“শেষ দেখা”

“শেষ দেখা”

আকস্মিক দেখা

আকাশটা তখন ভারী মেঘে ঢাকা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে আর বেশি দেরি নেই। ছোট্ট শহরের সেই পুরোনো রেলস্টেশন—যেখানে প্রতিদিন কয়েকটা ট্রেন থামে, আবার চলে যায়। লোকজনও বেশি নয়। ভিজে প্ল্যাটফর্মে হালকা ধোঁয়া মিশে আছে চায়ের কাপে, আর দূরে কোথাও বাজছে বৃষ্টির শব্দ।

ঋতিকা ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণে। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই, তবু বুকের ভেতর অদ্ভুত অস্থিরতা। আজ স্কুল থেকে ফেরার সময় হঠাৎ মাথায় এল ট্রেনে চড়ে অন্য শহরে চলে গেলে কেমন হতো! সে এমনিতেই সবসময় একরকম বন্দি মনে করে নিজেকে। পরিবারের নিয়ম, সমাজের বাঁধন—সব মিলিয়ে তার ভেতরে জমে আছে অনেক অজানা প্রশ্ন।

ঠিক সেই সময়েই ঘটে যায় ঘটনাটা।
দূরের সিগন্যাল পাল্টে যেতেই হুইসেল বাজিয়ে ঢুকে পড়ে এক্সপ্রেস ট্রেন। লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দৌড়ঝাঁপে। হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে ঋতিকার হাত থেকে ছাতাটা মাটিতে পড়ে যায়। ঝুঁকে সেটা তুলতে গিয়েই চোখ পড়ল এক অচেনা ছেলের মুখে।

ছেলেটি হয়তো কলেজ পড়ুয়া, চোখে গভীরতা, মুখে মিষ্টি হাসি। ভিজে চুল কপালে লেগে আছে। সে ছাতাটা কুড়িয়ে দিয়ে বলে উঠল,
—“এটা কি আপনার?”

ঋতিকা কিছু বলার আগে নিজের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি টের পেল। যেন অনেককাল আগের চেনা কেউ হঠাৎ ফিরে এসেছে। তবু সামলে নিয়ে ছোট্ট করে বলল,
—“হ্যাঁ, ধন্যবাদ।”

ট্রেনটা থেমে গেল। লোকজন গাদাগাদি করে নামছে। ছেলেটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে, যেন কোথাও যাবার নেই, শুধু তাকিয়েই আছে। অচেনা হলেও সেই দৃষ্টিতে এক ধরনের টান ছিল। ঋতিকা চোখ সরাতে পারছিল না।

অল্প সময়ের মধ্যেই কথোপকথন শুরু হলো।
ছেলেটির নাম অরিজিৎ। সে পাশের কলেজে পড়ে। প্রায়ই এই স্টেশনে আসে, কখনও বন্ধুদের সাথে, কখনও একা। আজও নাকি তার বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না।

আলাপ হতে হতে বোঝা গেল, দু’জনের মধ্যেই একরকম একাকিত্ব লুকিয়ে আছে। অরিজিৎ জানাল, তারও মনে হয় মাঝে মাঝে—ট্রেন ধরে কোথাও চলে গেলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো। ঋতিকা অবাক হলো। ঠিক এই কথাটাই তো সে কিছুক্ষণ আগে নিজের মনে ভাবছিল!

বৃষ্টির ফোঁটা আরও ঝমঝম করে নামতে লাগল। দু’জনেই একসাথে দাঁড়িয়ে সেই বৃষ্টির শব্দ শুনছিল। চারপাশের কোলাহল যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল, কেবল এক অদৃশ্য সুর বাঁধছিল তাদের মধ্যে।

সময়টা খুব বেশি ছিল না। ট্রেন আবার বাঁশি বাজাল। লোকজন উঠে পড়ল, কেউ নামল। অরিজিৎও বলল,
—“আমাকে যেতে হবে। আবার দেখা হবে?”

ঋতিকা কিছু বলল না। শুধু চোখে তাকিয়ে রইল। শব্দহীন একটা প্রতিশ্রুতি যেন অদলবদল হলো।

অরিজিৎ চলে গেল ট্রেনে উঠে। কিন্তু তার দৃষ্টি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঋতিকার চোখে আটকে রইল।
ট্রেন যখন ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল, ঋতিকা অনুভব করল বুকের ভেতরে কেমন অচেনা আলো জ্বলে উঠেছে।

সেই প্রথম দেখা।
অচেনা হলেও—অজান্তেই শুরু হলো এক সম্পর্কের বীজ, যা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গল্প হয়ে উঠবে।

অচেনা থেকে আপন

প্রথম দেখার পর কদিন কেটে গেল। ঋতিকা নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন টের পাচ্ছিল। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় তার চোখ অজান্তেই চলে যেত সেই রেলস্টেশনের দিকে। মনে হতো, যদি আবার দেখা হয়!

অদ্ভুতভাবে, ঠিক তাই-ই হলো। এক সপ্তাহ পর একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ শুনল পরিচিত গলা—
—“আপনি এখানে?”

চমকে ফিরে তাকাতেই দেখল অরিজিৎ। আজ তার হাতে বই, কাঁধে ব্যাগ। মুখে চেনা সেই হাসি। ঋতিকার বুক কেঁপে উঠল। যেন বহুদিনের আপনজনের সাথে দেখা হলো।

আলাপ শুরু হলো সহজভাবে—ক্লাস, বই, বৃষ্টি, গান নিয়ে। ঋতিকা অবাক হয়ে দেখল, এই ছেলেটির সাথে কথা বলতে কতটা স্বস্তি লাগছে। সমাজ, পরিবার—যারা সবসময় তার চিন্তাকে বেঁধে রাখে, তাদের থেকে একেবারেই আলাদা অরিজিৎ। তার চোখে আছে স্বপ্ন, কণ্ঠে আছে সাহস, আর ভাবনায় আছে মুক্তির ছোঁয়া।

এরপর থেকে নিয়ম হয়ে গেল—যে দিনই সুযোগ পায়, দু’জনেই চলে আসে স্টেশনে। কখনও ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আড্ডা দেয়, কখনও ভিজে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গান গায়। চায়ের দোকানের মালিকও চিনে ফেলল তাদের। সে মুচকি হেসে বলত—“আজও এলেন তো?”

একদিন সন্ধ্যায় অরিজিৎ হঠাৎ বলল,
—“তুমি জানো, আমি ছোটবেলা থেকে গান লিখি। কিন্তু কাউকে কখনও দেখাইনি।”
বলে সে ব্যাগ থেকে একটা খাতায় লেখা কয়েকটা লাইন পড়ে শোনাল। সেই কথাগুলো ছিল ভীষণ আবেগী, না-পাওয়া ভালোবাসার কথা।

ঋতিকার মনে হলো, শব্দগুলো যেন তার নিজের মনের কথা। চুপ করে শুনে গেল। তারপর ধীরে বলল,
—“তুমি যদি এগুলো হারিয়ে ফেলো, আমি লিখে রাখব মনে।”

এই একটি বাক্যেই অরিজিৎ বুঝল—সে ঋতিকাকে আপন ভেবে ফেলেছে।

দিন গড়াতে গড়াতে দু’জনের সম্পর্ক অচেনা থেকে আপন হয়ে উঠল। তারা একে অপরের ভেতরে আশ্রয় খুঁজে পেল। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা, পরিবার, স্বপ্ন—সবকিছুর আড়ালে গড়ে উঠল তাদের ছোট্ট দুনিয়া।

তবে ভয়ের ছায়াটাও ছিল। ঋতিকা জানত, তার পরিবার খুব রক্ষণশীল। কারো সাথে এমন ঘনিষ্ঠতা তারা মেনে নেবে না। আবার অরিজিৎও জানত, তার বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ—মা একা সংসার চালান, বাবাকে ছোটবেলায় হারিয়েছে।

তবু এই সীমাবদ্ধতার মাঝেই তাদের ভালোবাসা বেড়ে উঠতে লাগল। কখনও ঋতিকা স্কুলের অজুহাতে দেখা করত, কখনও অরিজিৎ কলেজ ছুটির পর ছুটে আসত স্টেশনে।
তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকত বৃষ্টিভেজা রেললাইন, চায়ের কাপে ধোঁয়া, আর ট্রেনের হুইসেল।

একদিন অরিজিৎ হঠাৎ বলল—
—“ঋতিকা, আমি জানি না ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে। তবে একটা কথা জানি—তুমি ছাড়া আমি কোনো স্বপ্ন দেখব না।”

ঋতিকা কিছু বলল না। শুধু চোখ ভরে তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতরে যে আবেগ জমে উঠেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো শক্তি তার ছিল না।

অচেনা মানুষটি, আজ তার আপন হয়ে উঠেছে।
কিন্তু দুজনেই জানত না, সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন এক বাস্তবতা—যা হয়তো তাদের এই ছোট্ট স্বপ্নকে ভেঙে দেবে টুকরো টুকরো করে।

বাস্তবতার দেয়াল

দিন গড়িয়ে মাস কেটে গেল। ঋতিকা আর অরিজিৎ দু’জনেরই মনে হচ্ছিল—তাদের ভালোবাসা যেন ধীরে ধীরে শেকড় গেঁড়ে বসছে। কিন্তু যতই তারা কাছাকাছি আসছিল, ততই বাস্তবতার দেয়াল যেন সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল।

ঋতিকার পরিবার খুবই রক্ষণশীল। বাবা স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক, সমাজে সম্মানিত। তিনি চান, ঋতিকা শুধু পড়াশোনা করুক, তারপর সংসারী জীবনে পা রাখুক তাঁর পছন্দের ছেলের সাথে। মা-ও বাবার কথাই মানেন। ঋতিকার ছোট্ট শহরে মেয়েদের জন্য স্বাধীনতা শব্দটা যেন কেবল বইয়ের পাতায় আটকে আছে।

অন্যদিকে অরিজিৎ—তার বাবা নেই। ছোটবেলায় মারা গিয়েছেন। সংসার চলে মায়ের সেলাইয়ের কাজ আর অরিজিতের টিউশনের টাকায়। সে ভালো ছাত্র, স্বপ্ন দেখে বড় লেখক হওয়ার। কিন্তু সংসারের চাপ সবসময় তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে।

একদিন বিকেলে স্টেশনে দেখা করতে এসে ঋতিকা হঠাৎ খুব চুপচাপ হয়ে গেল। অরিজিৎ জিজ্ঞেস করল—
—“কী হয়েছে? তুমি কিছু বলছ না কেন?”

ঋতিকা ধীরে বলল—
—“আজ মা আমাকে বলেছেন, তারা আমার বিয়ে ঠিক করবেন শিগগিরই। বাবা ইতিমধ্যে এক আত্মীয়ের ছেলের কথা ভাবছেন।”

অরিজিতের মুখ সাদা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—
—“তুমি কী বলেছ?”

—“আমি বলেছি, এখনই বিয়ে নয়। পড়াশোনা শেষ করতে চাই। কিন্তু মা–বাবা কি আমার কথা শুনবেন?”

ওই মুহূর্তে দু’জনের মাঝে যে নীরবতা নেমে এলো, তা কোনো শব্দ দিয়ে ভাঙা গেল না। ট্রেনের হুইসেলের শব্দও যেন তাদের বুকের ভেতরের চাপা কষ্টকে আরো তীব্র করে তুলল।

দিন যত গড়াতে লাগল, চাপ তত বাড়তে থাকল। ঋতিকার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করল, নতুন নতুন প্রস্তাব আসছিল। বাবার চোখে তখন শুধু সমাজের মান-সম্মান। আর ঋতিকার বুক ভরে যাচ্ছিল অস্থিরতায়।

অন্যদিকে অরিজিৎও বুঝতে পারছিল—সে কোনোভাবেই এখন ঋতিকাকে নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ দিতে পারবে না। পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেই তার প্রাণ বেরিয়ে যায়। অনেক রাতে খাতা-কলম নিয়ে লিখতে বসে সে, কিন্তু মনে কেবল ঘুরতে থাকে—“আমি কি পারব তাকে ধরে রাখতে?”

একদিন দু’জনের দেখা হলো ভোরবেলায়। বৃষ্টির ফোঁটা তখনো মাটিতে লেগে আছে। ঋতিকা অরিজিতের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—
—“আমরা কি কোনোদিন একসাথে থাকতে পারব? নাকি এ সবই কেবল স্বপ্ন?”

অরিজিৎ উত্তর দিল না। শুধু তার হাত ধরে রাখল শক্ত করে। কিন্তু সেই নীরবতা ঋতিকাকে বুঝিয়ে দিল—বাস্তবতার দেয়াল তাদের সামনে ক্রমেই উঁচু হয়ে উঠছে।

সেদিন তারা বিদায় নিল ভারী মন নিয়ে। দুজনেই জানত, জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় আসছে সামনে।

বিচ্ছেদের পথ

দিনগুলো যেন ভারী হয়ে উঠল। আগের সেই প্রাণখোলা আড্ডা, হাসি, গান—সবই যেন কোথায় হারিয়ে গেল। ঋতিকা আর অরিজিতের দেখা হতো ঠিকই, কিন্তু কথার বদলে নীরবতা যেন বেশি কথা বলত।

একদিন বিকেলে, আকাশটা মেঘলা। স্টেশনের ধারে দাঁড়িয়ে দু’জন চুপচাপ ট্রেনের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ঋতিকা ভাঙা গলায় বলল—
—“অরিজিৎ, বাবা আমার বিয়ের দিন প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন।”

অরিজিতের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। তার মনে হলো, যেন রেললাইনের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সে বলল—
—“তুমি কি রাজি?”

ঋতিকা চোখ নামিয়ে বলল—
—“রাজি হবার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু… আমার কি আর কিছু করার আছে? আমি তো জানি, তুমি চাইলে-ও এখন আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে পারবে না। তোমারও সংসারের বাঁধন আছে।”

শব্দগুলো যেন বিষের মতো বিঁধল অরিজিতের ভেতরে। সে চাইল বলতে—“আমি সবকিছু ছেড়ে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব।” কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বেরোল না। কারণ সে জানত, বাস্তবতা তার সেই স্বপ্নটাকে মুহূর্তে ভেঙে দেবে।

সেই দিন থেকে তাদের দেখা হওয়া কমে গেল। চিঠি লিখত অরিজিৎ, কিন্তু ঋতিকা পৌঁছাতে পারত না সবসময়। ফোন করার সুযোগও ছিল না। শুধু বুকের ভেতরে জমে উঠতে লাগল না-বলা হাজারো কথা।

sesh dekha 2

ঋতিকার চোখে জল জমে উঠত প্রায়ই। সে ভাবত, কেন তারা একে অপরকে এতটা ভালোবেসে ফেলল, যদি শেষটা এমন হয়!
অন্যদিকে অরিজিৎ রাত জেগে লিখত ডায়রিতে—
“ভালোবাসা কি সত্যিই এত দুর্বল? নাকি সমাজের দেওয়ালই এত শক্ত?”

অবশেষে এল সেই দিন। ঋতিকা খবর দিল—
—“পরশু আমার বিয়ে। আজই শেষবার তোমার সাথে দেখা করতে এলাম।”

শুনে অরিজিৎ যেন ভেতর থেকে ভেঙে পড়ল। তবু সে মুখে হাসি রাখল, বলল—
—“তুমি সুখে থেকো। আমি প্রার্থনা করব, তোমার জীবন সুন্দর হোক।”

ঋতিকা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে ফিসফিস করে বলল—
—“তুমি জানো তো, আমি যতদিন বাঁচব, ততদিন তুমি আমার হৃদয়ে থাকবে।”

ট্রেন এসে দাঁড়াল। দু’জনেই বুঝল, এই হয়তো শেষ দেখা।
ট্রেন ছেড়ে দিলে, ঋতিকা ধীরে ধীরে সরে গেল ভিড়ের মধ্যে। আর অরিজিৎ দাঁড়িয়ে রইল, বুকের ভেতরে হাজারো না-বলা কথা জমে।

সেদিনই তাদের বিচ্ছেদের পথ শুরু হলো।
ভালোবাসা রয়ে গেল, কিন্তু সময় আর সমাজ সেই ভালোবাসাকে কবর দিল নীরবে।

বহু বছর পর

সময় বড়ই নিষ্ঠুর। সে কাউকে থামতে দেয় না।
বছর গড়িয়ে গেছে—পাঁচ, সাত, দশ। ঋতিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, দূরের এক শহরে। তার সংসার, সন্তান, পরিবার—সবকিছুই আছে। তবু বুকের ভেতরে কোথাও এক শূন্যতা রয়ে গেছে, যা কখনও পূর্ণ হয়নি।

অন্যদিকে অরিজিৎ—কলেজ শেষ করে শহরে চাকরি পেয়েছে। লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছে, কিছু কবিতা ছাপাও হয়েছে পত্রিকায়। জীবনে সাফল্য আসছে, কিন্তু তার হাসির আড়ালে একটা দীর্ঘশ্বাস সবসময় লুকিয়ে থাকে।

একদিন অফিসের কাজে অরিজিতের সেই ছোট্ট শহরে আসা হলো। বহু বছর পর। শহরটা বদলে গেছে, কিন্তু রেলস্টেশনের পুরোনো চেহারা প্রায় একই রকম। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তার মনে হলো—এই জায়গাটাই তো তাদের স্বপ্নের জন্মস্থান। বুকের ভেতর টান অনুভব করল প্রবলভাবে।

সেই সন্ধ্যাতেই ঘটে গেল বিস্ময়।
স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল এক পরিচিত মুখ—ঋতিকা!
চোখের কোণে চশমা, শাড়ি পরা, পাশে ছোট্ট মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। বয়সের ছাপ পড়েছে বটে, তবু সেই দৃষ্টি, সেই হাসি—সবই যেন আগের মতো।

দুজনের চোখ মিলতেই সময় থমকে গেল। যেন মুহূর্তেই তারা ফিরে গেল দশ বছর আগের সেই বৃষ্টিভেজা বিকেলে।

—“ঋতিকা?”—কাঁপা গলায় ডাকল অরিজিৎ।
ঋতিকা একটু থমকে দাঁড়াল, তারপর মৃদু হাসল।
—“অরিজিৎ… সত্যিই তুমি?”

চোখে জল এসে গেল দু’জনেরই। তারা কিছুক্ষণ চুপ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। পাশে মেয়েটি কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু তারা যেন পৃথিবীর সব শব্দ ভুলে গেছে।

অবশেষে ঋতিকা ধীরে বলল—
—“তুমি ভালো আছ?”
অরিজিৎ হেসে মাথা নেড়ে বলল—
—“হ্যাঁ, বেঁচে আছি… তবে কোথাও কিছু অপূর্ণ রয়ে গেছে।”

ঋতিকা দৃষ্টি নামিয়ে নিল। তার বুকও ভরে উঠল একই কষ্টে। সে জানে, জীবনে যতই সে সব পেয়েছে মনে হোক, তবু যে জায়গাটা একদিন অরিজিতের জন্য খালি রেখেছিল, তা আজও খালি।

ট্রেন আসার সময় হলো। ঘোষণার শব্দ ভেসে উঠল। মুহূর্তগুলো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল।
অরিজিৎ হঠাৎ ফিসফিস করে বলল—
—“তুমি জানো তো, আমি আজও তোমাকে ভুলতে পারিনি?”

ঋতিকা চমকে তাকাল। চোখ ভিজে উঠল। ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু সে শুধু বলল—
—“আমি-ও না…”

sesh dekha 3

কথাগুলো বাতাসে মিলিয়ে গেল। ট্রেন এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে। ঋতিকা মেয়েকে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার ফিরে তাকাল। চোখে জল, ঠোঁটে অসম্পূর্ণ হাসি।

অরিজিৎ দাঁড়িয়ে রইল, তার দৃষ্টি ঋতিকার উপর স্থির। বুকের ভেতরে কেবল প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—
“যদি তুমি ফিরতে… যদি সবকিছু নতুন করে শুরু করা যেত…”

কিন্তু বাস্তবতা আবারও তাদের আলাদা করে দিল।
ঋতিকা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।
আর অরিজিৎ দাঁড়িয়ে রইল একা—বুকের গভীরে চিরকালীন অপ্রাপ্তির আগুন নিয়ে।

সেদিন, বহু বছর পর, তারা আবার মুখোমুখি হয়েছিল।
কিন্তু সেই দেখা-ও ছিল শেষ দেখা।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *