"যেখানে বন্ধু থাকে"

যেখানে বন্ধু থাকে

শৈশব ও স্কুল জীবনের বন্ধুত্ব

স্কুলের প্রথম দিনটা ছিল উজ্জ্বল আর গোলাপি আলোয় ভরা। ক্লাসরুমে এক পাশে সারি সারি বেঞ্চ, সামনে সাদা বোর্ড আর ঘরের কোণে পড়ে থাকা বড় বড় বইয়ের তাক। ঋদ্ধি প্রথম দিনেই অচেনা মুখের ভিড়ে নিজেকে একা মনে করছিল। হঠাৎ, সামীর তার পাশে বসে। ছোট্ট হাসি আর বন্ধুত্বপূর্ণ স্বর—“হ্যালো, আমি সামীর। তুমি?”—ঋদ্ধি কিছুটা শান্ত অনুভব করল।

ছোট খাঁচার মতো প্রথম বেঞ্চে বসে তারা একে অপরকে দেখল। প্রথম দিনেই শুরুর সেই ছোট খোঁচা, বই ভাগাভাগি, একসাথে খেলা—সব মিলিয়ে তাদের বন্ধুত্বের বীজ বোনা শুরু হলো। দিনের শেষে, যখন সবাই বাসায় ফিরে যায়, ঋদ্ধি আর সামীর বসে গল্প করত স্কুলের ছোটখাটো দুঃখ-কষ্ট আর হাসি মজার মুহূর্তগুলো নিয়ে।

খেলা তাদের প্রিয় শখ। ফুটবল ময়দানে তারা একে অপরকে খুঁজে পেত। স্কুলের প্রতিটি খেলার সময় তারা ছিল একে অপরের শক্তি। পড়াশোনায়ও তারা একে অপরকে সাহায্য করত—কোনো সমস্যার সমাধান, গাণিতিক ধাঁধা বা ইতিহাসের তথ্য, সবই তারা ভাগাভাগি করত।

jekhane bandhu thake 3

দুষ্টুমিতে তারা ছিল একে অপরের সঙ্গী। হঠাৎ ক্লাসরুমে শিক্ষক যে কঠিন নিয়ম ঘোষণা করত, তখন তারা একসাথে হাসি হেসে তা অতিক্রম করত। কখনও কখনও ছোট ভুল বোঝাবুঝিও হতো, কিন্তু সে ভুলগুলো তাদের বন্ধুত্বকে দুর্বল করতে পারে না। বরং, সেই ভুলগুলোই শিখিয়েছিল—একজন সত্যিকারের বন্ধু মানে এমন একজন, যে সবসময় পাশে থাকে, চূড়ান্ত আনন্দ বা দুঃখে।

এই শৈশবের দিনগুলোই তাদের বন্ধুত্বের মাটি গড়ে তুলেছে। একে অপরের সঙ্গে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলো, গোপন হাসি, একসাথে করা দুষ্টুমি—সব মিলিয়ে একটি অদৃশ্য বন্ধনের সূচনা।
এই অধ্যায়ের শেষে বোঝা যায়, জীবন যতই জটিল হোক, ছোট্ট বন্ধুত্বের এই প্রথম ধাপই তাদের ভবিষ্যতের শক্তি হয়ে থাকবে।

কলেজ ও স্বপ্নের পথে

সময় যেন দ্রুত পাখা মেলল। স্কুলের বেঞ্চ থেকে কলেজের গেট পর্যন্ত আসতে আসতে ঋদ্ধি আর সামীরের বন্ধুত্ব আরও গভীর হলো। তবে এবার জীবন একটু বড়, স্বপ্নও বড়।

কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনেই দু’জনের চোখে আলাদা উচ্ছ্বাস। নতুন বই, নতুন মুখ, নতুন সুযোগ। কিন্তু তাদের ভেতরের বন্ধুত্ব একই রকমই রয়ে গেল—অটুট আর প্রাণবন্ত।

ঋদ্ধি তখন সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল মানুষের জন্য কিছু করার, সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। অন্যদিকে সামীর প্রযুক্তির জগতে নতুন কিছু করতে চেয়েছিল—কম্পিউটার, কোডিং, আর উদ্ভাবনের প্রতি তার এক অদ্ভুত টান ছিল।

কলেজ জীবনে ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেলেও তারা একে অপরকে প্রেরণা দিত। পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়াশোনা করা, ক্যান্টিনে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা করা, বা লাইব্রেরির কোণে গোপন পরিকল্পনা করা—সবকিছুর মাঝেই তাদের বন্ধুত্বের সুর বাজত।

তবে কলেজ মানেই শুধু পড়াশোনা নয়। প্রতিযোগিতা, নতুন বন্ধু, নানা দায়িত্ব—সবকিছুই তাদের জীবনে ঢুকে পড়ল। মাঝে মাঝে মনে হতো, হয়তো তারা ধীরে ধীরে আলাদা পথে হাঁটছে। কিন্তু এমন সময় এলে একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারা বুঝত—“তুই আছিস, মানেই আমি হারব না।”

একবার সামীর বড় এক প্রজেক্টে ব্যর্থ হয়ে ভেঙে পড়েছিল। সবাই সমালোচনা করছিল, কিন্তু ঋদ্ধি তার পাশে দাঁড়াল। আবার একসময় ঋদ্ধি সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিয়ে সমস্যায় পড়ল, তখন সামীর তাকে সাহস দিল। তাদের বন্ধুত্ব যেন জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় একে অপরকে সামলে রাখত।

এই অধ্যায়ে বোঝা যায়—কলেজের ভিড়, ব্যস্ততা, নতুন স্বপ্ন আর প্রতিযোগিতার মধ্যেও সত্যিকারের বন্ধুত্ব কখনও ম্লান হয় না। বরং স্বপ্নপূরণের পথে সেই বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় শক্তি।

সমস্যার মুখোমুখি

কলেজ জীবনের উজ্জ্বল আলো যতই আশার স্রোত বয়ে আনছিল, ঠিক ততটাই অন্ধকারও ছায়া ফেলতে শুরু করল। ঋদ্ধি হঠাৎ এমন এক পরিস্থিতিতে পড়ল, যেটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

একদিন কলেজের এক বড় অনুষ্ঠানে কিছু ঘটনা ঘটে গেল। ভুল বোঝাবুঝি, গুজব আর অন্যদের হিংসার কারণে সবাই ঋদ্ধিকে দোষারোপ করতে লাগল। বন্ধুদের অনেকেই দূরে সরে গেল, শিক্ষক পর্যন্ত তাকে কঠিন নজরে দেখতে লাগলেন। যাদের সঙ্গে প্রতিদিন হাসি-ঠাট্টা ভাগ করত, তারাই একে একে মুখ ফিরিয়ে নিল।

ঋদ্ধির পরিবারও পরিস্থিতি ভুল বুঝল। মায়ের চোখে কান্না, বাবার রাগ, আত্মীয়দের ফিসফাস—সব মিলিয়ে বাড়িটাও হয়ে উঠল অচেনা। হঠাৎ করেই সে অনুভব করল, যেন গোটা পৃথিবী তাকে একা করে দিয়েছে।

ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে থাকা ঋদ্ধির চোখে একসময় জল এসে ভরে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, জীবন যেন থমকে গেছে। কিন্তু সেই সময়ে, ঠিক তখনই, পাশে দাঁড়াল একমাত্র সামীর।

সামীর সবকিছু জানত। সে জানত ঋদ্ধি নির্দোষ, আর জানত এই পরিস্থিতি সামলানো সহজ নয়। সবাই যখন অভিযোগ তুলছিল, তখন সামীর বুক চিতিয়ে বলল—
“ঋদ্ধিকে আমি চিনি। সে কখনও ভুল করতে পারে না। তোমরা চাইলে আমাকে দোষ দাও, কিন্তু ওকে নয়।”

সামীরের এই সাহস ঋদ্ধিকে নতুন করে দাঁড়াবার শক্তি দিল। গুজব আর সমালোচনার জটলা ভেদ করে সামীর প্রতিদিন তার পাশে রইল। লাইব্রেরিতে পড়তে বসলে, রাতে ফোনে কথা বললে—প্রতিটি মুহূর্তে সামীর তাকে মনে করিয়ে দিল—
“বন্ধু, তুই একা নস। আমি আছি।”

ঋদ্ধি ধীরে ধীরে বুঝতে শিখল, সবার সমর্থন না পেলেও, একজন সত্যিকারের বন্ধু থাকলেই জীবন লড়াই করার শক্তি পায়।

এই অধ্যায়ে বোঝা যায়—যখন পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন একটিমাত্র সত্যিকারের বন্ধু-ই জীবনের সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে ওঠে।

দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি

সময় এগিয়ে চলল। কলেজ জীবন শেষ হতে না হতেই নতুন এক পথ খুলে গেল সামীরের সামনে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পেল সে। ছোটবেলা থেকে প্রযুক্তির জগতে কিছু করার স্বপ্ন দেখত, আর এবার সেই স্বপ্ন পূরণের দরজা খুলে গেছে।

খুশির মুহূর্ত হলেও ঋদ্ধির মনে হালকা শূন্যতা এসে ভর করল। এতদিন একসাথে পথচলা, প্রতিটি বাঁকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকা—হঠাৎ যেন সবকিছু ভেঙে যাবে। সামীর যাওয়ার আগে বলেছিল,
“দূরে থাকব ঠিকই, কিন্তু তোকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না। আমাদের বন্ধুত্ব কখনও দূরত্বে হারাবে না।”

কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা বেড়ে গেল, যোগাযোগ কমে গেল। ফোন বা বার্তায় কথা হলেও, আগের মতো আর গভীরতা থাকল না। ঋদ্ধির মনে সন্দেহ দানা বাঁধল—হয়তো সামীর ভুলে যাচ্ছে তাকে।

একদিন ঋদ্ধি সামাজিক মাধ্যমে দেখল সামীর নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তুলছে, হাসছে, আনন্দ করছে। সেই মুহূর্তে বুকের ভেতর একটা চাপা ব্যথা অনুভব করল। মনে হলো, তাদের বন্ধুত্ব কি তবে কেবল অতীতের গল্প?

অন্যদিকে সামীরও ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছিল। প্রতিদিন পড়াশোনা, নতুন পরিবেশের চাপ, প্রজেক্ট আর কাজের ব্যস্ততায় হয়তো সে আগের মতো সময় দিতে পারছিল না, কিন্তু বন্ধুত্ব নিয়ে তার বিশ্বাস এক বিন্দুও কমেনি। তবুও ঋদ্ধির নীরবতা তাকে ভাবিয়ে তুলত। মনে হতো—ঋদ্ধি কি বুঝছে না, দূরে থাকলেও সে তার মনের সবচেয়ে কাছের মানুষ?

দূরত্ব আর ভুল বোঝাবুঝি তাদের সম্পর্কের মাঝে এক অদৃশ্য প্রাচীর তুলে দিল। দু’জনের ভেতরেই অভিমান জমতে লাগল, কিন্তু কেউই মুখ খুলে কিছু বলল না।

তবুও, অচেনা শহরের রাস্তায় হাঁটার সময় সামীর প্রায়ই মনে মনে বলত—
“বন্ধু, তোকে ছাড়া আমি পূর্ণ নই।”
আর ঋদ্ধি রাতের অন্ধকারে জানলার বাইরে তাকিয়ে ভাবত—
“সামীর, তুই কি আমায় ভুলে যাচ্ছিস?”

এই অধ্যায়ে বোঝা যায়—দূরত্ব শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও হতে পারে। ভুল বোঝাবুঝি যত গভীরই হোক, অন্তরে যদি সত্যিকারের বন্ধুত্ব থাকে, তবে সেই সম্পর্ক কখনও ভেঙে যায় না।

সংকটময় মুহূর্ত ও পুনর্মিলন

সময় গড়াল। ঋদ্ধির জীবনে একের পর এক দায়িত্ব এসে ভর করল। পরিবারে আর্থিক সমস্যা, চাকরির চাপ, সমাজসেবামূলক কাজের বাধা—সব মিলিয়ে সে যেন এক অনন্ত দৌড়ের মধ্যে বন্দি হয়ে গেল। আর সেই দৌড়ে দাঁড়াবার মতো কাউকে খুঁজে পেল না।

অভিমান জমে থাকা সামীরের সঙ্গেও যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দিন কেটে যাচ্ছিল নিঃশব্দে, দূরত্ব যেন আরও বেড়ে যাচ্ছিল। তবুও ভেতরে ভেতরে ঋদ্ধি প্রতিদিন অপেক্ষা করত—হয়তো একদিন সামীর আবার ফিরে আসবে।

এক রাতে বড় বিপদ এসে নামল। ঋদ্ধি যে সামাজিক সংগঠন নিয়ে কাজ করছিল, সেখানে হঠাৎ এক বড় দুর্ঘটনা ঘটল। অভিযোগের আঙুল সরাসরি তার দিকেই উঠল। সবাই তাকে দোষী ভাবল। সংবাদপত্রে নাম ছাপা হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষ চলতে লাগল। যাদের জন্য সে এতদিন চেষ্টা করেছিল, তারাই মুখ ফিরিয়ে নিল।

ঋদ্ধি একেবারেই ভেঙে পড়ল। মনে হলো, এবার আর বাঁচার পথ নেই।

"যেখানে বন্ধু থাকে"

কিন্তু ঠিক তখনই, হঠাৎ করে দরজার সামনে দাঁড়াল সামীর। দূরদেশ থেকে ছুটে এসেছে সে, সবকিছু শুনে। ক্লান্ত চেহারা, চোখে উদ্বেগ, কিন্তু কণ্ঠে এক অটল দৃঢ়তা—
“আমি জানি তুই দোষী নস। পৃথিবী ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু আমি তোকে কখনও ভুল বুঝব না।”

ঋদ্ধির চোখে জল এসে গেল। কতদিনের অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি—সব যেন মুহূর্তেই গলে গেল। সে নিঃশব্দে বলল—
“আমি ভেবেছিলাম, তুই আর ফিরবি না।”

সামীর মৃদু হেসে উত্তর দিল—
বন্ধুত্ব মানে তো ফিরে আসা। যত দূরেই যাই, শেষমেশ তোকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”

এরপর দুজন একসাথে দাঁড়াল কঠিন পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। সামীর তার সব যোগ্যতা, সাহস আর কৌশল দিয়ে ঋদ্ধিকে সাহায্য করল। একে অপরকে ভরসা দিয়ে তারা লড়াই চালিয়ে গেল। ধীরে ধীরে সত্য প্রকাশ পেল, অভিযোগ মুছে গেল।

এই পুনর্মিলন শুধু ভুল বোঝাবুঝি দূর করল না, তাদের বন্ধুত্বকে আরও অটুট করল। তারা বুঝল—বন্ধুত্ব মানে শুধু আনন্দ ভাগাভাগি নয়, সবচেয়ে কঠিন সময়ে একে অপরকে শক্তি দেওয়া।

বন্ধুত্বের মূল্য

জীবনের প্রতিটি বাঁকে ঋদ্ধি আর সামীরের বন্ধুত্ব যেন নতুনভাবে পরীক্ষিত হলো। কিন্তু প্রতিবারই তারা প্রমাণ করল—সত্যিকারের বন্ধুত্ব কখনও ভাঙে না।

সংকট কেটে যাওয়ার পর একদিন তারা দুজন বসেছিল পুরোনো স্কুলের মাঠে। বাতাসে ভেসে আসছিল শৈশবের স্মৃতি—যেখানে প্রথম ফুটবল খেলেছিল, যেখানে প্রথম একসাথে স্বপ্ন বুনেছিল।

ঋদ্ধি ধীরে বলল—
“সামীর, জানিস তো, আমি যখন একেবারে একা হয়ে পড়েছিলাম, তখন শুধু তোর হাতটাই খুঁজছিলাম। কিন্তু অভিমান আমাকে আটকে রেখেছিল।”

সামীর মুচকি হেসে উত্তর দিল—
“বন্ধুত্বের আসল মূল্য বোঝা যায় কেবল সংকটে। ভালো সময়ে সবাই পাশে থাকে, কিন্তু খারাপ সময়ে যে থেকে যায়, সেও আসল বন্ধু। তাই না?”

ঋদ্ধির চোখ ভিজে গেল। সে জানল—এই সম্পর্ক রক্তের বন্ধনের চেয়েও গভীর। সমাজ, দূরত্ব, ভুল বোঝাবুঝি—কিছুই তাদের আলাদা করতে পারে না।

তারা প্রতিজ্ঞা করল—
জীবনে যত ব্যস্ততা আসুক, যত চ্যালেঞ্জই আসুক, একে অপরকে কখনও হারিয়ে ফেলবে না। কারণ তারা বুঝে গেছে—বন্ধুত্বই হলো সেই শক্তি, যা মানুষকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *