শুধু তুমি থেকো পাশে
পর্ব ৫
প্রতিকূলতার আগুন
“তুমি থাকলেই আমি লড়াই করতে পারি, তুমি না থাকলে পৃথিবীটাই অচেনা হয়ে যায়।”
গ্রামের হাওয়ায় এক অদ্ভুত ভারী গন্ধ মিশে গেছে। যেন বাতাসও মানুষের কথায়, মানুষের গুজবে ভার হয়ে উঠছে। মাঠ থেকে ফেরা কৃষকের দল, হাটে বসা দোকানদার, পুকুরঘাটে দাঁড়ানো মেয়েরা—সবাই যেন একটাই বিষয়ে কথা বলছে—“মায়া”।
কেউ বলছে,
“মেয়েটা একেবারে বখে গেল। শহরের ছেলের সঙ্গে গান গেয়ে ঘোরে।”
আবার কেউ হেসে যোগ করল,
“গান গেয়ে ক’জনের পেট চলে? সংসারের দায়িত্ব কি ও নিতে পারবে?”
এমন কথাগুলো গ্রামের ভেতরে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল।
সমাজের চোখ
মায়ার দাদা প্রতিদিনই নতুন কোনো মন্তব্য শুনে ফিরত। চায়ের দোকানে বসা বুড়োরা চোখ মেলে তাকাত, যেন সে নিজের দায়িত্বে ব্যর্থ।
“মেয়েদের বেহাল দশা হচ্ছে এসবের জন্যই,” এক বুড়ো বলল।
“মেয়েকে সামলাতে পারিস না? সমাজে মানসম্মান রাখবি কী করে?” আরেকজন যোগ করল।
দাদার ভেতরে যেন ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল। সে হাঁটতে হাঁটতে দাঁত চেপে ভাবল—
“এভাবে চলতে দিলে মায়া শুধু আমাদের নয়, পুরো বংশের মুখ কালো করবে।”
বাড়ির ভেতর ঝড়
সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকেই সে ঝড় তুলল।
“মা, তুমি কি কিছুই দেখতে পাও না? মায়া আবার সেই শহুরে ছেলের সঙ্গে মিশছে। চারদিকে লোকে লোকে হাসাহাসি করছে। আমি আর মুখ দেখাবো কাকে?”
মা ভয়ে কেঁপে উঠে বললেন—
“তুই শুধু সমাজের কথা ভাবছিস। কিন্তু মায়া যে গান ভালোবাসে, ওর প্রাণের টান—তা কি একবারও ভাবলি?”
দাদা রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করল—
“গান দিয়ে পেট চলে? সংসার চলে? তুমি তাকে শাসন না করলে আমি নিজের হাতে ওর বিয়ে দেব। আগামী মাসেই সব ঠিক করে ফেলব।”
মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মুখে আর কোনো শব্দ বেরোল না। শুধু চোখে অঝোর জল জমল।
মায়ার নিঃসঙ্গতা
ঘরের এক কোণে বসে সব শুনছিল মায়া। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। সে নিজের খাতার পাতায় নতুন গান লিখছিল, হঠাৎ দাদা এসে ছুঁড়ে ফেলে দিল বইটা।
“এসব বাজে স্বপ্ন এখনই বন্ধ কর। সংসারে মেয়েদের গান টান চলে না।”
খাতার ভাঁজ থেকে একটি অর্ধেক লেখা গান ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে গেল। মায়ার চোখে ঝাপসা জল জমল।

রাতে যখন সবাই ঘুমোতে গেল, মায়া একা বসে খাতাটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল।
নিঃশব্দে সে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার নিশ্বাস। আমি তোমাকে ছাড়ব না। যেভাবেই হোক লড়ব।”
অয়নের খোঁজ
এদিকে অয়ন খবর পেল সব। গ্রামের ছেলেদের মধ্যে গুজব রটে গিয়েছিল—মায়ার দাদা তার বিয়ে ঠিক করছে। শুনে অয়নের বুকটা হাহাকার করে উঠল।
রাত নামতেই সে ছুটে এল বাঁশবাগানের ধারে, যেখানে মায়া প্রায়ই বসত।
অয়ন দেখল মায়া নিঃশব্দে বসে আছে, মুখে কোনো কথা নেই, চোখে শুধু অব্যক্ত দুঃখ।

অয়ন গম্ভীর কণ্ঠে বলল—
“মায়া, তোমার দাদা যা করছে সেটা অন্যায়। তুমি চাইলে আমি সবকিছু ছেড়ে দিতে রাজি আছি। কিন্তু তোমার গান, তোমার স্বপ্ন ভাঙতে দেব না।”
মায়া তার দিকে তাকাল। চোখে অদ্ভুত ভরসা আর কষ্টের মিশেল।
“অয়ন, আমি লড়াই করতে ভয় পাই না। কিন্তু আমি চাই না, আমার জন্য তুমি সমাজের চোখে ছোট হয়ে যাও।”
অয়ন মায়ার হাত শক্ত করে ধরল—
“ভালোবাসা মানে শুধু সুখ নয়, লড়াইও। তোমার স্বপ্নই আমার স্বপ্ন। গান গাওয়ার অধিকার তোমার আছে, আর আমি সেই স্বপ্নের পাশে আছি।”
দৃঢ় প্রতিজ্ঞা
সেই রাতে মায়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। দূরে হাজারো তারা জ্বলজ্বল করছে। তার মনে হলো, প্রতিটি তারা যেন তার গানের সুর।
সে মনে মনে বলল—
“যতই আঁধার আসুক, আমি ভাঙব না। আগুনে ঝাঁপ দিতে হলেও দেব। কিন্তু গান ছাড়ব না। অয়নই আমার সাহস।”
চারদিকে সমাজের চাপ, পরিবারের কড়া শাসন—সবকিছু মিলিয়ে যেন আগুনে পুড়ছিল তার জীবন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেই আগুনই তাকে শক্ত করছিল, যেন ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন জন্ম নিতে প্রস্তুত হচ্ছে সে।
দাদার কঠিন সিদ্ধান্ত
পরের দিন ভোরেই গ্রামের মন্দিরের পাশে চায়ের দোকানে গিয়েছিল মায়ার দাদা। ওখানেই বসে পাড়ার কয়েকজন বয়স্ক লোক তাকে উসকাচ্ছিল—
“তুই যদি মেয়েটার বিয়ে না দিস, কালকেই কিন্তু গাঁয়ের মিটিং ডাকা হবে।”
“গান-বাজনা করতে দিতে থাকলে নাম–যশ সব শেষ হয়ে যাবে।”
এমন কথাগুলো দাদার কানে গরম সিসার মতো ঢুকছিল। সে আর দেরি করল না। বাড়ি ফিরে গর্জে উঠল—
“মা, মায়ার বিয়ে আমি ঠিক করে দিচ্ছি। আর কোনো কথা শুনব না।”
মা থরথর করে কাঁপছিলেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন—
“কিন্তু ও তো এখনও পড়াশোনা করছে… ও তো গান নিয়েই বাঁচে।”
দাদা চেঁচিয়ে উঠল—
“মেয়েদের বেশি স্বপ্ন দেখতে নেই। সংসারই মেয়েদের আসল জায়গা। আগামী মাসেই ওর বিয়ে হবে।”
মায়া দরজার ফাঁক দিয়ে সব শুনছিল। বুকের ভেতর যেন কেউ ছুরি বসিয়ে দিল।
মায়ের অসহায়তা
সেই রাতে মা মায়াকে আলতো করে কাছে টেনে নিলেন।
“মা, আমি তোকে আটকাতে পারব না। আমি জানি তোর মন শুধু গানেই বাঁধা। কিন্তু দাদা যা বলছে… আমি তো আর তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি না।”
মায়ার চোখ ভিজে উঠল। সে মায়ের হাত ধরে বলল—
“মা, আমি লড়াই করব। তুমি শুধু আমার ওপর ভরসা রাখো।”
অয়ন খবর পেল মায়ার বিয়ে ঠিক করার আয়োজন চলছে। খবরটা শুনে তার মাথা ঘুরে গেল। সে গ্রামের বাইরের শহরে কোনো এক ছোট স্টেজ প্রোগ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু মন টানছিল না।

রাতে সে আবার গোপনে এল মায়ার সঙ্গে দেখা করতে। বাঁশবাগানের অন্ধকারে মায়া দাঁড়িয়ে ছিল। অয়ন তাকে দেখেই বলল—
“আমি চুপ করে থাকতে পারব না। তোমার দাদা তোমার জীবন কেড়ে নিতে চাইছে। আমরা পালিয়ে যেতে পারি, মায়া।”
মায়া আঁতকে উঠল।
“না অয়ন, পালিয়ে গেলে সমাজ বলবে আমি দোষী। আমার গানকেও তারা কলঙ্ক বলবে। আমি চাই না তোমার ওপরও দাগ লাগুক।”
অয়ন হতাশ হয়ে বসে পড়ল।
“তাহলে কী করব আমরা? আমি তোমাকে হারাতে পারব না। তোমার স্বপ্নকেও মরতে দেব না।”
অন্তর্দ্বন্দ্ব
সেই রাতেই মায়া খাতায় লিখল—
“ভালোবাসা মানে পালিয়ে যাওয়া নয়, লড়াই করা। আমি দাদার সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। যদি আগুনে পুড়তেই হয়, তাহলে জেনে-বুঝেই পুড়ব।”
তার কলম যেন কাঁপছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আগুনের মতো দৃঢ় হচ্ছিল সে।
দাদার সঙ্গে মুখোমুখি
পরদিন সকালে সাহস সঞ্চয় করে মায়া দাদার সামনে দাঁড়াল।
“দাদা, তুমি আমার বিয়ে ঠিক করতে পারো। কিন্তু জেনে রাখো, আমি গান ছাড়ব না। সংসার করব, কিন্তু গান আমার প্রাণ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না কেউ।”
দাদা বিস্মিত হয়ে তাকাল।
“তুই এত সাহসী হয়ে গেছিস? আমি যা বলব, তাই হবে।”
মায়া চোখ নামাল না।
“আমাকে বিয়ে দাও, করো। কিন্তু যদি গান গাইতে না দাও, তবে আমি নিজেই নিজের পথ বেছে নেব।”
ঘরে নীরবতা নেমে এল। মা এক কোণে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। দাদার চোখে রাগের আগুন, কিন্তু কোথাও যেন একটা ধাক্কা খেল সে—বোনকে এত দৃঢ় আগে কখনও দেখেনি।
সমাজের রায়
ক’দিনের মধ্যেই গ্রামের মিটিং ডাকল পঞ্চায়েত। ভিড় জমল মাঠে। দাদার মুখ লাল হয়ে উঠল রাগে।
“আমার বোন গান নিয়ে পাগলামি করছে। আমি বিয়ে ঠিক করছি। কিন্তু সমাজ যেন আর কিছু না বলে।”
এক বৃদ্ধ উঠে বলল—
“গান গাওয়া মেয়ে মানেই কলঙ্ক নয়। কিন্তু যদি বিয়ের বয়স হয়ে যায়, দেরি করা ঠিক নয়। আমাদের নিয়ম মানতেই হবে।”
অন্যরা গলা মিলিয়ে বলল—
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও। নইলে আমাদের গ্রামের মান-সম্মান থাকবে না।”
মায়া মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। মনে হচ্ছিল তাকে কেউ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিচ্ছে।
দাদার কঠোরতা
বাড়ি ফিরে দাদা গর্জে উঠল—
“এবার আর দেরি নয়। আগামী মাসেই তোকে বিয়ে দেব। গান-টান সব শেষ।”
মা ভয়ে কিছু বলতে পারলেন না। শুধু চোখের জল ফেললেন।
মায়া ঠান্ডা গলায় বলল—
“দাদা, তুমি যদি আমাকে বিয়ে দাও, আমি রাজি। কিন্তু গান ছাড়ব না। আমার গানই আমার জীবন।”
দাদা হাত তুলে বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মায়ের কণ্ঠ থামিয়ে দিল—
“ওকে মারিস না। ওর চোখে আমি বাবার জেদ দেখছি।”
অয়ন খবর পেল বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। রাতভর অস্থির হয়ে কাটাল সে।
“আমি কি সত্যিই মায়াকে হারাব? ওর গানকে মরে যেতে দেব?”
তার ভেতরে দুই সুর বাজছিল—
একদিকে ভালোবাসা, অন্যদিকে মায়ার মর্যাদা।
সে সিদ্ধান্ত নিল—
“যদি মায়া গান গাইতে চায়, আমি তার পাশে দাঁড়াব। পালিয়ে নয়, লড়াই করে।”
মায়ার মানসিক আগুন
রাতে মায়া খাতায় লিখল—
“জীবন যদি নদী হয়, তবে আমি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটব। সমাজের বাঁধন আমাকে রুখতে পারবে না।”
কলমের কালি যেন রক্ত হয়ে বেরোচ্ছিল। চোখ ভিজে যাচ্ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে।
ঠিক তখনই পাড়ার কয়েকজন মহিলা এসে মাকে বলল—
“তোমার মেয়ে আবার অয়নের সঙ্গে দেখা করছে। সাবধানে থেকো।”
মা ভয়ে কেঁপে উঠলেন। দাদা শুনে দরজা আছাড় মারল।
“এবার যদি আবার ওর সঙ্গে দেখা করে, আমি মায়াকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেব।”
ঘরে বিষণ্ন নীরবতা।
মায়া জানল, সামনে ঝড় আসছে।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			