তেঁতুলতলার মাঠ -“সোনালি বিকেলের শেষ ওভার”
“শুধু বল আর ব্যাট নয়, বিকেলের আলোয় খেলা হয় জীবন ও স্মৃতির এক অনন্ত ওভার।”
তেঁতুলতলার মাঠ
তেঁতুলতলার মাঠটা যেন ছিল এক স্বপ্নের পৃথিবী। শহরের এক কোণায়, একটা বড় তেঁতুল গাছের ছায়ায় ঢাকা সবুজ ঘাসে মোড়া সেই মাঠ ছিল সকাল থেকে সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকা ছেলেমেয়েদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
প্রতিদিন বিকেল চারটায় মাঠ যেন প্রাণ ফিরে পেত। সূর্য মাথার ওপরে যখন একটু ঢলে পড়ত, তখন আকাশ আর সূর্য—দু’জনই তৈরি হয়ে যেত মাঠের রাজত্বে নামার জন্য। আকাশ ব্যাট নিয়ে, সূর্য বল হাতে। বাইরের দুনিয়ার সবকিছু যেন ভুলে যেত তারা। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, তীব্র রোদ হোক—এই দুজনের তেঁতুলতলার মাঠে হাজিরা কখনো মিস হতো না।
সূর্য আর আকাশ—এই দুই বন্ধু ছিল যেন দুই বিপরীত মেরু। আকাশ যতটা শান্ত, সূর্য ততটাই আগ্রাসী। কিন্তু খেলায় তাদের বন্ধুত্ব ছিল দুর্নিবার। ক্রিকেটে আকাশের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। আর সূর্যের বলের গতি আর আগুনে চোখের চাহনি… যেন একদম আন্তর্জাতিক মানের বোলার!
মাঠ মানেই জীবন
তেঁতুলতলার মাঠটা শুধুই খেলার জন্য ছিল না। ওটা ছিল আকাশ আর সূর্যের দ্বিতীয় বাড়ি, স্বপ্ন দেখার জায়গা, বন্ধুতা গড়ার চৌহদ্দি। মাঠে পা রাখলেই যেন মন খুলে যেত—দূরে বয়ে যাওয়া নদীর মতো। ক্লাসের পর ব্যাগ ছুঁড়ে রেখে যে দৌড়টা তারা দিত মাঠের দিকে, সেটা ছিল দিনের সবচেয়ে আনন্দের সময়।

সেই তেঁতুলতলার মাঠে শুধু ক্রিকেটই খেলত না তারা। বর্ষায় ফুটবল, শীতে কাবাডি,  তবুও ক্রিকেটের জাদু ছিল আলাদা।
ব্যাট আর বল মানেই যুদ্ধ, মান-অভিমান, কাঁদা-মাটি, আর জেতার স্বপ্ন।
একটা ফাটা ব্যাট, রঙচটে যাওয়া বল, আর তিনটা ইট দিয়ে বানানো উইকেট—তাতেই গড়ে উঠত বিশাল এক স্টেডিয়াম! মাঠে নামলে আর কেউ ছাত্র থাকত না, কেউ গরীব-ধনী থাকত না, সবাই হতো খেলোয়াড়—জেতার নেশায় পাগল।
কখনও ঝগড়া লেগে যেত—কে ওপেন করবে, কে আউট হয়েছে নাকি হয়নি, কে বাউন্ডারির বাইরে দাঁড়িয়ে বল ধরেছে।
কিন্তু খেলায় শেষ বাজনার পরে, সব ভুলে সবাই একসাথে হাঁটত বাড়ি। পেছনে ফেলে যেত দিনের উত্তেজনা, কিন্তু বুকের মধ্যে নিয়ে যেত স্মৃতির সোনালি অংশটুকু।
আকাশ ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিল দুর্দান্ত—সোজা খেলায় পাকা। ওর ব্যাটিংয়ের সময়ে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যেত। আর সূর্য—তার বলিং ছিল আগুনে। এমনকি ফেলে দেওয়া জুতো পরে, ছেঁড়া জামায় খেললেও ওর চোখে থাকত আগুনের ভাষা।
তাদের চোখে মাঠ মানে ছিল স্বাধীনতা। পড়ালেখা, দুঃখ-কষ্ট, ভবিষ্যতের টানাপোড়েন—সবকিছু ভুলে যাওয়া এক টুকরো পৃথিবী।
তেঁতুলতলার মাঠটা ছিল তাদের স্বপ্নের মানচিত্র, যেখানে তারা নিজেদের জয়ের কাহিনি লিখত, আবার হার মেনে নিতে শিখত।
এবং সত্যি বলতে—মাঠটাই তাদের প্রথম শিক্ষক ছিল, প্রথম ভালোবাসা ছিল, আর জীবনকে শেখার প্রাক্-পর্ব।
আক্রম ভাই ও অনান্য চরিত্র
তেঁতুলতলার মাঠ শুধু সূর্য আর আকাশের গল্প নয়। সে এক জীবন্ত মহল্লা ছিল, যার প্রতিটি কোণেই জমে থাকত নানা চরিত্র, নানা মুখ, নানা কাণ্ড।
সবার আগে বলতে হয় আক্রম ভাই-এর কথা। পেশায় স্কুলশিক্ষক, কিন্তু মনটা যেন তেঁতুলতলার মাঠেই পড়ে থাকত। হাফ শার্ট,  মাঝে মাঝে ট্র্যাকস্যুট পরে প্রতিদিন বিকেলেই চলে আসতেন। বলতেন,
— “প্রথম বলটা আমার, আর প্রথম ব্যাটটাও!”
কিন্তু আকরাম ভাইয়ের চোখে ছিল শিশুর মতো উচ্ছ্বাস। কোনোদিন তো শুনা যেত, ক্লাস নিতে নিতে মনের ভুলে মাঠে চলে এসেছেন!
তারপর ছিল রাম দা—সবার দাদাভাই। বয়সে বড় হলেও মনে প্রাণে ছিল খেলোয়াড়। একটু পেট ভারি, তাই দৌড়তে পারতেন না ঠিকঠাক। কিন্তু উইকেট কিপার হিসেবে ছিলেন অদ্বিতীয়। বলতেন,
— “আমি আছি মানে কেউ স্ট্যাম্পিং করতে পারবে না!”
পার্থ দা ছিলেন খেলার কোচের মতো। বুদ্ধিদীপ্ত ফিল্ডিং সাজানো, কৌশল ঠিক করা, ঝগড়া মেটানো—সব কিছুতেই পার্থ দার মত ছিল শেষ কথা। মাঝে মাঝে রেফারি, আবার মাঝখান দিয়ে ছক্কা মেরে বাজিমাতও করতেন।
আর ছিল ছোটদের দলে উজ্জ্বল মুখ সোনা। ছিপছিপে চেহারা, চুল এলোমেলো, কিন্তু বল হাতে নামলে যেন বাঘ। সোনার বোলিংয়ে অনেক বড়রা আউট হতো, আর সে গলা উঁচিয়ে বলত,
— “দেখলেন তো! আমি না থাকলে হতো!”
বিট্টু , ছিল দলের মজার লোক। ব্যাটিংয়ে খারাপ হলেও মাঠে তার হাসির রসদ ছিল অফুরান। ম্যাচে হেরে গেলেও বলত,
— “আমি ইচ্ছে করেই হেরেছি, কাল জিতব না?”
আপু ছিল একমাত্র খেলোয়াড়। হ্যাঁ, সে নিয়মিত না এলেও যখন আসত, তখন সবাই একটু বেশি মনোযোগ দিত। ওর থ্রো-টা ছিল দারুণ শক্তিশালী। সবার মধ্যেই ছিল ওকে নিয়ে একরকম মুগ্ধতা, যার কথা কেউ মুখে বলত না—তবে চোখে ছিল।
আর ভোলা—সবচেয়ে ছোট হলেও খেলার প্রতি ওর আগ্রহ ছিল দারুণ। ব্যাট ধরতে পারত না ঠিক করে, কিন্তু বল কুড়াতে, রানের হিসাব রাখতে ওর জুড়ি ছিল না। মাঝে মাঝে বল হাতে নিয়েই বলত,
— “আজ আমি খেলব, কেউ আটকাবে না!”
এই চরিত্রগুলো মিলে মাঠটা যেন একটা আস্ত পৃথিবী হয়ে উঠেছিল। তারা একেকটা পাতা ছিল সূর্য-আকাশের স্মৃতির বইয়ে, যেটা খুললেই আজও যেন ভেসে ওঠে সেই কোলাহল, সেই গন্ধ, সেই বিকেলের আলো।
শহরের ডাকে সূর্যের যাত্রা
সময় থেমে থাকে না। স্কুলের পর কলেজে ভর্তি হয় সূর্য। তার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে শহরের এক ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয় সে। বোলার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু শুরুটা দেরিতে করেছিল বলে কোচদের উৎসাহ কম, আর অন্য খেলোয়াড়দের কাছে সূর্য হয়ে ওঠে ঠাট্টার পাত্র।
তবুও সে হাল ছাড়ে না। প্রতিদিন অনুশীলন করে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। আকাশ তখন বিএ পড়ছে। ওরা ফোনে কথা বলত—মাঠ, ক্রিকেট আর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। স্বপ্নটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়। শহরের ব্যস্ততা, একাকিত্ব, আর সাফল্যের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া সূর্যকে একসময় ফিরে আসতে হয় নিজের কাজে তেঁতুলতলার মাঠ ছেড়ে ।
বিকেলের আলো ও স্মৃতির ছায়া
সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তেঁতুলগাছের ছায়া লম্বা হয়ে মাঠের এক প্রান্ত ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাঠে এখন আর সেই চেনা মুখগুলো নেই—আকাশের প্রাণচঞ্চল চিৎকার, সূর্যের আগ্রাসী বলিং, বাপ্পা দার গল্প, আকরাম ভাইয়ের আবদার… সবই এখন শুধুই স্মৃতি।
আজ সূর্য সেই পুরনো রাস্তা দিয়ে কাজ থেকে ফিরছে। পায়ের তলার ধুলো এখনো সেই পুরনো, বাতাসে মিশে আছে ঘামের গন্ধ । কিন্তু মাঠটা যেন অন্য রকম।
শব্দ নেই, জোর গলায় কে এলবি দিল—তা নিয়ে তর্ক নেই, নেই ঝগড়া আর বিজয়ের উল্লাস।

তেঁতুলতলার মাঠ এক কোণে দু’তিনটি ছেলেমেয়ে টুকটাক খেলছে, কেউ মোবাইল তাক করে রিল বানাচ্ছে। সূর্য দাঁড়িয়ে পড়ে। কাঁধে থাকা ব্যাগটা একটু নিচে নামায়।
চোখে জল আসে না, কিন্তু বুকের ভেতরটা যেন ভারি হয়ে ওঠে।
তার চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে ছোটবেলার সেই বিকেল—আকাশ বলছে, “একটা ছক্কা মারলে চ্যাম্প!”… বাপ্পা দা ডেকে উঠছেন, “পিচ সরাসরি রাখিস, নইলে আমি ফিরলাম!”
অথচ তারা কেউ আজ আর মাঠে নেই। আছে শুধু স্মৃতির ছায়া। মাঠটা যেন একটা জাদুর আয়না, যেখানে সূর্য প্রতিদিন নিজের হারানো সময়কে খুঁজে ফেরে।
একসময় সে হাঁটা শুরু করে। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন ফুটে ওঠে একটি করে ছবি—একটি করে সোনালি বিকেল।
কিন্তু সে জানে, যতই ফিরে দেখতে চাই, সেই বিকেল আর ফিরবে না।
শুধু আলোটা থেকে যাবে…
আর তার ছায়ায় লুকিয়ে থাকবে—একটা হারিয়ে যাওয়া সময়ের গল্প।
সোনালি বিকেলের শেষ ওভার
তেঁতুলতলার মাঠ আজও আছে। তবে সে আগের মতো চিৎকারে মুখর নয়। মাঠের এক কোণে আজও দাঁড়িয়ে থাকে সেই পুরনো তেঁতুলগাছটা, পাতাগুলো কমে এসেছে, গা ছেড়ে দিয়েছে শৈশবের কোলাহল। সূর্য শহরে, আকাশ নিজের ব্যবসার কাজে। জীবন সবাইকে টেনে নিয়ে গেছে আলাদা আলাদা দিকে। কিন্তু বিকেল হলেই সূর্যের মনে পড়ে যায়—শেষ ওভারটা।
সেই বিকেলে, অগাস্টের শেষ সপ্তাহে, পাটফাটা রোদ আর বাতাসের মধ্যে, তারা ঠিক করেছিল শেষবারের মতো একটা ম্যাচ খেলবে।কলেজের পর, সূর্য হয়তো কোচিং-এ ঢুকবে, আকাশের পরিবারও তাকে শহরের বাইরে পাঠাবে পড়ার জন্য। খেলাটা যেন একটা বিদায়-বেলার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তখন ছিল ৭ বলে ৮ রান। আকাশ বল করছিল। সূর্য ব্যাট হাতে। বাকিরা চারপাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ—একটা অদ্ভুত নীরবতা যেন সবাই টের পাচ্ছিল। জীবনের শেষ নির্ভেজাল ম্যাচ হয়তো এটাই।
প্রথম বল, ডট।
দ্বিতীয় বল, সিঙ্গেল।
তৃতীয় বল, আউট!
সূর্য হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েছিল, কিন্তু কেউ হাসেনি। কেউ উল্লাস করেনি।
আকাশ এসে পাশে বসে বলেছিল,
— “হেরে গেলে না, তুই জিতেছিস। শেষ বিকেলে যে এতদিনের ম্যাচটা এমনভাবে মনে থাকবে—এই তো আসল জয়।”
সেই দিন সূর্য বুঝেছিল, ম্যাচ কখনো শুধু খেলা নয়, সেটা একেকটা সময়ের গল্প, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের গল্প, হারাতে হারাতেও কিছু অনুভব করে ফেলার গল্প।
আজ তেঁতুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে সূর্য একা। মাঠে খেলা ছেলেদের বলটা গড়িয়ে আছে সূর্যের দিকে , হাতে তুলে যেন তার মনে হয় সেই পুরনো লাল বলটা।
 আকাশ ও সে  শেষবার খেলেছিল ৫ বছর আগে।। এখন ও ব্যবসার কাজে ব্যস্ত। তবে এই মাঠটা, এই তেঁতুলগাছ, আর এই শেষ ওভারের স্মৃতি—সেগুলো আজও ঠিক আগের মতোই।
সূর্য বলটা ছুঁড়ে দেয় বাতাসে—কেউ ব্যাট করতে নেই, কেউ উইকেট ধরতে নেই—তবু একটা ওভার যেন এখনো চলেই যাচ্ছে।
একটা সোনালি বিকেল… একটুকরো না-ফেরা সময়…
তেঁতুলতলার মাঠ-“সোনালি বিকেলের শেষ ওভার” একটি হৃদয়ছোঁয়া বাংলা গল্প, যেখানে দুই বন্ধু সূর্য ও আকাশের শৈশবের মাঠজুড়ে গড়ে ওঠা ক্রিকেটপ্রেম, বন্ধুত্ব, স্বপ্ন ও স্মৃতির পরিভ্রমণকে ঘিরে আবর্তিত হয়। শহরের তেঁতুলতলার মাঠ, বিকেলের নরম আলো, হারিয়ে যাওয়া মুখগুলো ও ব্যর্থতার মধ্যেও রয়ে যাওয়া ভালোবাসার গল্প—সবকিছু মিলিয়ে এই গল্প একটি সময়ের দালিলিক চিত্র হয়ে ওঠে।
প্রিয় পাঠক,
আপনাদের ভালোবাসা, সময় আর গভীর অনুভবেই বেঁচে থাকে গল্পকথা। আমরা বিশ্বাস করি—প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি মাঠ, বিকেল, চোখের জল কিংবা একটুখানি হাসিরও নিজস্ব গল্প আছে বলার। আর সেই গল্পগুলোই আমরা তুলে আনতে চাই—বিনামূল্যে, কপিরাইটমুক্ত, হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে।
আপনারা যারা এখানে এসে গল্প পড়েন, মন ভেজান, হয়তো শৈশবের একটা ছবি মনে পড়ে যায়, কিংবা হারানো কোনো বন্ধুর কথা… আপনাদের জন্যই প্রতিটি লাইন, প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি শব্দ।
আমাদের গল্পের পেছনে থাকে কোনো বিজ্ঞাপন নয়, কোনো ক্লিকের ফাঁদ নয়—থাকে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গড়া কিছু সোনালি বিকেলের স্মৃতি।
আপনি যদি কখনও এই গল্পগুলোর মাঝে নিজেকে খুঁজে পান—তবে জানবেন, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
ভালোবাসা জানাই আপনাদের প্রতি,
– গল্পকথা পরিবার
বিশেষ অনুরোধ:
যদি কোনো গল্প ভালো লাগে, একবার শেয়ার করুন। হয়তো কারো ফেলে আসা বিকেলটা আবার রঙিন হয়ে উঠবে।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			