের জীবন যেন এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছিল। প্রতিদিন ট্রেনের কামরায় দৌড়ে বেড়ানো, গালমন্দ খাওয়া, পুলিশের ভয়—সবকিছু যেন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু ভাগ্য যেন হঠাৎ একদিন তার সামনে নতুন দরজা খুলে দিল।

সেই বিশেষ দিন

এক বিকেলে লোকাল ট্রেন ছেড়ে গেছে। ভিড় কম, যাত্রীও হাতে গোনা। রাহুল তখনো হাঁপাতে হাঁপাতে চা বিক্রি করছে। হঠাৎ এক ভদ্রলোক ডাক দিলেন—

“এই ছেলে, এদিকে আসো।”

ভদ্রলোকের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, হাতে বইয়ের ব্যাগ। চশমার ভেতর থেকে ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে আছেন। রাহুল ভয় ভয় করে এগিয়ে গেল। ভদ্রলোক এক কাপ চা নিলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন—

“পড়াশোনা করো?”

রাহুল লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল,
“না স্যার, ঘরে মা অসুস্থ। টাকার জন্য পড়তে পারিনি।”

chatgpt image aug 19, 2025, 09 00 24 am

ভদ্রলোকের চোখে মমতার ছায়া ফুটে উঠল। তিনি নিজের নাম বললেন—অরুণবাবু, কাছের এক কলেজের অধ্যাপক।

অরুণবাবু তাকে কিছু টাকা দিলেন না, বরং ছোট্ট একটা খাতা আর কিছু বই দিলেন। সঙ্গে বললেন—

“যদি সত্যিই পড়ার ইচ্ছে থাকে, রাতে সময় বের করে পড়তে শুরু করো। জীবন শুধু হকারি নয়, এর বাইরেও অনেক বড় কিছু আছে।”

রাহুলের চোখ ভিজে এল। জীবনে প্রথম কেউ তাকে বিশ্বাস করল, প্রথম কেউ তার ভেতরের স্বপ্নটা বুঝল।

আলোর শুরু

সেদিন থেকেই রাতের অন্ধকার রাহুলের কাছে আর ভয়ংকর লাগত না।
দিনে হকারি করত,
আর রাতে বই খুলে বসত—আলো জ্বলে থাকা একমাত্র কেরোসিন লণ্ঠনের সামনে।

মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করত—
“এত কষ্ট করে আবার পড়াশোনা করছিস কেন?”
রাহুল উত্তর দিত—
“মা, এই পড়াশোনাই একদিন আমাদের ভাগ্য বদলাবে।”

হকারি আর পড়াশোনার দ্বন্দ্বের মাঝেই সময় কাটতে লাগল। অরুণবাবু প্রায়ই ট্রেনে রাহুলের খোঁজ নিতেন, তাকে উৎসাহ দিতেন। ধীরে ধীরে রাহুলের ভেতরে আত্মবিশ্বাস জন্মাতে শুরু করল।

সে বুঝল—
আলো খুঁজতে হলে অন্ধকারের ভেতর দিয়েই হাঁটতে হয়।

আশার আলো পেলেও পথটা সহজ ছিল না। রাহুল জানত—শুধু স্বপ্ন থাকলেই চলবে না, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে অসীম পরিশ্রম করতে হবে।

দিনের বেলায় আগের মতোই ট্রেনে চা, বিস্কুট, ডিম বেচত। যাত্রীরা মাঝে মাঝে মজা করত, কখনো টিটকিরি মারত—
“তুই কি হকার হয়ে সারাজীবন কাটাবি?”

রাহুল চুপচাপ সব সহ্য করত। তার মাথার ভেতর তখন শুধু একটাই দৃশ্য ভাসত—পরীক্ষার খাতা, বইয়ের পাতা আর মায়ের হাসি।

রাতে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বই খুলত। চোখ জ্বলত, মাথা ঘুরত, তবু সে থামত না। কারণ তার মনে ছিল অরুণবাবুর কথা—
“তুই যদি লড়তে জানিস, জিতবিই।”

প্রথম সাফল্যের স্বাদ

অনেক কষ্টের মাঝেও রাহুল মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করল। গ্রামের মানুষ অবাক হলো—
“যে ছেলে ট্রেনে চা বেচে, সে আবার পরীক্ষায় ভালো করল!”

কিন্তু এটাই ছিল শুধু শুরু। রাহুল নিজেকে থামাল না। সে ঠিক করল, পড়াশোনা চালিয়ে যাবে যেকোনো মূল্যে।

উচ্চমাধ্যমিকের সময় সবচেয়ে কঠিন দিন কাটল।
কখনো খাওয়ার মতো কিছু থাকত না,
কখনো ট্রেন ভাড়া বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুল কলেজে যেত,
আবার কখনো নিজের খাবার বেচে দিয়ে বই কিনত।

মা অসুস্থ থাকলেও ছেলেকে উৎসাহ দিত—
“তুই যা করছিস, একদিন মানুষ হবে। আমি তোর জন্য গর্বিত।”

রাহুল ধীরে ধীরে বুঝতে শিখল—
জীবনের ট্রেন কখনো সোজা পথে চলে না, কখনো বাঁক নেয়, কখনো ধাক্কা খায়। কিন্তু যে যাত্রী হাল ছাড়ে না, সে-ই শেষ গন্তব্যে পৌঁছায়।

সে দিন দিন শক্ত হয়ে উঠছিল। শুধু নিজের জন্য নয়, মায়ের জন্য, সমাজের জন্য, আর সেই সব ছোট হকারদের জন্য, যারা ঠিক তার মতো স্বপ্ন দেখার সুযোগই পায় না।

রাহুলের জীবন যেন প্রতিদিনই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করত। কিন্তু সে শিখেছিল—
চ্যালেঞ্জ মানেই সুযোগ।
ভয় মানেই লড়াইয়ের ডাক।

কলেজ পাশ করার পর তার সামনে সুযোগ এল চাকরির। একটি ছোট কোম্পানিতে কাজ পেয়েছিল, মাসে অল্প বেতন। সাধারণ মানুষ হলে হয়তো এটাই আঁকড়ে ধরত। কিন্তু রাহুল জানত, তার লক্ষ্য কেবল একটা চাকরি নয়—তার চাই বড় কিছু।

হকারি থেকে অনুপ্রেরণা

সে মনে মনে ভাবত—
“আমি যদি ট্রেনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হকারি করতে পারি, তবে একটা ব্যবসা কেন চালাতে পারব না?”

স্টেশনে ছোটবেলা থেকে যা শিখেছিল—
মানুষের সাথে কথা বলা,
তাদের প্রয়োজন বোঝা,
অল্প টাকায় জিনিস বেচে আস্থা তৈরি করা—
সবটাই যেন ব্যবসার প্রথম পাঠ ছিল।

চাকরির টাকায় আর অল্প কিছু ঋণ নিয়ে সে এক ছোট্ট চায়ের দোকান খোলে স্টেশনের কাছেই। দোকানের নাম রাখে—
“জীবনের ট্রেন কফি কর্নার”

মানুষ প্রথমে অবাক হয়েছিল—
“হকার ছেলে ব্যবসা করবে?”
কিন্তু দোকানের চা ছিল অনন্য। রাহুল নিজেই চা বানাত, যাত্রীদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলত। অল্প দিনেই দোকান জমে উঠল।

চা দোকানের লাভ দিয়ে ধীরে ধীরে আরও দুটি শাখা খুলল। শুধু চা নয়, খাবারের মানও ভালো রাখল। স্টেশনের হকারদেরও কাজ দিল, যেন তার মতো আর কোনো ছেলে পড়াশোনার সুযোগ হারিয়ে না ফেলে।

কিছু বছরের মধ্যে সেই ছোট্ট চা দোকান হয়ে উঠল একটি ক্যাফে চেইন। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল তার আউটলেট।

রাহুল কখনো ভুলে গেল না নিজের অতীত। তাই সে উদ্যোগ নিল—
হকার শিশুদের জন্য বিনামূল্যে সন্ধ্যার স্কুল,
অসহায় পরিবারদের জন্য কাজের সুযোগ,
আর স্টেশনের প্রতিটি হকারকে সম্মান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি।

সফল উদ্যোক্তা

আজ মানুষ তাকে ডাকে—“রাহুল দত্ত, সফল উদ্যোক্তা”
কিন্তু রাহুল সবসময় বলে—
“আমি শুধু এক হকার ছেলে, যে বিশ্বাস করেছিল জীবনও এক ট্রেন। যত ঝড়-ঝাপটা আসুক, লাইন বদলালেও ট্রেন একদিন গন্তব্যে পৌঁছায়।”

রাহুলের এই যাত্রা প্রমাণ করে—
ছোট শুরু মানেই ছোট স্বপ্ন নয়।
পরিশ্রম, শিক্ষা আর আত্মবিশ্বাস থাকলে যে কেউ নিজের ভাগ্য লিখতে পারে।

রাহুলের জীবনের ট্রেন বহু বাঁক, অন্ধকার টানেল আর ধাক্কাধাক্কি পেরিয়ে আজ সফলতার স্টেশনে এসে থেমেছে।

ছোটবেলায় যে ছেলে প্ল্যাটফর্মে চা-বিস্কুট বেচত, গালমন্দ শুনত, পুলিশি হেনস্তা সহ্য করত—আজ সেই ছেলের নাম শহরের মানুষ সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করে।

জীবন তাকে এক অমূল্য শিক্ষা দিয়েছে—
গরিবি কোনো অভিশাপ নয়, অভিশাপ হলো হাল ছেড়ে দেওয়া।
কষ্ট হলো সফলতার টিকিট।
শিক্ষাই জীবনের আসল পাসপোর্ট।

সে প্রমাণ করেছে, যদি ইচ্ছে শক্তি আর অধ্যবসায় থাকে, তবে একজন হকারও উদ্যোক্তা হতে পারে।

রাহুল সবসময় বলে—
“যে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যায়, তাকে কেউ আটকাতে পারে না। জীবনও তেমনই—তুমি যদি নিজের লক্ষ্য ঠিক করো আর সাহস করে লড়াই করো, তবে তোমার ট্রেনও একদিন গন্তব্যে পৌঁছাবেই।”

তার এই যাত্রা শুধু তার নিজের নয়, হাজারো রাহুলের—যারা আজও প্ল্যাটফর্মে হকারি করে, স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়।

রাহুলের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—

  • প্রতিটি অন্ধকারের পরেই আলো আছে।
  • প্রতিটি স্টেশনের পরেই নতুন যাত্রা শুরু হয়।
  • আর প্রতিটি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নিজের ভাগ্য গড়ার শক্তি।

মূল অনুপ্রেরণা

“যে হাল ছাড়ে না, তার জীবনও একদিন স্বপ্নের স্টেশনে পৌঁছায়।”

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *