প্রেম মানে পেঁপের ঝোল

প্রেম মানে পেঁপের ঝোল

(একটা মজাদার লাভ স্টোরি)

প্রথম দর্শনে প্রেম না, হেঁচকি

কলেজের প্রথম দিন। সকালের টকটকে রোদে নতুন ব্যাগ, নতুন খাতা আর মনে নতুন উত্তেজনা নিয়ে গেট পার হলো নীলু। তার মনে হচ্ছিল—আজ যেন সে সিনেমার নায়িকা, সবার নজর কাড়বে।

ক্লাসরুমে ঢুকেই সেই নায়িকা-ভাব গলে গেল গরমে রাখা আইসক্রিমের মতো।
প্রথম বেঞ্চে বসে আছে এক মোটা, ফর্সা, গোলগাল ছেলে। শার্ট বোতাম টেনে টেনে লাগানো, পেট চেয়ারের সামনের দিকে ঠেসে আছে, হাতে কাগজের ঠোঙা ভর্তি সিঙ্গারা। চিবোচ্ছে এমনভাবে, যেন জীবন-মরণের পরীক্ষা চলছে।

নীলু সিট খুঁজে বসার আগেই বিপদ ঘটল। ব্যাগের ফিতা পায়ে জড়িয়ে গিয়ে সে একেবারে সামনে গিয়ে হোঁচট খেল।

ধপ করে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই ক্লাস ফেটে পড়ল হাসিতে। আর সামনের বেঞ্চ থেকে সেই গোলগাল ভদ্রলোক হাঁসতে হাঁসতে বলল—
“ওহো! সাবধানে মিস। আমার সিঙ্গারা যদি পড়ে যেত, আপনাকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হতো।”

সবাই খিলখিল করে উঠল।
নীলুর মুখ লাল হয়ে গেল লজ্জায়। সে ভেবেছিল কলেজে এসে সবাই তাকে স্মার্ট, সুন্দরী, নায়িকার মতো ভাববে। অথচ প্রথম দিনেই সে হাসির খোরাক হয়ে গেল!

নীলু রাগে ফুঁসে উঠে বলল—
“আপনি কে যে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন?”
ছেলেটা গম্ভীর গলায় বলল—
“আমার নাম গোপাল। আমার কাজ খাওয়া, আর শখ হলো মাঝে মাঝে মানুষ হাসানো।”

ক্লাস আবারও হেসে উঠল।
নীলু দাঁতে দাঁত চেপে নিজের সিটে গিয়ে বসল।

ক্লাস শেষে নীলু ভেবেছিল ছেলেটাকে আর কোনোদিন পাত্তা দেবে না। কিন্তু বেরোবার সময় দেখল, সেই গোপালই তার ব্যাগটা কাঁধে তুলে ধরেছে। বলল—
“দেখো, আমি আসলে খারাপ ছেলে নই। মুখে যেটা আসে বলে ফেলি। তোমাকে দেখে মনে হলো সিনেমার নায়িকা, তাই একটু ডায়লগ মেরে দিলাম।”

নীলু ভুরু কুঁচকে বলল—
“নায়িকা? নাকি খোঁচা দেওয়ার নতুন উপকরণ?”
গোপাল দাঁত বের করে হাসল—
“আচ্ছা শোনো, তোমাকে খোঁচা দিতে গিয়ে যদি হোঁচট খাও, তবে বুঝতে হবে এটাই প্রথম দর্শনে হেঁচকি।”

নীলু রাগ চেপে রাখতে চাইল, কিন্তু শেষে নিজেই খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল।
এভাবেই শুরু হলো তাদের অদ্ভুত বন্ধুত্ব—যেখানে প্রথম দর্শনে প্রেম হয়নি, বরং উঠেছিল হেঁচকি।

প্রেম না, পেঁপের তরকারি

কলেজের ক্যান্টিনে চায়ের কাপ ধোঁয়া উঠছে। চারপাশে ছাত্রছাত্রীদের আড্ডা, হাসাহাসি, তর্ক-বিতর্ক। নীলু বসে আছে এক কোণে, সামনে বিস্কুটের প্লেট। তার পাশে গোপাল, হাতে চায়ের গ্লাস আর চোখে সেই চিরচেনা দুষ্টু হাসি।

নীলু হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিল—
“শোনো গোপাল, প্রেম মানে আসলে কী জানো?”

গোপাল চুমুক দিতে দিতে বেশ ভাব গাম্ভীর্য করে বলল—
প্রেম মানে একেবারে পেঁপের তরকারি।”

নীলু কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল।
“মানে? প্রেম আবার পেঁপের তরকারি হয় কীভাবে?”

গোপাল কানে হাত দিয়ে যেন দর্শন শোনাচ্ছে—
“দেখো, প্রথমে পেঁপের তরকারি কেউ খেতে চায় না। গন্ধটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। প্রেমও তাই—শুরুতে একটু অস্বস্তি, একটু অচেনা। কিন্তু একবার অভ্যেস হয়ে গেলে না খেলে পেট খালি লাগে। তখন যতই বিরক্তিকর লাগুক, সেটা ছাড়া আর চলে না।”

ক্যান্টিনে বসে থাকা বাকিরা এই দর্শন শুনে ফেটে পড়ল হাসিতে।
কেউ বলল—“গোপাল, তুই তো একেবারে প্রেমের গুরু!”
কেউ আবার মজা করে যোগ করল—“আগামীকাল থেকে ক্যান্টিনে শুধু পেঁপের তরকারিই বিক্রি হবে।”

নীলু মুখ গম্ভীর করার চেষ্টা করল, কিন্তু হাসি চেপে রাখতে পারল না।
“তাহলে তুমি বলতে চাইছো প্রেম মানেই বিরক্তিকর, কিন্তু অভ্যাস হয়ে গেলে দরকারি?”

গোপাল মাথা নেড়ে বলল—
“ঠিক তাই। যেমন আমার ক্ষেত্রে সিঙ্গারা আর তুমিই—দুটো ছাড়া আমার দিন কাটে না।”

নীলুর মুখ লাল হয়ে গেল। হাসি না কান্না—সে নিজেই বুঝতে পারছিল না।
মনে মনে ভাবল—এই মোটা, খাওয়ার লোভী ছেলেটা মাঝে মাঝে এমন কথা বলে ফেলে যে হৃদয়ের ভেতর কোথাও যেন দোলা লাগে।

মোটা-পাতলা মিলে ঝগড়া

বন্ধুত্ব যত দিন বাড়ছিল, ততই তাদের ছোটখাটো খুনসুটি আর ঝগড়ার সংখ্যাও বাড়ছিল।
কারণটা সহজ—নীলু ভীষণ ফিটনেস ফ্রিক। সকালে উঠে যোগব্যায়াম, বিকেলে দৌড়, ডায়েটে শুধু স্যালাড আর স্যুপ।
আর গোপাল? তার কাছে ব্যায়াম মানেই ক্যান্টিনে গিয়ে লুচি-ছোলার লাইনে দাঁড়ানো, আর ডায়েট মানেই দুপুরে পাঁচটা রসগোল্লার বদলে তিনটায় নামিয়ে আনা।

একদিন ক্লাসের ফাঁকে নীলু রাগ করে বলল—
“শোনো গোপাল, তুমি একটু ডায়েট করো না কেন? এত মোটা হয়ে গেলে বিয়ের সময় তো তোমাকে হাতির মতো পালকি করে নিতে হবে।”

গোপাল সিঙ্গারায় কামড় দিতে দিতে হাঁসলো—
“তাতে সমস্যা কী? হাতির ওপর রাজকন্যা বসে না? তুমি তো রাজকন্যা, আমি হাতি—চমৎকার মানাবে।”

ক্লাসের সবাই হেসে গড়াগড়ি।
নীলুর মুখ লাল হয়ে গেল, কিন্তু সে হার মানল না।
“তুমি যদি এভাবে খেতে থাকো, একদিন না একদিন হাসপাতালের বেডে যেতে হবে।”

গোপাল গম্ভীর মুখ করে বলল—
“তাতে কী? তখন তুমি নার্সের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে পাশে, আমাকে স্যালাড খাওয়াবে। দেখবে প্রেম তখনও মিষ্টিই লাগবে।”

নীলু রাগ দেখাতে দেখাতে হেসে ফেলল।
আসলে গোপালকে নিয়ে রাগ করা প্রায় অসম্ভব। সে এমনভাবে উত্তর দিত যে রাগ আর টিকতই না।

তবে ঝগড়ার তালিকা অনেক লম্বা—

  • ফুচকা খাওয়ার সময় কে বেশি খাবে তা নিয়ে
  • সেলফি তুলতে গিয়ে কে মোটা/পাতলা দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে
  • লাইব্রেরিতে গোপালের নাক ডাকার আওয়াজ নিয়ে
  • এমনকি ক্লাসে প্রফেসরের প্রশ্নের ভুল উত্তর দিয়ে নীলুকে হাসির খোরাক বানানো নিয়েও

কিন্তু এসব ঝগড়ার শেষে একটাই নিয়ম—হাসি।
দু’জনেই যতই তর্ক করুক, শেষমেশ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলত।

কলেজে সবাই জানত, ওদের মধ্যে অদ্ভুত এক টান আছে।
কারও কারও মনে হতো—এই ঝগড়া আসলে প্রেমের অন্যরকম ভাষা।
যেমন পেঁপের তরকারি—গন্ধে বিরক্তিকর, কিন্তু খেলে অভ্যাস হয়ে যায়।

প্রথম প্রোপোজাল – সিনেমার থেকেও মজার

তৃতীয় বর্ষের ফেয়ারওয়েল পার্টি। কলেজের হলঘর আলোয় ঝলমল করছে। সবাই সাজগোজ করেছে—কেউ শাড়ি, কেউ কোট, কেউ আবার ঝলমলে পাঞ্জাবি।

নীলু সেদিন লাল শাড়ি পরে এসেছিল। চোখে কাজল, কপালে ছোট্ট লাল টিপ। হলঘরে ঢুকতেই সবাই ফিসফাস করে উঠল—
– “দেখেছো? নীলুকে আজ একেবারে সিনেমার নায়িকা লাগছে।”

কোণের এক টেবিলে বসে থাকা গোপালের চোখে তখন শুধু নীলুই। মোটা শরীরটা নিয়ে সে দাঁড়ানোর আগে দু’বার ভাবল, তারপর সাহস করে উঠে গেল মঞ্চে।

মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবাই ভেবেছিল সে হয়তো গান গাইবে বা কৌতুক বলবে। কিন্তু গোপাল গলা খাঁকারি দিয়ে বলল—
“শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রিয় বন্ধুবান্ধব… আজ আমি একটা বিশেষ ঘোষণা করতে চাই।”

সবাই চুপ করে শুনছে।
গোপাল হঠাৎ মঞ্চের উপরেই হাঁটু গেড়ে বসল। হাতে একটা লাড্ডুর ডিব্বা

prem mane peper jhol 2

সে সরাসরি নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল—
“নীলু, আমি জানি আমি তোমার স্বপ্নের হিরো নই। আমি কোনো ফিটনেস মডেলও নই। আমি শুধু গোপাল—যার পেট খিদেতে ভরা আর হৃদয়টা শুধু তোমার জন্য।”

চারপাশে ‘উফফ’ শব্দ, কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে, কেউ হাততালি দিচ্ছে।
গোপাল থামল না।

“তুমি কি আমার সঙ্গে সারা জীবন পেঁপের তরকারি খেতে রাজি? মাঝেমাঝে সিঙ্গারা, মাঝে মাঝে লাড্ডু—কিন্তু সবসময় একসঙ্গে।”

হল ফেটে পড়ল হাসি আর হাততালিতে।
নীলু প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তার চোখে জল চলে এলো—হাসি না কান্না, কেউ বুঝতে পারল না।

ধীরে ধীরে সে মঞ্চে উঠে এলো।
গোপালের হাত থেকে লাড্ডুর ডিব্বাটা তুলে নিয়ে একটা লাড্ডু মুখে দিল। তারপর তাকিয়ে বলল—
“প্রেম মানে শুধু পেঁপের তরকারি নয় গোপাল, মাঝে মাঝে মিষ্টিও লাগে।”

সেই মুহূর্তে হলঘর হাততালিতে গর্জে উঠল।
বন্ধুরা হুইসেল মারল, কেউ বলল—“ওরে বাবা, সিনেমার থেকেও জমকালো প্রোপোজ!”

গোপাল দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বলল—
“তাহলে সবাই শুনে রাখো, আজ থেকে গোপাল আর নীলু অফিসিয়ালি ‘পেঁপের তরকারি উইথ লাড্ডু কম্বো’।”

হাসিতে, উল্লাসে, খুনসুটিতে সেদিনের রাতটা মনে রাখার মতো হয়ে রইল।

বিয়ের পরের কাণ্ডকারখানা

বছর দু’য়েকের মধ্যে গোপাল আর নীলুর ধুমধাম করে বিয়ে হলো।
বিয়ের দিনেই কাণ্ডকারখানা শুরু।

বরযাত্রী পৌঁছানোর আগেই গোপাল খুঁজছে—
“এহ, কেউ লুচি-ছোলার আয়োজন করেছে তো?”
শ্বশুরমশাই হাঁপিয়ে বললেন—
“বাবা, এখন তো শুধু মালাবদল হবে।”
গোপাল গম্ভীর গলায় বলল—
“তাহলে মালার সঙ্গে একটা লুচিও দিলে ক্ষতি কী!”

prem mane peper jhol 1

মালা বদলের সময় নীলু গোপালের গলায় মালা দিতে যাচ্ছিল, আর গোপাল হঠাৎ হেঁচকি তুলে বলল—
“একটু সাবধানে দাও, মালাটা যেন আমার ডাবল চিনে আটকে না যায়।”
সবাই হেসে গড়াগড়ি।

সংসার শুরু

বিয়ের পরও ঝগড়াঝাঁটি থামল না।
রাতে খাওয়ার মেনু নিয়ে রোজ মহাযুদ্ধ।

নীলু: “আজ রাতে শুধু ভেজিটেবল স্যুপ খাব।”
গোপাল: “স্যুপ খেলে তো পেট খালি থাকবে। তার সঙ্গে অন্তত দশটা পরোটা দাও।”

একদিন আবার লাইট চলে গেল।
নীলু ভয় পেয়ে গোপালের গা আঁকড়ে ধরল।
গোপাল শান্ত গলায় বলল—
“ভয় কিসের? ভূত আসুক, আগে দেখি সে ভাত খায় না লুচি। যদি লুচি খায় তবে বন্ধু, না খেলে শত্রু।”

শাশুড়ি-বউমা বনাম জামাইবাবাজি

শাশুড়ি একদিন গোপালকে সাবধান করলেন—
“শোনো, তোমার ওজন কিন্তু অনেক বেড়ে যাচ্ছে।”
গোপাল গম্ভীর হয়ে বলল—
“মা, এটাই তো আমার ইনভেস্টমেন্ট। যত মোটা, তত ঠাণ্ডায় গরম থাকে। গ্যাসের খরচ বাঁচবে।”

শাশুড়ি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন, আর নীলু মাথা কচলাতে লাগল—“এ লোকটার মাথায় ভাজা ঘি ঢেলে দিলেও সে খাওয়ার উদাহরণ দেবে।”

রোম্যান্স বনাম খিদে

একদিন রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে নীলু রোম্যান্টিক ভঙ্গিতে বলল—
“গোপাল, আকাশের ওই চাঁদটা দেখো, কেমন সুন্দর!”
গোপাল তাকিয়ে থেকে বলল—
“হুঁ… ঠিক যেন রসগোল্লা। খেতে পারলে মজা হতো।”

নীলু কপাল চাপড়ে হাসতে হাসতে বলল—
“তুমি মানুষ নাকি মিষ্টির দোকান?”
গোপাল হাঁসলো—
“আমি মানুষই, তবে তোমার জন্য মিষ্টির মতো মিষ্টি।”

হাসিই আসল প্রেম

এখনও তাদের সংসার ঝগড়া, হাসাহাসি আর কাণ্ডকারখানায় ভরা।
পাড়ার সবাই বলে—“এদের ঝগড়া শুনলে মনে হয় নাটক চলছে।”
কিন্তু ঝগড়া শেষে দু’জনের হাসি এমন ঝলমল করে ওঠে যে, যে কেউ বুঝতে পারে—এটাই আসল ভালোবাসা।

সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে নীলু একদিন আবার জিজ্ঞেস করল—
“গোপাল, প্রেম মানে আসলেই কী?”
গোপাল চুমুক দিয়ে উত্তর দিল—
“প্রেম মানে তুমি… আর আমি। আর বাকিটা? পেঁপের তরকারি, লাড্ডু, রসগোল্লা, সিঙ্গারা—সব মিশিয়ে এক ধামফাটা হাসির থালা।”

নীলু হেসে হেসে বলল—
“তুমি একেবারে পেটুক কবি।”
গোপাল গম্ভীর হয়ে বলল—
“না না, আমি ‘লাভ গুরু গোপাল’। খিদে আর হাসিই আমার অস্ত্র।”

আর চারপাশে আবারও ধামফাটা হাসির রোল উঠল।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *