“হেমলকের গন্ধ”
নীরবতার ডায়েরি
স্থান: শান্তিনিকেতন শহরের পুরাতন লাইব্রেরি, সময়: রাত ১১:০০ টা
এই শহরের নাম ‘শান্তিনিকেতন’ হলেও, অমিত রায়ের জীবনের কোণায় এখন আর শান্তি বড় একটা ঘেঁষে না। এক সময়ের ঝানু সাংবাদিক, যিনি এক দশক আগে পর্যন্তও কলকাতার পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনামে ঝড় তুলতেন, এখন তিনি একটি ছোট, জীর্ণ লাইব্রেরির একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক। টেবিল ল্যাম্পের ফিকে হলদে আলোয় অমিতের ধূসর হয়ে আসা গোঁফ আর কপালে গভীর রেখাগুলো আরও স্পষ্ট দেখায়। বর্ষাকাল, বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। লাইব্রেরির কাঠের দরজা বন্ধ করার আগে অমিত শেষবারের মতো বারান্দা পেরোলেন। পুরনো ইটের মেঝেতে বৃষ্টির জল ছিটে আসছে। হঠাৎ, ভেজা সিমেন্টের ওপর কী যেন একটা বস্তুর অস্তিত্ব অনুভব করলেন তিনি। ঝুঁকে তুলে নিলেন বস্তুটি—একটুকরো চামড়ার মলাট, ভিজে স্যাঁতসেঁতে। সেটি আসলে একটি ডায়েরি। মলাটটা আংশিকভাবে ছেঁড়া, তার ওপর কালচে রক্তের মতো কিছু শুকিয়ে লেগে আছে। হেমলক ফুলের পাতার মতো তার গাঢ় সবুজ রঙের উপর রক্তের দাগ যেন আরও বেশি করে রহস্যের জন্ম দিচ্ছে।
সাংবাদিকতা ছেড়ে এলেও, খবর চেনার সহজাত প্রবৃত্তিটা অমিতের মরে যায়নি। এই ডায়েরিটা কোনো সাধারণ বস্তু নয়। লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকে সাবধানে ল্যাম্পের আলোয় ডায়েরিটা খুললেন তিনি। ভেতরের পাতাগুলো জলে ভিজে প্রায় নষ্ট হতে বসেছে, কিন্তু হাতে লেখা কিছু অক্ষর এখনও পড়া যাচ্ছে। ডায়েরির প্রথম পাতায় খোদাই করা নামটি ছিল: ডাঃ সুব্রত লাহিড়ী, প্রত্নতত্ত্ববিদ। এই নামটা অমিত চেনে। গত সপ্তাহে স্থানীয় পত্রিকায় ছোট একটি খবর বেরিয়েছিল: সুব্রত লাহিড়ী, যিনি এই অঞ্চলের এক প্রাচীন গুপ্ত মন্দিরের সন্ধানে এসেছিলেন, হঠাৎ নিখোঁজ। পুলিশ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, হয়তো ভেবেছিল পথ হারিয়েছেন।
ডায়েরিটা উল্টাতে গিয়ে অমিতের চোখ আটকে গেল শেষ পাতায়। ভেজা কাগজটিতে পেনসিল দিয়ে দ্রুত হাতে আঁকা একটি ছবি—গাঢ় সবুজ, শিরাযুক্ত একটি পাতার রেখাচিত্র। তার ঠিক নিচে কয়েকটি অস্পষ্ট অক্ষর।
“অন্ধকার যেখানে শেষ, আলো সেখানে শুরু। হেমলকের গন্ধে ঘুমিয়ে থাকে… (অক্ষরগুলো অস্পষ্ট, পড়া যাচ্ছে না) …দু’জন সাক্ষী, একজন নীরব।”
“হেমলকের গন্ধ?” বিড়বিড় করলেন অমিত। এই অঞ্চলে কি হেমলক গাছ পাওয়া যায়? আর কে এই “দু’জন সাক্ষী, একজন নীরব”?
ডায়েরিটা বন্ধ করে অমিত অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন। তিনি জানেন, এই রক্ত এবং এই ধাঁধা তাঁকে আবার সাংবাদিকতার অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর মন বলছে, প্রত্নতত্ত্ববিদ নিখোঁজ হননি, তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভোর পাঁচটায় যখন হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে, তখন অমিত ডায়েরিটি একটি প্লাস্টিক প্যাকেটে ভরে নিজের স্কুটারে চাপলেন। তার গন্তব্য—নিখোঁজ সুব্রত লাহিড়ীর সন্ধানের মূল এলাকা। এই শান্ত শহরের নির্জীব পরিবেশের নিচে যে একটা ভয়ংকর সত্য লুকিয়ে আছে, সেই নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে তিনি চললেন।
মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ শহরের উত্তর দিকে, জনবসতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। ভাঙা পাথরের স্তূপ আর আগাছায় ভরা সেই জায়গায় পৌঁছতেই অমিত দেখলেন, দু’টি পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে।
দ্রুত স্কুটার থামিয়ে এগিয়ে গেলেন অমিত। দূর থেকে তিনি দেখলেন—কয়েকজন পুলিশ আর স্থানীয় লোক ভিড় করে আছে। একজন কনস্টেবল ভিড় সামলাচ্ছে। কাছাকাছি যেতেই অমিতের কানে এলো কয়েকজনের চাপা গুঞ্জন।
“ডাক্তার লাহিড়ী… মৃতদেহ পাওয়া গেছে,” একজন স্থানীয় লোক ফিসফিস করে বলল।
অমিতের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি জানতেন, এই খবরই তাঁকে শুনতে হবে। কিন্তু যখন তিনি পুলিশ কর্ডনের কাছে পৌঁছালেন, লাহিড়ীর মৃতদেহ তখনও সরানো হয়নি। প্রত্নতত্ত্ববিদের চোখ ছানাবড়া, মুখে তীব্র যন্ত্রণার চিহ্ন। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি ছিল তাঁর ডান হাতের তালুতে। ডায়েরির শেষ পাতায় আঁকা সেই একই পাতার ছবি, যেন তড়িঘড়ি করে ধারালো কিছু দিয়ে খোদাই করা হয়েছে। সেই ছবির চারপাশে এখন শুকিয়ে যাওয়া রক্ত।
অমিতের হাতে থাকা ডায়েরিটা যেন নিজের অস্তিত্ব জানান দিল। পুলিশ এটিকে আত্মহত্যা বা স্রেফ কোনো বিষক্রিয়ায় মৃত্যু ধরে কেসটা বন্ধ করে দেবে নিশ্চিত, যেমনটা তারা নিখোঁজ হওয়ার সময় করেছিল। কিন্তু অমিত রায় জানেন, এটা কেবল শুরু। হেমলকের গন্ধ তাঁকে একটি নীরব সত্যের দিকে ইঙ্গিত করছে, যার জন্য শহরের উচ্চবিত্ত সমাজ হয়তো হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করেছে।
অমিত নিজেকে শান্ত রেখে সাবধানে এক পুলিশ অফিসারের কাছে গেলেন।
“আমার নাম অমিত রায়, প্রাক্তন সাংবাদিক। আমি ডায়েরিটা দিতে এসেছি,” বললেন তিনি।
ডায়েরিটি পুলিশের হাতে তুলে দিলেন অমিত, কিন্তু মনে মনে শপথ নিলেন—এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত তিনি যাবেনই।
“বিষবৃক্ষের সন্ধানে”
স্থান: শান্তিনিকেতন শহরের পুলিশ স্টেশন এবং লাইব্রেরি, সময়: পরের দিন সকাল
ডায়েরিটি পুলিশের হাতে তুলে দিলেও, অমিত রায়ের মন শান্ত হলো না। পুলিশ অফিসার, ইনস্পেক্টর মুখার্জি, ডায়েরিটির উপর তেমন গুরুত্ব দিতে চাইলেন না। “স্যার, এটা তো জলে ভেজা ডায়েরি। একজন প্রত্নতত্ত্ববিদের কাছে এ ধরনের ধাঁধা থাকা স্বাভাবিক। হয়তো হতাশা থেকে নিজেই কিছু একটা খেয়ে নিয়েছেন। প্রাথমিক রিপোর্টে বিষক্রিয়ার লক্ষণই স্পষ্ট,” মুখার্জির উদাসীন মন্তব্য অমিতের কানে বিষ ঢেলে দিল।
“কিন্তু হাতে আঁকা এই একই চিহ্ন?” অমিত প্রতিপ্রশ্ন করলেন। “যদি আত্মহত্যাই হবে, তবে নিজের হাতে এত কষ্ট করে এই পাতা কেন আঁকলেন?”
মুখার্জি কাঁধ ঝাঁকালেন। “হয়তো শেষ মুহূর্তে কোনো ভুল সংকেত দেওয়ার চেষ্টা। আপনি বরং বাড়ি যান, মিস্টার রায়। যদি কোনো তথ্য জানা থাকে, জানাবেন। কিন্তু পুরোনো সাংবাদিকতার ভূত মাথা থেকে নামান।”
অমিত বুঝলেন, পুলিশের কাছে এই কেস কেবল ফাইল বন্ধ করার একটি উপায়। একমাত্র ভরসা এখন সেই ডায়েরির অসম্পূর্ণ ধাঁধা এবং ‘হেমলকের গন্ধ’।

লাইব্রেরিতে ফিরে এসে অমিত এবার মন দিলেন গবেষণায়। সুব্রত লাহিড়ীর ডায়েরির ছেঁড়া পাতা এবং ধাঁধাটি মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করলেন।
“অন্ধকার যেখানে শেষ, আলো সেখানে শুরু। হেমলকের গন্ধে ঘুমিয়ে থাকে… (অক্ষরগুলো অস্পষ্ট, পড়া যাচ্ছে না) …দু’জন সাক্ষী, একজন নীরব।”
‘হেমলক’ শব্দটি তাঁকে স্থির করে দিল। তিনি স্থানীয় একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানীকে ফোন করলেন। ভদ্রলোক অনেক প্রাচীন গাছের নাম জানেন।
“শান্তিনিকেতন অঞ্চলে হেমলক? না, অমিত। হেমলক তো মূলত ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার গাছ। তবে, দেখতে প্রায় একই রকম একটি বিষাক্ত গাছ এখানে পাওয়া যায়—স্থানীয় নাম তার ‘মৃত্যু-তারা’। তার বৈজ্ঞানিক নাম ‘কোনিয়াম স্পটেড’ বা অনেকটা তারই সমগোত্রীয়। প্রাচীনকালে এর পাতা বা ফল বেটে গুপ্ত বিষ তৈরি করা হতো। এর গন্ধ হেমলকের কাছাকাছি,” জানালেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী।
‘মৃত্যু-তারা’। শব্দটি শুনে অমিতের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
এরপরেই অমিত গেলেন লাইব্রেরির সবচেয়ে পুরোনো এবং অব্যবহৃত অংশে। সুব্রত লাহিড়ী নিখোঁজ হওয়ার আগে এই লাইব্রেরিতে প্রচুর সময় কাটিয়েছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কিত বইয়ের তাকগুলো খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে তিনি দুটি বই পেলেন, যা তাক থেকে সামান্য বেরিয়ে আছে: একটি প্রাচীন ‘স্থানিক উদ্ভিদ পরিচিতি’ এবং অন্যটি এই অঞ্চলের ‘গুপ্ত মন্দির এবং লোকগাথা’ নিয়ে লেখা।
‘গুপ্ত মন্দির এবং লোকগাথা’ বইটি খুলতেই অমিত একটি জায়গায় পেলেন একটি শুকনো পাতার টুকরো, যা দেখতে হুবহু ডায়েরিতে আঁকা হেমলকের পাতার মতো। সেই পাতার নিচে একটি অনুচ্ছেদ হাইলাইট করা:
“… মন্দিরটির প্রবেশদ্বারের দু’পাশে দু’জন প্রস্তর নির্মিত দ্বাররক্ষক, যা দু’জন সাক্ষীর প্রতীক। মন্দিরটি যেখানে স্থাপন করা হয়েছিল, তার কাছেই জন্মাতো ‘মৃত্যু-তারা’ বা বিষবৃক্ষটি। বলা হয়, মন্দিরের আসল গুপ্ত কক্ষটি সেখানেই, যেখানে বিষবৃক্ষের নিচে চিরকালের জন্য ‘নীরব’ ঘুমিয়ে আছে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বা সেই সময়ের কোনো গুরুত্বপূর্ণ রক্ষক।”
“দু’জন সাক্ষী, একজন নীরব,” বিড়বিড় করলেন অমিত। ধাঁধার অর্ধেক সমাধান হয়ে গেল। দু’জন সাক্ষী হলো মন্দিরের দ্বাররক্ষক। নীরব হলো মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি বিষবৃক্ষের নিচে ঘুমিয়ে আছেন। আর সেই বিষবৃক্ষ হলো ‘মৃত্যু-তারা’, যা সুব্রত লাহিড়ীর মৃত্যুতে ব্যবহৃত হয়েছে এবং যার গন্ধ হেমলকের মতো।
তাহলে লাহিড়ী সেই মন্দির এবং গুপ্তধনের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু ‘অন্ধকার যেখানে শেষ, আলো সেখানে শুরু’—এই লাইনটার মানে কী?
সন্ধ্যা নামার মুখে অমিত ডায়েরির অস্পষ্ট অক্ষরগুলো নিয়ে কাজ করছিলেন। একটি শক্তিশালী ম্যাগনিফাইং গ্লাস আর একটি পুরোনো ফটোগ্রাফিক ফিল্টারের সাহায্যে তিনি অক্ষরগুলো স্পষ্ট করতে পারলেন। অসম্পূর্ণ লাইনটি এবার সম্পূর্ণ হলো:
“হেমলকের গন্ধে ঘুমিয়ে থাকে ‘অন্ধকারের দলিল’। দু’জন সাক্ষী, একজন নীরব।”
‘অন্ধকারের দলিল’। এ কোনো সাধারণ গুপ্তধন নয়। কোনো প্রাচীন চুক্তি বা দলিল, যা হয়তো এমন কোনো সত্য ধারণ করে যা স্থানীয় প্রভাবশালীরা হাজার বছর ধরে গোপন রাখতে চেয়েছেন।
হঠাৎ, লাইব্রেরির দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। এই অসময়ে কেউ লাইব্রেরিতে আসে না। অমিত দরজা খুলে দেখলেন, একজন সুবেশিত, ধনী ব্যক্তি বাইরে দাঁড়িয়ে। ইনি এই শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় ট্রাস্টের চেয়ারম্যান—মি. প্রবীর দাসগুপ্ত।
“শুনলাম আপনি নাকি লাহিড়ীর ডায়েরিটা পেয়েছেন, অমিত বাবু?” শান্ত অথচ কঠোর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন প্রবীর দাসগুপ্ত। “আপনার মতো একজন প্রাক্তন সাংবাদিকের উচিত পুলিশকে সাহায্য করা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আপনি অন্য কিছু খুঁজছেন।”
অমিতের সাংবাদিকের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। প্রবীর দাসগুপ্তের চোখ দুটোয় যেন একটা চাপা ভীতি ও কৌতূহল মেশানো।
“আমি শুধু আমার একজন পাঠকের নিখোঁজ হওয়ার কারণ খুঁজছি, মি. দাসগুপ্ত,” দৃঢ়তার সাথে জবাব দিলেন অমিত।
“এই পুরনো মন্দির-টন্দির নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই ভালো। কিছু জিনিস নীরব থাকাই উচিত। আর এই শহর খুবই ‘শান্ত’, অমিত বাবু। একে অকারণ অশান্ত করবেন না।” মৃদু হেসে একটা নীরব হুমকি দিয়ে চলে গেলেন প্রবীর দাসগুপ্ত।
অমিত বুঝলেন, তাঁর তদন্ত এখন কেবল একটি প্রাচীন রহস্য নয়, শহরের প্রভাবশালী মহলের গোপনীয়তার দিকেও আঙুল তুলছে। প্রবীর দাসগুপ্ত নিশ্চিতভাবেই এই রহস্যের অন্যতম প্রধান সন্দেহভাজন। ‘অন্ধকারের দলিল’ কী, তা জানতে হলে তাঁকে আবার যেতে হবে সেই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে।
“নীরবতার মূল্য”
স্থান: শান্তিনিকেতন শহরের কফি শপ এবং প্রবীর দাসগুপ্তের অফিস, সময়: পরের দিন দুপুর
প্রবীর দাসগুপ্তের নীরব হুমকি অমিতের মনে গভীর সন্দেহের জন্ম দিল। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কেন একজন মৃত প্রত্নতত্ত্ববিদের ডায়েরি নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হবেন? ‘অন্ধকারের দলিল’-এর সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক?
অমিত সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রবীর দাসগুপ্তের ওপর নজর রাখতে হবে। তিনি শহরের একমাত্র পুরোনো কফি শপ ‘সোনালী সকাল’-এ গিয়ে বসলেন। এখান থেকে প্রবীর দাসগুপ্তের ট্রাস্ট অফিসের প্রবেশদ্বারটি দেখা যায়।
দুপুরের দিকে, অমিত দেখলেন প্রবীর দাসগুপ্ত তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীকে নিয়ে তাঁর বিলাসবহুল সেডান গাড়িতে উঠছেন। অমিত দ্রুত তাঁর স্কুটার নিয়ে তাঁদের অনুসরণ করলেন। গাড়িটি শহরের বাইরে একটি বিশাল, পুরোনো জমিদার বাড়ির সামনে থামল। বাড়িটির চারপাশে উঁচু পাঁচিল, আর লোহার গেটে খোদাই করা একটি প্রতীক—যা দেখতে মন্দিরের দ্বাররক্ষকদের হাতে থাকা ঢালের চিহ্নের মতো!

অমিত দূর থেকে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দশ মিনিট পর, প্রবীর দাসগুপ্তের সহকারী তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলেন এবং গেটের পাশে অপেক্ষারত একজন পুরোনো মালী গোছের লোককে কিছু টাকা দিলেন। এই লোকটির হাতে ছিল একটি ছোট, টবে লাগানো গাছ—যার পাতাগুলো হেমলকের মতো দেখতে ‘মৃত্যু-তারা’।
অমিতের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। ‘মৃত্যু-তারা’ গাছটি কেবল দুর্গম মন্দিরের কাছেই পাওয়া যায়, যা প্রত্নতত্ত্ববিদের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রবীর দাসগুপ্তের এই পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে কী এমন হচ্ছে? তিনি কি কেবল প্রাচীন গাছ সংগ্রহ করছেন, নাকি অন্য কোনো অন্ধকার কাজ চলছে?
সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে, অমিত কৌশলে সেই মালী লোকটির সাথে পরিচিত হলেন। সামান্য টাকা এবং কফি অফার করার পর মালীটি ধীরে ধীরে মুখ খুলল।
“বাবুকে (প্রবীর দাসগুপ্ত) এই বাড়িটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। তিনি মাঝে মাঝে আসেন, কিন্তু ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেন না। বলেন, এটা নাকি তাঁর পারিবারিক ‘স্মৃতিরক্ষার কক্ষ’। কিন্তু মাসখানেক আগে এক মাঝরাত্রে তিনি একজনকে ডেকে এনেছিলেন। লোকটা ছিল কলকাতার— লম্বা, চশমা পরা। সে-ই নাকি এই ‘মৃত্যু-তারা’ গাছগুলো খুঁজতে চেয়েছিল,” মালী ফিসফিস করে বলল।
অমিতের মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। লম্বা, চশমা পরা সেই লোকটি নিঃসন্দেহে ডাঃ সুব্রত লাহিড়ী। প্রবীর দাসগুপ্ত লাহিড়ীকে শহরে ডেকে এনেছিলেন, এবং লাহিড়ী যখন ‘অন্ধকারের দলিল’ এবং ‘মৃত্যু-তারা’ গাছের সাহায্যে গুপ্তধনের কাছে পৌঁছে গেলেন, তখনই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
অমিত মালীকে জিজ্ঞেস করলেন, “লাহিড়ীকে কোথায় ডাকা হয়েছিল? মন্দিরের কথা কি উনি জানতেন?”
মালী বলল, “বাবু নিজেই বলেছিলেন, গুপ্তধনের কথা জানতে চাইলে যেন ওই পরিত্যক্ত বাড়িটায় আসে। বাবু নাকি লাহিড়ীকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে গাছটা যখন পাওয়া গেল, লাহিড়ী সাহেব যেন খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন। তিনি নাকি বাবুর সঙ্গে প্রচণ্ড তর্কে জড়িয়েছিলেন, বলেছিলেন—’এই দলিল আপনারা এতদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিলেন? এর জন্য এতগুলো মানুষের জীবন নিলেন?'”
“জীবন নিলেন? মানে কী? লাহিড়ীর আগে আর কেউ মারা গেছে?”
“তা আমি জানি না বাবু। শুধু শুনেছি, ওই দলিলটা নাকি বহু প্রাচীন পারিবারিক গোপন কথা বহন করে, যা ফাঁস হলে শহরের প্রভাবশালী সব পরিবারের পতন ঘটবে।”
অমিতের কাছে ছবিটি পরিষ্কার হতে শুরু করল। প্রবীর দাসগুপ্ত কেবল একজন ব্যবসায়ী নন, তিনি এই শহরের প্রাচীন এবং অন্ধকার ‘দলিল’-এর রক্ষক। লাহিড়ী সম্ভবত সেই দলিলের প্রকৃত বিষয়বস্তু জানতে পেরেছিলেন, যা কোনো গুপ্তধন নয়—বরং কোনো জঘন্য ঐতিহাসিক অপরাধের প্রমাণ। এই অপরাধ হয়তো বহু বছর আগে লাহিড়ীর পূর্বপুরুষদের সাথে সম্পর্কিত ছিল, বা এই দলিলের সাহায্যে দাসগুপ্ত পরিবার তাদের আজকের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিল।
অমিত জানতেন, প্রবীর দাসগুপ্ত আবার লাইব্রেরিতে আসবেন। কারণ, লাহিড়ীর মৃত্যুর পর ডায়েরির মূল তথ্য তিনি পাননি—পুলিশ শুধু সাধারণ অংশটুকুই দেখেছে। ‘অন্ধকারের দলিল’ এবং বিষবৃক্ষের ধাঁধার কথা একমাত্র অমিতই জানেন।
রাত ন’টা। লাইব্রেরির দরজায় আবার মৃদু টোকা পড়ল। বাইরে দাঁড়ানো প্রবীর দাসগুপ্ত। এবার তাঁর মুখে সেই মৃদু হাসি নেই, চোখে শুধু কঠোরতা।
“মিস্টার রায়,” তিনি ধীরেসুস্থে ভেতরে এলেন। “আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। আমি এই শহরের রক্ষক। কিছু সত্য আছে যা সাধারণ মানুষের জানা উচিত নয়। লাহিড়ী সেই গোপন সত্য জেনে গিয়েছিলেন এবং তা ফাঁস করতে চেয়েছিলেন। তার পরিণতি তিনি পেয়েছেন। ডায়েরিটা তো আপনি পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন, তাই না? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আপনি তার চেয়ে বেশি কিছু জানেন।”
প্রবীর দাসগুপ্ত অমিতের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন। “আমাকে বলুন, ‘অন্ধকারের দলিল’-এর কথা আপনি কী করে জানলেন? ওই ডায়েরির শেষ পাতাটা কি আপনার কাছে আছে? কারণ, সেই পাতাটা পুলিশ পায়নি।”
অমিত স্থির চোখে প্রবীর দাসগুপ্তের দিকে তাকালেন। তিনি জানেন, এই মুহূর্তে সত্য গোপন করা তাঁর জীবন বাঁচাতে পারে, কিন্তু সাংবাদিকের ধর্ম তাকে মিথ্যা বলতে বারণ করছে।
“আমি জানি, মি. দাসগুপ্ত,” অমিত শান্তস্বরে বললেন। “দলিলটা কী, সেটাও আমি জানি। কিন্তু লাহিড়ীকে কেন হত্যা করা হলো, সেটা জানতে হলে আমাকে মন্দিরের সেই বিষবৃক্ষের নিচে যেতে হবে। যেখানে আপনাদের ‘নীরব সাক্ষী’ ঘুমিয়ে আছেন।”
প্রবীর দাসগুপ্তের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন, অমিত রায়কে আর কোনোভাবে থামানো যাবে না। “আপনারও পরিণতি লাহিড়ীর মতোই হবে, অমিত রায়। চুপ থাকুন, নয়তো এই শান্ত শহর আপনাকেও গিলে খাবে।”
উত্তেজনাপূর্ণ এই সংঘাতের মধ্য দিয়ে তৃতীয় অধ্যায় শেষ হলো। অমিতের কাছে এখন তিনটি তথ্য: প্রবীর দাসগুপ্ত খুনি, লাহিড়ীর মৃত্যু ‘অন্ধকারের দলিল’ ফাঁস করার প্রচেষ্টার ফল, এবং সেই দলিল আছে মন্দিরের নিচে, বিষবৃক্ষের গোড়ায়।
“অন্ধকারের দলিল”
স্থান: প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, ‘মৃত্যু-তারা’ গাছের স্থান, সময়: রাত ১২:৩০ টা
রাত গভীর। আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকলেও বৃষ্টি থেমে গেছে। প্রবীর দাসগুপ্তের হুমকির পর লাইব্রেরিতে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করা নিরাপদ মনে করলেন না অমিত রায়। তিনি জানেন, পুলিশও তাঁকে সন্দেহ করা শুরু করেছে, আর প্রবীর দাসগুপ্তের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তি সহজেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারেন।
অমিত তাঁর টর্চ এবং একটি ছোট কোদাল নিয়ে স্কুটারে চেপে বসলেন। গন্তব্য সেই প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, যেখানে সুব্রত লাহিড়ীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল এবং যেখানে সেই রহস্যময় ‘মৃত্যু-তারা’ গাছটি জন্মায়।

মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে পৌঁছাতে প্রায় এক ঘন্টা লাগল। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়। জীর্ণ পাথরের স্তূপের মাঝে ইতস্তত ঘুরে অমিত শেষ পর্যন্ত সেই জায়গাটা খুঁজে পেলেন, যেখানে লাহিড়ীর মৃতদেহ ছিল। জায়গাটার মাঝে, ধ্বংসাবশেষের প্রায় কেন্দ্রে, একটি অস্বাভাবিক ঘন সবুজ, লতানো গাছ দাঁড়িয়ে আছে। তার ফলগুলো ছোট, গোল এবং বিষাক্ত হেমলকের ফলের মতো দেখতে। এটাই ‘মৃত্যু-তারা’ বা বিষবৃক্ষ।
গাছটির গোড়ায় দুটি বড়, বহু পুরোনো পাথরের মূর্তি পড়ে আছে—যেন তারা মন্দিরের দ্বাররক্ষক। ‘দু’জন সাক্ষী’—ডায়েরির ধাঁধা মিলিয়ে নিলেন অমিত।
এটাই সেই স্থান, যেখানে ‘নীরব সাক্ষী’ ঘুমিয়ে আছে এবং যেখানে লুকিয়ে আছে ‘অন্ধকারের দলিল’।
অমিত কোদাল দিয়ে গাছটির গোড়া খুঁড়তে শুরু করলেন। মাটি নরম, সম্ভবত সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ভিজেছে। খানিকটা খোঁড়ার পর তিনি অনুভব করলেন, কোদালের ডগা পাথরের মতো শক্ত কিছুতে আঘাত করল। সাবধানে মাটি সরাতেই বেরিয়ে এলো একটি পাথরের বাক্স, যার ওপর প্রাচীন দেবনাগরী হরফে কিছু খোদাই করা।
পাথরের ঢাকনা সরাতেই ভেতরের শীতল, শুষ্ক বাতাস অমিতের নাকে এলো। ভেতরে ছিল দুটি জিনিস: একটি ছোট, হলুদ হয়ে যাওয়া পুঁথিপত্র, চামড়ার ফিতায় বাঁধা; এবং একটি জীর্ণ মূর্তির ভাঙা অংশ।
পুঁথিপত্রটিই যে ‘অন্ধকারের দলিল’, তা বুঝতে অমিতের অসুবিধা হলো না। টর্চের আলো ফেলে তিনি পাতা উল্টালেন। পুঁথিটি বাংলায় নয়, প্রাচীন কোনো স্থানীয় ভাষায় লেখা, তবে শেষের দিকে কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করা আছে, সম্ভবত সুব্রত লাহিড়ী নিজে হাতে লিখেছিলেন।
অমিত সেই অনুবাদ অংশটি পড়লেন:
“… এই দলিল প্রমাণ করে, প্রায় দুশো বছর আগে, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর সময়, এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি মন্দিরের পাশে সমাধিস্থ হয়েছিলেন, তিনি কেবল এই শহরের শাসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ভয়ঙ্কর কালোবাজারি। তিনি খাদ্যশস্য গোপনে মজুদ করে রেখেছিলেন, যার ফলে শত শত মানুষ ক্ষুধায় মারা যায়। মন্দিরটি আসলে তাঁর অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ নির্মাণ করা হয়, তবে গুপ্তধন হিসেবে তাঁর সকল অবৈধ সম্পত্তি লুকানো ছিল এই বিষবৃক্ষের নিচে, যা তিনি বলেছিলেন “নীরব সাক্ষী”। তিনি নিজেই হেমলকের সমগোত্রীয় বিষ পান করে এখানে সমাধিস্থ হন, যাতে এই জঘন্য সত্য চিরকাল মাটির নিচে নীরব থাকে।”
অমিতের মুখ হাঁ হয়ে গেল। প্রবীর দাসগুপ্ত তাঁর পারিবারিক ইতিহাস নয়, এই শহরের গোড়াপত্তনের সবচেয়ে অন্ধকার দিকটি গোপন করতে চেয়েছেন। এই দলিল ফাঁস হলে শহরের সমস্ত ইতিহাসের ওপর কালি পড়বে, আর শহরের সম্মানিত পরিবারগুলোর (সম্ভবত দাসগুপ্ত পরিবার সেই প্রতিষ্ঠাতার বংশধর) সম্মান ধূলায় মিশে যাবে।
আর সুব্রত লাহিড়ী? তিনি কেবল গুপ্তধন নয়, সত্য উন্মোচনের জন্য এসেছিলেন। তিনি দলিলটির কথা জানতে পেরেছিলেন এবং সেটার প্রতিলিপি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই প্রবীর দাসগুপ্ত তাঁকে থামিয়েছেন, ঠিক একই বিষ (মৃত্যু-তারা’র নির্যাস) খাইয়ে, যা তাঁর পূর্বপুরুষ দুশো বছর আগে পান করেছিলেন। প্রত্নতত্ত্ববিদ তাঁর শেষ মুহূর্তে তাঁর হাতে সেই বিষবৃক্ষের প্রতীক এঁকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, এবং এটি কোনো আত্মহত্যা নয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে, পায়ের পাতার শব্দে অমিত চমকে উঠলেন। টর্চের আলো সরিয়ে দেখলেন—প্রবীর দাসগুপ্ত! তিনি একাই এসেছেন, হাতে একটি ধারালো কোদাল।
“আপনি ভুল করলেন, অমিত রায়,” প্রবীর দাসগুপ্ত ফিসফিস করে বললেন। “এই দলিল আমি শত বছর ধরে পাহারা দিয়েছি। এই শহর মিথ্যা আর শান্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আপনার মতো একজন প্রাক্তন সাংবাদিককে আমি এই শান্তি নষ্ট করতে দেব না।”
“আপনার পূর্বপুরুষের অপরাধ চাপা দিতে আপনি একজন নিরীহ মানুষের জীবন নিলেন, মি. দাসগুপ্ত,” অমিত পাল্টা জবাব দিলেন। “এটাই এখন ‘অন্ধকারের দলিল’-এর নতুন পাতা হবে।”
দাসগুপ্ত উন্মত্তের মতো হেসে উঠলেন। “আর সেই পাতাটি কেউ পড়তে পারবে না, অমিত রায়। আপনি এবং লাহিড়ীর মৃতদেহ—দু’জনেই এই মন্দিরের নীরব সাক্ষীদের তালিকায় যুক্ত হবেন।”
দাসগুপ্ত কোদাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই অমিত তৎক্ষণাৎ সরে গেলেন। অমিতের হাতে তখনো পাথরের বাক্স এবং পুঁথিটি। তাঁর এখন পালাতে হবে, আর এই দলিল জনসমক্ষে আনতে হবে।
অমিতের কাছে আর একটি অধ্যায় বাকি, যেখানে এই গল্পের শেষ ও সত্যের জয় নিশ্চিত করতে হবে।
“সত্যের আলোকপাত”
স্থান: প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে শান্তিনিকেতন শহরের পুলিশ স্টেশন, সময়: রাত ২:০০ টা
প্রবীর দাসগুপ্তের উন্মত্ত আক্রমণ অমিত রায়কে বাঁচতে বাধ্য করল। ভাগ্যক্রমে, খনন করার জন্য যে কোদালটি অমিত ব্যবহার করেছিলেন, সেটি তখনও তাঁর হাতের কাছে ছিল। তিনি পাথরের বাক্স ও দলিলটি শক্ত করে ধরে এক লাফে প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের একটি উঁচু পাথরের স্তূপের আড়ালে সরে গেলেন।
প্রবীর দাসগুপ্ত, রাগ এবং ভয়ে অন্ধ হয়ে, অন্ধকারে অমিতের পিছু নিলেন। “কোথায় লুকোচ্ছেন? ওই দলিল আমার! ওই মিথ্যা ফাঁস হলে সব শেষ হয়ে যাবে!”
অমিত জানতেন, খোলা জায়গায় তিনি দাসগুপ্তের সঙ্গে লড়তে পারবেন না, বিশেষত তাঁর হাতে যখন একটি ধারালো অস্ত্র। তাঁর প্রধান লক্ষ্য এখন একটিই—দলিলটি নিরাপদ রাখা এবং প্রমাণ সংগ্রহ করা।
পাথরের স্তূপের ফাঁক দিয়ে অমিত দেখলেন, দাসগুপ্ত টর্চ হাতে উন্মত্তের মতো তাঁকে খুঁজছেন। অমিতের মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। তিনি দ্রুত ডায়েরির শেষ পাতায় আঁকা ‘মৃত্যু-তারা’ পাতার ছবিটির কথা ভাবলেন। তিনি জানেন, দাসগুপ্তের দৃষ্টি এখন শুধু দলিলের দিকে।

অমিত আলতো করে পাথরের বাক্সটির মুখটি খোলা রেখে, সেটিকে সাবধানে একটি বড় পাথরের খাঁজে রেখে দিলেন। এরপর তিনি দ্রুত অন্য একটি দিকে সরে গেলেন, নিজের কোদালটি নিয়ে।
দাসগুপ্ত যখন দেখলেন অমিত নেই, তখন তিনি পাথরের বাক্সের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন অমিত দলিল ফেলে পালিয়েছেন। টর্চের আলো ফেলে তিনি পাথরের খাঁজে রাখা বাক্সটি দেখতে পেলেন। যেই তিনি ঝুঁকে দলিলটি তুলে নিতে যাবেন, অমিত পিছন থেকে তাঁর কোদাল দিয়ে পাথরের মূর্তির একটি আলগা অংশ—সেই ‘দু’জন সাক্ষীর’ একটির ভাঙা হাত—জোরে দাসগুপ্তের মাথায় আঘাত করলেন।
দাসগুপ্ত মুহূর্তের জন্য দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি টলে গিয়ে বিষবৃক্ষ ‘মৃত্যু-তারা’ গাছটির ওপর পড়ে গেলেন। তিনি আর উঠতে পারলেন না। প্রচণ্ড আঘাত এবং বিষবৃক্ষের তীব্র গন্ধে তাঁর শরীর নিস্তেজ হয়ে এল। তাঁর হাত থেকে কোদালটি ছিটকে দূরে পড়ল।
অমিত দ্রুত পাথরের বাক্স এবং দলিলটি তুলে নিলেন। তিনি নিশ্চিত হলেন যে দাসগুপ্ত আর কোনো আক্রমণ করার অবস্থায় নেই।
অমিত আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলেন না। তিনি দ্রুত তাঁর স্কুটারে চেপে বসলেন। এবার তাঁর গন্তব্য পুলিশ স্টেশন, ইনস্পেক্টর মুখার্জির কাছে।
পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে রাত আড়াইটার দিকে অমিত সোজা মুখার্জির চেম্বারে ঢুকলেন। ইনস্পেক্টর তখন ঘুম চোখে হাই তুলছিলেন।
“মিস্টার রায়, এত রাতে? আপনি কি আবার…?”
“ইনস্পেক্টর, খুনি ধরা পড়েছে। আর আপনাদের শহরের প্রায় দুশো বছরের পুরনো সত্যও আমার হাতে,” দৃঢ় কণ্ঠে বললেন অমিত।
অমিত তাঁর সামনে পাথরের বাক্স, ‘অন্ধকারের দলিল’ এবং লাহিড়ীর ডায়েরিটি রাখলেন। তিনি দাসগুপ্তের হামলার স্থান, ‘মৃত্যু-তারা’ গাছের সন্ধান এবং লাহিড়ীর হাতে আঁকা চিহ্নের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিলেন।
মুখার্জি প্রথমে অবিশ্বাস করলেও, দলিলের প্রাচীনতা এবং দাসগুপ্তের জমিদার বাড়ির মালী প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে লাহিড়ীর মৃত্যুর ধরন মিলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে তিনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন। বিশেষত যখন অমিত তাঁর হাতে থাকা ভাঙা পাথরের মূর্তির টুকরোটি দেখিয়ে বললেন, “মি. দাসগুপ্ত এখন মন্দিরের পাশে ‘মৃত্যু-তারা’ গাছের কাছেই পড়ে আছেন। আপনাদের নীরব সাক্ষী।”
পরের দিন ভোরে, পুলিশ দল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে গিয়ে প্রবীর দাসগুপ্তকে গুরুতর আহত অবস্থায় খুঁজে বের করল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দাসগুপ্ত প্রথমে সব অস্বীকার করলেও, ‘অন্ধকারের দলিল’ এবং মালী সহ অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করল।
শহরের দৈনিক পত্রিকাগুলোয় এই খবর ফলাও করে বের হলো। প্রথম পাতা জুড়ে শিরোনাম: “হেমলকের গন্ধ: শহরের দুই শতকের অন্ধকার ইতিহাস উন্মোচিত”।
অমিত রায়, প্রাক্তন সাংবাদিক, আবার শিরোনামে। কিন্তু এবার তিনি খবর লিখলেন না, নিজেই খবর হলেন। শহরের ভিত্তি যে জঘন্য অপরাধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, সেই সত্যের আলো পড়ল।
কয়েক দিন পর, লাইব্রেরির শান্ত পরিবেশে একা বসে অমিত শেষবারের মতো সুব্রত লাহিড়ীর ডায়েরিটা খুললেন। তিনি সফল হয়েছেন। একজন নীরবে কাজ করা প্রত্নতত্ত্ববিদের অপূর্ণ কাজ তিনি সম্পূর্ণ করেছেন। সত্যের জয় হয়েছে।
অমিত রায় বুঝতে পারলেন, তিনি হয়তো আর সাংবাদিকতা পেশায় ফিরতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর ভেতরে থাকা অনুসন্ধিৎসু মানুষটি কখনও নীরব হবে না।
