এক বৃষ্টিভেজা রাত
অচেনা শহর, অচেনা দেখা
কলকাতা শহরটা তনয়ার কাছে নতুন। ছোটবেলা থেকে সে শুনে এসেছে এই শহরের গল্প— বইয়ের পাতায়, টিভির পর্দায়, কিংবা মায়ের মুখে। কিন্তু বাস্তবের কলকাতা যেন কেমন আলাদা। এত আলো, এত মানুষ, এত শব্দ— সব মিলিয়ে প্রথম দেখায় ভীষণ অচেনা।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বেরিয়েই যেন একসাথে হাজারো শব্দ এসে আঘাত করল তার কানে। ট্যাক্সির হর্ন, রিকশাওয়ালার ডাকাডাকি, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আর মাথার ওপর হঠাৎই নামা আকাশভাঙা বৃষ্টি। হাতে ছোট্ট ব্যাগ, গায়ে পাতলা সালোয়ার কামিজ— তনয়া বুঝতেই পারল না এই অঝোর বৃষ্টিতে কোথায় যাবে।
সে গড়িয়াহাটে এক আত্মীয়ার বাড়ি উঠবে ঠিক করেছিল, সেখান থেকেই ইন্টারভিউতে যাবে। কিন্তু এত রাতে, এত ভিড়ের মধ্যে ঠিক কীভাবে পৌঁছোবে তা নিয়ে ভয় জমতে লাগল বুকের ভেতর।
ট্যাক্সি ডাকতে ডাকতে সে প্রায় ভিজে একাকার। ছাতা নেই, ব্যাগের ভেতর জামাকাপড় ভিজে যাবে কিনা সে নিয়ে দুশ্চিন্তা। পায়ের তলায় কাদাজল, চারদিক অচেনা মুখ। অস্থিরতায় তার গলা শুকিয়ে আসছিল।
ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ শুনতে পেল এক কোমল স্বর—
— “মাফ করবেন, কোথাও যাচ্ছেন? এত ভিজছেন কেন?”
তনয়া চমকে উঠল। পাশে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। বয়সে খুব বেশি না, হয়তো সাতাশ-আঠাশ হবে। গায়ে হালকা নীল শার্ট, হাতে কালো ছাতা। মুখে অদ্ভুত স্বস্তির ছাপ, চোখে যেন সহজ ভরসা।
তনয়া প্রথমে উত্তর দিল না। ভেবে দেখল— অচেনা শহর, অচেনা লোক; কথা বলা কি ঠিক হবে? কিন্তু বৃষ্টির তোড়ে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছিল না।
শেষে আস্তে বলল—
— “হ্যাঁ… গড়িয়াহাটের দিকে যেতে হবে। কিন্তু কোনো ট্যাক্সি পাচ্ছি না।”
ছেলেটি হাসল। হাসিটা ছিল শান্ত, অমায়িক।
— “আমি ওই দিকেই যাচ্ছি। চাইলে আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি। অন্তত এই বৃষ্টিতে একা ভিজে কষ্ট পাবেন না।”
তনয়া খানিক ইতস্তত করল। মনে একটুখানি ভয়, আবার ভরসাও। চোখের সামনে ঝাপসা বৃষ্টি, আর ছেলেটির বাড়ানো প্রস্তাব।
অবশেষে সে মাথা নুইয়ে ধীরে বলল—
— “ঠিক আছে… তবে আমি আপনার ছাতার নিচে থাকব, কিন্তু কোনো ঝামেলা চাই না।”
ছেলেটি মুচকি হেসে বলল—
— “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি অরণ্য। শুধু সাহায্য করতে চাই।”
এই প্রথম অচেনা শহরে তনয়া একটুখানি ভরসার আলো দেখতে পেল। অরণ্যের ছাতার নিচে পা বাড়াল সে, আর বৃষ্টিভেজা কলকাতা শহরের রাস্তায় শুরু হলো তাদের প্রথম পাশাপাশি হাঁটা।
ছাতার আড়ালে কাছাকাছি আসা
রাস্তার ওপর বৃষ্টির জল যেন ছোট ছোট খাল তৈরি করে দৌড়ে চলেছে। হেডলাইটের আলোয় ঝিলমিল করছে সেই জল। কলকাতার ব্যস্ত রাত হঠাৎই যেন অন্য রূপ নিয়েছে— রঙিন, অথচ ভিজে ভিজে নিস্তব্ধ।
অরণ্যের ছাতাটা খুব বড় নয়। দু’জনকে একসাথে নিয়ে হাঁটতে হলে অতি অবশ্যই কাছাকাছি আসতে হবে। তনয়া শুরুতে একটু দূরে দূরে হাঁটছিল, কিন্তু কয়েক কদম যেতেই বুঝল— তাতে কোনো লাভ নেই, ভিজতেই হবে।
অরণ্য ছাতার কোণটা তার দিকে একটু বেশি করে নামিয়ে দিল।
— “আপনি একটু মাঝখানে আসুন, না হলে ভিজে যাবেন।”
তনয়া লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে ফেলল।
— “না… আমি ঠিক আছি।”
অরণ্য হালকা হেসে কিছু বলল না। শুধু ছাতাটা আরও তার দিকে সরিয়ে ধরল।

পথটা খুব সহজ নয়। কোথাও কাদা, কোথাও জমে থাকা জল। এক জায়গায় হঠাৎই তনয়ার পা পিছলে গেল। ব্যাগ কাঁধ থেকে হেলে পড়ে যাচ্ছিল, সে নিজেও প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল।
মুহূর্তের মধ্যেই অরণ্যের হাত তাকে ধরে ফেলল। শক্ত, দৃঢ় হাত। যেন ঝড়ের মাঝেও তাকে টলতে দেবে না।
তনয়া শ্বাস ফেলে বলল—
— “ধ… ধন্যবাদ। না হলে পড়ে যেতাম।”
অরণ্যের ঠোঁটে মৃদু হাসি।
— “পড়ে গেলে আমি কি দাঁড়িয়ে দেখতাম?”
তনয়া কিছু বলল না। বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপন তৈরি হলো। অচেনা এই মানুষটিকে সে মোটে আধঘণ্টা আগে দেখেছে। অথচ তার হাত ধরে দাঁড়াতে গিয়ে যেন একটা চেনা নিরাপত্তা খুঁজে পেল।
বৃষ্টির শব্দের ভেতর দু’জনেই চুপচাপ হাঁটছিল। মাঝে মাঝে শুধু গাড়ির হর্ন কিংবা রিকশার ঘণ্টি বাজছিল।
তনয়া সাহস করে জিজ্ঞেস করল—
— “আপনি কোথায় থাকেন?”
অরণ্য সহজ গলায় বলল—
— “গড়িয়াহাটের কাছেই। আমি একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করি। লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কিন্তু আপাতত বিজ্ঞাপনেই টিকে আছি।”
তনয়া অবাক হলো। তার নিজেরও লেখালেখি ভালো লাগে— ডায়েরি, ছোট ছোট কবিতা, গল্প। কিন্তু অচেনা লোককে তা বলা যায় না ভেবে চুপ করে রইল।
অরণ্য আবার জিজ্ঞেস করল—
— “আপনি কলকাতায় কেন এলেন?”
তনয়া মৃদু গলায় উত্তর দিল—
— “কাল সকালে একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। মা অনেক কষ্ট করে সুযোগটা করে দিয়েছেন। তাই এসেছি।”
অরণ্যের চোখে তখন অদ্ভুত মায়া।
— “আপনার মা নিশ্চয়ই খুব গর্বিত হবেন আপনার জন্য।”
তনয়া হালকা হেসে ফেলল। এত সহজে যে কেউ তাকে বোঝে— সেটা তার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা।
ছাতার নিচে হাঁটতে হাঁটতে তাদের মাঝে দূরত্ব যেন অজান্তেই কমে যাচ্ছিল। বৃষ্টির শব্দ তাদের নীরবতাকে ঢেকে দিচ্ছিল, অথচ সেই নীরবতার ভেতরও এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা জন্ম নিচ্ছিল।
বৃষ্টির ভেতর গল্প
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। রাস্তার বাতিগুলো ভিজে হলুদ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। অরণ্য আর তনয়া হাঁটছে পাশাপাশি, ছাতার নিচে একই ছায়ায়।
কথা যেন অজান্তেই বেরিয়ে আসতে শুরু করল। তনয়া সাধারণত নতুন লোকের সঙ্গে এত সহজে কথা বলে না। কিন্তু অরণ্যের কণ্ঠস্বরের মধ্যে অদ্ভুত এক শান্তি ছিল, যেন সেই স্বর শুনলেই ভয় কেটে যায়।
অরণ্য জিজ্ঞেস করল—
— “আপনার ছোট শহরটা কেমন?”
তনয়া হেসে উত্তর দিল—
— “খুব ছোট, শান্ত জায়গা। সবাই সবাইকে চেনে। সন্ধ্যার পর রাস্তায় নীরবতা নামে। এখানে যেমন রাতেও এত কোলাহল, ওখানে তেমন কিছু নেই।”
অরণ্য মন দিয়ে শুনছিল। তারপর মৃদু গলায় বলল—
— “আসলে বড় শহরে সবাই এত তাড়াহুড়োয় ছুটে চলে যে, অনেক সময় নিজেদের মনটা শোনার সুযোগই হয় না।”
তনয়া তার চোখের দিকে তাকাল। সত্যিই কি এই মানুষটা এমন, নাকি শুধু এক রাতের আলাপের ভেতরেই তাকে এমন মনে হচ্ছে?
তারপর তনয়া নিজের গল্প খুলে বলল। বাবা নেই অনেক বছর, মা একাই সংসার সামলেছেন। সেই মায়ের স্বপ্ন— মেয়ে যেন চাকরি করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। তাই কলকাতায় আসা।
অরণ্য শুনে মৃদু হেসে বলল—
— “আপনার মা নিশ্চয়ই খুব সাহসী। আর আপনি… খুব ভাগ্যবান, এমন মায়ের মেয়ে।”
তনয়ার গলা হঠাৎ যেন আটকে গেল। অচেনা এক মানুষের মুখ থেকে নিজের জীবনের এত বড় কথার স্বীকৃতি পেয়ে বুক ভরে উঠল আবেগে।
অরণ্য এবার নিজের কথা বলল। সে কবিতা লেখে, ছোট গল্প লেখে। কলেজে পড়ার সময় থেকেই স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার। কিন্তু টিকে থাকার জন্য চাকরির পথ বেছে নিতে হয়েছে।
— “তবু লিখি,” সে বলল, “কারণ শব্দ না লিখলে আমি বাঁচতে পারি না।”
তনয়া অবাক হয়ে তাকাল। তার নিজের ডায়েরির পাতাগুলো হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল। অথচ সে কাউকে তা কখনো বলেনি।
বৃষ্টির শব্দ যেন ধীরে ধীরে তাদের চারপাশে অন্য এক জগৎ তৈরি করছিল। রাস্তার ভিজে আলোয় দু’জনের আলাপ চলতে থাকল— ছোট ছোট গল্প, অচেনা স্বপ্ন, আর অদ্ভুত মিল।
মাঝে মাঝে তনয়া খেয়াল করছিল, অরণ্যের চশমার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা জমছে। আর সেই ভেজা চোখে এমন এক কোমলতা, যা অজান্তেই তাকে টেনে নিচ্ছে আরও গভীরে।
তনয়া বুঝতে পারল, এ শহরে প্রথম রাতেই সে হয়তো এক অচেনা মানুষকে চেনা শুরু করে ফেলেছে।
হঠাৎ আশ্রয়
বৃষ্টি যেন থামার নামই নিচ্ছিল না। বরং রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই তার স্রোত আরও প্রবল হচ্ছিল। রাস্তার ধারে জমে থাকা জল ছোট ছোট পুকুরের মতো হয়ে উঠছিল, মাঝে মাঝে গাড়ি ছুটে গেলে সেই জলের ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল হাঁটতে থাকা মানুষকে।
অরণ্য আর তনয়া হাঁটতে হাঁটতে একসময় বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। গড়িয়াহাট তখনো অনেকটা দূরে। তনয়ার পায়ের স্যান্ডেল ভিজে একেবারে নরম হয়ে গিয়েছিল, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল।
অরণ্য খেয়াল করল।
— “আপনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন, তাই না?”
তনয়া হালকা হাসল।
— “হ্যাঁ… কিন্তু উপায় কী?”
ঠিক তখনই রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান চোখে পড়ল। টিনের চাল, বাঁশের বেঞ্চি, আর ভেতরে কেরোসিন লণ্ঠনের আলো। বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ করে ছাউনি থেকে ঝরছিল। দোকানদারও গুটিসুটি মেরে বসে আছে।
অরণ্য বলল—
— “চলুন, একটু বসি। গরম চা খেলে ভালো লাগবে।”
তনয়া একটুখানি দ্বিধা করল, তারপর রাজি হলো। দু’জন ভিজে ভিজে দোকানের ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট ঘরটা ভরে আছে ভেজা কাদার গন্ধে, তবে সেই গন্ধের ভেতরেই যেন এক অদ্ভুত উষ্ণতা।
দোকানদার গরম গরম চা এগিয়ে দিল কাঁচের ভাঙা গ্লাসে। তনয়া হাত দিয়ে গ্লাসটা জড়িয়ে ধরল, উষ্ণতা তার কাঁপতে থাকা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল।
অরণ্য মুচকি হেসে বলল—
— “জানেন, বৃষ্টির রাতে চায়ের স্বাদ আলাদা হয়। আর এ শহরে যত প্রেমের গল্প শুরু হয়েছে, তার অর্ধেকই এমন কোনো বৃষ্টির রাতে।”
তনয়া তাকাল অরণ্যের দিকে। কথাটা মজা করে বললেও, চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা ছিল। যেন সত্যিই সে বিশ্বাস করে বৃষ্টির রাত মানেই নতুন গল্পের শুরু।
তনয়া লজ্জা পেয়ে গ্লাসের ভেতর চায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার বুকের মধ্যে অজানা কাঁপন ছড়িয়ে গেল।
চায়ের দোকানের ভেতরে চারপাশ নিস্তব্ধ। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে, টিনের চালের শব্দ ঢেকে দিচ্ছে সবকিছু। মনে হচ্ছিল, এই ছোট্ট আশ্রয়টা শুধু তাদের জন্যই তৈরি হয়েছে— দুই অচেনা মানুষকে একে অপরের কাছাকাছি আনার জন্য।
অরণ্য ধীরে বলল—
— “আপনার নামটা এখনো জানলাম না তো।”
তনয়া মাথা তুলল।
— “তনয়া।”
অরণ্য নামটা কয়েকবার মনে মনে উচ্চারণ করল। তারপর বলল—
— “ভালো নাম। মানে— বৃষ্টির রাতে মানিয়ে যায়।”
তনয়া কিছু না বলে শুধু হাসল। অথচ সেই হাসির ভেতরে অরণ্যের জন্য প্রথমবার যেন একটা অচেনা দরজা খুলে গেল।
অচেনা রাত, চেনা অনুভূতি
চায়ের দোকান থেকে বেরোতেই তনয়া বুঝল, বৃষ্টি আরও জোরে নামছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, ট্যাক্সিও আর চোখে পড়ছে না। দোকানদার দোকান গুটিয়ে নিচ্ছে, যেন রাতটা শেষ হয়ে এসেছে শহরের।
অরণ্য কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল—
— “এভাবে ভিজে থাকা ঠিক হবে না। আমার বাসা কাছেই। চাইলে রাতটা ওখানে কাটিয়ে কাল সকালে চলে যেতে পারেন। নিরাপদ হবে।”
তনয়া থমকে গেল। এক অচেনা শহরে, এক অচেনা মানুষের সঙ্গে তার বাড়ি যাওয়া— এটা কি আদৌ ঠিক? ভেতরে ভেতরে ভয় তাকে গ্রাস করতে লাগল। কিন্তু বাইরে এই অঝোর বৃষ্টি, আর কোনো উপায় নেই।
অরণ্যের চোখে সে কোনো লোভ বা কৌশল দেখতে পেল না। বরং ছিল এক ধরনের নিশ্চিন্ত আশ্বাস। অনেক ভেবেচিন্তে তনয়া মৃদু গলায় বলল—
— “ঠিক আছে, তবে… আলাদা ঘরে থাকব।”
অরণ্য হেসে মাথা নাড়ল—
— “অবশ্যই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
অরণ্যের বাড়ি ছোট্ট ভাড়া বাসা। একতলা, সামনে ছোট বারান্দা। ভেতরে ঢুকতেই তনয়ার চোখে পড়ল— চারপাশে বইয়ে ভর্তি আলমারি, টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র, কলম। দেওয়ালে কিছু পুরনো ফ্রেমে বাঁধানো ছবি— হয়তো পরিবার বা বন্ধুদের।
ঘরটা খুব সাধারণ, অথচ কোথাও যেন একটা উষ্ণতা আছে। যেন অনেক স্বপ্নের নিঃশ্বাস মিশে আছে এই ছোট্ট ঘরে।
অরণ্য আলাদা ঘরে তনয়ার জন্য বিছানা তৈরি করল। একটা তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বলল—
— “ভিজে গেছেন, শুকিয়ে নিন। কাল সকালে আমি আপনাকে গড়িয়াহাট পৌঁছে দেব।”
তনয়া ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। এত অচেনা হয়েও এই মানুষটা যেন একদম সহজভাবে যত্ন নিচ্ছে।
রাত গভীর হলো। বাইরে বৃষ্টি এখনো ঝরছে। জানালার কাচে ফোঁটা ফোঁটা জল জমে গেছে। তনয়া বিছানায় শুয়ে আছে, অথচ ঘুম একটুও আসছে না।
মনের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি জমছে। ভয় নয়, অস্বস্তিও নয়— বরং এক অচেনা টান। যেন এই রাতটা শুধু তার আর অরণ্যের জন্যই তৈরি।
সে কানে পেল পাশের ঘরে কলমের শব্দ। হয়তো অরণ্য কিছু লিখছে। সেই শব্দের ফাঁকে বৃষ্টির টুপটাপ আওয়াজ মিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করছিল।
তনয়া চোখ বন্ধ করল। মনে হলো, হয়তো এই রাত তার জীবনে কোনোদিন মুছে যাবে না।
ভোরের আলো
রাতের দীর্ঘ বৃষ্টির পর যখন ভোরের আলো আস্তে আস্তে জানালা ভরিয়ে দিল, তনয়া ঘুম ভাঙল অচেনা এক প্রশান্তিতে। বাইরে ঝরঝরে আকাশ, মাটি এখনো ভিজে, আর বাতাসে ধুয়ে যাওয়া একরাশ নির্মলতা।

সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অরণ্য ইতিমধ্যেই জেগে গিয়েছে। রান্নাঘর থেকে চায়ের গন্ধ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ পর হাতে দু’কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে বেরিয়ে এল সে।
— “ঘুম কেমন হলো?” অরণ্যের গলায় এক অদ্ভুত কোমলতা।
তনয়া হেসে মাথা নাড়ল, — “ঘুমের চাইতে বৃষ্টির শব্দেই বেশি সময় কেটেছে।”
অরণ্য চুপ করে চায়ের কাপ তার হাতে দিল। দু’জনেই কিছুক্ষণ নীরবে চা খেল। নীরবতার ভেতর কোনো অস্বস্তি ছিল না, বরং ছিল এক অচেনা স্বস্তি, একে অপরের উপস্থিতি অনুভব করার শান্তি।
তনয়া ব্যাগ গুছোতে গুছোতে থেমে গেল। তার বুকের ভেতর হঠাৎ অদ্ভুত কষ্ট জমল। এই মানুষটিকে এক রাতের আলাপেই কেন এত কাছের মনে হচ্ছে? কেন যেন মনে হচ্ছে, বিদায়টা সহজ হবে না?
অরণ্য যেন তার মনের কথা পড়তে পারল। মৃদু হেসে বলল—
— “জানেন, গত রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে বিশেষ রাত ছিল। এতদিনে বুঝলাম, কিছু সম্পর্ক চেনা দিয়ে শুরু হয় না, হয় একসাথে কাটানো কিছু অদ্ভুত মুহূর্ত দিয়ে।”
তনয়ার চোখ ভিজে উঠল। সে আস্তে বলল—
— “আমারও তাই মনে হচ্ছে। কাল রাতটা… মনে হয় ভুলতে পারব না কোনোদিন।”
ট্যাক্সি ডাকল অরণ্য। ব্যাগ হাতে তনয়া গাড়িতে উঠল। ভোরের রোদে ঝলমল করছে শহর, কিন্তু তার চোখে ভেসে আছে ভেজা রাতের স্মৃতি।
গাড়ি ছুটে গেল। তনয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল— অরণ্য তখনো দাঁড়িয়ে, গেটের সামনে, বৃষ্টিভেজা মাটিতে সূর্যের আলোয় তাকে বিদায় দিচ্ছে।
সেই মুহূর্তে তনয়া অনুভব করল— হয়তো জীবন মাঝে মাঝে এমন কিছু রাত সাজিয়ে দেয়, যা এক জীবনের গল্প লিখে দেয়।
এ শহরে তার নতুন অধ্যায় শুরু হলো চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে। কিন্তু তার হৃদয়ের গোপন অধ্যায় শুরু হয়েছিল সেই এক বৃষ্টিভেজা রাতেই।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			