গল্প
|

১৪ ভুতের গল্প সিরিজ – তৃতীয় গল্প

নিশির ডাক: মধ্যরাতের ফিসফিস

আঁধার নামার ইতিকথা

বর্ষার শেষে এক ঘন অন্ধকার রাত। আকাশজুড়ে থমথমে মেঘের দল, যেন কোনো ভারী শোকের ছায়া পুরো গ্রামকে গ্রাস করেছে। পশ্চিমের বাঁশবাগান থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ইলেক্ট্রিসিটি এই গ্রাম, শিবপুর-এর বিলাসিতা নয়; তাই কুপি আর কেরোসিনের দুর্বল আলোই এখানকার সম্বল। ঘন অন্ধকারে চারিদিকে কেবল জোনাকির সবুজ-হলুদ আলোর আনাগোনা, মনে হয় যেন তারা আঁধারের ক্যানভাসে ক্ষণিকের জন্য জীবন এঁকে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। শিবপুর—একটি প্রত্যন্ত, প্রাচীন গ্রাম, যেখানে প্রকৃতির সরলতার আড়ালে বছরের পর বছর ধরে এক গা ছমছমে অলৌকিক মৃত্যুর ভয় চাপা পড়ে আছে।

আজ প্রায় মাসখানেক হলো শহরে থাকা যুবক অমিত তার গ্রামের বাড়িতে এসেছে। তার দাদা, হারাধন বাবু, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সত্তরোর্ধ্ব হারাধন বাবু প্রবীণ হলেও মনে মনে বেশ আধুনিক; গ্রামের অনেক কুসংস্কারকেই তিনি তুচ্ছ করেন। কিন্তু শিবপুরের এই বিশেষ ভয়টিকে তিনি কখনো উপেক্ষা করতে পারেননি, হয়তো বহুদিনের লোককথা গল্প আর ঘটনা পরম্পরা তাঁকে বাধ্য করেছে।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর, অমিত তার ঘরের দিকে যাচ্ছিল। হারাধন বাবু তাকে ডেকে কাছে বসালেন। তাঁর চোখে এক গভীর সতর্কতার ছাপ।

“শোন অমিত,” হারাধন বাবু শুরু করলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর গভীর ও কিছুটা চাপা, “কাল তোর শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল, তাই এখন মন দিয়ে আমার কথাটা শোন। বেশি রাত করিস না। আর শোন, মধ্যরাতে যদি বাইরে থেকে কেউ তোর নাম ধরে ডাকে, ভুলেও সাড়া দিস না। দরজা খুলবি না, কথা বলবি না, চুপ করে শুয়ে থাকবি।”

অমিত প্রথমে কিছুটা অবাক হলো। “এসব কী বলছো দাদা? কে ডাকবে এই মাঝরাতে?”

হারাধন বাবু মৃদু হাসলেন, কিন্তু সে হাসিতে কোনো আনন্দ ছিল না, ছিল গভীর উদ্বেগ। “নিশি,” তিনি শুধু এই শব্দটি উচ্চারণ করলেন। “এই গ্রামে একটা অশুভ আত্মা ঘুরে বেড়ায়। লোকে তাকে ‘নিশির ডাক’ বলে। সে নাকি ঠিক তোমার সবচেয়ে প্রিয়জনের গলায় নাম ধরে ডেকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যায়। একবার সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দরজা খুলেছিস তো শেষ! তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, নয়তো পরের দিন সকালে পাওয়া যায় গ্রামের শ্মশান ঘাটের ধারে… নিথর, রক্তশূন্য দেহ।”

অমিতের শরীরটা মুহূর্তের জন্য শিউরে উঠল। সে ছোটবেলা থেকেই এই গল্প শুনেছে, কিন্তু শহরের জীবনে এসব ভুলে গিয়েছিল। দাদা যখন এত গুরুত্ব দিয়ে বলছেন, তখন আর অবিশ্বাস করা যায় না। “কিন্তু দাদা, যদি সত্যিই কেউ বিপদে পড়ে ডাকে? তোমার শরীর খারাপ, তুমি যদি…”

nisir dak

“না বাবা,” হারাধন বাবু বাধা দিলেন, “আমি জানি কখন আমার শরীর খারাপ লাগবে। আর আমি তোকে ডেকে ঘরের বাইরে পাঠাবো না। মনে রাখিস, নিশির ডাক শুনতে খুব মিষ্টি হয়, খুব পরিচিত হয়, কিন্তু তার উদ্দেশ্য খুব ভয়ানক কেউ দরজা খোলেনি, এমন ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু যারা খুলেছে, তারা আর ফেরেনি।”

দাদার ঘর থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে এলো অমিত। ঘরটা পুরনো দিনের, বেশ বড়, একপাশে কাঠের সিন্দুক আর অন্যপাশে ছোট্ট জানালা। অমিত তেলের কুপিটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

বাইরে কেবল ঝিঁঝির একঘেয়ে ডাক। অমিতের মনে দাদার বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। সে যুক্তি দিয়ে মনকে বোঝাতে চাইল—এসব মনগড়া গল্প, অন্ধ বিশ্বাস।

হঠাৎ, রাত তখন সম্ভবত দুটো বা তার কাছাকাছি। বাইরে ঝিঁঝির ডাক থেমে গেল। চারপাশটা যেন আরও বেশি নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

অমিতের কানে ভেসে এলো একটি ফিসফিস আওয়াজ। খুব মৃদু, খুব কোমল।

“অমিত… ঘুমিয়েছিস?”

অমিতের হৃদস্পন্দন প্রায় থেমে গেল। এ স্বর তার বড়ই চেনা। এ যে তার সদ্য প্রয়াত মা-এর কণ্ঠস্বর! গত বছর মা মারা গেছেন। তার কণ্ঠস্বর এমন আবেগপূর্ণ আর পরিচিত হতে পারে না।

“অমিত… দরজাটা খোল বাবা… আমার যে বড় কষ্ট হচ্ছে,” কণ্ঠস্বরটি যেন তার খুব কাছে, দরজার ঠিক বাইরে থেকে আসছে।

অমিতের শরীর হিম হয়ে গেল। সে নড়তে পারল না, কথা বলতে পারল না। সে বুঝতে পারল, এই সেই নিশির ডাক

সন্দেহের জাল

ডাকে সাড়া না দেওয়া

মধ্যরাতের সেই ফিসফিস ডাক শুনে অমিতের সারা শরীর যেন বরফের মতো জমে গিয়েছিল। তার মায়ের কণ্ঠস্বর! এত স্পষ্ট, এত জীবন্ত যে তার মনে হচ্ছিল এই বুঝি মা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পরিচিত ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কিন্তু মস্তিষ্কের কোণে দাদার শেষ সতর্কবাণীটা ইলেকট্রিক শকের মতো কাজ করল: “ভুলেও সাড়া দিস না।”

nisir dak 1

অমিত বিছানায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইল, কান চেপে ধরল বালিশ দিয়ে। শ্বাস নিতেও ভয় হচ্ছিল, পাছে তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে অশুভ আত্মাটি আরও কাছে চলে আসে। বাইরের কণ্ঠস্বরটি আরও কয়েকবার ডাকল, এবার কাতরতা যেন আরও বেশি, “অমিত… তোর কষ্ট হচ্ছে রে… দরজাটা খোল।” প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে এই ভয়াবহ নীরব যুদ্ধ চলল। অবশেষে, একসময় কণ্ঠস্বরটি থেমে গেল। বাইরের ঝিঁঝিঁ পোকারা আবার তাদের একঘেয়ে সুর শুরু করল, যেন কিছুই ঘটেনি।

ভোরের আলো যখন জানালার ফাঁক গলে ঘরে প্রবেশ করল, তখন অমিতের শরীর থেকে ভয়ের হিমেল স্রোত কিছুটা অপসারিত হলো। সে দ্রুত উঠে দাদার ঘরে গেল।

“দাদা! তুমি ঠিক ছিলে,” অমিত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কাল রাতে… মা’র গলা নকল করে কেউ ডাকছিল!”

হারাধন বাবু ধীরেসুস্থে উঠে বসলেন। তাঁর চোখে কোনো বিস্ময় নেই, যেন তিনি ঘটনাটি জানতেন। “আর দেখলি? আমি তোকে আগেই বলেছিলাম। তোকে পরীক্ষা করছিল। তুই ঠিক করেছিস, দরজা খোলিসনি।”

হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্প

অমিতের মনে তখনও সন্দেহের জাল: হয়তো সেটা কোনো নিশাচর প্রাণী বা অন্য কিছু। কিন্তু তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আরও বাড়িয়ে দিতে হারাধন বাবু গ্রামের কিছু অতীতের ঘটনা শোনালেন।

“অবিশ্বাস করিস না বাবা। এই বছর খানেক আগের কথা। আমাদের পাশের বাড়ির কানাইয়ের বউ, লক্ষ্মী, সেই রাতে অসুস্থ ছিল। মাঝরাতে কানাইয়ের কানে এল লক্ষ্মীর ক্ষীণ স্বর, ‘ওগো, জল তেষ্টা পাচ্ছে, একটু ওঠো।’ কানাই ভাবল, সত্যিই হয়তো তার বউ ডাকছে। সে দরজা খুলেছিল। সকালে সবাই দেখল, কানাইয়ের নিথর দেহটা পড়ে আছে পুকুর পাড়ে, নাক-মুখ থেকে রক্ত ঝরেছে, চোখ দুটো বিস্ফারিত। অথচ লক্ষ্মী পাশেই নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।”

দাদা দম নিলেন। “আর জানিস? বছর দশেক আগে, পনেরো বছরের কিশোরী মালতী, সেও শুনেছিল তার ছোট ভাইয়ের ডাক, ‘দিদি, খুব ভয় করছে, দরজা খোল।’ মালতী স্নেহবশে দরজা খুলেছিল। তারপর থেকে মালতী নিরুদ্দেশ। তাকে আজও কেউ খুঁজে পায়নি। শুধু তার ঘরের দরজার বাইরে একটি নতুন, অপরিচিত শেকড় গজিয়েছিল, যা আগে সেখানে ছিল না।”

মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও ভয়ের শেকড়

অমিতের যুক্তি এবার নড়বড়ে হয়ে গেল। সে তো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, কিন্তু এই ধরনের ব্যাখ্যাতীত ঘটনা তার মনে গভীর ছাপ ফেলল। সে ভাবল—নিশি কীভাবে প্রিয়জনের গলার স্বর নকল করে? এই অশুভ আত্মা কি তবে তার সবচেয়ে গোপন ভালোবাসার মানুষগুলোর কথা জানে?

“দাদা, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম ওটা মা’র গলা। ঠিক যেন মনে হচ্ছিল মা দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন…” অমিতের কণ্ঠস্বরে অসহায়তা।

“এটাই নিশির কৌশল, বাবা,” হারাধন বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “সে তোমার সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করে। যার ডাকে তোমার হৃদয়ে সহজে সাড়া জাগে, সেই স্বরই সে ব্যবহার করে। কাল রাতে তুই জয়ী হয়েছিস, কিন্তু সে বারবার ফিরে আসবে।”

দ্বিতীয় রাতের প্রস্তুতি

সেই দিনটা অমিতের কাটল আতঙ্কে। সন্ধ্যার পরই সে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা-জানালা সব শক্ত করে বন্ধ করল। সে একটি টর্চলাইট হাতে রাখল, যদি কিছু হয়। সে সিদ্ধান্ত নিল, আজ রাতে যাই ঘটুক, সে দরজা খুলবে না। সে সারারাত জেগে থাকবে।

রাত গভীর হলো। শিবপুর গ্রামে আবার নেমে এল জমাট বাঁধা অন্ধকার। ঝিঁঝির ডাক যেন আরও তীক্ষ্ণ, আরও অস্থির। রাত দুটো নাগাদ, যখন নিস্তব্ধতা সবচেয়ে গভীর, তখন দরজার বাইরে থেকে আবার ডাক শোনা গেল।

এইবার কণ্ঠস্বরটি আর তার মায়ের নয়। এটি আরও স্পষ্ট, আরও পরিচিত, এবং আরও ভীতিপ্রদ। এই স্বরটি তার দাদা হারাধন বাবুর:

“অমিত, ও অমিত! দরজাটা খোল বাবা, শরীরটা বড় খারাপ লাগছে, একটা ওষুধ লাগবে। তাড়াতাড়ি কর বাবা, আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”

এইবার অমিতের সবথেকে কঠিন পরীক্ষা! সে জানে দাদা সত্যিই অসুস্থ। তাহলে কি সত্যিই দাদা এসেছেন, নাকি এটি নিশির ডাকের নতুন কৌশল? অমিতের হাত কাঁপতে শুরু করল। তার মনে হলো, যদি সত্যি দাদা বিপদে থাকেন আর সে দরজা না খোলে…

নিশির আসল রূপ

পরীক্ষা

মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেওয়া সেই ডাক অমিতকে এক ভয়াবহ দ্বিধার মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। বাইরে স্পষ্ট তার দাদা হারাধন বাবুর কণ্ঠস্বর: “অমিত, ও অমিত! দরজাটা খোল বাবা, শরীরটা বড় খারাপ লাগছে, একটা ওষুধ লাগবে।”

অমিতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। এই ডাক আর গত রাতের ডাকের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কাল ছিল মায়ের ফিসফিসানি, যা তাকে কেবল আবেগপ্রবণ করেছিল। কিন্তু আজ, দাদার কণ্ঠে অসুস্থতার এমন করুণ আর বাস্তব আর্তনাদ! সে জানে দাদা একা থাকেন এবং সত্যিই গুরুতর অসুস্থ। যদি এই ডাক সত্যি হয়? যদি ওষুধ দিতে দেরি হয়ে যায়?

কিন্তু পরক্ষণেই হারাধন বাবুর সতর্কবাণী মনে পড়ল: “নিশি তোর সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করবে।” এই কণ্ঠস্বর বিশ্বাস করার অর্থ চিরতরে হারিয়ে যাওয়া।

হাতে রাখা টর্চলাইটটা শক্ত করে ধরল অমিত। দরজা না খুলেই, যতটা সম্ভব চাপা স্বরে সে জিজ্ঞাসা করল: “দাদা, কী ওষুধ লাগবে? তোমার প্রেসার মাপার মেশিনটা কোথায় রেখেছো?”

ভয়ঙ্কর উত্তর

উত্তর এল দ্রুত। কিন্তু এবার কণ্ঠস্বরটি বদলে গেল। সেটি আর হারাধন বাবুর ভারি গলা নয়। সেটি হঠাৎ তীক্ষ্ণ ও কাতর হয়ে উঠল। অমিতের শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল। এইবার ডাকছে তার ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু রাহুল, যে বছর পাঁচেক আগে এক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল।

“অমিত, আমি তোর বন্ধু রাহুল! খুব বিপদে পড়েছি, প্লিজ দরজাটা খোল… প্লিজ! আমি এই অন্ধকারে একা থাকতে পারছি না! আমাকে বাঁচা!”

এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন অমিতকে নিশ্চিত করল—এটি কোনো মানুষ নয়, এটি সেই অশুভ শক্তি, যে প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর চুরি করে। একটি আত্মা এত দ্রুত কণ্ঠস্বর বদলাতে পারে? এই আত্মা তার জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত স্বরগুলি কীভাবে জানল?

অমিতের হৃদয়ে হিমেল স্রোত বইতে লাগল। বন্ধুর অসহায় ডাক শুনেও সে দরজা খুলতে পারল না। সে জানত, একবার দরজা খুললেই সব শেষ। সে নিজেকে শক্ত করল, চোখ বন্ধ করে মন্ত্রের মতো দাদার কথাগুলি মনে করার চেষ্টা করল।

আত্মার শক্তি ও ফাঁদ

অমিত যখন চুপ করে রইল, তখন বাইরের ডাক আরও মরিয়া হয়ে উঠল। “অমিত! তুই কি ভুলে গেলি আমাদের বন্ধুত্বের কথা? একবার শুধু একবার দরজাটা খোল!”

হঠাৎ, সেই করুণ ডাক থেমে গেল। তার জায়গায় ভেসে এলো একটি চাপা খুসখুস করে হাসির শব্দ। সেই হাসি অত্যন্ত বিকৃত, শীতল, এবং মানুষের নয়। মনে হলো যেন কোনো গাছের শুকনো পাতা বাতাসের সাথে মিশে কঙ্কালের মতো হাসছে। হাসিটি ঘরের চারপাশের দেওয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, যেন আত্মাটি শুধু দরজার বাইরে নয়, অমিতের ঘরের আনাচে-কানাচেও ছড়িয়ে আছে।

হাসি বন্ধ হওয়ার পর আবার ডাক এলো। এইবার স্বরটি সব প্রতিরোধের শেষ সীমা ভেঙে দিল। এটি রাহুল বা দাদার গলা নয়, এটি ছিল অমিতের নিজেরই শৈশবের কণ্ঠস্বর। সেই স্বর কান্নার মতো করে বলছে:

“আমাকে বাঁচা! আমি বাইরে আটকা পড়ে গেছি! এই অন্ধকার থেকে আমাকে উদ্ধার কর! আমি ভয় পাচ্ছি!”

অসহায় এক শিশুর কান্না, আর সেই শিশুটি স্বয়ং অমিত! নিজেকে এমন বিপন্ন অবস্থায় ডাকতে শুনে অমিতের যুক্তি, সতর্কতা সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আত্মাটি তার অস্তিত্বের উপরই আঘাত হানল।

ভুলের সিদ্ধান্ত

অমিতের মস্তিষ্কে কাজ করা বন্ধ করে দিল। সে ভাবল—হয়তো এটি আত্মা নয়, কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষ, যে তাকে ডেকে ভেতরে আসতে চাইছে। অথবা, আত্মাটি তার শৈশবের কোনো ট্রমা ব্যবহার করে তাকে ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু শৈশবের নিজের কণ্ঠস্বরকে এভাবে বিপন্ন অবস্থায় ডাকা শুনে সে আর স্থির থাকতে পারল না।

এক প্রবল ঝাঁকুনিতে সে উঠে দাঁড়াল। তার মন তখন একটাই কথা বলছে: উদ্ধার করো! সে দ্রুত হাতে দরজার ভারী ছিটকিনিতে হাত রাখল। দাদা বা নিশির ডাকের কথা তার আর মনে রইল না।

খট!

অমিত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সশব্দে দরজা খুলে দিল। তার মনে তখন শুধু আলো জ্বালাবার, এবং বাইরে কে আছে দেখার তীব্র তাড়না।

চিরন্তন অনুসরণ

ভৌতিক উপস্থিতি

বিবেক, যুক্তি আর সতর্কবার্তার শেষ দেওয়াল ভেঙে অমিত যখন দরজা খুলে দিল, তখন গভীর রাত। বাইরের পরিবেশ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ, সেই চাপা হাসির শব্দও থেমে গেছে।

দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই একটি ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে বাতাসের স্রোত ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। সেই বাতাস এতই শীতল ছিল যে, তা যেন গ্রীষ্মকালের উষ্ণতাকে এক নিমেষে গ্রাস করে নিল। অমিতের হাতে ধরা কুপিটির ক্ষীণ শিখাটি সেই ঠাণ্ডা হাওয়ায় মুহূর্তে দপ করে নিভে গেল, ঘরের ভেতরে নেমে এল গাঢ়, জমাট বাঁধা অন্ধকার।

অমিত আতঙ্কিত হয়ে টর্চলাইটটা জ্বালাতে চাইল, কিন্তু তার হাত কাঁপছিল। আলোর তীব্র প্রয়োজনের মুহূর্তে তার মনে হলো, সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি সেই অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু সে স্পষ্টভাবে অনুভব করল একটি অত্যন্ত ভারী, স্থবির উপস্থিতি। কোনো আকৃতি নেই, কোনো অবয়ব নেই—কেবল এক জমাট বাঁধা, অতল কালো অন্ধকার, যা সমস্ত আলো শুষে নিচ্ছে।

অমিতের নিরাশা

অমিতের নাম ধরে ডেকে দেওয়া কণ্ঠস্বরটি এবার দ্রুত বিকৃত হতে শুরু করল। সেই পরিচিত, করুণ স্বরগুলি মিলিয়ে গেল, তার জায়গায় সৃষ্টি হলো একটি অজানা, কর্কশ শব্দ। মনে হলো যেন শত শত বছর ধরে জমা হওয়া কোনো অতৃপ্ত আত্মার দীর্ঘশ্বাস একীভূত হয়ে যাচ্ছে। সেই শব্দটিই এবার হাসির রূপ নিল—কিন্তু সে হাসি মানুষের নয়, বিকৃত এবং বিভীষিকাময়। আত্মাটি যেন তার বিজয় নিশ্চিত করে হেসে উঠল।

মুহূর্তের মধ্যে অমিতের মনে পড়ে গেল দাদার শেষ সতর্কবার্তা: “সাড়া দিলেই সর্বনাশ!”

অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার ভুল সিদ্ধান্ত তাকে চিরন্তন বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সে বুঝতে পারল, তার শৈশবের কণ্ঠস্বর ছিল নিশির পাতা শেষ ফাঁদ। তার চোখ তখনো সেই জমাট অন্ধকারের দিকে তাকানো, কিন্তু সে দেখতে পেল না কী তাকে অনুসরণ করছে। সে শুধু অনুভব করতে পারল, সেই অতল কালো ছায়াটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে, নিঃশব্দে।

অমিতের পালানোর আর কোনো উপায় ছিল না।

অপহৃত

পরের সেকেন্ডেই একটি ঠান্ডা, ধারালো স্পর্শ অমিতের কাঁধ চেপে ধরল। স্পর্শটি কোনো মানুষের হাতের মতো নয়—বরং বরফের মতো শীতল এবং লোহা বা শেকড়ের মতো শক্ত। সেই প্রবল শক্তি অমিতকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল।

অমিত চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। নিশির শক্তি যেন তার কণ্ঠস্বরও কেড়ে নিয়েছে। সে প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ করতে চাইল, কিন্তু আত্মাটির শক্তি ছিল অপ্রতিরোধ্য। যেন একটি বিশাল, অদৃশ্য হাত তাকে টানতে টানতে দরজার বাইরে, অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এই ভয়ঙ্কর ধস্তাধস্তির মাঝেই, পাশের ঘরে ঘুমানো হারাধন বাবু ধড়মড় করে জেগে উঠলেন। তাঁর কানে এলো দরজার বাইরে একটি দ্রুত, অস্পষ্ট পায়ের আওয়াজ—ধূসর বালির উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো শব্দ। শব্দটি মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের পাশ কাটিয়ে বাঁশবাগানের দিকে মিলিয়ে গেল।

হারাধন বাবুর হৃদস্পন্দন তীব্র হলো। তিনি বুঝতে পারলেন—ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। তিনি দ্রুত আলো জ্বালিয়ে লাঠি হাতে অমিতের ঘরের দিকে ছুটে গেলেন।

তিনি যখন অমিতের ঘরের সামনে পৌঁছালেন, তখন দেখলেন: দরজাটি হাট করে খোলা, বাইরের গাঢ় অন্ধকারের পটভূমিতে ঘরের অন্ধকার যেন আরও তীব্র। বিছানা খালি, আর ঘরের মেঝেতে অমিতের হাতে থাকা টর্চলাইটটি পড়ে আছে, যার আলো তখনও জ্বলছে। সেই জ্বলন্ত আলোতেই দেখা গেল, মেঝেতে ধুলোর উপর সামান্য টানের দাগ।

হারাধন বাবু কাঁপতে কাঁপতে অমিতের নাম ধরে ডাকলেন, “অমিত! ও অমিত!”

নিস্তব্ধ রাতের বাতাস কেবল তাঁর দুর্বল স্বরটিকেই ফিরিয়ে দিল। অমিতের ঘর থেকে কোনো উত্তর এল না। নিশির ডাক তার শিকারকে চিরতরে কেড়ে নিয়েছে।

নীরবতা ও আতঙ্ক

অনুসন্ধান এবং নিরাশা

ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই শিবপুর গ্রামে এক ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। হারাধন বাবুর আর্তনাদ শুনে গ্রামের কিছু লোক তাঁর বাড়িতে ছুটে এলো। অমিতের ঘরের খোলা দরজা, মেঝেতে পড়ে থাকা টর্চলাইট এবং বিছানার শূন্যতা দেখে তাদের বুঝতে আর দেরি হলো না—নিশির ডাক তার শিকার খুঁজে নিয়েছে।

গ্রামের মানুষজন লাঠি, টর্চ আর প্রদীপ হাতে অমিতের খোঁজে বের হলো। তারা নিশির ডাকের শিকার হওয়া কানাই এবং মালতীর ঘটনা মনে রেখে গ্রামের সমস্ত প্রান্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল। বিশেষ করে বাঁশবাগান এবং শ্মশানঘাটের দিকের পরিত্যক্ত জায়গাগুলো ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।

বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো, কিন্তু অমিতের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। কোনো রক্ত, কোনো ছেঁড়া কাপড়, বা কোনো পায়ের ছাপও ছিল না। অমিত যেন ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেছে। গ্রামের প্রবীণরা মাথা নেড়ে হতাশা ব্যক্ত করলেন। তারা নিশ্চিত—অমিত চিরতরে হারিয়ে গেছে। নিশির ডাকের শিকার হওয়া মানুষজন এভাবেই গায়েব হয়ে যায়, যেন মাটির ভেতর অদৃশ্য কোনো গর্তে তারা তলিয়ে গেছে।

অমিতের মতো একজন শিক্ষিত, সতর্ক যুবকও যে এভাবে ভুল করে দরজা খুলে দেবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি। গ্রামের নীরবতা আরও গভীর হলো, শোকের সঙ্গে মিশে গেল এক নিদারুণ ভয়। শিবপুর গ্রামের উপর দিয়ে একটি ঠান্ডা, গভীর নিস্তব্ধতা নেমে এলো।

অন্ধকারে সমাপ্তি

সন্ধ্যা নামার আগেই গ্রামের সমস্ত বাড়িঘরে কপাট পড়ে গেল। মধ্যরাতের দরজা বন্ধ রাখার নিয়ম আরও কঠোরভাবে পালন করতে শুরু করল মানুষজন। বাইরের সামান্যতম শব্দেও তারা কেঁপে উঠছিল।

হারাধন বাবু নিজের ঘরে একা বসে ছিলেন। তাঁর চোখে ঘুম ছিল না, কেবল এক অসহায় শূন্যতা। চোখের সামনে দেখলেন, কীভাবে তাঁর প্রিয়জনেরা একে একে তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে গেল—প্রথমে স্ত্রী, আর এবার ভাইপো অমিত। তিনি জানতেন, নিশি সহজে ছাড়ে না। সে ফিরে আসবে।

তিনি টর্চ জ্বালিয়ে অমিতের ঘরে ঢুকলেন। মেঝেতে যেখানে টর্চটি পড়েছিল, সেখানে ধুলোর মধ্যে অমিতের হাতের কিছু আঁচড়ের চিহ্ন। তার হাতে তখনো তার সেই চশমাটি শক্তভাবে ধরা ছিল, যা হয়তো সে শেষ মুহূর্তে আত্মাটির কাছ থেকে নিজেকে বাঁচাতে আঁকড়ে ধরেছিল।

হারাধন বাবু সেই চশমা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরলেন। তিনি দরজার ছিটকিনিতে হাত রেখে শক্ত করে ধরে রইলেন। তিনি জানতেন, মধ্যরাতের ঘণ্টা বাজলেই শুরু হবে অপেক্ষা।

রাত গভীর হলো। ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজল।

বাইরের ঝিঁঝির ডাক তখনো চলছে। কিন্তু সেই ডাকের সঙ্গে হঠাৎ মিশে গেল একটি নতুন শব্দ। সেটি কোনো ডাক নয়, বরং একটি যন্ত্রণার শব্দ।

হারাধন বাবুর কানে ভেসে এলো অমিতের শেষ দিনের কাশির শব্দ। মৃদু, চাপা, অসুস্থতার কারণে আসা সেই পরিচিত কাশির শব্দ। শব্দটি দরজার ওপার থেকে আসছে, ঠিক যেন অমিত কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলতে চাইছে।

হারাধন বাবুর চোখ বন্ধ হয়ে গেল। তিনি কাঁপতে লাগলেন, কিন্তু দরজা খোলার সাহস করলেন না। তিনি নিজেকে শান্ত করে মন্ত্রের মতো মনে মনে আওড়াতে লাগলেন, “এটা অমিত নয়, এটা নিশি… এটা অমিত নয়, এটা নিশি…”

কাশি থেমে গেল। তার পরিবর্তে সেই চাপা, বিকৃত খুসখুসে হাসি আবার ভেসে এলো, যেন নিশি হারাধন বাবুর মনের জোর ভেঙে দিতে চাইছে। হাসিটি মিনিটখানেক স্থায়ী হলো, তারপর ধীরে ধীরে তা মিলিয়ে গেল বাঁশবাগানের অন্ধকারে।

ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত হারাধন বাবু কাঁপতে কাঁপতে দরজার ছিটকিনি শক্ত করে ধরে রইলেন। তিনি জানতেন, নিশি আজ না হলেও কাল আবার আসবে, অন্য কোনো প্রিয়জনের স্বর নিয়ে।

nisir dak 4

শিবপুর গ্রামের প্রতিটি মানুষ জানত—নিশির ডাক চিরন্তন। সে প্রিয়জনের গলার স্বর, তাদের দুর্বলতা ব্যবহার করে মানুষকে ডাকতে থাকে। কেউ একবার সাড়া দিলেই সে হারিয়ে যায় চিরকালের জন্য, মধ্যরাতের ফিসফিসের অন্ধকারে, যেখানে আর কখনও ভোরের আলো পৌঁছায় না। আর সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটির আত্মা হয়তো তার প্রিয়জনের স্বর হয়ে পরের রাতে অন্য কাউকে ডাকার জন্য নিশির হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *