যদি এমন হতো—
যদি সময়টা আবার ফিরিয়ে নেওয়া যেত !!!!!
প্রথম দিনের কচি সম্পর্ক
সকালবেলার রোদ তখনও পুরোপুরি উঠেনি। স্কুলের মাঠে শিশির ভেজা ঘাস ঝিলমিল করছে। ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই টিফিন বক্স হাতে তাড়াহুড়ো করে স্কুলে ঢুকল অনন্যা। তার চশমার কাঁচে কুয়াশার হালকা আবরণ জমে আছে, কপালে ঝুলে থাকা চুলে শিশির বিন্দুর ঝিলিক।
ঠিক তখনই হেঁটে আসছিল অরিজিত—হাতে নতুন কেনা ঝকঝকে কলম। তাড়াহুড়ো করে দৌড় দিতে গিয়ে অনন্যাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল কলমটা মাটিতে।
— “এই! চোখে দেখে হাঁটতে পারো না নাকি?” – অনন্যার কণ্ঠে বিরক্তি, কপালে ভাঁজ।
— “তুমিই তো হুট করে সামনে এলে। দেখো না, আমার নতুন কলমে মাটি লেগে গেল!” – অরিজিত মুখ বাঁকিয়ে বলল।
অনন্যা ঠোঁট কামড়ে রাগ চেপে রাখল। বুকের ভেতর যেন ছোট্ট ঝড় উঠেছে। কিন্তু তবু চোখের কোণে একরকম কৌতূহল লুকিয়ে রইল। অরিজিতও কলম মুছতে মুছতে চোরাগোপ্তা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল অনন্যার দিকে।
সেদিন থেকেই শুরু হল তাদের কচি সম্পর্ক—
না, তখন সেটা প্রেম নয়।
কেবল ঝগড়া, খুনসুটি, অভিমান আর না বলা টান।
ক্লাসে খাতার পাতা নিয়ে টানাটানি, টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া, লাইব্রেরিতে বই নিতে গিয়ে একই বই ধরতে চাওয়া—সবকিছুতেই তাদের অদ্ভুত এক জটিল মিষ্টি টান তৈরি হল।
এখনও কেউ কাউকে কিছু বলেনি, তবু অদৃশ্য এক সুতোয় বাঁধা পড়তে শুরু করেছে দুই কিশোর হৃদয়।
অভিমান আর না বলা ভালোবাসা
দিন যায়, মাস ঘুরে যায়।
অনন্যা আর অরিজিতের সম্পর্কটা যেন স্কুলের প্রতিটি দেয়ালে অদৃশ্য অক্ষরে লেখা হয়ে যায়—
কেউ বলে না, তবু সবাই বুঝে।
ক্লাসে বসার সময় অনন্যার চোখ হঠাৎ করেই চলে যায় অরিজিতের খাতার দিকে।
যখনই সে অঙ্কে ভুল করে, অরিজিত খাতায় লাল কালি দিয়ে ছোট্ট করে লিখে দেয়— “মনোযোগ দাও।”
অনন্যা রাগ করে খাতা বন্ধ করে দেয়, তবু তার ভেতরে এক মায়াবী উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।
একদিন টিফিনে ঝগড়া লেগে গেল।
অনন্যা তার চকোলেট ভাগ করে দিল সবার সঙ্গে, কিন্তু অরিজিতকে দিল না।
অরিজিত ঠোঁট কামড়ে চুপচাপ ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।
অনন্যার বুকের ভেতর কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করল, তবু সে মুখে কিছু বলল না।

সে রাতে অনন্যা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় ভিজে ভাবল—
“কেন যেন ওর রাগটা আমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ? ও হাসলে আমার বুক ভরে যায়, অথচ রেগে গেলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় কেন?”
অন্যদিকে অরিজিতের ভেতরেও ঝড় বয়ে চলেছে।
সে ডায়েরির পাতায় লিখল—
“কেন আমি ওর কাছ থেকে এত প্রত্যাশা করি? অনন্যা আমাকে গুরুত্ব না দিলে বুকটা ভারী হয়ে যায়। বলতে পারি না, আবার না বললেও সহ্য হয় না।”
অভিমান জমতে জমতে একদিন মেঘ হয়ে দাঁড়াল।
অনন্যা পরীক্ষায় কম নম্বর পেল। অরিজিত চেয়েছিল পাশে বসে তাকে সাহায্য করতে, কিন্তু অনন্যা ভুল বুঝল। সে ভেবেছিল, অরিজিত তাকে “অযোগ্য” প্রমাণ করতে চাইছে।
চোখ ভিজে উঠল অনন্যার। রাগে-অভিমানে সে ফিসফিস করে বলল—
— “আমার জীবনে আর আসবে না।”
অরিজিত বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতরটা হঠাৎ খালি হয়ে গেল।
সে বুঝল, না বলা ভালোবাসা কখনও কখনও তলোয়ারের মতো আঘাত করে।
সেদিন দুজনের চোখেই জল এল।
কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে বলেনি—
“থেমে যা, আমি আসলে তোকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
তাদের কচি সম্পর্কের উপর অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি হল—
যেটা নাম অভিমান।
বিচ্ছেদ আর হারানোর বেদনা
অভিমানের দেয়ালটা যেন দিনে দিনে উঁচু হতে লাগল।
অনন্যা আর অরিজিত দুজনেই একই ক্লাসে থাকলেও, তাদের মধ্যে দূরত্বটা কয়েক মাইলের থেকেও বড় হয়ে গেল।
একসময় যেখানে চোখে চোখ পড়লেই হাসি ফোটাত,
এখন সেখানে নীরবতা জমে থাকে।
অনন্যা চেয়েছিল, অরিজিত প্রথমে এসে কথা বলুক।
অরিজিতও ভেবেছিল, অনন্যাই এগিয়ে আসবে।
কিন্তু সেই না-বলা ভালোবাসা যেন এক জেদে পরিণত হল।
স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অরিজিত দৌড় জিতল।
সবার হাততালির মাঝে অনন্যার বুক কেঁপে উঠল।
সে চেয়েছিল গিয়ে প্রথমেই শুভেচ্ছা জানাতে,
কিন্তু ঠোঁট শক্ত করে চুপ করে রইল।
মনে মনে বলল— “আমাকে যদি সত্যিই গুরুত্ব দিত, তবে ও-ই তো এগিয়ে আসত।”
অন্যদিকে অরিজিত মঞ্চ থেকে নেমে অনন্যার দিকে তাকাল।
চোখে ভাসল শুধু একটাই ছবি—
অনন্যা তার সাফল্যে গর্বিত হয়ে হাসছে।
কিন্তু বাস্তবে পেল নিস্তব্ধতা।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল।
এরপর এল মাধ্যমিক পরীক্ষা।
দুজনের বইয়ের পাতায় সমীকরণ আর কবিতা থাকলেও,
ভেতরের সমীকরণগুলো একে অপরের অজানা থেকে গেল।
পরীক্ষার পর স্কুল বদলাল।
অনন্যা চলে গেল অন্য এক শহরে পড়তে।
শেষ দিনে ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে ওরা দুজনেই চেয়েছিল একে অপরকে কিছু বলতে।
কিন্তু ঠোঁট থেকে বেরোয়নি একটিও শব্দ।
অরিজিত মনে মনে বলল—
“তুই চলে যাচ্ছিস… অথচ আমি তোকে বলতেও পারলাম না,
আমার প্রতিটা লাইনে, প্রতিটা খাতায় শুধু তুই আছিস।”
অনন্যার বুক কেঁপে উঠল—
“শেষ দিনেও যদি একবার বলে দিতি, আমি হয়তো সব অভিমান ভুলে যেতাম।”
কিন্তু সেই সুযোগ আর এল না।
ট্রেনের হুইসেল বাজল,
অনন্যা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল—
অরিজিত দূরে দাঁড়িয়ে আছে,
চোখে অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে।
দূরে সরে যেতে সরে যেতে শহরের আলো ম্লান হয়ে এল,
কিন্তু বুকের ভেতরের আলো নিভল না।
ওরা দুজনেই বুঝল—
না-বলা ভালোবাসা, একবার হারালে আর ফিরে পাওয়া যায় না।
সেদিন থেকে শুরু হল হারানোর বেদনা।
সময়ের ফাঁকে ফেলে আসা স্মৃতি
সময় যে কীভাবে পাল্টে যায়, অনন্যা-অরিজিত দুজনেই তা বুঝতে পারল আলাদা পথে হাঁটার পর।
স্কুলের সেই সবুজ মাঠ, করিডরে জমে থাকা হাসি-ঠাট্টা, ছোটখাটো ঝগড়া—সবই রয়ে গেল স্মৃতির পাতায়।
অরিজিত কলেজে উঠল।
নতুন বন্ধু হলো, পড়াশোনার চাপও বাড়ল।
কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প-আড্ডার মাঝেও হঠাৎ করে মনে পড়ত—
ক্লাসে কারও কলম হারালে, ঝগড়া করতে করতে অনন্যার লাল হয়ে ওঠা মুখ।
প্রতিবার মনে হতো, “যদি সময়টা আবার ফিরে আসত… একবার যদি অভিমান ভাঙিয়ে নিতে পারতাম।”
রাতের নির্জনতায় পড়ার টেবিলের ওপর বই খোলা থাকত,
কিন্তু অক্ষরের বদলে চোখে ভেসে উঠত অনন্যার মুখ।
খাতার প্রান্তে অজান্তেই আঁকা হয়ে যেত সেই নাম—
অনন্যা।

অন্যদিকে অনন্যাও চেষ্টা করেছিল নতুন জীবন গড়ার।
নতুন শহর, নতুন স্কুল, নতুন মানুষ।
কিন্তু খাতার ভাঁজে লুকিয়ে থাকা অরিজিতের দেওয়া ছোট্ট একটি কাগজ—
যেখানে লেখা ছিল, “তুই রাগ করিস না, আমি তোকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না।”
সেটা যেন তার বুকের ভেতর অমোঘ কষ্ট হয়ে রয়ে গেল।
একদিন সন্ধ্যায় বন্ধুরা মিলে ছাদে বসে গল্প হচ্ছিল।
সবাই হেসে-খেলে ব্যস্ত, কিন্তু অনন্যার মনে পড়ল—
কীভাবে অরিজিত স্কুলের অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করত।
তার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ যেন হৃদয়ে বাজত।
অনন্যার চোখ ভিজে উঠল।
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”
সে শুধু মাথা নেড়ে বলল, “কিছু না… মনে পড়ল পুরোনো দিনের কথা।”
সময়ের স্রোত এগিয়ে চলে,
কিন্তু কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে বারবার,
যেন নদীর বুকে ভেসে থাকা শাপলা ফুল—
যাকে ডুবিয়েও ফেলা যায় না, ভুলিয়েও ফেলা যায় না।
বছরের পর বছর কেটে গেল।
অরিজিত বুঝতে পারল—জীবনে অনেক কিছুই পাওয়া যায়,
কিন্তু না-বলা ভালোবাসার আফসোস মুছে ফেলা যায় না।
অনন্যার মনেও একই যন্ত্রণা,
কিন্তু অভিমানের বাঁধনে আটকে থাকা অতীতের সেই অধ্যায়
আর কখনো উল্টে দেখা গেল না।
স্মৃতিগুলো হয়ে উঠল শুধু একটিই সত্য—
“ও ছিল, ও আছে, আর চিরকাল থাকবে,
যদিও আজ দুজন দুই পৃথিবীতে।”
ফিরে পাওয়া না-পাওয়ার আক্ষেপ
বছরের পর বছর কেটে গেছে।
অরিজিত এখন এক সফল চাকুরিজীবী।
চারপাশে যশ, সম্মান, আর আরাম—সবই আছে।
কিন্তু মনের গভীরে রয়ে গেছে এক শূন্যতা,
যা কোনো অর্জনেই পূর্ণ হয়নি।
কখনো রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে—
“অনন্যা এখন কোথায়? সুখে আছে তো?
আমাকে কি একটিবারও মনে পড়ে ওর?”
কিন্তু উত্তর মেলে না।
মেলে শুধু শূন্যতার প্রতিধ্বনি।
অন্যদিকে অনন্যা—
জীবনের চাপে, পরিবারের চাহিদায় বিয়ে হয়ে গেছে অন্যত্র।
স্বামী, সংসার, সন্তানের ব্যস্ততার ভিড়ে দিন কেটে যায়।
তবুও মাঝে মাঝে মনের কোণে
চুপিচুপি অরিজিতের নামটা বাজে।
আয়নায় চুলে সাদা রঙের রেখা দেখা দিলেও
মনে পড়ে স্কুলের সেই দিনগুলো—
যখন অভিমানে রাগ করে চুপ করে থাকলেও
হৃদয়ের গভীরে জমে উঠেছিল ভালোবাসা।
একদিন, এক অচেনা রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
বহু বছর পর, চোখে চোখ পড়ল।
কিন্তু দুজনের চোখেই ছিল এক অদ্ভুত নীরবতা।
অনেক কিছু বলার ছিল,
অগণিত প্রশ্ন, অভিমান, আর ভালোবাসার স্বীকারোক্তি—
কিন্তু ঠোঁটে শুধু একটুকু মৃদু হাসি এল।
অরিজিত মনে মনে বলল—
“যদি এমন হতো… সময়টা ফিরিয়ে নিতে পারতাম,
তাহলে প্রথম দিন থেকেই তোকে আঁকড়ে ধরতাম,
কোনো অভিমানকে আমাদের মাঝখানে আসতে দিতাম না।”
অনন্যার চোখে জল চিকচিক করল,
কিন্তু সে জানত—
এখন আর কিছুই বলা যাবে না।
সময় থেমে থাকে না,
ফিরে পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝেই
মানুষকে বাঁচতে হয়।

দুজনেই আলাদা পথে হাঁটা দিল।
কেউ কিছু বলল না,
তবুও মনের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হল একটাই কথা—
“আমরা দুজনেই একে অপরের ছিলাম,
কিন্তু সেই ‘ছিলাম’-টাই আজকের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।”
 এভাবেই গল্পটা শেষ হলো—
একটা স্কুলজীবনের অভিমান থেকে জন্ম নেওয়া প্রেম,
যা সময়ের কাছে হেরে গিয়ে চিরন্তন আক্ষেপে পরিণত হল।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			