লুকোচুরি আর লাট্টু
শৈশবের উঠোন
গ্রীষ্মের দুপুর। সূর্য তখন মাথার ওপরে, অথচ গ্রামের পুকুরপাড়ে, তালগাছের ছায়ায় কিংবা কোনো উঠোনে শিশুদের কলতান যেন রোদের উত্তাপকে ভুলিয়ে দেয়।
পাড়ার প্রতিটা দুপুরই যেন এক উৎসব, আর সেই উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো খেলা।
অর্ক তখন মাত্র বারো বছরের ছেলে। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলাতেই তার আগ্রহ বেশি। সকালে মায়ের বকুনি খেয়ে পড়তে বসলেও, দুপুরের দিকে ঘড়ি তাকিয়ে ওঠে—কারণ সেই সময়ই পাড়ার সব বন্ধু একে একে চলে আসে তাদের বাড়ির উঠোনে।
মাটির উঠোন, মাঝখানে আমগাছের ছায়া—সেটাই তাদের খেলার ময়দান।
অর্কের সবচেয়ে কাছের বন্ধু মিতা। সে প্রায়ই নতুন কোনো খেলার আয়োজন করে। সেদিনও মিতার হাতে একটা নতুন লাট্টু। কাঠের তৈরি, গায়ে রঙ করা। সবার সামনে গর্বভরে লাট্টু ঘোরাতে গিয়ে বলে উঠল,
—“আজ দেখবি, আমার লাট্টু-ই সবার থেকে বেশি সময় ঘুরবে।”
অর্ক হেসে জবাব দিল—
—“দেখি, কে জেতে! আমি তোকে হারাবোই।”
এরপর শুরু হলো খেলা। উঠোনজুড়ে টুংটাং শব্দে লাট্টু নাচতে থাকল। কারো লাট্টু মাটিতে পড়ে থেমে গেল, কেউ আবার সঠিকভাবে ঘুরাতে পারল না। অর্কের লাট্টু দ্রুত ঘুরতে ঘুরতে বৃত্ত আঁকছে, আর মিতার লাট্টু যেন নাচতে নাচতে আলো ছড়াচ্ছে।
দু’জনের চোখে তখন প্রতিযোগিতার ঝিলিক, কিন্তু মনের গভীরে লুকানো আনন্দই আসল খেলার সুর।
খেলা শেষ হলে জয়-পরাজয়ের হিসেব থাকলেও, হাসির কলরব ঢেকে দেয় সব। পাশের গাছে কাক ডাকছে, দূরে কারো রেডিওতে বাজছে পুরোনো বাংলা সিনেমার গান, আর বাতাসে ভেসে আসছে আমের গন্ধ।
এই সবকিছু মিলিয়েই শৈশবের উঠোন যেন হয়ে ওঠে এক রঙিন পৃথিবী।
সন্ধ্যা নামতে না নামতেই পাড়ার সবাই ডাকতে শুরু করে—
“খেলা শেষ কর, বাড়ি আয়!”
কিন্তু অর্ক আর মিতা তখনও উঠোনে দাঁড়িয়ে।
অর্ক বলল—
—“আগামীকাল লুকোচুরি খেলব, কেমন?”
মিতা চোখ মুছে হেসে মাথা নেড়ে বলল—
—“হ্যাঁ, ঠিক আছে।”
আকাশে তখন জোনাকির আলো জ্বলে উঠেছে। খেলার দিন শেষ হলেও অর্ক আর মিতার মনে শৈশবের উঠোনের গল্প তখনই নতুন করে শুরু হলো।
“শৈশবের খেলা হয়তো শেষ হয় সূর্য ডোবার সঙ্গে, কিন্তু সেই হাসির প্রতিধ্বনি থেকে যায় সারাজীবন।”
বন্ধুত্বের রঙ
গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলো যেন থামতেই চাইছিল না। প্রতিদিন দুপুরবেলা অর্ক আর মিতার সঙ্গে পাড়ার বাকি বন্ধুরা মিলে খেলায় মেতে ওঠে। লাট্টু, মার্বেল, কিতকিত, লুকোচুরি—কোনো দিনই খেলার তালিকায় ফাঁক থাকত না।
তবু অর্ক আর মিতার সম্পর্ক যেন অন্যরকম।
খেলার ফাঁকে, প্রতিযোগিতার ভিড়েও তারা একে অপরের দিকে তাকালে চোখে পড়ত অন্যরকম মায়া।
স্কুলের দিনগুলো
অর্ক আর মিতা একই স্কুলে পড়ে। সকালের দিকটা বই-খাতার ভিড়ে কাটলেও দুপুর গড়াতেই তাদের মন ছুটে যায় খেলার মাঠে।
স্কুলের ক্লাসে মিতা প্রায়ই খাতার কোণে আঁকিবুঁকি করে। কখনো ফুল আঁকে, কখনো লিখে রাখে দু’একটা লাইন—
“বড় হলে কী হব জানি না, তবে খেলা যেন শেষ না হয়।”
অর্ক সেটা দেখে হেসে ফিসফিস করে বলে—
—“তুই ডাক্তার হবি, আমি মাস্টার হব, তারপরও খেলা চলবেই।”
শিক্ষকের বকুনি সত্ত্বেও তাদের খুনসুটি থামে না।
🎶 ছোট ছোট আনন্দ
বিকেলে পড়া শেষ হলে মিতা অনেক সময় অর্কের বাড়িতে আসে। অর্কের পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজে—কুমার শানু বা লতা মঙ্গেশকরের সুর। দু’জন মিলে চুপচাপ গান শোনে, কখনো হাসে, কখনো আবার গানের কথার সঙ্গে নিজেদের স্বপ্ন মেলাতে থাকে।
বর্ষার দিনে তারা পুকুরপাড়ে কাগজের নৌকা ভাসায়। নৌকার গায়ে রঙিন কাগজে নাম লেখা—“অর্ক” আর “মিতা”। ঢেউয়ে দুলতে থাকা নৌকার মতোই তাদের বন্ধুত্ব দুলতে দুলতে আরও গভীর হতে থাকে।
গোপন চিঠি
মোবাইল ফোন তখনো আসেনি। তাই কথা জমে থাকত কাগজের টুকরোয় লেখা ছোট্ট চিঠিতে। কখনো “আগামীকাল স্কুলে কতটা বাজে আসবি?”—এমন প্রশ্ন, কখনো বা “আজকের খেলা মনে থাকবে তো?”—এমন সরল অনুভূতি।
অর্ক সেই চিঠিগুলো খাতার ভাঁজে লুকিয়ে রাখে।
মিতা চিঠি দিয়ে মুচকি হেসে দৌড়ে পালায়, আর অর্ক সেটাই সারাদিন ভেবে যায়।
রঙিন সন্ধ্যা
দিনের শেষে খেলায় যতই ভিড় হোক, সন্ধ্যা নামার সময় উঠোন ফাঁকা হয়ে গেলে অর্ক আর মিতা অনেক সময় চুপচাপ বসে থাকে। আমগাছের ডালে পাখিরা বাসায় ফেরে, বাতাসে ধানের গন্ধ ভেসে আসে।
অর্ক মিতাকে হঠাৎ বলে ফেলে—
—“তুই আমার সেরা বন্ধু।”
মিতা হেসে জবাব দেয়—
—“তুই-ও।”
শব্দগুলো ছোট, কিন্তু সেই ছোট্ট স্বীকারোক্তিতেই বন্ধুত্বের রঙ আরও গাঢ় হয়ে ওঠে।
“শৈশবের বন্ধুত্ব যেন রঙতুলি দিয়ে আঁকা ছবির মতো—রঙ মুছে গেলেও তার ছাপ থেকে যায় চিরকাল।”
চিঠির খামে লেখা গোপন কথা
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা এসে গেছে। গ্রামের মেঠোপথ কাদায় ভরে উঠেছে, মাঠে ফুটেছে শাপলা ফুল। বৃষ্টির ফোঁটায় পুকুরের জল যেন ঝিকমিক করে ওঠে।
এই ভেজা ঋতুতেও অর্ক আর মিতার খেলা থেমে নেই। তবে এবার খেলায় যোগ হয়েছে অন্য এক রঙ—চিঠি লেখার রঙ।
প্রথম চিঠি
স্কুলে একদিন বিরতিতে মিতা কাগজ ছিঁড়ে ছোট্ট কিছু লিখল। চিঠি অর্কের খাতার ভেতরে গুঁজে দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল।
অর্ক অবাক হয়ে খুলে দেখল—
“আগামীকাল স্কুল শেষে পুকুরপাড়ে আসিস। তোকে একটা নতুন গল্প শোনাবো।”
অর্কের চোখে হাসি খেলে গেল। সেই প্রথম, তাদের মধ্যে এমন গোপন বার্তার শুরু।
অর্কের প্রতিক্রিয়া
অর্কও ঠিক করল চিঠির জবাব দেবে। সেদিন রাতে খাতার ভাঁজে লুকিয়ে লিখল—
“আমি আসব। তবে শর্ত, গল্পটা লম্বা হতে হবে। না হলে রাগ করব।”
চিঠি পৌঁছে দেওয়ার সময় অর্কের বুকের ভেতর কেমন অচেনা ধকধকানির শব্দ হয়।
পুকুরপাড়ের গল্প
পরদিন বিকেলে দু’জন পুকুরপাড়ে বসে। মিতার হাতে ছোট্ট খাতা। সে নিজের লেখা গল্প পড়ে শোনায়—দুই বন্ধুর গল্প, যারা সবসময় একে অপরের পাশে থাকে।
অর্ক মুগ্ধ হয়ে শোনে। গল্প শেষ হলে বলে—
—“তুই তো একদিন লেখক হবি।”
মিতা মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে—
—“তুই থাকলে-ই পারব।”
সেই মুহূর্তে আকাশে নামল হালকা বৃষ্টি। তারা ছাতাহীন ভিজতে ভিজতেই দৌড়ে বাড়ি ফিরল, কিন্তু ভিজে ওঠা খাতায় মিতার গল্পের অক্ষরগুলো যেন অর্কের মনে চিরকালের জন্য আঁকা হয়ে গেল।
🌸 চিঠির ভেতরের আবেগ
দিন যত এগোতে থাকে, চিঠিগুলোও বদলাতে শুরু করে। এখন আর শুধু গল্প বা সময় জানানোর জন্য নয়, ছোট্ট ছোট্ট কচি আবেগ ঢুকে পড়ে সেই পাতায়—
“আজ তোকে খুব মিস করেছি।”
“তুই না থাকলে খেলা ফিকে লাগে।”
অর্ক বুঝতে শুরু করে, এই চিঠির খামগুলোয় শুধু শব্দ নেই, আছে তার নিজের অজানা এক অনুভূতি, যার নাম হয়তো তখনো সে জানে না।
“চিঠির পাতায় লেখা শব্দগুলো শুকিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আবেগ কখনোই শুকোয় না।”
বিদায়ের দিন
শীতের শেষভাগ। বাতাসে তখন বসন্তের আভাস, কাশফুলের দোলা, শিমুল ফুলের লাল ছটা। কিন্তু সেই আনন্দঘন সময়ে হঠাৎই অর্কের জীবনে নেমে এল এক অপ্রত্যাশিত ঝড়।
বদলির খবর
একদিন মিতার বাড়ির উঠোনে ভিড় জমেছে। মিতার বাবা সরকারি চাকরিজীবী, হঠাৎই তার বদলির চিঠি এসেছে। এবার অন্য জেলায় যেতে হবে—আরও দূরে, অনেক দূরে।
খবরটা যেন সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ার লোকজন মিতার পরিবারকে ঘিরে দুঃখ প্রকাশ করছে।
অর্ক দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। তার বুক কেঁপে উঠল—
“তাহলে মিতা যাচ্ছে? তবে কি কাল থেকে খেলায় আর মিতা থাকবে না?”
💔 বিদায়ের আগের দিন
সেই রাতে অর্ক ঘুমোতে পারল না। খাতার ভেতরে লুকানো মিতার লেখা পুরোনো চিঠিগুলো একে একে বের করে আনল। প্রতিটি শব্দ যেন বুকের ভেতর আরও গভীর ব্যথা হয়ে বাজতে লাগল।
সে লিখতে বসল নতুন এক চিঠি—
“তুই চলে যাচ্ছিস, তাও কি আমাদের খেলা শেষ হয়ে যাবে? মনে রাখিস, আমি তোর সেরা বন্ধু, কখনো ভুলবি না।”
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই চিঠি মিতাকে আর দিতে পারল না।
🪁 শেষ খেলা
বিদায়ের দিন সকালে পাড়ার সব বন্ধু মিতার সঙ্গে শেষবার খেলার জন্য জড়ো হলো। সবাই বলল—লুকোচুরি খেলতে হবে।
অর্ক গণনা শুরু করল—
“এক… দুই… তিন… চোখ বুজে গুনছি আমি…”
সবাই দৌড়ে লুকিয়ে পড়ল। মিতাও দৌড় দিল, তবে সে জানত এটাই শেষ খেলা।
অর্ক চোখ খুলে খুঁজতে শুরু করল। একে একে সবাইকে পেয়ে গেল, শুধু মিতাকে পেল না। উঠোন, বাগান, গাছতলায়—সব খুঁজেও মিতা নেই।

হঠাৎ রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে—মিতারা গাড়িতে উঠছে। সে হাত নাড়ল, ডাকল,
“মিতা…! খেলাটা তো শেষ হলো না…!”
কিন্তু গাড়ি ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল। লুকোচুরি আর লাট্টুর সঙ্গী মিতার শেষ লুকোনো জায়গা হয়ে রইল দূরত্বের আড়াল।
সন্ধ্যায় খেলার উঠোন ফাঁকা পড়ে থাকে। অর্ক একা বসে থাকে আমগাছের তলায়। মিতার হাসির শব্দ, খেলার দৌড়ঝাঁপ, সব যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
সে মনে মনে ভাবে—
“হয়তো খেলা শেষ হলো, কিন্তু বন্ধুত্বের রঙ মুছে যাবে না কোনোদিন।”
“শৈশবের খেলা থেমে যায় বিদায়ের সীমানায়, কিন্তু অসমাপ্ত লুকোচুরি থেকে যায় হৃদয়ের গভীরে।”
প্রাপ্তবয়স্ক অর্ক
বহু বছর কেটে গেছে।
অর্ক এখন আর সেই বারো বছরের খেলার দুষ্টু ছেলে নেই। চাকরি করছে শহরে, ব্যস্ততা আর দৌড়ঝাঁপের ভিড়ে সময় যেন কোথাও থেমে থাকে না। তবুও তার ভেতরের একটা অংশ আজও সেই শৈশবের উঠোনে আটকে আছে।
এক শীতের রাতে অফিস থেকে ফিরে অর্ক হঠাৎই পুরোনো আলমারি ঘাঁটছিল। এক কোণে বহুদিনের ভুলে যাওয়া স্কুলের খাতা পেল। খাতার পাতার ভেতরে চাপা পড়ে ছিল কাগজের টুকরো, আর সেগুলো খুলতেই বেরিয়ে এলো মিতার লেখা চিঠি।
“আজ তোকে খুব মিস করেছি…”
“আগামীকাল খেলতে আসিস…”
অর্কের বুক হু হু করে উঠল। সময়ের স্রোত তার জীবনে অনেক কিছু বদলেছে, কিন্তু চিঠির পাতায় লেখা শব্দগুলো যেন এখনও টাটকা, ঠিক যেমন ছিল সেই ৯০ দশকের দুপুরে।
পরের দিন ছুটির দিনে অর্ক হেঁটে চলে গেল সেই পুরোনো গ্রামে। উঠোনটা আর নেই, আমগাছটা কেটে ফেলা হয়েছে। পাড়ার খেলার মাঠে এখন বাড়ি তৈরি হয়েছে।
কিন্তু শিশুদের হাসির শব্দ এখনও ভেসে আসে। কয়েকজন বাচ্চা সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ মার্বেল খেলছে, আবার কারো হাতে লাট্টু ঘুরছে।

অর্ক হেসে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে। যেন সময় তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই দুপুরে—যখন মিতা নতুন লাট্টু নিয়ে বলেছিল, “আজ দেখবি, আমার লাট্টু-ই সবার থেকে বেশি ঘুরবে।”
🌙 অসমাপ্ত লুকোচুরি
আকাশে সন্ধ্যার আলো ম্লান হয়ে আসছে। অর্ক নিজের মনে ফিসফিস করে বলে—
“মিতা, তুই লুকিয়ে গেছিলি, আমি তোকে খুঁজে পাইনি। খেলাটা এখনো শেষ হয়নি।”
তার চোখে অশ্রু জমে ওঠে, কিন্তু ঠোঁটে হালকা হাসি খেলে যায়।
কারণ সে জানে—
কিছু খেলা কখনো শেষ হয় না। তারা শুধু মনে লুকিয়ে থাকে, এক চিরন্তন শৈশবের মতো।
“প্রেম নয়, বন্ধুত্ব নয়—শৈশবের স্মৃতিই মানুষের জীবনের দীর্ঘতম খেলা; যার শেষ লুকোচুরির মতোই চিরকাল অসম্পূর্ণ।”