গ্রীষ্মের দুপুরের লুকোচুরি স্মৃতি
|

গ্রীষ্মের দুপুরের লুকোচুরি স্মৃতি

দুপুরের পিকনিক

গ্রীষ্মের দুপুর যেন অন্যরকম এক সময়। রোদটা এতটা প্রখর হতো যে মনে হতো আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। চারপাশ নিস্তব্ধ—পাখির ডাক থেমে গেছে, মানুষজনও যেন ঘরের ভেতরে আড়াল নিয়েছে। শুধু মাঠের মাঝখানে বাতাসে নড়ছিল ছেঁড়া জামা।

আমরা তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুলে গরমের ছুটি শুরু হয়েছে মাত্র কয়েকদিন। দুপুর হলেই সবার চোখ টানে সেই আমগাছটা। বিশাল ডালপালা, ছায়ায় ঢেকে যেত আধখানা মাঠ। গাছ ভরা কাঁচা আম ঝুলে থাকত, যেন আমাদের ডাকছে—“আসো, এসো আমাকে খাও।”

আমাদের দলটা ছিল ৬ জনের। আমি, আমার সেরা বন্ধু মিলন, খোকন, সুমন, রতন আর একমাত্র মেয়ে সদস্য—চাঁদনী। ওদের সাথেই কাটত আমার শৈশবের সব দুষ্টুমি।

সেদিন দুপুরে আমরা ঠিক করলাম—আজ পিকনিক হবে আমগাছের তলায়। খাওয়ার জন্য আলাদা কিছু লাগবে না, গাছ থেকে পেড়ে নেওয়া কাঁচা আমই যথেষ্ট। সঙ্গে থাকবে নুন আর কাঁচা লঙ্কা।

মিলনের বাড়ি থেকে আমরা নুন নিয়ে এলাম একটা পুরোনো কাগজে বেঁধে। খোকন একটা ছোট্ট কৌটায় কাঁচা লঙ্কা নিয়ে এল। আর রতনের হাতে ছিল ছোট্ট ছুরি। সব প্রস্তুত।

চাঁদনী হেসে বলল—
— “তোমরা সব ঠিক করেছ, কিন্তু পাতায় খাবার পরিবেশন হবে তো? নইলে কিভাবে পিকনিক?”

আমরা সবাই হেসে উঠলাম। চাঁদনী নিজেই কাছে থাকা কদম গাছের বড় বড় পাতা ছিঁড়ে সুন্দর করে সাজিয়ে নিল। যেন সত্যিই রাজকীয় আয়োজন।

আমরা সবাই গাছের ছায়ায় বসে পড়লাম। দুপুরে গরম বাতাস গায়ে লাগলেও ছায়াটা ছিল শীতল। রতন গাছে উঠে টুপটাপ করে আম পাড়তে লাগল। নিচে দাঁড়িয়ে আমরা হাত বাড়িয়ে নিলাম। ছুরি দিয়ে টুকরো করে নুন-লঙ্কা মেখে একেকটা টুকরো মুখে দিতেই—“আহা, কী স্বাদ!”

মনে হচ্ছিল, পুরো পৃথিবীর সেরা খাবার আমরা খাচ্ছি।

সুমন মুখ বাঁকিয়ে বলল—
— “উফ, লঙ্কাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে।”
আমরা হেসে লুটোপুটি।

মিলন বলল—
— “কে জানে, একদিন হয়তো এ স্বাদ আর পাব না।”

তখন বুঝিনি, ওর কথার মধ্যে কতটা সত্যি ছিল।

আমাদের আম-লঙ্কার পিকনিক বেশ জমে উঠেছিল। একেকজনের চোখে-মুখে সেই নিষ্পাপ আনন্দ, যা কেবল শৈশবেই সম্ভব। কিন্তু সুখের সময় নাকি বেশিক্ষণ টেকে না—সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

আমরা মজে খাচ্ছি, হঠাৎ চাঁদনী ফিসফিস করে বলল—
— “দেখো… কেউ আসছে!”

সত্যিই, দূরে মাঠের ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে আসছে এক লোক। আমরা চিনতে দেরি করিনি—ওই যে গাছটার মালিক, গজেন কাকা। তিনি ছিলেন রাগী স্বভাবের, কারও গাছে ফল খাওয়া সহ্য করতেন না।

আমাদের বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। খোকন তো অস্থির হয়ে উঠল—
— “এবার বুঝি শেষ! সবাই পালাও!”

আমরা যে যার দিকে দৌড় দিলাম। রতন তখনও গাছে ঝুলছিল, তাড়াহুড়োয় নামতে গিয়ে পা পিছলে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। সুমনের জামাটা কাঁটায় ছিঁড়ে গেল। আমি আর মিলন দৌড়ে একটা ঝোপে লুকোলাম। চাঁদনী ভয় পেয়ে কেঁদেই ফেলল।

grismer dupurer lukochuri 2

গজেন কাকার গলা শুনতে পেলাম—
— “এই দুষ্টু ছেলে-মেয়েরা! আমার আম নষ্ট করে তোরা যদি আরেকবার ধরা পড়িস, তবে ঠিক থাকবে না।”

তিনি কিছু আম হাতে তুলে নিলেন আর চারপাশে খুঁজতে লাগলেন। আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঝোপে বসে রইলাম। মনে হচ্ছিল, যদি এবার ধরা পড়ি তবে আর রক্ষা নেই।

শেষমেশ ভাগ্য ভালো ছিল—কাকা অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। আমরা ধীরে ধীরে উঠে দৌড়ে বাড়ির পথে ছুটলাম।

ছোট ছোট স্মৃতি

ফিরতে ফিরতে হঠাৎ মনে পড়ল, এরকম ধরা পড়ার ভয় আমাদের নতুন কিছু নয়।

  • কখনো মাঠে বসে লাটিম ঘোরাতে ঘোরাতে সময় ভুলে যাওয়া,
  • কখনো স্কুল ফাঁকি দিয়ে বটতলায় আড্ডা মারা,
  • কখনো দুপুরে সাইকেলে চড়ে গ্রামের পুকুরপাড়ে দৌড়ে যাওয়া—
    এসব নিয়েই কাটছিল আমাদের দিন।

আর ছিল কাসেট প্লেয়ারের জাদু। দুপুরের খাওয়া শেষে মিলনের ঘরে গিয়ে আমরা সবাই মিলে টেপ রেকর্ডারে গান শুনতাম—কখনও কুমার শানুর কণ্ঠ, কখনও আলমগীর-সাবিনার সিনেমার গান। টেপ বারবার রিওয়াইন্ড করতে করতে কী যে মজা পেতাম!

এসবই যেন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।

ভয় আর পরিণতি

কিন্তু সেদিনের ভয় একেবারে আমাদের তাড়া করছিল। আমি বাড়ি ফিরতেই বাবার চোখে পড়ে গেল জামায় লঙ্কার দাগ আর হাতে আঁচড়ের চিহ্ন।

বাবা কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন—
— “কোথায় ছিলি দুপুরে?”

আমি তোতলাতে লাগলাম। কিন্তু বাবার চোখ এড়ানো গেল না। কান ধরে উঠবস করালেন। আর গম্ভীর গলায় বললেন—
— “কখনো অন্যের জিনিস চুরি করে খাওয়া চলবে না। মনে রাখিস, গাছের আম যতই লোভনীয় হোক, সেটা আমাদের নয়।”

বাবার কথাগুলো কানে বাজতে লাগল। মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধ আমরা করেছি। অথচ ভেতরে ভেতরে সেই আম-লঙ্কার স্বাদ এখনো রয়ে গেছে জিভে, মিষ্টি স্মৃতি হয়ে।

বাবার বকুনি আর কান ধরে উঠবসের পর সেদিন রাতে আমার মন ভার হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আর কোনোদিন দুপুরে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলো করতে পারব না। কিন্তু শৈশবের প্রাণচাঞ্চল্য কি এত সহজে দমে যায়?

পরদিন বিকেলেই মিলন এসে ডাক দিল জানলার নিচে—
— “এই শোন, তোর বাবা ঘরে আছেন?”
আমি ফিসফিস করে বললাম—
— “আছেন তো… কিন্তু তুই এসেছিস কেন?”
— “চলো, মাঠে সবাই অপেক্ষা করছে। ভয় পেলে চলবে না। আজ কিন্তু খেলা হবেই।”

আমার বুক ধড়ফড় করছিল, তবুও টের না পেয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে গেলাম।

শৈশবের ছোট ছোট দুষ্টুমি

আমাদের আড্ডা এবার মাঠের পাশের খালের ধারে। দুপুরে গরম এতটাই যে খালের কুলুকুলু জলে নেমে সবাই হাত-মুখ ধুয়ে নিল। কেউ কেউ লাফিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করল। আমি জলে ভেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম—নীল আকাশে ভেসে থাকা তুলার মতো সাদা মেঘ যেন আমাদের খেলার সাথী।

খোকন মজা করে বলল—
— “আজ থেকে আমরা সবাই মিলে গোপন ক্লাব বানাব। নাম হবে ‘নুন-লঙ্কা দল’। নিয়ম হলো, যার কাছে গোপনে কিছু খাওয়ার জিনিস থাকবে, সে সবার সাথে ভাগ করে খাবে।”
আমরা হেসে উঠলাম। সেই ‘নুন-লঙ্কা দল’-এর নিয়ম মেনে কখনো টক ঝাল মুড়ি, কখনো গুড়-ভাত, কখনো বা শুকনো চানাচুর ভাগাভাগি করে খেতাম।

একদিন গমের মাঠে খেলতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। কৃষক চিৎকার করতেই সবাই দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেদিনও একই ভয়ের হাসি ছিল সবার মুখে।

আড্ডার সন্ধ্যা

গ্রীষ্মের সন্ধ্যা নামতে শুরু করলে আমরা প্রায়ই মাটির রাস্তার ধারে বসে থাকতাম। মশার ভনভন শব্দ, দূরে কুয়োর পাশে মেয়েদের জল তুলবার আওয়াজ, আর গরু-ছাগল ফেরার গলায় বাঁধা ঘণ্টার টুংটাং শব্দ—সব মিলিয়ে এক অন্যরকম আবহ।

চাঁদনী তখন হঠাৎ বলল—
— “আমাদের কি কোনোদিন এই সময়গুলো ফিরবে?”

আমরা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। কে জানত, সত্যিই এই সময়গুলো একদিন কেবল স্মৃতি হয়ে যাবে?

মিলন একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে আঁকতে আঁকতে বলল—
— “যতদিন আমরা বন্ধু আছি, সবই ফিরে আসবে।”

তারপর সবাই একসাথে হেসে উঠলাম। হাসির শব্দে যেন অন্ধকার গ্রাম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

মনের গোপন কোণে

সেই সময়েই প্রথম বুঝতে শুরু করেছিলাম, বন্ধুত্বের ভেতর কত আবেগ লুকিয়ে থাকে।

  • চাঁদনীর লাজুক হাসি,
  • মিলনের সবসময় পাশে থাকার ভরসা,
  • খোকন-রতনের দুষ্টুমি,
    সব মিলিয়ে আমাদের দিনগুলো যেন রঙিন হয়ে উঠত।

তবুও ভয়টা লেগেই থাকত—যদি আবার গাছের মালিকের কাছে ধরা পড়ি, অথবা বাবার হাতে বকুনি খেতে হয়! অথচ সেই ভয় আর আনন্দই আমাদের শৈশবকে গড়ে তুলেছিল।

সময় কত দ্রুত পাল্টে যায়! সেই সোনালি শৈশবের পর একে একে সবাই আলাদা হয়ে গেল। কেউ শহরে পড়তে গেল, কেউ বাবার ব্যবসায় হাত লাগাল। আমি-ও অনেক দূরে চলে গেলাম জীবনের টানে।

বছর কেটে গেল প্রায় পনেরো। চাকরির চাপে, ব্যস্ত শহুরে জীবনে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এক গ্রীষ্মের বিকেলে হঠাৎই মনে পড়ে গেল সেই আমগাছের কথা, সেই দুপুরের পিকনিকের কথা। মনে হলো, আর দেরি নয়—একবার গ্রামে ফিরে যাই।

ফেরা

গ্রামে পা দিতেই যেন চোখে জল এসে গেল। মাটির রাস্তা এখনও আগের মতো, তবে কোথাও কোথাও পাকা হয়েছে। পাশের মাঠে এখন আধুনিক সার-ওষুধে ভরা ফসল। তবুও বাতাসে সেই পুরোনো গন্ধ—শালিকের ডাক, গরুর ঘণ্টার শব্দ, আর কাদার গন্ধে ভরে উঠল বুক।

আমার প্রথম গন্তব্য সেই বিশাল আমগাছ। দূর থেকে দেখেই চিনে নিলাম। বয়স বেড়ে গেছে, ডালপালা কিছুটা শুকিয়ে গেছে, তবুও দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।

আমি গিয়ে গাছের নিচে দাঁড়ালাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম খসখসে গাছের ছাল। মনে হলো, যেন গাছটা আমাকে চিনে ফেলেছে।

স্মৃতির জোয়ার

চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল সেই দিন—

grismer dupurer lukochuri 1
  • আমরা ছয়জন বন্ধু গাছের নিচে বসে নুন-লঙ্কা মাখানো আম খাচ্ছি,
  • হঠাৎ গজেন কাকার গলা শুনে দৌড়ে পালাচ্ছি,
  • বাবার বকুনি খাচ্ছি,
  • আবার পরদিন খালের ধারে আড্ডা দিচ্ছি।

সব যেন ছবির মতো পরিষ্কার। বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার জমে উঠল।

চাঁদনী, মিলন, খোকন—কোথায় তারা এখন? কে জানে, হয়তো একইভাবে আমরাও স্মৃতির পাতায় রয়ে গেছি।

উপলব্ধি

আমি গাছের নিচে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। মাটির গন্ধ, পাতার ফাঁক দিয়ে আসা আলো, আর ভেতরে ভেতরে জমে থাকা স্মৃতি আমাকে ভিজিয়ে দিল।

grismer dupurer lukochuri 3

মনে হলো—শৈশবের আসল সৌন্দর্য ছিল না কেবল খেলাধুলোয়, বরং সেই ভাগাভাগি করা মুহূর্তগুলোয়। নুন-লঙ্কা দিয়ে কাঁচা আম খাওয়া, ধরা পড়ার ভয়, বাবার বকুনি—এসবই আসলে আমাদের বড় হওয়ার গল্প।

এখন টেবিলে সাজানো দামি ফল, রেস্তোরাঁর মশলাদার খাবার—সবই নিস্বাদ মনে হয়। কারণ সেই স্বাদ শুধু জিভে নয়, হৃদয়ে লেগে ছিল।

সমাপ্তি

গাছের নিচে বসে আমি একটুকরো শুকনো আমপাতা তুলে নিলাম। মনে মনে বললাম—
“ধন্যবাদ, শৈশব। তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে ভাগাভাগির আনন্দ, দুষ্টুমির মজা, আর জীবনের সত্যিকারের আবেগ।”

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছিল। দূরে গ্রামের মসজিদের আজানের ধ্বনি ভেসে এল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। মনে হলো, এই গাছের ছায়াতেই রয়ে গেছে আমার সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো।

আর হ্যাঁ—সেই স্বাদ, নুন-লঙ্কা-আমের টক ঝাল স্বাদ—আজও যেন মুখে লেগে আছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *