নীল প্রজাপতির অভিশাপ

নীল প্রজাপতির অভিশাপ

অভিশপ্ত প্রজাপতি

অনেক, অনেক দিন আগে পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা এক অচেনা গ্রাম ছিল। সেই গ্রামে ছোটবেলা থেকেই একটি গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে আসছিল—

নীল প্রজাপতিকে ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পাথরে পরিণত হয়।

গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলতেন, শত বছর আগে এক দুষ্ট জাদুকর তার অভিশপ্ত অশ্রু ঢেলে দিয়েছিল একটি প্রজাপতির ডানায়। সেই থেকে প্রজাপতিটি হয়ে ওঠে মৃত্যুর প্রতীক। তাই গ্রামের মানুষ ভয়ে তাকে ‘অভিশপ্ত প্রজাপতি’ নাম দিয়েছিল।

কিন্তু সেই গ্রামেই থাকত এক কিশোরী—লাবণী। ছোটবেলা থেকেই কাহিনি শুনলেও সে ভয় পেত না। বরং তার মনে হত, রহস্যময় নীল প্রজাপতির মধ্যে যেন কোনো গোপন সত্য লুকানো আছে।

একদিন আচমকাই তার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিলেন। তখন গ্রামের ওঝা এক গোপন কথা জানালেন—
“যদি নীল প্রজাপতির ডানায় জমা শিশির আনা যায়, তবে এই অসুখ সেরে যাবে।”

nil prajapotir avishap 1

সবাই হতবাক হয়ে গেল। কারণ এর মানেই হলো মৃত্যু ডেকে আনা। কিন্তু লাবণী মায়ের কষ্ট সহ্য করতে পারল না। নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করল—

“আমি অভিশাপকে ভয় করি না। মাকে বাঁচাতেই হবে, যেকোনো মূল্যে।”

এইভাবেই লাবণীর জীবনে শুরু হলো এক অলৌকিক যাত্রার সূচনা, যা তাকে নিয়ে যাবে ভয়, অভিশাপ আর অজানা রহস্যের গভীরে…

বিপজ্জনক যাত্রা

ভোরের আলো ফুটতেই লাবণী পা বাড়াল বনপথে। দূরে পাহাড়ের গায়ে ঘন কুয়াশা, গাছের ডালে ঝুলছে শিশিরভেজা পাতা। কিন্তু পথটা ছিল ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধ—পাখির ডাকও যেন থেমে গেছে।

যত ভেতরে এগোতে লাগল, ততই অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতে লাগল। কোথাও ডাল ভাঙার শব্দ, কোথাও হঠাৎ গর্জন, যেন বনের অদৃশ্য প্রাণীরা তাকে লক্ষ করছে। তবুও লাবণীর চোখে ভয় নয়, ছিল অদম্য সংকল্প।

এক ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে সে দেখল এক বৃদ্ধা বসে আছেন। বৃদ্ধার চোখ জ্বলজ্বল করছে অদ্ভুত আলোয়। তিনি হাতে একটা পুরোনো তাবিজ এগিয়ে দিয়ে বললেন—
“পথটা সহজ নয়, মেয়ে। এই তাবিজ তোমার হৃদয়কে রক্ষা করবে। তবে মনে রেখো—ভয় যদি তোমার ভেতরে ঢোকে, তাবিজও শক্তি হারাবে।

লাবণী বিনীতভাবে তাবিজ গলায় পরে নিল। ঠিক তখনই বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক সাদা শেয়াল। আশ্চর্য ব্যাপার, সে মানুষের মতো কথা বলতে লাগল—
“তুমি নীল প্রজাপতিকে খুঁজতে যাচ্ছ? তবে জানো, সামনের পথ শুধু কাঁটা আর অন্ধকারে ভরা। কিন্তু সাহস থাকলে তোমার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।”

শেয়ালটি তাকে পাহাড়ি গুহার দিকে পথ দেখিয়ে দিল। লাবণীর মনে ভয় এলেও বুকের ভেতর শক্ত করে প্রতিজ্ঞা বাজল—
“আমি মাকে বাঁচাতেই এসেছি। কিছুতেই থামব না।”

nil prajapotir avishap 2

এভাবেই শুরু হলো লাবণীর অভিশপ্ত প্রজাপতির আস্তানার পথে বিপজ্জনক যাত্রা।

অশ্রুর রহস্য

লাবণী আর সাদা শেয়াল একে একে পাহাড়ি পথে চলতে চলতে পৌঁছাল এক গভীর গুহার মুখে। গুহার ভেতরটা অন্ধকারে ঢেকে ছিল, কেবল মাঝখান থেকে আসছিল এক অদ্ভুত নীল আলো।

লাবণী এগিয়ে গিয়ে দেখল—একটি নীল প্রজাপতি স্থির হয়ে আছে এক পাথরের ওপর। তার ডানায় ঝলমলে আলো খেলে যাচ্ছে, যেন আকাশের তারা মাটিতে নেমে এসেছে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লাবণী লক্ষ্য করল—প্রজাপতির চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ অশ্রু।

ঠিক তখনই বাতাসে ভেসে এলো এক মানবকণ্ঠ—
“আমি অভিশপ্ত রাজপুত্র। বহু বছর আগে এক দুষ্ট জাদুকর আমাকে এই রূপে বন্দি করেছে। যে-ই আমাকে ছোঁবে, সে পাথরে পরিণত হয়—কারণ এই অভিশাপ আমার গায়ে লেগে অন্যকে গ্রাস করে।”

লাবণী শিউরে উঠল। তবুও ভয়কে জয় করে বলল—
“আমি তোমাকে ছুঁতে আসিনি। আমি এসেছি আমার মাকে বাঁচাতে। শুনেছি তোমার ডানায় জমা শিশিরেই তার ওষুধ আছে।”

প্রজাপতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—
“হ্যাঁ, সেই শিশির তোমার মাকে সুস্থ করতে পারে। কিন্তু মনে রেখো—শুধু পবিত্র হৃদয়ের মানুষই এই অভিশাপ ভাঙতে সক্ষম। ভয় বা লোভ যদি তোমার মনে প্রবেশ করে, তবে তুমি-ও পাথরে রূপ নেবে।”

লাবণীর চোখ ভিজে উঠল মমতায়। তার মনে হলো, এই প্রজাপতি কোনো দানব নয়, বরং এক অসহায় বন্দি আত্মা। বুকের ভেতর সে শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করল—
“আমি ভয় পাব না। আমি মাকে বাঁচাবো, আর তোমাকেও মুক্ত করব।”

অন্ধকার গুহায় সেই প্রতিজ্ঞার শব্দ যেন অনন্তকাল প্রতিধ্বনিত হলো।

অভিশাপের পরীক্ষা

রাতের আকাশে চাঁদের আলো যেন ম্লান হয়ে এসেছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু দূর থেকে শোনা যায় অচেনা কোনো বাদুড়ের ডানার শব্দ। তিতিক্ষা জানত, আজকের রাতই তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা।

নীল প্রজাপতির আলো তাকে নিয়ে এসেছে এক প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে। চারপাশে ভাঙাচোরা স্তম্ভ, মাঝখানে কালো পাথরের বেদী, আর সেই বেদীর উপর খোদাই করা আছে অস্পষ্ট শাপগ্রস্ত লিপি।

হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে উঠল। অদ্ভুত এক কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো চারিদিকে—
“যদি মুক্তি চাও, তবে হৃদয়ের ভয়কে জয় করো। প্রলোভনের অশ্রু নয়, সত্যিকারের ত্যাগই তোমাকে রক্ষা করবে।”

nil prajapotir avishap 3

তিতিক্ষার বুক কেঁপে উঠল। তার সামনে ভেসে উঠল নানা মরীচিকা—
সে দেখল তার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে, যে তাকে ডাকছে ঘরে ফেরার জন্য। দেখল অচেনা সব ধনরত্ন, যেগুলো সে ছুঁতে গেলেই মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি দৃশ্য যেন তার দুর্বলতাকে নাড়িয়ে দিতে চাইছে।

কিন্তু সে মনে করল নীল প্রজাপতির অশ্রুর রহস্য। মনে করল, সত্যিকার সাহস মানেই নিজের লোভ, ভয় আর অশ্রুর বোঝা ত্যাগ করা।

সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল, দু’হাত জোড় করে বেদীর সামনে নত হলো। ঠোঁট কেঁপে উঠল, গলা ভারী হলো, আর সে উচ্চারণ করল—
“আমি কোনো ধন চাই না, কোনো মরীচিকা চাই না। যদি সত্যিই মুক্তি মেলে, তবে এই অভিশাপ থেকে শুধু আমার মানুষগুলোকে বাঁচাও।”

সেই মুহূর্তে বাতাস হঠাৎ থেমে গেল। চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠল নীল প্রজাপতির দীপ্তিতে। মরীচিকা ভেঙে গেল, বেদীর খোদাই জ্বলজ্বল করে উঠল, আর এক অদৃশ্য শিকল ভেঙে গেল তিতিক্ষার চারপাশ থেকে।

এ যেন ছিল প্রথম জয়—কিন্তু সে জানত, অভিশাপের পরীক্ষার শেষ অধ্যায় এখনও বাকি।

মুক্তির আলো

আকাশে ভোরের আলো ফুটছে ধীরে ধীরে। পাহাড়ের চূড়ায় লালচে রঙের আভা ছড়িয়ে পড়ছে, যেন প্রকৃতি নিজেই নতুন দিনের আগমন ঘোষণা করছে। কিন্তু লাবণীর হৃদয়ের ভেতর তখনও অন্ধকারের ভার জমে আছে—কারণ অভিশাপের শেষ বাঁধন এখনো খোলেনি।

গুহার গভীরতম প্রান্তে পৌঁছে সে দেখল, নীল প্রজাপতি কাঁপতে কাঁপতে আকাশে ভাসছে। তার ডানার দীপ্তি নিভে আসছে, যেন শেষ নিঃশ্বাসে টিকে আছে। চারদিকে এক ভয়ানক নীরবতা, হঠাৎ মনে হলো গুহার দেওয়ালগুলোও যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

তখনই আবার সেই অদ্ভুত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—
“শেষ পরীক্ষা বাকি, মেয়ে। মুক্তি চাইলে তোমাকে নিজের সব ভয়, সব ভালোবাসা, এমনকি নিজের জীবনকেও ত্যাগ করার সাহস দেখাতে হবে। কেবল নিঃস্বার্থ ত্যাগেই আলো জন্ম নেবে।”

লাবণীর বুক কেঁপে উঠল। সে জানত, তার মা মৃত্যুশয্যায়, আর প্রজাপতিকে মুক্ত না করলে সেই অভিশাপও ভাঙবে না। তবু প্রশ্ন ভেসে এল মনে—
“আমি কি সবকিছু দিতে পারব?”

হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠল মায়ের মুখ, যে ভালোবাসা দিয়ে এতদিন তাকে বড় করেছে। মনে পড়ল শৈশবের হাসি, মায়ের আঁচলের গন্ধ। চোখ ভিজে উঠল অশ্রুতে, কিন্তু সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“আমি মায়ের জীবন চাই। যদি দরকার হয়, আমার জীবন নিক, কিন্তু অভিশাপ ভাঙুক।”

সে হাত বাড়িয়ে দিল প্রজাপতির দিকে। জানত, ছুঁলেই হয়তো পাথরে পরিণত হবে। কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল—
প্রজাপতি তার হাতের ওপর বসতেই আলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কোনো অভিশাপ কাজ করল না। বরং লাবণীর বুক ভরে গেল এক অনাবিল শান্তি আর আলোয়।

নীল প্রজাপতি ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হলো এক রাজপুত্রে। তার চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু ঝলমল করছে। সে মাথা নত করে বলল—
“তুমি অভিশাপ ভেঙেছ। তোমার ত্যাগের শক্তিই আমাকে মুক্ত করেছে।”

গুহার অন্ধকার গলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল সোনালি ভোরের আলো। বাইরে পাখিরা গান ধরল, গাছের পাতা ঝরে পড়ল যেন আশীর্বাদের মতো।

রাজপুত্র নিজের ডানার শিশির লাবণীর হাতে তুলে দিলেন। সেই শিশিরই ছিল তার মায়ের জীবন বাঁচানোর ঔষধ। লাবণী কেঁদে উঠল আনন্দে—এ ছিল একসঙ্গে দুটি মুক্তি: মায়ের জীবনের মুক্তি আর এক অভিশপ্ত আত্মার মুক্তি।

গ্রামে ফিরে যখন লাবণী শিশির দিয়ে মায়ের কপালে হাত রাখল, তখনই মা চোখ খুলে হাসলেন। চারিদিক যেন আলোকিত হয়ে উঠল সেই হাসিতে।

এভাবেই এক অদম্য কন্যার সাহস আর ভালোবাসা অভিশাপ ভেঙে আনল মুক্তির আলো

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *