স্বপ্নের পাখি
ভোরের আলোর পথে
রাইয়া গ্রামের এক ছোট্ট, নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাড়ি শহরের সংলগ্ন বস্তিতে। বাবা শ্রমজীবী, প্রতিদিন ভোরে তেলের গন্ধ মেখে কাজ করে বাড়ি ফিরেন। মা গৃহিণী, ছোট দুই ভাই-বোনের যত্নে ব্যস্ত। পরিবারটি খুবই অল্প আয়ের। কিন্তু রাইয়ার বাবা-মা সবসময় বলে আসতেন—“পড়াশোনা তোর হাতেই, মেয়ে। শিক্ষা হলো তোর ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।”
রাইয়ার দিন শুরু হতো ভোরের অন্ধকারে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, শহরের রাস্তায় কেবল দূর থেকে কিছু কাকের ডাক। সে উঠে নিত পত্রপত্রিকার বান্ডিল। হাতগুলো ছোট, কিন্তু চোখে ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি। রাস্তার ভাঙা ফুটপাত পেরিয়ে, খোলা আকাশের নিচে সে পত্রিকা বিলি করত। প্রতিটি ঘরের দরজায় পৌঁছে দেওয়া তার জন্য শুধুই কাজ নয়, বরং স্বপ্নের প্রথম ধাপ।
পথ চলতে চলতে অনেক সময়েই মানুষ হেসে বলত—
—“এত ছোট মেয়ে, কি করবে?”
—“ক্লাসে তো কিছুই শিখছিস না, পড়াশোনা করেও তোর লাভ হবে না।”
কিন্তু রাইয়া কখনো মন হারাত না। তার মনে সবসময় একটিই কথার প্রতিধ্বনি—“স্বপ্ন দেখার অধিকার কারো জন্যও সীমাবদ্ধ নয়।”
স্কুলে যাওয়ার আগে, রাইয়া কখনো কখনো রাস্তার পাশে বসে সূর্যোদয় দেখত। সেই লাল-কমলা আলো যেন তাকে বলত—“আজকের দিনটা তোর।” এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো তার মনে সাহস যোগ করত।
দুপুরে স্কুল শেষ করে ফেরার পথে সে কদম-ঝোপের নিচ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরত। বিকেলের হালকা রোদ, শিশুরা খেলার চিৎকার, আর ঘরের রান্নার গন্ধ—সব মিলিয়ে যেন জীবন তাকে বলত, “চেষ্টা চালিয়ে যা।”

রাতে ঘরে ফেরার পর, খাবারের পর রাইয়া বসত টেবিলের কোণে। ল্যাম্পের নরম আলো তার কাগজের উপর পড়ত। চারপাশে অন্ধকার, কিন্তু তার চোখে আলো। বই, খাতা, কলম—এগুলো তার অস্ত্র। সে জানত, প্রতিটি লিখিত লাইন তার স্বপ্নের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এই অধ্যায়ের শেষ মুহূর্তে, রাইয়া জানত—ভোরের প্রতিটি আলোর সঙ্গে তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। আর সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কোনো বাধাই তাকে থামাতে পারবে না।
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি
রাইয়ার স্কুল জীবন কখনো সহজ ছিল না। ক্লাসরুমে অন্য অনেক পড়ুয়া সুবিধার মধ্যে পড়ত—বই, টিউশন, সহপাঠীদের সাহায্য। আর রাইয়ার হাতে ছিল কেবলই সাধারণ স্কুলের বই, যা বাড়িতে রাতের অন্ধকারে ল্যাম্পের আলোয় পড়ে লেখা। কখনো কখনো সে ভাবত, “আমি কি সত্যিই এগিয়ে যেতে পারব?”

শ্রেণিকক্ষে বসে সে দেখত, বন্ধুরা সহজেই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। শিক্ষক নতুন জটিল বিষয় পড়াচ্ছিলেন, আর অনেক সময় রাইয়া পিছিয়ে পড়ছিল। তার মনও দ্বিধায় ভরে যেত। কিন্তু সে থেমে থাকত না। সে জানত, প্রত্যেক চ্যালেঞ্জই নতুন শিক্ষা নিয়ে আসে।
বন্ধুরা মাঝে মাঝে হাসত,
—“তুই কি পারবি, রাইয়া? আমরা তো দেখছি সবাই এগিয়ে যাচ্ছে।”
কিন্তু রাইয়ার চোখে হতাশার কোনো ছায়া ছিল না। সে তার ছোট্ট ঘরের কোণে বসে খাতা খুলে লিখতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সে বুঝতে লাগল—প্রতিটি ভুল, প্রতিটি প্রশ্নই তার শক্তি বাড়াচ্ছে।
একদিন শিক্ষক ঘোষণা করলেন, এইবারের পরীক্ষা কঠিন হবে। অনেক পড়ুয়া আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। রাইয়া একা বসে ভাবল, “যদি আমি নিজেকে বিশ্বাস করি, যদি আমি চেষ্টা চালাই, তবে আমি পারব।”
বাড়ি ফিরে রাইয়া টেবিলের কোণে বসে প্রস্তুতি নিল। এক হাতে খাতা, আর এক হাতে কলম ধরে সে ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধান করতে লাগল। কখনো হালকা হতাশা আসে, কখনো চোখে জল—but সে থামল না।
তার ছোট বোন রাইয়ার পাশে বসে বলল—
—“দিদি, তুই সবসময় চেষ্টা করছ। একদিন তুই আমাদের গর্বের কারণ হবে।”
রাইয়া হাসল, “হ্যাঁ, আমি করব। শুধুই নিজের জন্য নয়, আমাদের পরিবারের জন্যও।”
শ্রেণিকক্ষে তার অধ্যবসায় সবাইকে চমকাচ্ছিল। শিক্ষকরা বলতেন,
—“রাইয়া, তোর মনোযোগ আর পরিশ্রম সত্যিই অসাধারণ।”
রাইয়া জানত, চ্যালেঞ্জ যত বড়ই হোক, ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের কাছে কোনো শক্তি টিকতে পারে না। সে প্রতিদিন নতুন উদ্যমে উঠে পড়াশোনা চালাত। রাতের অন্ধকার, পরিবারের অল্প সম্পদ—সবকিছুই তার ইচ্ছাশক্তিকে আরও শক্তিশালী করত।
আত্মবিশ্বাসের উত্থান
রাইয়া জানত, শুধু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া যথেষ্ট নয়—নিজের উপর বিশ্বাসও থাকতে হবে। তাই সে প্রতিদিন আরও কঠোর পরিশ্রম শুরু করল। সকাল বেলা সংবাদপত্র বিলি, দুপুরে স্কুল, বিকেলে বাড়ির ছোটখাটো কাজ—সবই সামলাতে হতো। কিন্তু তার মনোবল কখনো কমল না। প্রতিটি পদক্ষেপে তার আত্মবিশ্বাস আরও দৃঢ় হচ্ছিল।
শ্রেণিকক্ষে রাইয়া এখন চোখে পড়ার মতো। নতুন জটিল প্রশ্ন আসলেও সে আতঙ্কিত হত না। ধীরে ধীরে তার প্রয়াস ফল দিতে শুরু করল। বন্ধুরা হতাশ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু রাইয়ার চোখে ছিল অদম্য উজ্জ্বলতা।
একদিন স্কুলে বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হলো, যেখানে বলা হলো বোর্ড পরীক্ষার প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক আলাদা করে রাইয়াকে বললেন—
—“রাইয়া, যদি তুই মন দিয়ে চেষ্টা করিস, তবে সবাইকে চমকে দিতে পারবি।”
রাইয়া জানত, এই সুযোগ একবারই আসে। সে প্রতিজ্ঞা করল, প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে ল্যাম্পের আলোতে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি প্রশ্ন—সবই তার স্বপ্নের পাখিকে উড়তে সাহায্য করবে।
তার ছোট বোনও রাইয়ার পাশে বসে বলল—
—“দিদি, তুই সবসময় চেষ্টা করছ। আমি চাই একদিন তুই আমাদের গর্বের কারণ হবে।”
রাইয়া হাসল, “হ্যাঁ, আমি করব। শুধু নিজের জন্য নয়, আমাদের পরিবারের জন্যও।”
রাইয়ার অধ্যবসায় ধীরে ধীরে ফল দিতে শুরু করল। স্কুলে শিক্ষকরা তার প্রতিটি উত্তরের প্রশংসা করতে লাগলেন। বন্ধুরাও এখন তার প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। তারা দেখল, পরিশ্রম ও বিশ্বাস সত্যিই মানুষকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
রাইয়ার আত্মবিশ্বাস তার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠল। প্রতিদিন নতুন উদ্যমে সে ল্যাম্পের আলোয় পড়াশোনা করত, জানত—প্রতিটি ধাপ তাকে তার স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে।
পরীক্ষা এবং চাপ
বোর্ড পরীক্ষার দিন এল। রাইয়া জানত, এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সকাল থেকে ঘরের কোণে ল্যাম্পের আলোয় শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। সব কিছু একসাথে মনে করল—সূর্যোদয় থেকে শুরু করে প্রতিটি ভোর, প্রতিটি রাতে লেখা খাতা, প্রতিটি ভুল যা তাকে শক্তিশালী করেছে।
পরীক্ষা হলে রাইয়া দেখল, ক্লাসের অনেক ছাত্র-ছাত্রী আতঙ্কিত। কেউ কেউ প্রস্তুত, কেউ কেউ আতঙ্কিত। কিন্তু রাইয়া শান্ত। সে জানত, কঠোর পরিশ্রমই তার হাতিয়ার। প্রতিটি প্রশ্নের পৃষ্ঠা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো—“আমি পারব।”
প্রথম দিনে, গণিতের প্রশ্ন কাগজে পড়ার সময় তার মন দ্রুত চলে গেল প্রতিটি ধাপে ধাপে সমাধান করতে। রাইয়া জানত, একটিমাত্র ভুলও তাকে দমাতে পারবে না। সে মনোযোগ দিয়ে উত্তর লিখল, ভুল হলেও আবার সংশোধন করল।
পরবর্তী কয়েক দিনের পরীক্ষাতেও একই দৃঢ়তা। বন্ধুরা হতাশ হয়ে যাচ্ছিল, অনেকে হাল ছেড়ে দিচ্ছিল। কিন্তু রাইয়া জানত, এটি কেবল তার নিজের পরীক্ষা নয়—তার পরিবারের স্বপ্নও এখানে বাঁধা। প্রতিটি উত্তর লেখা, প্রতিটি সঠিক ধাপ তার বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করল।
রাইয়ার অধ্যবসায় ও মনোযোগ শিক্ষকদেরও চমকে দিল। তারা বললেন—
—“রাইয়া, তোর ধৈর্য এবং মনোযোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এগুলোই তোর সবচেয়ে বড় শক্তি।”
রাইয়া জানত, এই চাপের মুহূর্তেও আত্মবিশ্বাস হারানো চলবে না। প্রতিটি পৃষ্ঠায়, প্রতিটি প্রশ্নে সে মনে মনে বলত—“আমি পারব, আমি পারব।”
পরীক্ষার শেষ মুহূর্তে, রাইয়া শান্ত মনে চেয়েছিল—ফল যাই হোক না কেন, সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। রাতের অন্ধকারে ল্যাম্পের আলোয় যে ঘণ্টা ঘণ্টা পড়াশোনা করেছে, তা কোনোভাবেই বৃথা যায়নি।
স্বপ্নের সাফল্য
ফল প্রকাশের দিন এল। পুরো স্কুল, পরিবার, এবং গ্রাম—সবার চোখে উত্তেজনা ও উৎসাহ। রাইয়া জানত, তার এই সাফল্য শুধু তার নয়, তার পরিবার এবং অজস্র রাতের ল্যাম্পের আলোয় লেখা অধ্যবসায়ের ফল।
ফল বের হতেই জানা গেল—রাইয়া প্রথম স্থান অধিকার করল। নিঃশব্দে চোখে জল। বাবা-মা একে অপরের দিকে তাকালেন, কাঁদতে কাঁদতে বললেন—
—“আমাদের মেয়েটি সত্যিই অসাধারণ। আমরা গর্বিত।”

রাইয়া জানত, এই সাফল্য আসে ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস থেকে। গ্রামের মানুষও তার গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হলো। অনেকেই বলল—
—“যদি রাইয়া পারল, আমরা কেন পারব না?”
রাইয়া নিজেও মনে মনে জানত, এটি শেষ নয়। জীবনের আরো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু এই ছোট্ট সাফল্য তার মনে শক্তিশালী বিশ্বাস জাগিয়েছে—স্বপ্ন দেখার অধিকার সবার আছে, এবং কঠোর পরিশ্রম ও বিশ্বাস দিয়ে কেউ কিছুই অসম্ভব নয়।
গ্রামের শিশুরা যখন তাকে দেখে, তারা দেখল এক মেয়ের অদম্য মনোবল, যিনি সীমিত সুযোগের মধ্যে থেকেও স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করল। রাইয়া শুধু পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করেনি, বরং তার অধ্যবসায় ও ধৈর্যের মাধ্যমে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে অনেকের জন্য।
রাইয়ার চোখে তখন আনন্দের জল, মুখে হাসি, আর মনে শান্তি। ভোরের সেই প্রথম আলো থেকে শুরু করে প্রতিটি রাতের ল্যাম্পের আলো—সবই তার স্বপ্নের পথে এক এক ধাপ। আজ সে প্রমাণ করল, সত্যিই স্বপ্ন দেখার অধিকার কারো জন্য সীমাবদ্ধ নয়।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			