নিঃশব্দ আশীর্বাদ
| |

নিঃশব্দ আশীর্বাদ

“বাবার নীরব আশীর্বাদ কখনও কখনও সন্তানের জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল আলো হয়ে ওঠে।”

শৈশবের উঠোন

অর্পিতা তখন খুব ছোট। গ্রামের এক সাধারণ স্কুলে পড়ে। সকালের রোদে উঠোনে বসে যখন সে খাতা খুলে আঁকিবুকি কাটত, বাবা চুপচাপ দূর থেকে তাকিয়ে থাকতেন।

বাবা বলতেন,
—“মা, পড়াশোনা মন দিয়ে কর। জীবন শুধু খেলাধুলা বা আঁকিবুকি নয়, সংসার সামলাতে হলে লেখাপড়ার দরকার।”

কিন্তু অর্পিতা তখন সংখ্যার টানে টানতে পারত না। যোগ, বিয়োগ তার মাথায় ঢুকত না। তার চোখে সব থেকে সুন্দর লাগত গল্পের বই, পাড়ার লাইব্রেরির ধুলো ধরা পাতাগুলো।

তবু বাবা তাকে খাতা-কলম কিনে দিতেন। নতুন স্কুল ব্যাগ কিনে আনতেন। সেই ব্যাগের গন্ধে যেন বাবার আশা আশীর্বাদ গোপনে মিশে থাকত।

প্রথম ব্যর্থতা

পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার ফল বেরোল। অর্পিতা গড়পড়তা নম্বর পেয়েছে, কিন্তু গাণিতিকে খুব খারাপ। বাড়ি ফিরে সে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। মা শান্ত গলায় বললেন,
—“চিন্তা কোরো না, আবার পড়াশোনা করো।”

কিন্তু অর্পিতার ভয় ছিল বাবাকে নিয়ে। বাবা সেদিন অফিস থেকে ফিরলেন ক্লান্ত মুখে। ফলাফলের খাতা দেখে একটিও কথা বললেন না। শুধু টেবিলে রেখে উঠে গেলেন বারান্দায়।

অর্পিতা ভেবেছিল বাবা হয়তো রাগে কথা বলছেন না। কিন্তু বাবার সেই নীরবতাই তার মনে গভীর দাগ কেটে গেল।

স্কুল–কলেজের দিনগুলো

সময় গড়াল। মাধ্যমিক পরীক্ষায় অর্পিতা আবার গাণিতিকে ফেল করল। চারপাশের মানুষ তখন নানা কথা বলতে শুরু করল—
—“মেয়েটা দিয়ে হবে না।”
—“আজকালকার মেয়েরা শুধু মোবাইল ঘাটে।”

অর্পিতা খুব কষ্ট পেত। মনে হত, সে যেন সবার কাছে ব্যর্থ।

তবে তার পাশে ছিলেন শুধু বাবা। তিনি কোনোদিন সরাসরি উৎসাহ দেননি, কিন্তু প্রত্যেক সকালে তার স্কুল ড্রেসটা নিজে ইস্ত্রি করে দিতেন। ঠান্ডা সকালে গরম দুধের গ্লাস এগিয়ে দিতেন।

অর্পিতা বুঝত—বাবা চুপচাপ তার জন্য লড়ছেন, যদিও মুখে কিছু বলেন না।

অপ্রকাশিত স্পর্শ

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগের রাত। বাইরে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ, মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটা জানলার কাচে আঘাত করছে। পুরো বাড়িটা যেন নীরবতায় ডুবে গেছে।
অর্পিতা টেবিলের ওপর খোলা খাতা আর বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অক্ষরগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার চোখে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভেতরটা ভয় আর উৎকণ্ঠায় কুঁকড়ে আসছে।

অবশেষে সে সাহস সঞ্চয় করে বাবার ঘরে ঢুকল। বাবা তখন খাটের প্রান্তে বসে চশমা খুলে খবরের কাগজ গুটিয়ে রাখছিলেন। মেয়েকে দেখে শুধু চুপচাপ তাকালেন।

হঠাৎ চোখ ভিজে এল অর্পিতার। কান্নায় ভাঙা গলায় বলে উঠল—
—“বাবা, আমি পারব না। সবাই বলছে আমি ফেল করব… আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি।”

ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কোনো সান্ত্বনার শব্দ এল না। অর্পিতার বুক কেঁপে উঠল—হয়তো বাবা রাগ করবেন, হয়তো হতাশ হয়ে পড়বেন।

কিন্তু তার বদলে বাবা ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে আস্তে করে মাথায় হাত রাখলেন।

কোনো শব্দ নেই, কোনো বড় বড় উপদেশ নেই—শুধু নিঃশব্দ এক আশীর্বাদ।

অর্পিতার মনে হল, পৃথিবীর সব ভয় যেন মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন বাবার আশীর্বাদ-এর সেই হাত তাকে বলছে—
“ব্যর্থ হলেও তুমি আমার মেয়ে, আমার গর্ব।”

চোখ বুঁজে ফেলল সে। বুকের ভেতরটা ভরে উঠল অদ্ভুত শান্তিতে।
সেদিন অর্পিতা প্রথম বুঝল—বাবার নীরব স্পর্শই জীবনের সবচেয়ে বড় ভরসা।

নতুন স্বপ্ন

পরীক্ষার ফল আশানুরূপ এল না। বিজ্ঞানের দুনিয়ায় তার ঠাঁই হয়নি। চারপাশে সবাই হতাশ। মা বললেন—“শিক্ষকতার ট্রেনিং করো।”

কিন্তু অর্পিতার মন পড়াশোনায় টিকল না। সে তখন গল্প লিখতে শুরু করেছে। পাড়ার ছোট পত্রিকায় লেখা ছাপা হতে শুরু করল।

বাবা চুপচাপ সেই লেখা পড়ে রাখতেন। কোনোদিন প্রকাশ্যে আশীর্বাদ বা প্রশংসা করেননি, তবে অর্পিতা দেখেছে—বাবার চোখে অদ্ভুত আলো ঝলক দিচ্ছে।

সংগ্রামের দিন

কলেজ জীবনে অর্থকষ্ট বাড়ল। বাবার সামান্য চাকরির টাকায় সংসার চলত না। অর্পিতা টিউশনি শুরু করল। রাত জেগে পড়াত, আবার গল্প লিখত।

প্রথমবার তার লেখা একটি জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হলো। টেবিলের ওপর কেটে রাখা খবরের কাগজ বাবার হাতে দিয়ে সে বলল—
—“দেখো বাবা, আমার নাম ছাপা হয়েছে।”

বাবা কিছু বললেন না। শুধু কাগজটা ভাঁজ করে আলমারির ভেতরে যত্ন করে রেখে দিলেন।

অর্পিতা বুঝল—ওই নীরবতাই তার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি।

বাবার ছায়া

কয়েক বছর পর বাবা অসুস্থ হলেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ধরা পড়ল—হৃদরোগ। কিন্তু বাবা জেদ করে বললেন,
—“আমার জন্য চিন্তা কোরো না, তুমি তোমার লেখা চালিয়ে যাও।”

তখন অর্পিতা ছোট্ট এক প্রকাশনী থেকে প্রথম বই ছাপাল। হাতে বই নিয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাবা বইয়ের মলাটে হাত বুলিয়ে শুধু বললেন,
—“ভালো হয়েছে।”

তারপর আর কিছু বলেননি। কিন্তু মেয়ের মনে হল, পৃথিবীর সব ভালোবাসা ওই দুটি শব্দের মধ্যেই জমা হয়ে আছে।

সাফল্যের দিন

কলকাতার এক নামী অডিটোরিয়াম। বাইরে এখনও শীতের হালকা হাওয়া বইছে। চারদিকে ব্যস্ততার ছাপ—সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, মাইক্রোফোনের তার গুটিয়ে রাখছে কর্মীরা, অতিথিদের জন্য সাজানো চেয়ারগুলোতে একে একে ভরে যাচ্ছে দর্শক।

অর্পিতা এক কোণে বসে আছে। বুকের ভেতর ধুকপুক ধ্বনি যেন কানে শোনা যাচ্ছে। হাতে মুঠো করে চেপে রাখা আছে নিমন্ত্রণপত্রটা। তাতে স্পষ্ট লেখা—
“এ বছরের সেরা গল্পগ্রন্থের পুরস্কার—অর্পিতা সেন।”

তার মনে হচ্ছে, সবটাই যেন স্বপ্ন।
যে মেয়ে একসময় বারবার ফেল করত, চারপাশের মানুষ যার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলত, আজ সে এই মঞ্চে সম্মানিত হতে চলেছে!

আলো হঠাৎ ম্লান হলো। ঘোষকের কণ্ঠ মাইক্রোফোনে ভেসে এলো—
—“এবার আমরা আহ্বান জানাচ্ছি এ বছরের সেরা গল্পগ্রন্থের লেখিকা, অর্পিতা সেনকে।”

চারদিক হাততালিতে গমগম করতে লাগল।
অর্পিতা আস্তে আস্তে মঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে উঠল। প্রতিটি পদক্ষেপে তার পায়ের নিচে যেন কেঁপে উঠছে মাটি। আলোয় ভরা বিশাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সে একা হয়ে গেল।

তার হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। ঠান্ডা ধাতব ট্রফিটা হাতের মুঠোয় নিয়ে হঠাৎ অর্পিতার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

chatgpt image aug 17, 2025, 06 07 43 pm

না, সে এই হাততালি বা ঝলমলে আলো কিছুই দেখছে না। তার মনে ভেসে উঠছে শুধু এক রাত—যখন পরীক্ষার আগের রাতে ভেঙে পড়ে বাবার ঘরে ঢুকে বলেছিল,
—“বাবা, আমি পারব না।”

আর বাবা কিছু না বলে শুধু মাথায় হাত রেখেছিলেন।

হলঘর নিস্তব্ধ হয়ে আছে। সবার চোখ এখন তার দিকে।
অর্পিতা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিল। কণ্ঠ কেঁপে উঠল, কিন্তু সে থামল না।

—“আজ আমি যে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি, এই পুরস্কার হাতে নিচ্ছি, সেটা শুধু আমার কৃতিত্ব নয়। এর পেছনে আছেন এমন একজন মানুষ, যিনি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিঃশব্দে পাশে থেকেছেন।

যখন সবাই বলত—আমি ব্যর্থ, আমি অকাজের… তখন তিনিই একদিনও আমাকে অপমান করেননি। আমি যখন কেঁদে বলেছিলাম—‘আমি পারব না’, তখন কোনো উপদেশ দেননি, কোনো রাগও করেননি। শুধু মাথায় একটুখানি হাত রেখেছিলেন।

সেই নীরব হাতের ভরসাই আজ আমাকে এখানে দাঁড় করিয়েছে।”

অর্পিতার গলা ভারী হয়ে এলো। চোখ ভিজে উঠল।
সে একটু থেমে আবার বলল—

—“আমার বাবা আজ এই আসরে নেই। তিনি আর বেঁচে নেই। কিন্তু আমি জানি, কোথাও না কোথাও তিনি আছেন, আর আজকের এই মুহূর্ত দেখছেন। এই পুরস্কার আমার নয়, আমার বাবার—যার নিঃশব্দ আশীর্বাদ আমাকে জীবনভর পথ দেখিয়েছে।”

কথা শেষ হতেই হলঘর গর্জে উঠল হাততালিতে।
কেউ কেউ চোখ মুছে নিচ্ছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠছে।
কিন্তু অর্পিতা কিছুই শুনছে না, কিছুই দেখছে না। তার মনে শুধু একটাই ছবি—
বাবা টেবিলে বসে আছেন, খবরের কাগজ ভাঁজ করছেন, আর তার মাথায় রেখে দিচ্ছেন নীরব এক আশীর্বাদ।

অনুপস্থিত উপস্থিতি

পুরস্কার হাতে বাড়ি ফিরে এসে সে বাবাকে দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা তখন আর বেঁচে নেই। টেবিলের ওপর এখনও রাখা তাঁর পুরোনো চশমা, অর্ধেক পড়া খবরের কাগজ।

আলমারির ভেতরে গুছিয়ে রাখা সেই প্রথম ছাপা লেখার কাগজ, আর প্রথম বইয়ের কপি। সবকিছুই যেন বাবার নিঃশব্দ আশীর্বাদের সাক্ষী হয়ে আছে।

অর্পিতা বইয়ের পাশে পুরস্কারটা রেখে চোখ মুছল। মনে হল—বাবা কোথাও থেকে নিশ্চয়ই দেখছেন।

উপসংহার

অর্পিতা জানে, জীবনে যতই সাফল্য আসুক, বাবার সেই নীরব আশীর্বাদের সমান কিছুই হতে পারে না।

কোনোদিন উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেননি, কোনোদিন বড় বড় কথা বলেননি। কিন্তু মাথায় রাখা একটুখানি হাতই তার জীবনের পথ দেখিয়েছে।

নীরবতাই মাঝে মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা।
অর্পিতার জীবনে বাবার “নিঃশব্দ আশীর্বাদ” আজও প্রতিটি মুহূর্তে তাকে পথ দেখায়।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *