পোড়ো বটগাছের রহস্য
ফাঁকা মাঠের নিস্তব্ধতা
বাংলার পশ্চিমের এক অজ পাড়াগাঁ, নাম তার গোলকপুর। চারপাশে ধানক্ষেত, বাঁশঝাড়, পুকুর আর কাদা মাখা সরু পথ। দিনের বেলায় এই গ্রাম প্রাণবন্ত—ছেলেমেয়েরা খেলে, গরু-মহিষ মাঠে চরায়, মহিলারা ধান ঝাড়ে আর পুরুষেরা হালচাষ করে। কিন্তু রাত নামলেই যেন অন্য এক গ্রাম হয়ে ওঠে গোলকপুর। অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই সব যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, কেবল শিয়ালের ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে ভরে ওঠে চারদিক।
গ্রামের মাঝখানে একটা বিশাল মাঠ। সেই মাঠের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট বটগাছ, যেটাকে সকলে বলে “পোড়ো বটগাছ”। গাছটার গায়ে বজ্রপাতে পোড়া দাগ, শেকড়গুলো ঝুলে আছে লম্বা চুলের মতো। দিন দুপুরে রোদ গায়ে পড়লেও গাছটার তলায় যেন কুয়াশার মতো অন্ধকার ছায়া লেগে থাকে। গ্রামের লোকজন দিনের বেলাতেও ওদিক ঘেঁষে যায় না, আর রাত হলে তো দূর থেকেও তাকাতে ভয় পায়।
বয়স্করা বলে, বহু বছর আগে সেই মাঠেই নাকি ভয়ংকর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। জমিদারের নরকযন্ত্রণায় মরতে হয়েছিল কয়েকজন চাষিকে। তাদের রক্ত মিশে আছে এই মাটিতে। সেই থেকে রাত বারোটার পর ওই গাছের নিচে শোনা যায় কান্নার আওয়াজ। কারো গলা টিপে ধরা, শিকল টেনে নেওয়ার শব্দ, আবার কখনো বা একসাথে অনেক মানুষের হাহাকার।
গ্রামে একাধিকবার কৌতূহলী কিছু ছেলে সাহস করে গেছিল গাছের নিচে। অনেকে বলেছে, তারা স্পষ্ট দেখেছে লাল আগুনের মতো চোখওয়ালা ছায়া শেকড় থেকে বেরিয়ে আসছে। কেউ কেউ আবার শুনেছে নিজেদের পরিবারের মৃত মানুষের কান্নার শব্দ। ভোর হওয়ার আগেই তারা দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন জ্বরে কাতর থেকেছে, কারো বা মুখে কথা আটকে গেছে।
তাই গ্রামের মানুষ স্থির করে নিয়েছিল—পোড়ো বটগাছের কাছ ঘেঁষবে না। মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকে, গাছের তলায় চাষবাস হয় না। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি বেঁধে রেখেছে জায়গাটাকে।
কিন্তু ভয়ের মাঝেও মানুষের মনে জন্মায় কৌতূহল। সত্যিই কি ভূত আছে? নাকি এসব কেবলই গুজব? এ প্রশ্নটা গ্রামের তরুণ নীলুর মনে গভীরভাবে নাড়া দিল, আর সেখান থেকেই শুরু হবে এক ভয়ংকর রাতের কাহিনি…
নীলুর কৌতূহল
নীলু গ্রামেরই ছেলে। তবে সে ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো বলে তার বাবা তাকে শহরে পাঠিয়েছিলেন কলেজে ভর্তি করাতে। শহরের আলো-ঝলমলে জীবন, বইখাতা আর ব্যস্ততার ভিড়ে গ্রামীণ অন্ধবিশ্বাসকে নীলু কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। ভূত-প্রেতের গল্প শুনলেই সে হেসে বলত—
“ভূত বলে কিছু নেই, সবই মানুষের ভ্রম।”
কিন্তু ছুটিতে যখন নীলু গ্রামে ফিরে এল, তখন আবার শুরু হল পোড়ো বটগাছ নিয়ে গল্পগুজব। চায়ের দোকানে বসে গ্রামের লোকেরা গম্ভীর মুখে বলছিল—
“কাল রাতে আবার কান্নার শব্দ শোনা গেছে।”
“গরুর রাখাল ছেলেটা নাকি দূর থেকে লাল চোখ দেখেছে।”
সবাই ভয়ে চুপ হয়ে গেলেও নীলু হাসতে হাসতে বলল,
“এসব কিছুই কল্পনা। তোমরা ভয় পেলে চোখে ভুল দেখো, কানে ভুল শোনো।”
তার কথায় অনেকে রাগও করল, কেউ আবার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বয়স্ক হরিদাস কাকা মাথা নাড়িয়ে বলল—
“বাবা নীলু, শহরে পড়ে-লেখে এসেছ ঠিকই, কিন্তু গ্রামের মাটির সত্যিকে অস্বীকার কোরো না। ওই গাছের নিচে কারও ভাল হয় না।”
নীলুর কৌতূহল ততক্ষণে বেড়ে গেছে। সত্যিই যদি কিছু না থাকে, তবে এত লোক একই রকম গল্প বলে কেন? আবার যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেটা চোখে দেখা দরকার।
রাতেই ঠিক করল—সে একা যাবে পোড়ো বটগাছের নিচে।
শহর থেকে আনা ছোট একটা লণ্ঠন, হাতে একটা মোটা লাঠি আর ঘাড়ে তার প্রিয় লাল গামছা জড়িয়ে নিল। মাকে কিছু জানাল না, শুধু বন্ধুকে বলেছিল মজা করে—
“কাল সকালে যদি আমাকে না দেখ, তাহলে ধরে নিও আমি ভূতের সঙ্গে পালিয়ে গেছি।”
বন্ধুরা প্রথমে হাসলেও ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তবে নীলুর জেদ চেনে তারা, তাই আটকায়নি।
সেদিন চাঁদ ছিল আধখানা, আকাশে মেঘের আড়াল। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছিল। মাঠের দিকে যেতে যেতে নীলুর বুক ধকধক করছিল ঠিকই, তবে সে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল।
বটগাছের সামনে দাঁড়াতেই মনে হল হাওয়া হঠাৎ থেমে গেছে। নিস্তব্ধতার মাঝে যেন চাপা একটা গুমোট ভাব ছড়িয়ে পড়ল।
হঠাৎ কানে এলো খুব মৃদু এক শব্দ—
“ফিরে যা… ফিরে যা…”
নীলু থমকে দাঁড়াল। চারদিকে তাকাল, কেউ নেই। সে নিজেকে বলল, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সব কল্পনা।” কিন্তু বুকের ভেতরে কেমন যেন অদ্ভুত একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল।
আর তখনই শুরু হল সেই ভয়ংকর রাতের খেলা…
আতঙ্কের রাত
নীলু লণ্ঠনটা মাটিতে রেখে গাছের নিচে বসল। কাদামাখা শেকড়গুলো চারপাশে ঝুলে আছে, যেন অন্ধকারে অসংখ্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চারদিক এতটাই চুপচাপ যে নিজের হৃদস্পন্দনও নীলুর কানে গর্জনের মতো শোনা যাচ্ছিল।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। প্রথমে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, তারপর সেটা মিলিয়ে গিয়ে এল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় লণ্ঠনের শিখা কেঁপে উঠল। একই সঙ্গে নীলু টের পেল মাটির নিচ থেকে যেন কারও গোঙানি ভেসে আসছে।
“ওই… ওইখানে কে?” — গলা শুকিয়ে গেলেও নীলু চিৎকার করে উঠল।
কোনো উত্তর নেই। শুধু সেই গোঙানি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে—যেন একসাথে অনেকগুলো মানুষের কান্না।
অচানক একটা শেকড় দুলে উঠল সাপের মতো। নীলু ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। আর তখনই চোখে পড়ল—গাছের কাণ্ডের গা বেয়ে নামছে এক ছায়া। মুখ নেই, নাক নেই, শুধু দুটো লাল আগুনের মতো চোখ অন্ধকারে ঝলসে উঠছে।
নীলুর শরীর কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে কাঠ। ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
চারপাশে যেন মৃতের মতো নিস্তব্ধতা, শুধু শোনা যাচ্ছে শিকল টানার মতো শব্দ—“ঝন…ঝন…ঝন…”
হঠাৎ ছায়াটা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার দিকে। ভয়ে নীলু লণ্ঠনটা উঁচিয়ে ধরতেই এক ঝোড়ো হাওয়ায় শিখা নিভে গেল। চারদিক ডুবে গেল অন্ধকারে।
অন্ধকারের ভেতর কানে এল বিকট এক আর্তনাদ—
“আমাদের মুক্তি দে… আমরা এই গাছে বাঁধা… রক্ত… রক্তের হিসাব এখনো বাকি…”
নীলু টের পেল ঠান্ডা শেকড়ের মতো কিছু একটা তার হাত ধরে টেনে নিচ্ছে। সে প্রাণপণে ছটফট করতে লাগল। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না, শুধু বুকের ভেতর শ্বাস আটকে আসছিল।
ঠিক তখনই মাটির ফাঁক থেকে যেন অসংখ্য হাত বেরিয়ে এসে তাকে আঁকড়ে ধরল। নিস্তব্ধ রাত ভরে উঠল ভূতের কান্নায়, হাহাকারে, শিকল টানার করুণ শব্দে।
নীলুর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। চোখের সামনে সবকিছু ঘুরপাক খেতে খেতে ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে গেল।
পুরনো সত্যের উন্মোচন
ভোরবেলা মাঠে কাজে যাওয়ার সময় কয়েকজন চাষি দেখতে পেল নীলু পোড়ো বটগাছের তলায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার গায়ে মাটির দাগ, হাতে আঁকাবাঁকা নখের মতো চিহ্ন, চোখ দুটো ভয়ে ফেটে যাওয়ার মতো বড় হয়ে আছে। তারা তড়িঘড়ি করে তাকে বাড়ি নিয়ে এল।
মা-বাবা কেঁদে কেঁদে প্রলাপ দিচ্ছিল, গ্রাম্য কবিরাজ এসে মাথায় জল ছিটিয়ে, মন্ত্র পড়ে তবেই নীলুর জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে প্রথমেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
“ওরা… ওরা গাছের ভেতর বন্দি… শিকল… শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে তাদের…”
গ্রামের প্রবীণ হরিদাস কাকা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমরা তো জানতামই, একদিন এই কাহিনি আবার সামনে আসবেই।”
সবাই ভিড় করে শুনতে লাগল হরিদাস কাকার মুখে সেই পুরনো ইতিহাস।
অনেক বছর আগে এই গোলকপুর জমিদারের রাজত্ব ছিল। তখনকার দিনে প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করত ভয়ংকর অত্যাচারের মাধ্যমে। এক বর্ষার রাতে কয়েকজন চাষি খাজনা দিতে না পারায় জমিদারের সাঙ্গপাঙ্গরা তাদের ধরে এনে এই মাঠেই শিকল দিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। কেউ শ্বাসরোধ হয়ে, কেউ আবার বেত্রাঘাতে, আবার কারো বুক ছিঁড়ে রক্ত ঝরিয়েছিল।
সেই লাশগুলো এই বটগাছের গোড়ায় পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই গাছটার চারপাশে অদ্ভুত শক্তি তৈরি হয়। বলা হয়, নিহত চাষিদের আত্মা কখনো মুক্তি পায়নি, তারা এখনো শিকল টেনে কাঁদতে থাকে।
হরিদাস কাকা কাঁপা গলায় বললেন—
“আমি ছোটবেলায় দেখেছি, একজন পুরোহিত এসে মুক্তির জন্য যজ্ঞ করেছিলেন। কিন্তু যজ্ঞ চলাকালীন প্রবল ঝড় ওঠে, বজ্রপাত হয়, আগুন ধরে যায়। যজ্ঞ থেমে যায়। সেই থেকে আর কেউ চেষ্টা করেনি।”
নীলু স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তার হাত-পা তখনো কাঁপছে। চোখে ভাসছে সেই লাল চোখওয়ালা ছায়া আর শিকল বাঁধা হাতগুলো।
গ্রামের লোকেরা সিদ্ধান্ত নিল—আর কোনো ছেলেমেয়ে যেন কৌতূহলবশত ওই গাছের কাছে না যায়। রাতের পর রাত ওরা কাঁদুক, কিন্তু মানুষের কিছু করার নেই।
নীলু মনে মনে ভাবল—
“সত্যিই যদি আত্মারা মুক্তি না পায়, তবে কি তারা কোনোদিন শান্তি খুঁজে পাবে?”
এই প্রশ্ন তার বুকের ভেতর গেঁথে রইল।
শেষ সতর্কবার্তা
দিন কয়েক পর নীলু পুরোপুরি সুস্থ হল। তবে সে আর আগের মতো হাসিখুশি নেই। তার চোখে যেন সবসময় অদ্ভুত এক ছায়া লেগে থাকত। গ্রামের লোকেরা তাকে প্রশ্ন করলে শুধু বলত—
“ওরা আছে… সত্যিই আছে… আমাদের মতোই, কিন্তু বন্দি।”
চায়ের দোকানে বসা ছেলেরা মজা করে জিজ্ঞেস করত,
“তুই কি তবে ভূত দেখেছিস?”
নীলু গম্ভীর মুখে উত্তর দিত,
“ভূত নয়, অভিশপ্ত আত্মা। ওদের মুক্তি নেই। আর কেউ যদি ওই গাছের কাছে যায়, তারও ভালো হবে না।”
নীলুর সতর্কবার্তা শুনে গ্রামের মানুষ আরও ভয় পেয়ে গেল। কেউ আর সন্ধ্যা নামলেই মাঠের পথ দিয়ে যায় না। গবাদি পশু হারিয়ে গেলেও মালিকরা খুঁজতে সাহস পায় না।
নীলু আবার শহরে ফিরে গেল পড়াশোনা করতে। যাওয়ার আগে গ্রামের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে বলেছিল—
“আমি জানি তোমরা আমার কথা হয়তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু মনে রেখো, রাতের বেলা পোড়ো বটগাছের দিকে কেউ যেও না। ওরা কারও ক্ষতি করতে চায় না, শুধু মুক্তি চায়। কিন্তু আমরা মানুষ হয়ে সেই মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখি না।”
সেদিন থেকে গ্রামের মানুষ আরো বেশি সতর্ক হয়ে গেল।
তবে রাত গভীর হলে, দূর থেকে যারা গাছটার দিকে তাকায়, তারা আজও শোনে চাপা কান্নার শব্দ, শিকল টেনে নেওয়ার ঝনঝনানি, আর মাঝেমাঝে লাল চোখের ঝলক।
গ্রামের শিশুরা বড়দের কাছে শোনে গল্পটা—
“পোড়ো বটগাছের তলায় শিকলে বাঁধা আত্মারা এখনো কাঁদে।”
আর যারা সাহস করে প্রশ্ন করে—“ভূত কি সত্যিই আছে?”
তাদের উদ্দেশে নীলুর রেখে যাওয়া শেষ বাক্যটিই পুনরাবৃত্তি হয়—
“ভূত নয়, ওরা আমাদের মতো মানুষ… শুধু মুক্তির অপেক্ষায়।”

 
		 
			 
			 
			 
			 
			