নারীশক্তির পূজো
|

নারীশক্তির পূজো

পাড়ার পূজোর নতুন স্বপ্ন

শরৎ হাওয়ার নরম পরশে কাশফুল দুলছে দূরের মাঠে। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ধূপ-ধুনোর মিষ্টি গন্ধ। পাড়ার ছেলেরা ঢাক বাজাতে শুরু করেছে—“ধিম ধিম, কা-ধিম!” সেই আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠল উত্তর কলকাতার ছোট্ট মহল্লা।

প্রতি বছরই এই সময় প্যান্ডেলের সাজসজ্জা, প্রতিমা আনার পরিকল্পনা আর ভোগের মেনু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই। কিন্তু এবারের পূজো একটু অন্যরকম হতে চলেছে। পাড়ার মেয়েরাই ঠিক করেছে, তারা সামলাবে পুরো আয়োজন—প্রতিমা আনানো থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্যন্ত সবকিছু।

খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গলির মোড়ে, চায়ের দোকানে শোনা গেল ফিসফাস।
—“মেয়েরা আবার পূজো করবে?”
—“এত বড় আয়োজন সামলানো মেয়েদের পক্ষে সম্ভব?”
অবিশ্বাসের হাসি আর তির্যক মন্তব্যে ভরে উঠল চারপাশ।

কিন্তু এই কটাক্ষের ভিড়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়াল অনন্যা। তার চোখে ঝিলিক, কণ্ঠে দৃঢ়তা।
—“মা দুর্গা তো নারীশক্তির প্রতীক। তাহলে কেন নারীরাই নেতৃত্ব নেবে না?”

নারীশক্তির পূজো

অনন্যার কণ্ঠে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল। সেই শক্তি যেন সবার মনে আলো জ্বেলে দিল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো প্রতিমা, রূপা, মিষ্টি আর আরও অনেকেই। কেউ বলল—
—“চলো, আমরা একসঙ্গে চেষ্টা করি।”

সেই মুহূর্তে মনে হল, মহল্লার বাতাসে যেন এক নতুন সম্ভাবনার জন্ম হল। শুরু হল এক নতুন লড়াইয়ের যাত্রা—যা কেবল পূজো নয়, নারীর জয়যাত্রার প্রতীক হয়ে উঠবে।

সংগ্রামের দিনগুলো

প্রথম বছর যেন যুদ্ধের মতো লড়াই শুরু হয়েছিল। পূজোর খরচ মেটানোর মতো টাকা নেই। মহল্লার প্রবীণরা আবার বারবার সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
—“এত টাকার হিসেব রাখবে কীভাবে?”
—“প্যান্ডেলে ভিড় সামলানো মেয়েদের কাজ নয়।”
—“শেষমেষ তো আবার আমাদেরই ভুগতে হবে!”

কথাগুলো কানে বাজলেও মেয়েরা দমে গেল না। প্রতিমা, রূপা আর মিষ্টি সন্ধ্যা নামতেই শাড়ি পরে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ি বাড়ি ঘুরে হাসিমুখে বলত—
—“কাকিমা, এ বছর আমাদের মেয়েদের পূজো। আপনি যদি একটু সাহায্য করেন, তবে আমরা মায়ের চরণে অঞ্জলি দিতে পারব।”

কেউ প্রথমে অবাক হয়ে তাকাত, কেউ বা হেসে ছোটখাটো টাকা দিত। ধীরে ধীরে চাঁদার খাতা ভরতে শুরু করল।

প্যান্ডেলের সাজসজ্জার সময়ও একই দৃশ্য। অন্য বছর যেখানে পুরুষেরা বাঁশ কেটে, কাপড় বেঁধে কাঠামো বানাত, সেখানে এবার মেয়েরাই হাতে তুলে নিল রঙতুলি। অনন্যা বলল—
—“এবার আলো-ঝলমলে না হলেও, আমাদের প্যান্ডেল হবে মায়ের মতো উজ্জ্বল।”

narishaktir puja 2

পাড়ার ছেলেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। শুরুতে হাসাহাসি করলেও, যখন দেখল মেয়েরা ভিজে কাপড় মুছে, হাত মেখে রঙ করে প্রতিটি অংশে প্রাণ দিচ্ছে, তখন তাদের চোখে এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা ফুটে উঠল।

রাতের আকাশে তারার ঝিকিমিকি, চারদিকে বাঁশের কাঠামোর শব্দের সঙ্গে মিলেমিশে ভেসে উঠল মিষ্টির গান—
—“আমরা পারব… মা তো আমাদের সঙ্গেই আছেন।”

সেই গলায় ছিল ভরসা, ছিল অটুট বিশ্বাস। যেন মহল্লার আকাশও বলে উঠল—
“হ্যাঁ, তোমরাই পারবে।”

প্রথম বিজয়

শরতের সেই সকালটা আজও কারও ভোলার নয়। যেদিন প্রতিমা এলো, মহল্লার অলি-গলিতে ঢাকের শব্দে কেঁপে উঠল বাতাস।
“ধিম ধিম, ধাক্ ধিম!”
তার সঙ্গে মিলিয়ে উঠল কাঁসরের ধ্বনি, শঙ্খধ্বনি। ছোট ছোট মেয়েরা রঙিন পোশাক পরে উল্লাসে নেচে উঠল, যেন স্বাগত জানাচ্ছে মাকে।

মহিলারা মাথায় আঁচল টেনে ধূপ হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। একসঙ্গে সবাই মিলে ধুনুচি নাচ শুরু হতেই ধোঁয়ার ভেতর ভেসে উঠল হাসিমুখ, উজ্জ্বল চোখ। উৎসবের আলোয় ভরে গেল গোটা মহল্লা।

সেই বছর আলোর শোভা, বড় বড় ব্যানার কিংবা ঝলমলে সাজসজ্জা কিছুই ছিল না। তবুও প্যান্ডেলের ভেতরে ছিল অন্য এক দীপ্তি—ঐক্যের আলো, ভালোবাসার আলো।

ভোগে হাত লাগালেন পাড়ার গৃহিণীরা। রান্নার বড় বড় হাঁড়ি থেকে ভেসে এলো খিচুড়ি আর লাবড়ার গন্ধ। কেউ ভাত পরিবেশন করছে, কেউ মিষ্টি বিলাচ্ছে।
অন্যদিকে পাড়ার কিশোরীরা হাতে দড়ি বেঁধে ভিড় সামলাচ্ছে, যেন তারা নিজেরাই মায়ের সেনাদল।

একজন বৃদ্ধ বিস্ময়ে বলে উঠলেন—
—“আরে, মেয়েরা তো একেবারে মা দুর্গার মতই সামলাচ্ছে সব!”

চারদিকে তখন শুধু প্রশংসার শব্দ, বিস্ময়ের দৃষ্টি আর আনন্দে ভেসে যাওয়া মুখ। মনে হল, সত্যিই যেন দেবী মা নেমে এসেছেন, তাঁর শক্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিটি মেয়ের মাঝে।

এভাবেই প্রথম বছর পূজোর সাফল্যে মহল্লার মেয়েরা জয় ছিনিয়ে নিল—
এক জয়, যা ছিল শুধু আয়োজনের নয়, বরং সমাজের চোখে স্বীকৃতিরও।

পরিবর্তনের হাওয়া

সময়ের স্রোতে কেটে গেল পাঁচটি বছর। যে পূজো একদিন অবিশ্বাস আর বিদ্রূপের মাঝে শুরু হয়েছিল, আজ তা মহল্লার সবচেয়ে বড় গর্ব। এখন আর কেউ বলে না “মেয়েরা পারবে তো?”—বরং সবাই বুক ফুলিয়ে বলে—
“এটা আমাদের মেয়েদের পূজো।”

পাড়ার ছেলেরা গর্বভরে হাসতে হাসতে বলে—
—“এবার তো দিদিরাই আমাদের ভরসা। আমরা শুধু হাত মেলাতে এসেছি।”
তাদের চোখে আর প্রতিযোগিতা নেই, আছে সমানভাবে পাশে থাকার আনন্দ।

অষ্টমীর সকাল। শঙ্খধ্বনি, ঢাকের তালে চারদিক কেঁপে উঠছে। সাদা-লাল শাড়িতে মহিলারা অঞ্জলির জন্য ভিড় করেছেন। ধূপের ধোঁয়ায় চারপাশ ধূসর হলেও ভেসে বেড়াচ্ছে অনন্যার চোখের দীপ্তি।

সে হাত জোড় করে চোখ বুজে বলল—
“মা, তুমি যেমন অসুরকে বধ করেছিলে, আমরাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ব। আমাদের শক্তি দাও, সাহস দাও।”

প্রার্থনার সেই মুহূর্তে ঢাকের আওয়াজ যেন আরও জোরে কাঁপল, ধূপের গন্ধে ভরে উঠল আকাশ। মনে হল, মহল্লার প্রতিটি প্রাণ একসঙ্গে মিশে গেছে অনন্যার কণ্ঠে উচ্চারিত সেই প্রার্থনায়।

narishaktir puja 4

সেদিন সবাই বুঝেছিল—এই পূজো কেবল দেবী আরাধনা নয়, বরং সমাজ বদলের প্রতীক। এক পরিবর্তনের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছে, যা বয়ে আনছে নতুন শক্তি, নতুন দিশা।

নারীর জয়ধ্বনি

চার দিন ধরে চলা আনন্দ, ঢাকের শব্দ, আলোর মেলা ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছে। বিজয়ার সকালে প্রতিমার সামনে ভিড় জমল মহল্লার সবাই। পূজো শেষে এবার এক অন্যরকম দৃশ্য—মহল্লার প্রবীণরা এগিয়ে এলেন মেয়েদের দিকে।

কেউ গলায় মালা পরিয়ে দিল, কেউ হাতে তুলে দিল একটি করে শাল, কেউ আবার চোখ ভিজিয়ে বললেন—
—“তোরা সত্যিই আমাদের গর্ব।”

সবাইয়ের সামনে এগিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা, যিনি প্রথম বছর সবচেয়ে বেশি আপত্তি করেছিলেন। কাঁপা হাতে অনন্যার মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন—
—“আগে ভাবতাম মেয়েরা কিছুই করতে পারে না। এখন বুঝেছি, মেয়েরাই আসল শক্তি। তোরা-ই আমাদের মা দুর্গা।”

অনন্যার চোখ ভিজে গেল। সে তাকিয়ে রইল মায়ের প্রতিমার দিকে। মায়ের চোখের দীপ্তিতে যেন ভেসে উঠল সেই স্বীকৃতি—নারীর শক্তি আর পরিশ্রমকে সমাজ অবশেষে গ্রহণ করেছে।

narishaktir puja 5

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিমা, রূপা, মিষ্টি—সবাই হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের চোখে অশ্রুজল, ঠোঁটে হাসি। যেন মনে মনে বলছে—
“এটাই আমাদের আসল বিজয়া।”

নারীশক্তির এই জয়ধ্বনি ভেসে গেল মহল্লার আকাশে, কাশবনের উপর দিয়ে, ঢাকের শেষ তাল মিশিয়ে দিল নতুন বার্তা—
এই দুর্গাপুজোর আসল আনন্দ ঝলমলে আলো বা সাজসজ্জা নয়, বরং সমাজের মনে নারীর শক্তিকে সম্মান জানানোর উজ্জ্বল দীপ্তি।

দুর্গাপুজো কেবল দেবী আরাধনা নয়, এটা আসলে নারীর শক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়ার উৎসব। মায়ের প্রতিমার চোখের দীপ্তি, পাড়ার মেয়েদের হাসি, আর সমাজের বদলে যাওয়া মনোভাব—সব মিলিয়েই যেন সত্যি হয়ে উঠল সেই প্রাচীন বাণী—
“যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে, রমন্তে তত্র দেবতা।”
(যেখানে নারীর পূজা হয়, সেখানেই দেবতারা বাস করেন।)

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *