না লেখা চিঠি
|

না লেখা চিঠি 💌

ধুলোর আড়ালে একটি অসম্পূর্ণ প্রেম

শুরু: ছোট্ট, মফস্বল শহর শান্তিপুরের প্রাণকেন্দ্রে, পুরোনো লাইব্রেরিটি দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এই লাইব্রেরিই হলো কলেজ শিক্ষক দীপার দ্বিতীয় ঘর। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে বারবার টেনে আনে এই ধূসর, পুরোনো কাগজের ভিড়ে। শীতের নরম আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে লাইব্রেরির ভেতরের শান্ত পরিবেশে এক মায়াবী আভা সৃষ্টি করেছে।

দীপা তখন লাইব্রেরির পুরোনো দাতা নথিপত্রের স্তূপ ঘাঁটছিল। একপাশে পড়ে থাকা কাঠের সিন্দুকের ভেতরে ছিল শত শত বছরের পুরোনো অব্যবহৃত বই ও কাগজপত্র। সেই সিন্দুকের একদম তলায়, একটি চামড়ার বাঁধানো অ্যাকাউন্টিং বইয়ের ভাঁজে, দীপা একটি হলুদ হয়ে যাওয়া খাম খুঁজে পেল। খামটির কোণে একটি বহু পুরোনো ছাপ মারা, যা এখন আর ব্যবহার হয় না। খামটি সাবধানে খুলতেই বেরিয়ে এলো হাতে লেখা এক টুকরো কাগজ। অক্ষরগুলো যত্নের সাথে লেখা, কালিতেও সামান্য মলিনতা। চিঠিটিতে কোনো তারিখ নেই, প্রাপকের নাম বা ঠিকানাও অস্পষ্ট, কিন্তু প্রেরকের আবেগে তা ভরপুর।

দীপা ফিসফিস করে পড়লো: “তুমি না এলে, এই শহর আজও আমার কাছে অসম্পূর্ণ।” এই একটি বাক্যেই যেন চিঠিটি তার মন ছুঁয়ে গেল। এই অসম্পূর্ণতা, এই দীর্ঘ অপেক্ষা—দীপার চোখে জল এনে দিলো।

ঠিক সেই সময়, তার পাশে থাকা একটি টেবিলের ধার ঘেঁষে বসে থাকা অভিরূপ তার দাদুর লেখা পুরোনো নোটবুকটি দেখছিলেন। অভিরূপ, যিনি কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন, কিন্তু দাদুর স্মৃতি খুঁজতে শান্তিপুরে এসেছেন, লাইব্রেরিকে কিছু পুরোনো সম্পত্তি দান করার জন্য। অভিরূপের চোখ হঠাৎ দীপার হাতে থাকা চিঠির উপর পড়লো। চিঠিটা দেখে তিনি চমকে উঠলেন। চিঠির লেখার ধরন, অক্ষরের বাঁক—সবকিছুই তার কাছে খুব পরিচিত মনে হলো।

“চিঠিখানা সরিয়ে নিন,” অভিরূপ ইতস্তত করে বলল। “আমার দাদুর হাতের লেখা ঠিক এমনি ছিল। এই চিঠি হয়তো আমাদের দু’জনের নয়, কিন্তু আমাদের সময়ের গল্প বলতে এসেছে।”

na lekha chithi 3

দীপা দ্রুত চিঠিটি লুকিয়ে ফেললো, কিছুটা লজ্জিত হয়ে। “আমি… আমি দুঃখিত। আমি শুধু পুরোনো দিনের… আবেগ খুঁজছিলাম।”

“এই আবেগের লেখক আমার দাদু হতে পারেন,” অভিরূপ নরম স্বরে বলল। “তিনিও ঠিক এভাবেই ‘অসম্পূর্ণ’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। তিনি তাঁর সেরা বন্ধুকে এই শহরে আসার অনুরোধ করেছিলেন, যিনি আর আসেননি। আর সেই না আসার কষ্ট তাঁর লেখায় সারাজীবন ছিল।”

দীপা সাবধানে চিঠিটি অভিরূপের হাতে তুলে দিল। অভিরূপ চিঠিটি পড়লেন। তার চোখেও জল চিকচিক করে উঠলো। চিঠির নিচে প্রেরকের নাম লেখা ছিল: ‘অ’।

দীপা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “পুরোনো প্রেমের খোঁজ করাটা আপনার কাছে একটা খেলা হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এই বইগুলো জীবন।”

অভিরূপ হেসে উত্তর দিল, “খেলা নয়, ম্যাডাম। এটা হলো প্রেমকে তার পুরোনো ঠিকানায় ফিরিয়ে দেওয়া। আর বিশ্বাস করুন, আপনার জীবনের চেয়ে এই চিঠিটা বেশি প্রাণবন্ত। চলুন, আমরা এই অসম্পূর্ণতা পূরণ করি।”

দীপা অভিরূপের চোখে এক অদ্ভূত সততা দেখতে পেল। এই চিঠির লেখকের মতোই যেন অভিরূপের মধ্যেও এক চাপা আবেগ রয়েছে। সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তাদের প্রথম অনুসন্ধান শুরু হলো লাইব্রেরির বাইরে লেখা একটি অস্পষ্ট ঠিকানা থেকে।

ভুল চায়ের দোকানে প্রথম অনুসন্ধান

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে দীপা আর অভিরূপ হাঁটতে শুরু করলো শান্তিপুরের সরু গলি ধরে। দীপা আগে থেকেই এই শহরের পুরোনো ইতিহাস জানলেও, অভিরূপের চোখ দিয়ে যেন নতুন করে শহরটাকে দেখছিল। তাদের হাতে ছিল শুধু সেই হলুদ চিঠি আর চিঠির খামের ওপর লেখা একটি অস্পষ্ট পিন কোড ও একটি পুরোনো রাস্তার নাম, যা এখন বদলে গেছে।

“এই রাস্তার নাম এখন ‘শান্তি সড়ক’,” দীপা জানালো। “কিন্তু সত্তর দশকে এটা ‘গোলাপ গলি’ নামে পরিচিত ছিল। আর এই পিন কোড… এটা ঠিক এই এলাকার নয়, একটু দূরের বাজারের দিকে।”

অভিরূপ সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে বলল, “প্রেমিকেরাই তো ভুল ঠিকানা দেয়, যাতে প্রেমিকা খুঁজতে আসে! চলুন, প্রথমে গোলাপ গলি, তারপর বাজার!”

দীপার মন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। একজন অপরিচিত মানুষের সাথে, একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত প্রেমের গল্প খুঁজতে বের হওয়া—এটা তার জন্য অচেনা। কিন্তু অভিরূপের চোখে যে নিষ্পাপ কৌতূহল ছিল, তা তাকে আকর্ষণ করলো।

তারা প্রথমে পৌঁছালো পুরোনো গোলাপ গলি। এখন সেখানে আধুনিক বহুতল ভবন উঠেছে। কিন্তু ঠিক গলির মুখে, একটি জীর্ণ, পুরোনো চায়ের দোকান এখনও টিকে আছে, যার নাম ‘নটবরের আড্ডা’। দোকানটি প্রায় বন্ধই থাকে।

na lekha chithi 3

দীপা বলল, “এই দোকানটা আমার মনে হয় না সেই সময়কার কোনো সূত্র দিতে পারবে।”

অভিরূপ কিন্তু এক মুহূর্ত দেরি না করে দোকানটির পুরোনো কাঠের দরজায় টোকা মারলো। ভেতরে থাকা নটবর কাকা, যিনি বয়সজনিত কারণে প্রায় চোখে দেখতে পান না, দরজা খুললেন।

অভিরূপ জিজ্ঞেস করলেন, “কাকা, অনেক বছর আগে, এই গলিতে কি ‘অ’ নামে কেউ থাকতেন, যিনি হয়তো তার এক প্রিয় বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন?”

নটবর কাকা কাশি দিলেন। “অ’? না গো বাবা। তবে এই গলিতে এক যুবক ছিল, যার নাম ছিল অপূর্ব। সে রোজ সকালে এসে আমার চায়ের দোকানে বসতো আর একটা অদ্ভুত কবিতা লিখতো। সে বলতো, সে তার বন্ধুকে এই শহরকে জানাতে চায়।”

অভিরূপ ও দীপা পরস্পরের দিকে তাকালো। “অপূর্ব!”—এই নামের ‘অ’ অক্ষরটি যেন তাদের প্রথম সূত্র।

নটবর কাকা চায়ের দোকানের একটি পুরোনো, তালাবন্ধ কাঁচের আলমারি দেখালেন। “অপূর্ব চলে যাওয়ার আগে, তার সব পুরোনো লেখার খাতা আর একটা ভাঙা রেডিও এখানেই রেখে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘যদি কেউ কোনোদিন এই শহরের অসম্পূর্ণতাকে বুঝতে চায়, তবে এখানে খোঁজ নেবে।'”

দীপা ও অভিরূপ বুঝতে পারলো—তারা ভুল চায়ের দোকানে আসেনি, এটিই তাদের গন্তব্য ছিল। নটবর কাকা আলমারিটি খুলতে পারলেন না।

অভিরূপ হেসে বলল, “আপনারা এই শহরের সবচেয়ে কম মিষ্টি চা তৈরি করতেন, তাই না কাকা? আমি আপনার চা-এর কথা শুনেছি।”

নটবর কাকা হাসলেন। “তেতোই ভালো ছিল, বাবা।”

দীপা অর্কের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আপনার তো মিষ্টি ছাড়া চলে না, তবুও আপনি তেতো চা-এর প্রশংসা করছেন? কী ব্যাপার?”

অভিরূপ দুষ্টুমি ভরা হাসি হেসে বলল, “আমি জীবনে প্রথম তেতো চা খেলাম আপনার জন্যই, ম্যাডাম। আর এখন তেতোতেই মজা লাগছে। আপনার রসবোধ না থাকুক, কৌতূহল তো আছে!

তাদের এই দুষ্টু-মিষ্টি মুহূর্তের ঝগড়াই যেন এই পুরোনো চায়ের দোকানের তেতো চা-এর মধ্যেও এক চিমটি চিনি মিশিয়ে দিলো। নটবর কাকার আলমারির ভেতরে সেই অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্পের সূত্র তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছিল।

পুরোনো রেডিও আর গোপন সংকেত

নটবর কাকা চাবি খুঁজে পেলেন না। অগত্যা অভিরূপ ও দীপা ঠিক করলো, পরের দিন সকালে তারা তালা ভাঙার যন্ত্র নিয়ে আসবে। কিন্তু দীপার কৌতূহল থামছিল না। রাতে সে ঘুমাতে পারলো না। সেই চিঠিটির প্রতিটি অক্ষর যেন তাকে ডাকছিল।

na lekha chithi 2

পরের দিন, সকালে দীপা যখন লাইব্রেরির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন দেখলো অভিরূপ আগে থেকেই নটবর কাকার চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে শুধু তালা ভাঙার যন্ত্র আনেনি, সঙ্গে এনেছে দু’কাপ গরম কফি—একটি দীপার জন্য, অন্যটি নিজের জন্য।

“আমারটা কি অতিরিক্ত মিষ্টি?” দীপা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো।

অভিরূপ হাসলো। “একেবারেই নয়। এটা আপনার জন্য ‘নিখুঁত কালো কফি’। আর আমারটা… অবশ্যই অতিরিক্ত চিনি। কারণ এই অসম্পূর্ণ গল্প মিষ্টি না হলে চলবে কেন?”

তারা তালা ভেঙে আলমারি খুললো। আলমারির ভেতরে ছিল একটি পুরোনো কাঠের ফ্রেমের রেডিও, কিছু হাতে লেখা খাতা এবং পুরোনো পোস্টকার্ডের স্তূপ। খাতাগুলো ছিল অপূর্বের লেখা কবিতা ও গানের কথায় ভরা। রেডিওটি ছিল সম্পূর্ণ ভাঙা।

পোস্টকার্ডগুলোর মধ্যে একটি পোস্টকার্ডে দীপা একটি অদ্ভূত প্রতীক (Symbol) লক্ষ্য করলো—একটি ছোট গাছের ছবি, যার একটি ডাল ভাঙা। এই প্রতীকটি চিঠির নিচেও আঁকা ছিল।

দীপা বলল, “এই প্রতীকটা হয়তো ওদের কোনো গোপন সংকেত।”

অভিরূপ রেডিওটি হাতে নিলো। রেডিওটির ভেতরে কোনো ব্যাটারি ছিল না। অভিরূপ রেডিওটি ঝেড়ে পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ দেখলো—রেডিওটির পেছনের অংশে একটি খুব ছোট ছিদ্রের মধ্যে একটা ছোট কাগজের টুকরো ভাঁজ করা আছে।

কাগজটি বের করে তারা দেখল, সেখানে শুধুমাত্র একটি তারিখ লেখা: “১৪ই ফাল্গুন, বিকেল ৪টা” এবং তার নিচে একটি শব্দ: “কাব্যতীর্থ”

দীপা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “‘কাব্যতীর্থ’! এটা শান্তিপুরের সবচেয়ে পুরোনো ঘাট, যেখানে রবীন্দ্রনাথ একবার এসেছিলেন বলে কথিত আছে। অপূর্ব হয়তো তার বন্ধুর জন্য সেখানে অপেক্ষা করতেন।”

অভিরূপ তারিখটি দেখলো। “১৪ই ফাল্গুন মানে বসন্তের শুরুর দিন। কিন্তু কোন বছর? দাদু তাঁর বন্ধুকে ভালোবাসার কথা না বলে একটি চিঠি লিখেছিলেন। অদ্ভুত! মনে হচ্ছে ওরা দু’জনই খুব লাজুক ছিল।”

দীপা মাথা নেড়ে বলল, “এটা পুরোনো দিনের প্রেম, অভিরূপ। সেখানে সব কথা মুখের ভাষা দিয়ে বলা হতো না। এই লুকানো সংকেত, এই ভাঙা রেডিও… এগুলোই তাদের মনের কথা।”

হঠাৎ অভিরূপ দীপার দিকে তাকালো। “আপনি এই গল্পটাকে এত আপন করে নিচ্ছেন কেন, দীপা? আপনিও কি এমন কোনো অসম্পূর্ণতার গল্প জানেন?”

দীপা চুপ করে গেল। তার চোখে সামান্য মেঘ জমলো। “প্রত্যেক ইতিহাসবিদের জীবনে এমন কিছু হারানো সময়ের গল্প থাকে, যা তাকে কষ্ট দেয়। আমি হয়তো এই চিঠিটির মাধ্যমে আমার ভেতরের অসম্পূর্ণতাটাকেই পূরণ করতে চাইছি।”

অভিরূপ আর প্রশ্ন করলো না। সে বুঝতে পারলো, দীপা নিজের ভেতরেও কিছু চাপা কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে আলতো করে রেডিওটি ব্যাগে ভরল। “তাহলে কাল ১৪ই ফাল্গুন না হলেও, আমরা কাব্যতীর্থে যাবো। অপূর্বের অসম্পূর্ণতা মেটানোর প্রথম ধাপ।”

সন্ধ্যা নামার সময় দীপা অভিরূপের হাত থেকে চায়ের দোকানের ভাঙা আলমারির চাবিটি নিলো। সেই মুহূর্তে তাদের হাতের ছোঁয়া লেগেছিল। পুরোনো দিনের প্রেমের মতো এই স্পর্শও ছিল মৃদু এবং মিষ্টি।

কাব্যতীর্থে অপেক্ষা ও দীপার নীরবতা

পরের দিন বিকেলে, দীপা ও অভিরূপ কাব্যতীর্থে পৌঁছালো। জায়গাটি শহর থেকে কিছুটা দূরে। বিরাট শিমুল গাছের ছায়ায়, গঙ্গার পাড়ে ছোট্ট একটি বাঁধানো ঘাট। বসন্তের আগমনীর বাতাস বইছে। বিকেল ৪টের সময়, শিমুল ফুলের লাল পাপড়িগুলো ঘাটের সিঁড়িতে বিছিয়ে আছে।

ঘাটে কোনো মানুষ নেই। দীপা ও অভিরূপ দু’জনেই হতাশ হলো। এতো পুরোনো সংকেত, এতো বছরের অপেক্ষা—এখানে আর কী সূত্র মিলবে?

দীপা মৃদু স্বরে বলল, “অপূর্ব হয়তো জানতো, তার বন্ধু কোনোদিন আসেনি। তাই সে তার বন্ধুকে লেখা সমস্ত আবেগকে এই শহরেই রেখে গেছে। এই ঘাট… এই শিমুল গাছ… সব যেন সেই না-আসা বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে।”

অভিরূপ গম্ভীর হয়ে গেলো। “কিন্তু একটা কিছু তো থাকতে হবে! একটা উত্তর!”

অভিরূপ চারিদিকে খুঁজতে লাগলো। দীপা বসে পড়লো ঘাটের সিঁড়িতে। কিছুক্ষণ পর অভিরূপ শিমুল গাছের গুঁড়িতে একটি পুরোনো খোদাই (Engraving) লক্ষ্য করলো। সেখানে অস্পষ্টভাবে লেখা ছিল: “অ+র”। আর নিচে আরও অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা: “আমি তোর জন্য শেষ চিঠিটা…”

দীপা ও অভিরূপের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ‘অ’ হলো অপূর্ব, আর ‘র’ হয়তো তার বন্ধুর নাম। কিন্তু শেষ চিঠিটা কী?

হঠাৎ দীপা কেঁপে উঠলো। তার চোখে জল ভরে এলো। অভিরূপ অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।

“কী হয়েছে, দীপা?”

দীপা চোখ মুছে বলল, “এই ‘র’ অক্ষরটা… এই হাতে লেখা স্টাইল… আমি এর আগেও দেখেছি।”

অভিরূপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়? কবে?”

দীপা দ্বিধা করলো। এইবার সেই সময় যখন তার নিজের অসম্পূর্ণতার গল্পটি বলা প্রয়োজন ছিল। সে বলল, “আমার বাবা… আমার বাবাও ঠিক এভাবেই ‘র’ অক্ষরটা লিখতেন। আর আমার বাবার একজন খুব কাছের বন্ধু ছিলেন, যিনি তার পুরনো শহরে আর ফিরতে পারেননি।”

অভিরূপের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো, এই গল্প শুধু অপূর্বের নয়।

দীপা দ্রুত তার পুরোনো স্মৃতিতে ফিরে গেল। তার বাবা প্রায়ই তাকে বলতেন, “শান্তিপুর শহরে আমার এক বন্ধু ছিল, যার জন্য আমার জীবনটা বদলে যেতে পারতো। কিন্তু শেষমেশ আমি তাকে একটা চিঠি লিখতেও পারিনি। সে আমার জন্য অপেক্ষা করতো।”

অভিরূপ এবার দীপার হাতের লেখা চিঠিটির দিকে তাকালো। “…তুমি না এলে, এই শহর আজও আমার কাছে অসম্পূর্ণ।”

“দীপা, আপনার বাবার বন্ধু হয়তো অপূর্ব। কিন্তু আপনার বাবার কাছে অপূর্বের শেষ চিঠি কী ছিল?”

দীপা মাথা নাড়লো। “বাবা আমাকে বলেছিলেন, তিনি তার বন্ধুর কাছে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ‘না লেখা চিঠি’ রেখে এসেছিলেন। সেই চিঠিটি যদি কখনো খুঁজে পাই, তবে যেন আমি তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করি।”

দীপা এবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। সে কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার বাবা, যিনি কিছুদিন আগেই মারা গেছেন, তার সেই অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প যেন আজ অভিরূপের মাধ্যমে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই চিঠিটি হয়তো সেই ‘না লেখা চিঠি’ নয়, কিন্তু সেই সম্পর্কের এক নীরব সাক্ষী।

অভিরূপ দীপার কাঁধে হাত রাখলো। এই স্পর্শ ছিল খুব কমলের, এক বন্ধুত্বের বা তার থেকেও বেশি কিছু। সে বুঝতে পারলো, এই অনুসন্ধান এখন শুধু ইতিহাসের নয়, এটি দীপার ব্যক্তিগত জীবনের এক গভীর আবেগ।

“আপনার বাবা শেষ কী বলেছিলেন?” অভিরূপ জানতে চাইলো।

দীপা চোখ মুছে বলল, “বাবা বলেছিলেন, ‘এই শহরের সবচেয়ে মিষ্টি জিনিসটার কাছেই আমার শেষ ইচ্ছা লুকানো আছে, যা আমি অপূর্বকে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দেওয়া হয়নি’।”

সমাপ্তি—সবচেয়ে মিষ্টি সমাধান

দীপা ও অভিরূপের অনুসন্ধান এখন এক নতুন মোড় নিলো। তাদের নিজেদের জীবনের ইতিহাস অপূর্ব ও তার বন্ধুর অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্পের সাথে মিলে গেছে।

“সবচেয়ে মিষ্টি জিনিস?” অভিরূপ ভাবলো। “শহরটি পুরোনো, এখানে মিষ্টি জিনিসের অভাব নেই। কিন্তু বাবার শেষ কথা ছিল—যা তিনি অপূর্বকে দিতে চেয়েও পারেননি। কী হতে পারে?”

দীপা বলল, “পুরোনো দিনে হাতে তৈরি মিষ্টির দোকান ছিল ‘মিষ্টান্ন ভবন’ নামে, যা বহু বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তার পাশে ‘আনন্দভুজ’ নামে নতুন একটি দোকান হয়েছে, যা এখনও চলে।”

তারা দুজনে ‘আনন্দভুজ’-এ পৌঁছালো। এটি এখন খুবই আধুনিক, কিন্তু দীপার মনে পড়লো—ছোটবেলায় তার বাবা প্রায়ই এই দোকানের পুরোনো অংশে তাকে নিয়ে আসতেন, যা এখন বন্ধ।

তারা দোকান মালিকের সঙ্গে কথা বললো। মালিক জানালেন, পুরোনো ‘মিষ্টান্ন ভবন’ আসলে এই দোকানেরই অংশ ছিল। সেখানে, দোকানের এক কোণে একটি পুরোনো কাঠের তৈরি বাক্স রাখা আছে, যা অনেক বছর কেউ স্পর্শ করেনি।

অভিরূপ ও দীপা বাক্সটি খুললো। ভেতরে কোনো চিঠি বা কবিতা ছিল না। ছিল শুধুমাত্র একটি পুরোনো দিনের হাতে তৈরি সন্দেশ, যা সম্পূর্ণ শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু তার সুগন্ধ এখনও লেগে আছে। সন্দেশটির নিচে একটি ছোট কাগজের টুকরো, তাতে শুধু লেখা: “তুমি না এলে, এই আনন্দের ভাগ কাকে দেব? – র”

দীপা বুঝতে পারলো। তার বাবা (যার নাম ‘র’ অক্ষর দিয়ে শুরু ছিল) আসলে তার প্রিয় বন্ধু অপূর্বকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারেননি। তাদের সময়ে হয়তো পুরুষে পুরুষে ভালোবাসার প্রকাশ সহজ ছিল না। বাবা অপূর্বকে বলেছিলেন যে তিনি তাকে শহরের সবচেয়ে মিষ্টি জিনিস-টি দেবেন, যদি অপূর্ব ফিরে আসে। কিন্তু অপূর্ব আসেনি। তাই বাবা সেই সন্দেশটি, তার না বলা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে, সেই মিষ্টির দোকানেই রেখে গিয়েছিলেন।

অভিরূপের চোখে জল এলো। “দাদু (অপূর্ব) সারাজীবন অপেক্ষা করেছেন, আর আপনার বাবা তার না-বলা ভালোবাসা এই সন্দেশের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই অসম্পূর্ণতা, দীপা, এটাই হয়তো সবচেয়ে মধুর প্রেম।”

দীপা হাসলো। “এটা প্রেম, অভিরূপ। যা কোনোদিন শেষ হয় না, শুধু সময়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আমরা আজ এই দুই বন্ধুর ভালোবাসাকে মুক্তি দিলাম।”

দীপা সন্দেশটি হাতে নিলো। সে এই পুরোনো দিনের ভালোবাসার প্রতীকটিকে সাবধানে একটি কাপড়ের ভাঁজে রাখলো।

অভিরূপ তখন দীপার হাত ধরলো। তার চোখে ছিল এক শান্ত আবেগ। “এই শহরের অসম্পূর্ণতা আজ পূর্ণ হলো, দীপা। কিন্তু আমাদের গল্প… আমাদের গল্প এখনও শুরু হয়নি। আমার হাতেও সেই মিষ্টি জিনিস আছে, যা আমি আপনাকে দিতে চাই।

দীপা মাথা তুলে অভিরূপের দিকে তাকালো। তার মুখে ছিল এক স্নিগ্ধ হাসি, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

অভিরূপ তার ব্যাগ থেকে সেই ভাঙা রেডিওটি বের করলো। “অপূর্ব এই রেডিওটি রেখে গিয়েছিল। আমি সারাই করে এনেছি।” সে রেডিওটি চালু করলো। পুরোনো দিনের একটি মিষ্টি গান বেজে উঠলো। অভিরূপ রেডিওটি দীপার হাতে দিয়ে বলল, “এই গানটা আমার। আর এই সময়টা আপনার। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে মিষ্টি উপহার, যা আমি কাউকে দিতে চেয়েছিলাম।”

দীপা রেডিওটি বুকে চেপে ধরলো। অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প শেষ হলো এক সম্পূর্ণ অনুভূতির মাধ্যমে। দীপা আর অভিরূপ, এই দুই পুরোনো আবেগের অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়েই নিজেদের জন্য এক নতুন, মিষ্টি ও মধুর পথ খুঁজে পেল।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *