মদনের চায়ের ঠেক
শুরু, শৈশবের স্মৃতি আর ঠেকের জন্ম
গ্রামের মোড়টা আজও চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। বাঁশঝাড়ের আড়াল দিয়ে হাওয়া এসে লাগত, পাশ দিয়ে টালির রাস্তা, আর সেই রাস্তার ধুলো মিশত চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে। তখনো মোবাইল আসেনি, টেলিভিশনও সবার ঘরে পৌঁছোয়নি। গ্রামের একমাত্র বিনোদন ছিল আড্ডা—আর সেই আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল “মদনের চায়ের ঠেক”।
আমাদের শৈশব মানেই ওই ঠেকের চারপাশে ঘোরাফেরা। ভোরের কাক ডাকতে না ডাকতেই মদনদা তার বাঁশের ছোট্ট দোকান খুলে ফেলতেন। একটা কেরোসিন ল্যাম্প, মাটির কেতলি, কয়েকটা ভাঙাচোরা বেঞ্চ—এই নিয়েই শুরু। দোকানটা তখনো “ঠেক” নাম পায়নি। সবাই শুধু বলত—
“চলো, মদনের দোকানে যাই।”
শৈশবের প্রথম টান
আমি তখন ছোট, হয়তো ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার পথে মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গন্ধ নিতাম। গরম কেতলির চায়ের সোঁদা গন্ধ যেন টেনে নিয়ে যেত। মা বারণ করতেন—“চা খেলে নাকি চোখ নষ্ট হয়!” তাই আমরা খেতাম না, কিন্তু মাঝে মাঝে মদনদা খুশি হয়ে এক চামচ দুধ ফেনা দিয়ে দিতেন কাঁচা গ্লাসে। আহা! সে যে কী আনন্দ, তা ভাষায় বোঝানো যায় না।
চায়ের দোকানটা ছিল আসলে আমাদের ছোট্ট স্বপ্নবিলাস। পড়ার বই নিয়ে না আসলেও আমরা আসতাম মদনের দোকানে—কারণ এখানে গল্প থাকত, হাসি থাকত, অচেনা নতুন কিছু জানার উৎসাহ থাকত।
কেউ জানত না আসলে মদনের ঠেক কীভাবে জন্ম নিল। পরে শুনেছি, মদনদার জীবন ছিল অনেক কষ্টে ভরা। বাবা মারা গিয়েছিল ছোটবেলায়, সংসার সামলাতে পড়াশোনা তেমন এগোয়নি। প্রথমে দিনমজুরের কাজ করতেন, কখনো মাঠে, কখনো ইটভাটায়। কিন্তু ভোরে উঠে চা খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সেখান থেকেই নাকি ভাবনা—“যদি নিজের একটা চায়ের দোকান খুলি!”
তখনকার দিনে চায়ের দোকান মানেই বড় ব্যাপার। কিন্তু মদনদা হাল ছাড়েননি। বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিলেন, কয়েকটা বাঁশ কেটে নিজের হাতে ঘর বাঁধলেন। পাশে টিনের চালা, একটা ভাঙা কাঠের টেবিল, আর হাতে মাটির কেতলি। সেই দিয়েই শুরু হল পথচলা।
সকালের মুখরোচক দৃশ্য
ভোর চারটেয় দোকান খোলার শব্দে গোটা গ্রাম যেন নতুন দিন শুরু করত। কেতলিতে ফুটতে থাকা চায়ের গন্ধ মিশত ঠান্ডা সকালের হাওয়ায়।
- চাষারা আসত মাঠে যাওয়ার আগে এককাপ গরম চা খেতে।
- রিকশাওয়ালারা হেলান দিয়ে বসে থাকত, কাপে চুমুক দিতে দিতে রুটির ঝোল খেত।
- গ্রামের স্কুলশিক্ষক, ডাকপিয়ন, এমনকি ডাক্তারবাবুও একবার হলেও থামতেন এই দোকানে।
চায়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্পও জমে উঠত। কে কত জমি চাষ করল, কার গরু বেশি দুধ দিল, কোন সিনেমা শহরের হলে চলছে—সব খবর মিলত এখানেই।
আমাদের শৈশবের আড্ডা
আমরা ছেলেপুলেরা স্কুল শেষে দৌড়ে চলে যেতাম ওই দোকানে। বেঞ্চিতে বসে থাকতাম, হাতে ধরা থাকত এক গ্লাস লেবু চা বা কখনো শুধু বিস্কুট। মদনদা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসতেন—
“পড়াশোনা করো, তারপর যত খুশি আড্ডা দিও।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা!
আমাদের আসল আনন্দ ছিল আড্ডা আর গল্প শোনা। বড়রা যখন রাজনীতি বা ক্রিকেট নিয়ে তর্ক করত, আমরা চুপচাপ কান পাততাম। মনে হতো, আহা! একদিন আমরাও হয়তো এভাবেই গম্ভীর আলোচনা করব।
ঠেকের নামকরণ
প্রথমে দোকানটা স্রেফ চায়ের দোকানই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রামবাসীর কাছে এটা হয়ে উঠল একেবারে আড্ডাখানা। কেউ বলত—“চলো মদনের আড্ডায় যাই।”
আবার কেউ মজা করে বলত—“চায়ের ঠেক না, এ তো সংসদ!”

একদিন হঠাৎ গ্রামের নেতা এসে ঘোষণা করলেন—
“এখন থেকে জায়গাটার নাম হবে মদনের ঠেক। সবাই তাই ডাকছে।”
সেই নাম আজও রয়ে গেছে।
💭 আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি
একবার মনে আছে, আমি পরীক্ষায় খারাপ করেছিলাম। বাসায় প্রচণ্ড বকুনি খেয়ে মন খারাপ করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। সোজা চলে গিয়েছিলাম মদনের দোকানে। তখন সন্ধ্যা, আলো-আঁধারি। মদনদা চা বানাচ্ছিলেন। আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বললেন—
“কী রে, এমন গোমড়া মুখ কেন?”
আমি কেঁদে ফেললাম। কিছু না বলে মাথা নামিয়ে বসে রইলাম।
মদনদা কোনো প্রশ্ন না করে সামনে এক গ্লাস গরম দুধ দিয়ে বললেন—
“চা নয়, তুই এটা খা। মনে রাখবি, পড়াশোনা খারাপ হলে জীবন শেষ হয় না। আবার চেষ্টা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সেদিন যেন প্রথম বুঝেছিলাম—একটা ছোট্ট চায়ের দোকানও কারও কাছে হতে পারে আশ্রয়, সান্ত্বনা, ভালোবাসা।
ধীরে ধীরে জমে ওঠা
বছর ঘুরতে ঘুরতে মদনের দোকান একেবারে গ্রামের প্রাণকেন্দ্র হয়ে গেল। বিয়ে, জন্মদিন, দুর্ঘটনা, ঝগড়া—যে কোনো খবরে মানুষ প্রথমেই ছুটে আসত মদনের ঠেকেই। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প হতো, মতবিনিময় হতো, কখনো আবার ঝগড়াও বাঁধত।
কিন্তু মদনদা ছিলেন শান্তির মানুষ। তিনি সবসময় বলতেন—
“চা যদি গরম হয়, মুখ পুড়ে যায়। ঝগড়াও তেমনি, আগুন লাগায়। তাই গরম হলে ঠান্ডা হতে দিতে হয়।”
কৈশোরের দিনগুলো, বিকেলের তাসের আড্ডা আর মন খারাপের আশ্রয়
শৈশব কেটে কৈশোর এল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আড্ডার রঙও বদলাল। একসময় যে বেঞ্চিতে বসে বিস্কুট খেতে খেতে লুকিয়ে হাসাহাসি করতাম, সেই বেঞ্চিতেই এখন বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা জমত। আর সেই আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু ছিল “মদনের চায়ের ঠেক”।
বিকেলের তাসের আসর
গ্রামের বিকেল মানেই অন্যরকম। সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে, মাঠ থেকে ফিরে আসে গরু-বাছুর, আর দোকানের পাশে জমে ওঠে কচি থেকে বুড়ো সবার ভিড়। তবে সবচেয়ে জমজমাট আসর ছিল তাস খেলা।
বয়সকরা মানুষরা কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয় তাস মেলে ধরত। কেউ বাজি রাখত এক কাপ চা, কেউ আবার এক মুঠো চিনেবাদাম। খেলার মাঝেই শোরগোল উঠত—
“এই যে, উল্টো করে ফেললি কার্ডটা!”
“না না, আমি ফাউল করি নাই!”
আমরা ছেলেরা দূরে বসে মজা দেখতাম। মাঝে মাঝে হেরে গেলে চা কিনে দিতে হত। তখন আমাদেরই সবচেয়ে আনন্দ—ফ্রি চায়ের গন্ধ নাকে আসবে!
তাস খেলার এই আড্ডা ছিল আসলে গ্রামের মানুষকে একসূত্রে বাঁধার জায়গা। রাজনৈতিক মতবিরোধ, জমির ঝামেলা, এমনকি পারিবারিক দ্বন্দ্ব—সব ভুলে সবাই একসঙ্গে বসত মদনের ঠেকে।
বাচ্চাদের কোণ
দোকানের একপাশে বাঁশ দিয়ে আলাদা করা ছোট্ট জায়গাটা ছিল আমাদের প্রিয় কোণ। সেখানে বসেই আমরা লুডো খেলতাম, কাগজ ভাঁজ করে পায়রা বানাতাম, পরে যখন মোবাইল এল, তখন শুরু হল গেম খেলার হুল্লোড়।
একটা মোবাইল ঘিরে চার-পাঁচজন বসে থাকত, সবাই চেঁচিয়ে নির্দেশ দিত—
“এইদিকে মার! না না, ওদিকে যাস না!”
মদনদা তখন কেতলি হাতে মুচকি হেসে বলত—
“তোমাদের গেমও তাস খেলার মতো, হেরে গেলে চা খাওয়াতে হবে।”
সেই হাসি আজও কানে বাজে।
মন খারাপের আশ্রয়
কৈশোর মানেই আবেগের দোলা। কারও প্রেমে ব্যর্থতা, কারও আবার সংসারের টানাপোড়েন। আমাদের গ্রামে কারও মন খারাপ হলে সে সোজা চলে যেত মদনের ঠেকে।
একবার মনে আছে, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সঞ্জয় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কান্নাকাটি করছিল। আমি তাকে টেনে নিয়ে গেলাম দোকানে। মদনদা কিছু না জিজ্ঞেস করে সোজা এক কাপ গরম চা এগিয়ে দিলেন। বললেন—
“চা যেমন কষায় দিয়ে শুরু হয়, শেষে তেমনি মিষ্টি হয়ে যায়। জীবনের কষ্টও একদিন এমনিই মিষ্টি হয়ে উঠবে।”
সঞ্জয় হয়তো পুরোপুরি ভুলতে পারেনি, কিন্তু সেদিন তার কান্না হাসিতে বদলে গিয়েছিল।
সন্ধ্যার আলো-আঁধারি
সন্ধ্যা নামলেই দোকানের রূপ বদলে যেত। ল্যাম্পের আলোয় ধোঁয়াটে আবহাওয়া, চারপাশে ঝিঁঝিঁর ডাক, আর কাপে কাপে চায়ের টুংটাং শব্দ। আমরা তখন কৈশোরের ঝড়ো সময়ে, কিন্তু এই ঠেক যেন আমাদের আবেগের নিরাপদ আশ্রয়।
কখনো পরীক্ষার ভয় নিয়ে আলোচনা, কখনো ক্রিকেট ম্যাচের বাজি, কখনো আবার ভবিষ্যতের স্বপ্ন—সব কিছুই জমত এই দোকানে।
মদনের ধৈর্য
মদনদা ছিলেন আশ্চর্য ধৈর্যশীল মানুষ। সারাদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেও কখনো ক্লান্তির কথা মুখে আনতেন না।
কেউ ঝগড়া করলে তিনি শান্ত গলায় বলতেন—
“চা খাওয়ার জায়গায় ঝগড়া মানায় না।”
কেউ মন খারাপ করলে তিনি গল্প শোনাতেন নিজের শৈশবের।
আমরা তখনো বুঝতে পারিনি, কী অমূল্য শিক্ষক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন
কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিতে দিতে আমরা অনেকেই পড়াশোনার জন্য শহরে চলে গেলাম। কিন্তু ছুটি পেলেই ফিরে আসতাম গ্রামে, আর প্রথমেই ছুটতাম মদনের চায়ের ঠেকে। দোকানটা যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকত।
নতুন বেঞ্চি যোগ হয়েছে, দোকানের পাশে ছোট্ট ছাউনি, কখনো লাউগাছের মাচা। কিন্তু গন্ধটা একই—চায়ের। আর সেই গন্ধেই ফিরে আসত আমাদের সমস্ত স্মৃতি।
যৌবনের দিনগুলো, গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া আর ফেরা
কৈশোর পেরিয়ে আমরা ধীরে ধীরে যৌবনে পা দিলাম। গ্রাম যেন আর আমাদের আটকে রাখতে পারছিল না। কেউ কলেজে পড়তে শহরে চলে গেল, কেউবা চাকরির খোঁজে দূরে। আমি নিজেও ভর্তি হলাম শহরের এক কলেজে। মনে হচ্ছিল, নতুন পৃথিবী, নতুন স্বপ্ন—সবকিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
কিন্তু শহরের ভিড়, কোলাহল, অচেনা মুখ—এসবের মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ত গ্রামের সেই মোড়, মাটির গন্ধ, আর অবশ্যই মদনের চায়ের ঠেক।
শহরের নিঃসঙ্গতা
শহরে প্রথম দিকে কেমন যেন একাকিত্বে ভুগতাম। ব্যস্ত রাস্তা, অচেনা ভিড়, গাড়ির হর্ন—সব কেমন ঠান্ডা লাগত। কলেজের বন্ধুরা ছিল, কিন্তু তবুও মনে হতো কিছু একটা নেই।
ক্যাফের কাপে চা খেতাম, কিন্তু সেসব চায়ে মদনদার হাতের সেই গন্ধ কোথায়! না ছিল বাঁশের বেঞ্চি, না ছিল গল্পের আসর। মনে হতো, এক কাপ চা খাওয়ার সঙ্গে যে হৃদয়ের টান মিশে থাকে, তা শুধু মদনের ঠেকেই পাওয়া যায়।
ছুটিতে ফেরা
প্রথম ছুটিতে গ্রামে ফিরেই সোজা ছুটলাম মদনের ঠেকে। কতটা সময় কেটে গেছে, তবুও জায়গাটা যেন ঠিক একই রকম। শুধু নতুন একটা কেতলি আর মাটির গ্লাস এসেছে।
মদনদা আমাকে দেখে হেসে বললেন—
“কী রে, শহুরে ছেলে, ভুলে গেলি না তো?”
আমি হেসে মাথা নাড়লাম। গরম চা হাতে পেয়ে মনে হল, এটাই জীবনের আসল স্বাদ। শহরের কফি শপে যতই দামি কাপ থাকুক না কেন, মাটির গ্লাসে মদনের চা-ই আসল আনন্দ।
পুরোনো বন্ধুদের আসর
আমাদের ব্যাচের অনেকেই তখন পড়াশোনা বা চাকরির কারণে বাইরে চলে গেছে। ছুটি এলেই সবাই আবার একত্র হই মদনের দোকানে।
কে কোথায় পড়ছে, কার চাকরি কোথায়, কার প্রেম কোথায় গড়াল—সব খবর জমে উঠত ওই দোকানেই।
কেউ মজা করে বলত—
“এই দোকানটাই আমাদের অফিস, কলেজ আর সংসদ একসাথে।”
মদনদা তখন ব্যস্ত কেতলি হাতে। তবুও হাসতে হাসতে আমাদের কথায় যোগ দিতেন।
দূরে চলে যাওয়া
সময় যত গড়াল, আমরা সবাই আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কেউ বিদেশে চাকরি পেল, কেউ আবার শহরে সংসার গড়ল। মদনের ঠেক যেন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল।
তবুও যখনই ছুটি পেতাম, ফিরে আসতাম। মনে হতো, এই জায়গাটা না থাকলে আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ হারিয়ে যেত।
একবার বিদেশ থেকে ফেরা এক বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম মদনের দোকানে। সে অবাক হয়ে বলেছিল—
“এত সাদামাটা দোকান, অথচ এত প্রাণ! এরকম জায়গা তো বিদেশে নেই।”
তখন মনে হল, আমরা যাকে সাধারণ ভেবেছি, সেটাই আসলে অসাধারণ।
সন্ধ্যার আড্ডা
যৌবনের দিনগুলোতে সন্ধ্যাবেলার আড্ডাই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে স্মরণীয়।
- কেউ চাকরির টেনশন শেয়ার করত।
- কেউ প্রেমের গল্প বলত।
- কেউ আবার স্বপ্নের পরিকল্পনা করত—কোনো একদিন বড় কিছু করার।
আর মদনদা শুনতেন মন দিয়ে। মাঝেমাঝে বলতেন—
“দেখো বাবারা, মানুষের জীবন যতই দূরে যাক, চায়ের মতোই আসল গন্ধটা ফেলে যেও না।”
কথাটা তখন তেমন গুরুত্ব দিয়ে শুনিনি, কিন্তু আজ বুঝি—তিনি আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় উপদেশ দিয়েছিলেন।
স্মৃতির বাঁধন
যৌবনে আমরা যতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, মদনের ঠেক ততই স্মৃতির বাঁধনে জড়িয়ে গেছে। শহরে বসে থাকলেও মনে হতো, সন্ধ্যা নামলেই গ্রামের মোড়ে ল্যাম্প জ্বলছে, তাসের আসর বসছে, আর মদনদার কেতলি থেকে ধোঁয়া উঠছে।
কোনো দুঃখে, কোনো আনন্দে মনে পড়ত সেই দোকান। যেন আমাদের গ্রাম, আমাদের কৈশোর আর যৌবনের সমস্ত গল্প ওই ঠেকেই জমা হয়ে আছে।
বর্তমান সময়, ৩৫ বছরের পথচলা আর নস্টালজিয়ার পরিণতি
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভাবলে মনে হয়, সময় কত দ্রুত বদলে গেছে! গ্রামের মোড়ে সেই বাঁশের দোকানটা এখনো আছে, তবে চারপাশ পাল্টে গেছে অনেক। পাকা রাস্তা হয়েছে, পাশেই দাঁড়িয়ে গেছে কয়েকটা নতুন দোকান। মোবাইলের আলো আর বাইকের হর্নে গ্রাম যেন অনেক বেশি আধুনিক হয়ে উঠেছে।
তবুও “মদনের চায়ের ঠেক” ঠিক একই রকম আছে—
একই গন্ধ, একই উষ্ণতা, আর একই অক্লান্ত মানুষ—মদনদা।
ভোরের শুরু, রাতের শেষ
আজও ভোর চারটেয় দোকান খোলেন তিনি। কাক ডাকতে না ডাকতেই মাটির কেতলিতে জল বসে যায়। রোজই চা, বিস্কুট, কখনো সমোসা, কখনো ঝালমুড়ি। দোকান খোলা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত একটানা পরিশ্রম—কোনোদিন ক্লান্তির ছাপ মুখে ফুটতে দেখিনি।
গ্রামের সবাই বলে—
“মদনের ঠেক যদি একদিন না খোলে, গ্রামটা যেন নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না।”
বিকেলের তাসের আড্ডা আজও জমে
সময় পাল্টেছে, কিন্তু বিকেলের তাসের আসর এখনো জমে ওঠে। শুধু বদলেছে অংশগ্রহণকারীরা। যারা একসময় খেলত, তারা এখন বয়সে নুইয়ে পড়েছে। তাদের জায়গায় এসেছে নতুন প্রজন্ম। তবুও খেলার নিয়ম এক—হারলে এক কাপ চা খাওয়াতে হবে!
মদনদা এখনো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন পাশে। মাঝে মাঝে মজা করে বলেন—
“এই ঠেকটা তোদের দাদুদেরও দেখেছে, বাবাদেরও দেখেছে, এখন তোদেরও দেখছে। এভাবেই চলবে।”
বাচ্চাদের নতুন দুনিয়া
দোকানের পাশে এখনো বাচ্চারা ভিড় জমায়। তবে লুডো বা কাগজ ভাঁজ করার দিন শেষ। এখন সবাই মোবাইল গেম নিয়ে ব্যস্ত।
একজন খেলছে, বাকিরা চারপাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছে।
মদনদা মাঝে মাঝে চোখ পাকান—
“এই সব গেমে আর কিসের মজা? আমাদের সময়ে ঘুড়ি ওড়ানোই ছিল আসল খেলা।”
তবুও তিনি চায়ের কাপে গরম দুধ ঢেলে দেন, কারণ জানেন, সময় বদলায়, কিন্তু বাচ্চাদের হাসি বদলায় না।
মন খারাপের ভরসা
আজও কেউ মন খারাপ করলে ছুটে আসে মদনের ঠেকেই। কারও ফসল নষ্ট হয়েছে, কারও সংসারে ঝগড়া, কেউ আবার শহরে গিয়ে ফিরে এসেছে ব্যর্থ হয়ে—সবাই এসে বসে এখানে।
মদনদা তখন কেতলির ঢাকনা খুলে দেন, গরম ধোঁয়া ওঠা চা এগিয়ে দেন, আর বলেন—
“দেখো দাদা, এই চায়ের মতো জীবনও ফুটতে থাকে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়।”
এই সহজ কথাতেই কত মন হালকা হয়ে যায়!
৩৫ বছরের স্মৃতি
এখন দোকানটার বয়স পঁইত্রিশ বছর। কত আনন্দ, কত কান্না, কত বন্ধুত্ব, কত বিদায়—সব জমে আছে এই ছোট্ট জায়গাটায়।
- কারও প্রেমের শুরু হয়েছিল এখানে।
- কারও পরীক্ষার সাফল্য প্রথম ঘোষণা হয়েছিল এখানে।
- কারও শোকের কান্না মিশেছিল চায়ের ধোঁয়ায়।
আমাদের জীবনের প্রতিটি বাঁকেই এই ঠেক কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে।
মদনদা – অক্লান্ত পথিক
মদনদার চুল এখন পেকে গেছে, চোখের কোণে ভাঁজ পড়েছে। কিন্তু হাসিটা একেবারে আগের মতোই। ভোর থেকে রাত অবধি তিনি এখনও একই উৎসাহে দোকান চালান।
আমরা যখনই গ্রামে ফিরি, প্রথমেই ছুটে যাই তার দোকানে। গরম চা হাতে নিতে না নিতেই মনে হয়—এই তো, আমরা আবার শৈশবে ফিরে গেছি।
একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম—
“মদনদা, এত পরিশ্রমে ক্লান্ত লাগে না?”
তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন—
“ক্লান্তি যদি থাকত, তবে তো এই দোকান টিকত না। এই ঠেকই তো আমার জীবন।”
নস্টালজিয়ার শেষ পরিণতি
আজ শহরে, বিদেশে ছড়িয়ে থাকা আমাদের ব্যাচের বন্ধুরা যখন একত্র হয়, তখন গল্পের শুরুই হয় মদনের চায়ের ঠেক দিয়ে। কেউ বলে—“ওখানেই তো আমাদের বন্ধুত্ব জন্মেছিল।” কেউ বলে—“আমার প্রথম প্রেমের কথা বলেছিলাম ওই বেঞ্চিতেই।”
আমাদের কাছে এই ঠেক শুধু দোকান নয়—এটা আমাদের জীবনের জাদুঘর, যেখানে সাজানো আছে প্রতিটি স্মৃতি।
মদনের চায়ের ঠেক ৩৫ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে সময়ের স্রোতের মধ্যে, গ্রামকে বেঁধে রেখেছে এক অদ্ভুত মায়ায়। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলা মদনের অক্লান্ত পরিশ্রম, তার সহজ-সরল কথা, আর এক কাপ গরম চায়ের উষ্ণতা আজও মানুষকে একত্র করে।
আমাদের জীবনের কত উত্থান-পতন হয়েছে, কিন্তু এই ঠেক সবসময়ই থেকেছে স্থির, আশ্রয়ের মতো।
হয়তো একদিন দোকানটা আর থাকবে না, হয়তো মদনদাও থাকবেন না, কিন্তু এই ঠেকের গন্ধ, হাসি আর স্মৃতি চিরকাল রয়ে যাবে আমাদের হৃদয়ে।