“শিক্ষকের আলো”
|

“শিক্ষকের আলো”

(শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কের কথামালা)

প্রথম পরিচয়

পল্লব ছিল এক সাধারণ গ্রামীণ স্কুলের ছাত্র। তার বাড়ি নদীর ধারে, কাঁচা রাস্তার পাশ ঘেঁষে। বাবা দিনমজুর, মা গৃহিণী। সংসারে অভাবের অন্ত ছিল না। পল্লব পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও সুযোগ-সুবিধার অভাব তাকে সবসময় পেছনে ঠেলে রাখত।

স্কুলে নতুন আসলেন এক তরুণ শিক্ষক—অভিজিৎ স্যার। সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে সরকারি নিয়োগে এই প্রত্যন্ত গ্রামে এসেছেন। প্রথম দিন থেকেই তিনি বুঝলেন এই গ্রামে শিক্ষা মানে কেবল পাশ নম্বর নয়, বরং টিকে থাকার সংগ্রাম।

অন্য ছাত্ররা যেমন চঞ্চল, পল্লব ছিল তেমন নয়। ক্লাসে সে চুপচাপ বসত, কিন্তু তার চোখে ছিল প্রশ্নের ঝিলিক। স্যার প্রথম দিনেই লক্ষ্য করলেন—এই ছেলেটি আলাদা।

শিক্ষার হাতছানি

অভিজিৎ স্যার ক্লাসে পড়ানোর সময় খেয়াল রাখতেন, যাতে প্রতিটি ছাত্র বুঝতে পারে। তিনি কঠিন অঙ্ক বা ইতিহাসের অধ্যায়কে গল্পের মতো করে শোনাতেন। বাচ্চারা যেন বন্ধু পেয়েছে, এমন আনন্দে শিখত।

পল্লব প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে স্যারের গল্প করত। সে বলত,
—“মা, স্যার বলেন অঙ্ক ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘অঙ্ক মানে গল্প, শুধু উত্তর খুঁজে পেতে হবে।’”

মা হাসতেন, যদিও অভাবের চাপে সেই হাসি নিস্তেজ ছিল। তবু মনে মনে তিনি ভাবতেন, এই ছেলেটাই হয়তো একদিন সংসারের অবলম্বন হবে।

অভাব বাড়তে লাগল। বাবার আয় অনিয়মিত। অনেকদিন স্কুলে দুপুরের খাবারই পল্লবের একমাত্র ভরসা। নোটবুক, কলম কেনার টাকাও থাকত না। ধীরে ধীরে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছিল।

অভিজিৎ স্যার তা টের পেলেন। একদিন স্কুল শেষে তিনি পল্লবকে ডেকে নিলেন।
—“পল্লব, পড়াশোনায় মন দিচ্ছিস না কেন?”
পল্লব কেঁদে ফেলল। বলল,
—“স্যার, খাতা-কলম নেই। বাড়ির অবস্থা খারাপ। আমি হয়তো স্কুল ছাড়তে হবে।”

স্যার এক মুহূর্ত নীরব থেকে ব্যাগ থেকে নতুন খাতা আর কলম বের করে দিলেন।
—“এবার অজুহাত নেই। যত কষ্টই হোক, স্কুল ছাড়বি না। আমি তোকে দেখে নেব।”

সেদিন থেকেই পল্লবের জীবনে নতুন আলো জ্বলে উঠল।

ছাত্র–শিক্ষকের সম্পর্ক

সময় গড়াল। পল্লব পরীক্ষায় ভালো করতে লাগল। কিন্তু শুধু পড়াশোনা নয়, স্যার তাকে জীবনবোধও শেখাতেন।

একদিন স্যার বললেন,
—“শিক্ষা মানে শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়। শিক্ষা মানে মানুষ হওয়া। সততা, পরিশ্রম আর দয়া—এই তিনটিই সবচেয়ে বড় পাঠ।”

পল্লব এসব কথা বুকের ভেতর গেঁথে রাখত। গ্রামে যখন অনেক বন্ধুরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে খেলত বা কাজ করতে যেত, তখন সে মনে করত—স্যারের কথা ভোলা যাবে না।

sikhaker alo 3

অভিজিৎ স্যার নিজের ব্যক্তিগত সময়েও ছাত্রদের পড়াতেন। কোনো টাকা নিতেন না। গ্রামের লোকজন প্রথমে অবাক হয়েছিল, পরে শ্রদ্ধা করতে শুরু করল।

প্রতিযোগিতার দিন

স্কুলে রাজ্যস্তরের বিজ্ঞান প্রতিযোগিতার আয়োজন হলো। পল্লব অংশ নিতে চাইল, কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। স্যার নিজেই ব্যবস্থা করলেন—প্রজেক্ট বানানোর খরচ, যাতায়াতের টাকা, সব তিনি দিলেন।

পল্লবের তৈরি ছোট্ট বৈদ্যুতিক চাকা মডেলটি বিচারকদের মন জয় করল। সে প্রথম হলো। যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরস্কার নিল, সবার সামনে বলল,
—“এই সাফল্য আমার নয়, আমার স্যারের। তিনি না থাকলে আমি স্কুলেই থাকতাম না।”

পুরো হল হাততালিতে গর্জে উঠল। সেদিন স্যারের চোখ ভিজে উঠেছিল।

কঠিন সিদ্ধান্ত

মাধ্যমিক পরীক্ষা ঘনিয়ে এলো। বাড়িতে চাপ শুরু হলো—পল্লবকে যেন কাজ করে সংসারে সাহায্য করতে হয়। বাবা বললেন,
—“ছেলেকে আর পড়ালে লাভ নেই। চাকরিবাকরি হবে না। মাঠে নামলে অন্তত কিছু রোজগার হবে।”

পল্লব চুপ করে শুনল। তার চোখে জল জমল। স্যার খবর পেয়ে নিজে বাড়িতে এলেন। বাবা-মাকে বোঝালেন—
—“এই ছেলেটার চোখে আমি ভবিষ্যৎ দেখি। একটু ধৈর্য ধরুন। পড়াশোনা শেষ করলে একদিন সংসারের ভার ও-ই নেবে।”

অবশেষে বাবা-মা রাজি হলেন। স্যার যেন পল্লবের অভিভাবক হয়ে উঠলেন।

নতুন দিগন্ত

মাধ্যমিকে পল্লব ভালো রেজাল্ট করল। পরে উচ্চমাধ্যমিকেও কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করল। সে শহরে কলেজে ভর্তি হলো—স্যারের উৎসাহ আর সাহায্যে।

শহরে গিয়ে প্রথম দিকে কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু স্যারের শেখানো মন্ত্র মনে রেখেছিল—“কষ্টকে ভয় পাস না, বরং তাকে জয় কর।”

কলেজ শেষে সে প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হলো। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করত, সংসারের খরচও সামলাত।

শিক্ষক দিবসে প্রত্যাবর্তন

বছর কেটে গেল। পল্লব এখন এক সফল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে তার কাছে সবচেয়ে বড় পরিচয়—সে এক ছাত্র, আর অভিজিৎ স্যার তার পথপ্রদর্শক।

এক শিক্ষক দিবসে সে হঠাৎ স্কুলে হাজির হলো। সঙ্গে ফুলের তোড়া, আর স্যারের জন্য একটি নতুন বইয়ের সেট।

sikhaker alo 2

স্যার তখনো সেই ছোট্ট গ্রামে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন, একই নিষ্ঠায়। পল্লব গিয়ে প্রণাম করল। বলল,
—“স্যার, আমি আজ যা কিছু হয়েছি, আপনার জন্যই। আপনি যদি সেদিন খাতা–কলম না দিতেন, হয়তো আমি এখন অন্য পথে হারিয়ে যেতাম।”

স্যার মৃদু হেসে বললেন,
—“না রে পল্লব, আমি শুধু দরজা দেখিয়েছি। ভেতরে ঢুকেছে তুই নিজেই। আমার সাফল্য তোকে মানুষ হতে দেখার আনন্দেই।”

সেই মুহূর্তে সারা স্কুলে করতালি বেজে উঠল। অন্য ছাত্ররা বুঝল—শিক্ষক দিবস মানে শুধু অনুষ্ঠান নয়, বরং একজন শিক্ষক ও ছাত্রের হৃদয়ের বন্ধনকে স্মরণ করা।

শিক্ষার প্রকৃত মানে

সন্ধ্যার আলোয় বিদায় নেওয়ার আগে পল্লব বলল,
—“স্যার, আপনার স্বপ্ন একদিন আমি এগিয়ে নিয়ে যাব। আপনাকে দেখে শিখেছি, শিক্ষক মানে শুধু পাঠদাতা নয়, শিক্ষক মানে জীবনদাতা।”

স্যার চোখ ভিজে বললেন,
—“তুই যদি একদিন অন্য কাউকে এভাবেই সাহায্য করিস, সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় অর্জন।”

পল্লব নীরবে মাথা নত করল। কারণ সে জানত—শিক্ষা মানে আলো ছড়ানো, আর সেই আলো তার জীবনে এসেছিল এক শিক্ষক দিবসের মতো উজ্জ্বল হয়ে।

এই গল্প শুধু পল্লব আর অভিজিৎ স্যারের নয়। এটি প্রতিটি ছাত্র–শিক্ষকের সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। সমাজে যে কোনো সফল মানুষকে খুঁজলে দেখা যায়, তার পেছনে কোথাও না কোথাও একজন শিক্ষকের স্পর্শ আছে।

শিক্ষক দিবস আমাদের সেই স্পর্শকে স্মরণ করিয়ে দেয়—যেখানে জ্ঞান শুধু পরীক্ষার ফল নয়, বরং জীবন গড়ার হাতিয়ার।

সমস্ত বিশ্বের শিক্ষক সমাজকে গল্পকথা পরিবারের আন্তরিক প্রণাম ও শ্রদ্ধা
আপনাদের আলোর প্রদীপ আমাদের পথ দেখায়, আপনাদের ধৈর্য, ভালোবাসা ও নিষ্ঠা আমাদের জীবনের প্রকৃত শক্তি হয়ে থাকে।

আজকের দিনে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই প্রতিটি শিক্ষককে—
যাঁরা শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না, জীবনকে গড়ার পাঠও শেখান।
আপনাদের অবদান অমূল্য, আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা চিরকাল অক্ষয়।

শুভ শিক্ষক দিবস
— গল্পকথা পরিবার 🌿

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *