ধ্রুব ও কালীমা আয়না
রত্নদ্বীপে ছায়ার আগমন
রত্নদ্বীপ রাজ্যটি সত্যিই ছিল তার নামের যোগ্য। দিন হোক বা রাত, এক অদ্ভুত জাদুকরী আলো সবসময় এই রাজ্যের চারপাশ ঘিরে রাখত। এখানকার মাটি এত উর্বর ছিল যে, সামান্য বীজ ফেললেই তা সোনা রংয়ের ফসলে ভরে উঠত। এর কারণ ছিল তাদের প্রধান দেবতা, পূর্ণিমা চাঁদ। বিশ্বাস করা হতো, চাঁদের এক ফোঁটা জাদুকরী রস রাজ্যের মাটির গভীরে মিশে আছে।
এই রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে, সবচেয়ে উর্বর খেতের পাশে, ধ্রুবের ছোট্ট কুঁড়েঘর। ধ্রুব ছিল এক তরুণ কৃষক, যার হাতে ছিল অদ্ভুত জাদু—তার ছোঁয়ায় মাটি আরও নরম হতো, বীজেরা যেন আরও খুশি হয়ে উঠত। তার সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল না তার ফসল, বরং তার সহজে খুশি হওয়ার ক্ষমতা। সামান্য রোদের আলো, একটি ফুটফুটে ফুল কিংবা জোড়া শালিক দেখলেই সে হেসে উঠত। তার হাতের তৈরি মাটির পুতুল, যা দিয়ে সে ফসলের খেত সাজাত, সেগুলির মধ্যেও যেন এক সরল আনন্দ ভরে থাকত।
চাঁদের রং বদল
একদিন, পূর্ণিমা শেষ হওয়ার পর থেকেই গোলমাল শুরু হলো। আকাশ থেকে যেন রাতের পর রাত রাজ্যের পরিচিত সেই উষ্ণ জোছনা উধাও হতে শুরু করল। চাঁদ প্রতি রাতে আরও বিবর্ণ, আরও কালো হতে থাকল। প্রথমে ফসলগুলি ফ্যাকাশে হলো, তারপর তারা শুকোতে শুরু করল। কৃষকেরা মাথায় হাত দিল, কিন্তু ধ্রুব তখনও আশা ছাড়েনি। সে ভাবত, হয়তো মেঘের আড়াল।
কিন্তু সমস্যাটা শুধু ফসলেই সীমাবদ্ধ রইল না। চাঁদের আলোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন থেকেও যেন আনন্দ, আর বিশ্বাস উধাও হতে লাগল। প্রতিবেশীরা একে অপরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে শুরু করল। সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া, আর মনে পুষে রাখা ছোট ছোট লোভগুলি এখন প্রকাশ্যে আসতে লাগল। যেন কেউ তাদের হৃদয়ের সরলতাটুকু চুরি করে নিয়েছে।
একদিন গভীর রাতে, ধ্রুব যখন তার শুকিয়ে যাওয়া খেতের কাছে বসেছিল, তখন সে স্পষ্ট দেখতে পেল—চাঁদের মাঝখানে একটি কালো বিন্দুর মতো কিছু যেন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, এবং চাঁদের আলো সেই বিন্দুর দিকে টেনে নেওয়া হচ্ছে।
কালীমা আয়নার জন্ম
ভোরের আগে, রাজ্যের বৃদ্ধ পুরোহিত ধ্রুবের কুঁড়েঘরে এলেন। তার চোখে ভয়, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা।
“ধ্রুব,” বৃদ্ধ বললেন, “যা ঘটছে, তা কোনো প্রাকৃতিক নয়। এটা কালীমা আয়নার অভিশাপ। কয়েকশো বছর আগে এটি রাজ্যের ধন-ভান্ডারের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। আয়নাটা মানুষের হৃদয়ের ক্ষুদ্রতম লোভ-কে আকর্ষণ করে এবং সেগুলিকে একত্র করে এক কালো শক্তি তৈরি করে। এখন সেই শক্তি চাঁদকে গ্রাস করছে।”
ধ্রুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কেন সে চাঁদকে গ্রাস করছে, পুরোহিত মশাই? চাঁদ তো আমাদের জীবন!”

পুরোহিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কারণ চাঁদ আমাদের নিঃস্বার্থতার প্রতীক। যত বেশি মানুষ লোভী হচ্ছে, আয়নার শক্তি তত বাড়ছে এবং সেই শক্তি চাঁদের আলো চুরি করে নিজের জগতে টেনে নিচ্ছে। এইভাবেই ধীরে ধীরে চাঁদ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হবে, আর রত্নদ্বীপ পরিণত হবে শুধু কালো মাটিতে।”
পুরোহিত ধ্রুবকে একটি ভাঙা মাটির হরিণের পুতুল দেখালেন। “এটি সেই সময়ের পুতুল, যখন আয়নাটি প্রথম তৈরি হয়েছিল। এই পুতুলই তোমাকে রক্ষা করতে পারে। তোমাকে যেতে হবে সেই গুপ্ত প্রবেশপথে, যেখানে আয়নাটি তার শক্তি বাড়াচ্ছে।”
ধ্রুব দ্বিধা করল না। সে তার কোদাল আর কিছু মাটির পুতুল নিয়ে প্রস্তুত হলো। তার মনে ভয় ছিল না, ছিল শুধু তার প্রিয় রত্নদ্বীপ এবং তার ফসল বাঁচানোর সরল সংকল্প।
ত্যাগের পথ ও জোছনা-কন্যার সন্ধান
বৃদ্ধ পুরোহিতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধ্রুব পরদিন ভোরে তার যাত্রা শুরু করল। পুরোহিত বলেছিলেন, কালীমা আয়নার গুপ্ত প্রবেশপথটি রাজ্যের সবচেয়ে পুরাতন এবং সবচেয়ে অবহেলিত ইচ্ছে পূরণকারী ঝর্ণা-র নীচে লুকানো আছে। এই ঝর্ণাটি এমন এক জায়গায় ছিল যেখানে কেউই আর কোনোদিন কিছু চাইতে যেত না, কারণ সময়ের সাথে সাথে রাজ্যের মানুষ একে অপরের থেকে আশা করাই শ্রেয় মনে করত।
ধ্রুব হাঁটতে হাঁটতে দেখল, রাজ্যের পথে-ঘাটে এখনকার মানুষের মুখগুলো কেমন যেন মলিন আর হতাশ। কেউ কাউকে সাহায্য করছে না। সবাই শুধু নিজেদের ছোট ছোট জিনিস আগলে রাখছে। এমনকি ধ্রুব যখন এক ক্ষুধার্ত বৃদ্ধাকে নিজের ঝুলি থেকে শেষ পাঁচটি সোনালী শস্যদানা দিতে গেল, তখন বৃদ্ধা সন্দেহের চোখে তাকালেন।
“তুমি কেন আমাকে দিচ্ছো, ছেলে? এর বদলে তুমি কী চাও?” বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন।
ধ্রুব হেসে উত্তর দিল, “কিছুই চাই না, মা। আমার হাসিটাই যথেষ্ট। আমি বিশ্বাস করি, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এই সরলতা দেখে বৃদ্ধা অবাক হলেও শস্যদানা নিলেন। ধ্রুবের এই নিঃস্বার্থ আচরণ ছিল কালীমা আয়নার শক্তির ঠিক বিপরীত, তাই সে এগিয়ে যেতে পারল। তার সরলতা যেন এক অদৃশ্য ঢালের মতো কাজ করছিল।
নিঃস্বার্থ ঝর্ণা
দুপুরের দিকে সে পৌঁছে গেল সেই ঝর্ণার কাছে। ঝর্ণাটি প্রায় শুকনো, চারপাশ আগাছায় ভরা। ধ্রুব দেখল, ঝর্ণার পাশে একটা পুরোনো পাথরে খোদাই করা আছে: “যেখানে চাওয়া শেষ, সেখানেই পথের শুরু।”
ধ্রুব বুঝল, পথ খোলার জন্য তাকে কিছু একটা নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ করতে হবে। তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ছিল তার হাতে তৈরি মাটির পুতুলগুলি, যা সে সবসময় নিজের কোমরবন্ধে বেঁধে রাখত। এই পুতুলগুলির মধ্যে একটি ছিল তার শৈশবের বন্ধু, একটি ছোট্ট টুনটুনি পাখি। এটা দিয়েই সে প্রথম মাটির কাজ শিখেছিল।
ধ্রুব কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিন্তু দৃঢ়তার সাথে, সেই টুনটুনি পাখির পুতুলটি ঝর্ণার শুকনো গর্তের মধ্যে রেখে দিল।
মুহূর্তের মধ্যে ঝর্ণার জল হঠাৎ ছলছল করে উঠল। জল নয়, আসলে সেটি ছিল সাদা জোছনার মতো তরল আলো। সেই আলো পাথরের ফাটলে মিশে গেল এবং ঝর্ণার নীচে একটি অন্ধকার গর্তের মতো গুপ্ত প্রবেশপথ খুলে গেল।
জোছনা-কন্যার দর্শন
ধ্রুব নিঃশব্দে সেই সুড়ঙ্গে নামতে লাগল। সুড়ঙ্গটা ছিল শীতল এবং স্যাঁতসেঁতে। কিছুদূর যাওয়ার পর সে দেখল, সুড়ঙ্গের দেয়ালে কালো পাথরের মতো অজস্র ছোট ছোট আয়না লাগানো। সেগুলি ছিল কালীমা আয়নার ছোট ছোট অংশ। প্রতিটি আয়নায় মানুষের হৃদয়ের ক্ষণিক লোভের ছবি ভেসে উঠছিল। একটিতে দেখা যাচ্ছিল এক প্রতিবেশী অন্যজনের জমির সীমানা চুরি করার কথা ভাবছে, আরেকটিতে দেখা যাচ্ছিল এক দোকানি কীভাবে তার ক্রেতাকে ঠকাবে।
ধ্রুব যখন এই লোভগুলি দেখছিল, তখন তার মন কিছুটা বিষণ্ণ হলো। হঠাৎ সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় সে দেখল এক উজ্জ্বল নীল আলোর ঝলকানি।

সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক অপরূপা নারী, যার শরীর যেন চাঁদের ছায়া দিয়ে তৈরি। তার পোশাক রাতের আকাশের মতো কালো, তাতে হাজারো তারার কাজ করা। তার নাম জোছনা-কন্যা।
“আমি জানতাম কেউ একজন আসবে,” জোছনা-কন্যা মৃদু কণ্ঠে বলল। “আমি সেই আলোর প্রতিচ্ছবি যা চাঁদ তৈরি করেছিল। তোমার সরলতা আর নিঃস্বার্থ ত্যাগই আমাকে এখানে ডেকে এনেছে। আমি এখানে কালীমা আয়নার বন্দী।”
ধ্রুব অবাক হয়ে বলল, “বন্দী? কিন্তু আপনি তো এত উজ্জ্বল!”
জোছনা-কন্যা করুণ হাসি হেসে বলল, “আয়নাটি আমার অস্তিত্ব কেড়ে নিতে পারেনি, কিন্তু সে আমাকে পথ দেখানোর শক্তি থেকে বঞ্চিত করেছে। আমি জানি আয়নাটি কোথায়, কিন্তু আমি সেখানে যেতে পারছি না। তোমার হাতের নিঃস্বার্থতা-ই একমাত্র শক্তি যা আমাকে পথ দেখাতে পারে।”
ধ্রুব জিজ্ঞেস করল, “এর জন্য আমাকে কী করতে হবে?”
জোছনা-কন্যা তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “তোমাকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু পথটি তৈরি হবে শুধু ত্যাগ-এর ওপর। প্রতি পদক্ষেপে তোমাকে তোমার সবচেয়ে প্রিয় কিছু ত্যাগ করতে হবে। তুমি কি পারবে, ধ্রুব? তোমার যাত্রা এখন থেকে আর তোমার নয়, এটা হবে শুধু ত্যাগের পথ।”
ত্যাগের অগ্নিপরীক্ষা
জোছনা-কন্যার কথায় ধ্রুব মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তার সরল জীবনে প্রিয় জিনিসের সংখ্যা হয়তো হাতে গোনা ছিল, কিন্তু সেগুলোর প্রতি তার আসক্তি ছিল গভীর। তবুও, তার প্রিয় রত্নদ্বীপকে বাঁচানোর সংকল্প তার ব্যক্তিগত আসক্তির চেয়ে অনেক বড় ছিল।
“আমি প্রস্তুত, জোছনা-কন্যা,” ধ্রুব দৃঢ়কণ্ঠে বলল। “আমার কাছে নিজের বলে যা আছে, সব দিয়ে হলেও আমি চাঁদকে রক্ষা করব।”
জোছনা-কন্যা মৃদু হেসে তার হাত ধরল। সেই স্পর্শ ছিল চাঁদের আলোর মতো শীতল ও শান্তিদায়ক। যেই মুহূর্তে তারা দু’জন একসঙ্গে প্রথম ধাপ ফেলল, সুড়ঙ্গের মেঝেতে একটি আলোর রেখা তৈরি হলো। এই রেখাটিই তাদের গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাবে।
কিন্তু এই পথ ছিল বিভ্রম এবং পরীক্ষার পথ। প্রতি কয়েক পা চলার পর, পথের আলো হঠাৎ থেমে যাচ্ছিল, আর সামনে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হচ্ছিল। জোছনা-কন্যা জানাল, এটি কালীমা আয়নার তৈরি বিভ্রম। পথ খোলার জন্য ধ্রুবকে তার সবচেয়ে মূল্যবান কিছু সেই অদৃশ্য দেয়ালে উৎসর্গ করতে হবে।
প্রথম ত্যাগ: কর্মের স্মৃতি
প্রথম দেয়ালের সামনে ধ্রুবর মনে পড়ল—তার কোদাল। এটা শুধু একটা যন্ত্র ছিল না, এটা ছিল তার কৃষিকাজের অহংকার, তার কঠোর পরিশ্রম এবং সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। এই কোদাল দিয়ে সে তার ফসলের জন্ম দিত।
দেয়ালটি তাকে ফিসফিস করে বলল: “তোমার শ্রমের গর্ব, তোমার হাতেই শেষ করো। এটা ছাড়া তুমি আর কৃষক নও, ধ্রুব।”
ধ্রুবের চোখ ছলছল করে উঠল। সে তার হাত থেকে কোদালটি নিয়ে ভারী হৃদয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে মারল। কোদালটি দেয়ালে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি ধুলোয় মিশে গেল, যেন তা কোনোদিন ছিলই না। অদৃশ্য দেয়াল সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল, আর আলোর পথ আবার তৈরি হলো। ধ্রুব অনুভব করল, সে যেন তার পরিচয়ের একটা অংশ হারিয়ে ফেলেছে।
দ্বিতীয় ত্যাগ: শিল্পের আনন্দ
তারা কিছুটা এগিয়ে চলল। এবার পথ তৈরি হলো আরও অন্ধকার এবং শীতল এক গুহার মধ্যে। দ্বিতীয় দেয়ালটি যখন পথ রুদ্ধ করল, ধ্রুব দেখল তার কোমরে বাঁধা মাটির পুতুলগুলি—যা সে তার শৈশব থেকে যত্ন করে রেখেছিল। এই পুতুলগুলো তার শিল্পের প্রতি ভালোবাসা এবং মাটি দিয়ে জীবন সৃষ্টি করার আনন্দের প্রতীক ছিল।
দেয়ালটি এবার তীক্ষ্ণ স্বরে বলল: “তোমার শিল্প, তোমার আনন্দ, তোমার নিজস্ব সৃষ্টি। এগুলি ছেড়ে দিলে তোমার জীবন ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। তুমি কি প্রস্তুত ফ্যাকাশে হতে?”
ধ্রুব জানত, কৃষিকাজের পর এই পুতুল তৈরি করাই তার জীবনের একমাত্র আনন্দ ছিল। সে তার প্রিয়তম পুতুলটি হাতে নিল—একটি ছোট্ট হাতি, যা সে তার বাবার স্মৃতিতে তৈরি করেছিল। চোখ বন্ধ করে, সেই হাতির পুতুলটিকে সে কঠিনভাবে দেয়ালে ছুঁড়ে মারল। মাটির পুতুলটি দেয়ালে লেগে আলোর কণায় পরিণত হলো এবং পথ খুলে গেল। ধ্রুবের বুক ভরে গেল এক গভীর শূন্যতা দিয়ে, যেন তার আনন্দের সমস্ত রং মুছে গেল।
চূড়ান্ত পরীক্ষা: ভালোবাসা আর আশা
শেষ দেয়ালটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। সেটি তৈরি হয়েছিল ধ্রুবের নিজের প্রতিচ্ছবি দিয়ে। এই দেয়ালটি কোনো বস্তুর ত্যাগ চাইছিল না, চাইছিল ধ্রুবের মনের সবচেয়ে প্রিয় অনুভূতি।
দেয়াল বলল: “তুমি চাঁদকে বাঁচাতে চাইছো কেন? কারণ তোমার আশা আছে, তোমার খেত আবার সোনায় ভরে উঠবে। তোমার এই আশা, তোমার ভালোবাসা, তোমার নিঃস্বার্থের ভান! তুমি কি পারো তোমার হৃদয়ের ‘আশা’ এবং ‘নিজেকে ভালোবাসার ক্ষমতা’ ত্যাগ করতে? যদি তুমি তা করো, তাহলে তুমি আর মানুষ থাকবে না, শুধু একটা শূন্য শরীর হবে।”
জোছনা-কন্যার মুখ মলিন হলো। সে মৃদুস্বরে বলল, “ধ্রুব, এটা সবচেয়ে কঠিন। এই ত্যাগের পর তুমি হয়তো আর কখনো হাসতে পারবে না।”

ধ্রুব পেছনে ফিরে রত্নদ্বীপের কথা ভাবল, যেখানে সবাই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। সে জানত, যদি সে ফিরেও যায়, তার আর কোনো আশা বা আনন্দ থাকবে না, যদি না চাঁদ ফেরে। সে দীর্ঘ, গভীর নিঃশ্বাস নিল।
“আমার নিজের আশা দিয়ে যদি গোটা রাজ্যের আশা ফিরে আসে, তবে আমি শূন্য হয়েও খুশি,” ধ্রুব বলল।
সে চোখ বন্ধ করল। তারপর নিজেকে ভালোবাসার এবং ভবিষ্যতের প্রতি সমস্ত আশা করার অনুভূতিকে জোর করে মন থেকে সরিয়ে দিল। সে অনুভব করল তার হৃদয়ের কোথাও একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা হলো, এবং সেই ব্যাথা একটি তীব্র আলোয় পরিণত হয়ে দেয়ালে আঘাত হানল।
দেয়াল ভেঙে গেল।
ধ্রুব হাঁপাতে হাঁপাতে দেখল, সামনে এক বিশাল, কালো গুহার মাঝখানে কালীমা আয়না তার পুরো শক্তি নিয়ে বসে আছে। ধ্রুব এখন আর খুশি নয়, কিন্তু সে দৃঢ়। তার হৃদয়ে এখন আর নিজের জন্য কোনো ভালোবাসা নেই, আছে শুধু কর্তব্যের অনুভূতি।
আয়নার বিভ্রম ও নিঃস্বার্থের যুদ্ধ
দেওয়াল ভাঙার পর ধ্রুব এবং জোছনা-কন্যা বিশাল এক গুহার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। গুহাটি ছিল সম্পূর্ণ কালো স্ফটিকের তৈরি। মাঝখানে একটি বিশাল কালো আয়না, যার নাম কালীমা আয়না, স্থিরভাবে দাঁড়িয়েছিল। আয়নার ভেতরের গভীর কালো শূন্যতা যেন চাঁদের চুরি হয়ে যাওয়া সমস্ত আলো গ্রাস করছিল। গুহার ছাদ থেকে ঝুলে থাকা কাঁচের মতো ছোট ছোট টুকরোগুলিতে রাজ্যের মানুষের লোভ, ঈর্ষা আর হতাশার প্রতিচ্ছবি ক্রমাগত প্রতিফলিত হচ্ছিল।
জোছনা-কন্যা ফিসফিস করে বলল, “ধ্রুব, এটাই আয়নার মূল কেন্দ্র। এর শক্তি এখন চরম পর্যায়ে। এর সামনে দাঁড়ানো মানে আমাদের ভেতরের সবচেয়ে দুর্বল আর লোভী অংশটার মুখোমুখি হওয়া।”
ধ্রুব অনুভব করল, তার হৃদয় এখন প্রায় শূন্য। তার ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা বা ভালোবাসার অনুভূতি না থাকায়, আয়না তার ওপর সহজে প্রভাব ফেলতে পারছিল না। কিন্তু, আয়নাটি এখন রাজ্যের সম্মিলিত লোভ-এর শক্তি দিয়ে আঘাত হানবে।
বিভ্রমের খেলা
হঠাৎ কালীমা আয়না থেকে একটি তীক্ষ্ণ, হিসহিসে কণ্ঠস্বর ভেসে এল। এটা কোনো মানুষের কন্ঠ ছিল না, ছিল রাজ্যের মানুষের সম্মিলিত লোভ আর হতাশার প্রতিধ্বনি।
“কৃষক ছেলে! তুমি এখানে কী চাও? তুমি তোমার জীবনের সব প্রিয় বস্তু ত্যাগ করে এসেছ। কিন্তু তুমি কি জানো, এই সব ত্যাগের ফল কী? তুমি যদি চাঁদকে ফিরিয়েও আনো, রত্নদ্বীপের মানুষ তোমাকে ভুলে যাবে। তারা মনে রাখবে না তুমি তাদের জন্য কী করেছ,” আয়নাটি বিদ্রূপ করল।
মুহূর্তের মধ্যে ধ্রুবের সামনে একটি বিভ্রম সৃষ্টি হলো। সে দেখল, সে গ্রামে ফিরে এসেছে। কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারছে না। তার ফেলে আসা জমিতে অন্য কেউ ফসল কাটছে। তার নাম মুছে গেছে ইতিহাস থেকে। বিভ্রমটি তাকে বলল: “নিজেকে ভালোবাসার ক্ষমতা যখন তুমি ত্যাগ করেছো, তখন তোমার কাজের স্বীকৃতি চাওয়ার অধিকারও নেই। যাও, এই ফাঁকা জীবন নিয়ে ফিরে যাও!”
কিন্তু ধ্রুবের পাশে ছিল জোছনা-কন্যা। তার শীতল স্পর্শ ধ্রুবকে মনে করিয়ে দিল: সে স্বীকৃতি চায় না, সে শুধু মুক্তি চায়।
নিঃস্বার্থের তীর
ধ্রুব চোখ বন্ধ করে নিজের ফাঁকা মনকে মনে করার চেষ্টা করল। সে এখন আর নিজেকে নিয়ে ভাবে না। সে শুধুই এক কর্তব্যের ধারক। সে তার শেষ অস্ত্র বের করল—তার হাতে তৈরি ভাঙা হরিণের পুতুলটি, যা পুরোহিত তাকে দিয়েছিলেন।
“এই পুতুল,” ধ্রুব বলল, “আমার কাছে কোনও ব্যক্তিগত মূল্য বহন করে না। এটা শুধু অতীতের একটি নিঃস্বার্থ প্রতিশ্রুতির প্রতীক। তুমি লোভ চাও, ঘৃণা চাও। কিন্তু তোমার সেই শক্তি নেই যে তুমি ত্যাগের গভীরতাকে স্পর্শ করো।”
ধ্রুব পুতুলটি শক্ত করে ধরল। তখন জোছনা-কন্যা দ্রুত বলল, “ধ্রুব! আয়নার আসল অভিশাপ তার কেন্দ্রে নয়, বরং এর প্রতিফলন-এ! মানুষের সম্মিলিত লোভের প্রতিফলনই চাঁদকে গ্রাস করছে। তোমাকে এর প্রতিফলন বন্ধ করতে হবে!”
ধ্রুব বুঝল। আয়নাটিকে ভাঙা সম্ভব নয়, কারণ তার শক্তি মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে আছে। কিন্তু প্রতিফলন বন্ধ করা যেতে পারে।
সে তার হাতে থাকা ভাঙা হরিণের পুতুলটি এমনভাবে ছুঁড়ে মারল, যাতে সেটি কালীমা আয়নার একদম কেন্দ্রে গিয়ে না পড়ে, বরং আয়নার ঠিক সামনে এসে মাটিতে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে যায়।
ভাঙা পুতুলটি আয়নার ভেতরের কালো শূন্যতাকে দু’ভাগ করে দিল।
আলোর বিস্ফোরণ
সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল। আয়নার সামনে থাকা ভাঙা পুতুল-এর ক্ষুদ্র ছায়াটি যেন আয়নার ভেতরের বিশাল কালো শক্তিকে ধরে ফেলল। কালীমা আয়না থেকে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বের হলো। পুতুলের ভাঙা অংশটি প্রতিফলিত হতে লাগল। সেই প্রতিফলনে লোভ বা ঘৃণা নয়, বরং একটি ভাঙা হৃদয়ের শূন্যতা ফুটে উঠল, যা কোনো লোভের জন্ম দেয় না।
আয়নাটি সেই শূন্যতা সহ্য করতে পারল না। সেটি জোরে কেঁপে উঠল এবং তার কালো স্ফটিকের শরীর ফেটে গেল। চাঁদ থেকে চুরি করা সমস্ত আলো একটি নীল-সাদা আলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে গেল।
জোছনা-কন্যা উল্লাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “আমরা পেরেছি, ধ্রুব! চাঁদ মুক্ত!”
ধ্রুব চারপাশে তাকাল। আয়নাটির এখন শুধু একটা ভাঙা, সাধারণ কাঁচের টুকরোর মতো পড়ে আছে। ধ্রুব অনুভব করল সে জেগে উঠেছে, কিন্তু তার হৃদয়ের সেই আনন্দের উৎসটি এখনও ফাঁকা।
নীরব প্রত্যাবর্তন ও ধ্রুবের স্থায়ী উপহার
আলোর বিস্ফোরণের পর, জোছনা-কন্যার সাহায্যে ধ্রুব দ্রুত সুড়ঙ্গপথে ফিরে এলো। ঝর্ণার কাছে পৌঁছে তারা দেখল, ঝর্ণার জল আবার উপচে পড়ছে, কিন্তু এখনকার জল শুধু জল নয়—তাতে চাঁদের সদ্য-মুক্ত হওয়া আলোর ঝলকানি মেশানো।
“আমার কাজ শেষ,” জোছনা-কন্যা শান্তস্বরে ধ্রুবকে বলল। “চাঁদ ফিরে গেছে, এবং রত্নদ্বীপে আবার আলো ফিরবে। তোমার নিঃস্বার্থ ত্যাগই এই কাজ সম্ভব করেছে। তুমি এখন মুক্ত, ধ্রুব।”
ধ্রুব জোছনা-কন্যার দিকে তাকাল। তার মনে কোনো আনন্দ বা বিজয়ীর উল্লাস ছিল না, কেবল এক গভীর শান্তি ছিল। সে তার নিজেকে ভালোবাসার ক্ষমতা, তার শিল্পকলার আনন্দ, তার শ্রমের গর্ব—সবকিছুই ত্যাগ করেছে। সে এখন একজন শূন্য ধারক, যা শুধু কর্তব্য পালন করতে জানে।
“ধন্যবাদ, জোছনা-কন্যা,” ধ্রুব বলল, তার কণ্ঠে কোনো আবেগ ছিল না।
জোছনা-কন্যা মৃদু হেসে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে চাঁদের আলোর সাথে মিশে গেল। ধ্রুব তখন একা, নিঃস্বার্থের পথে হাঁটা এক নীরব পথিক।
রত্নদ্বীপে নতুন আলো
ধ্রুব যখন রত্নদ্বীপের পথে ফিরে এলো, সে দেখল রাজ্যের পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। রাত এখনও গভীর, কিন্তু চাঁদ এখন আবার উষ্ণ, সোনালী আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলো মাটির উপর পড়তেই শুকিয়ে যাওয়া ফসলের খেতগুলিতে যেন প্রাণের স্পন্দন ফিরে আসছে। মানুষজন ঘর থেকে বের হয়ে অবাক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। তাদের চোখে এখন আর সন্দেহ বা লোভ নেই, আছে লজ্জা এবং এক নতুন কৃতজ্ঞতাবোধ।
ধ্রুব নীরবে তার কুঁড়েঘরের দিকে হেঁটে গেল। পথে তার সাথে অনেকের দেখা হলো, কিন্তু কালীমা আয়না যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, কেউই তাকে চিনতে পারল না। মানুষজন চাঁদের ফিরে আসার আনন্দেই মগ্ন ছিল, তাদের হৃদয়ের অন্ধকার দূর করতে একজন সাধারণ কৃষক কী ত্যাগ স্বীকার করেছে, তা জানার বা মনে করার সুযোগ তাদের ছিল না।
বৃদ্ধা, যাকে ধ্রুব তার শেষ শস্যদানাগুলি দিয়েছিল, তিনি ধ্রুবকে দেখেও জিজ্ঞেস করলেন, “কে তুমি, বাছা? আমার জমিতে সোনা রংয়ের ফসল ফলানোর জন্য চাঁদকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
ধ্রুব কিছু বলল না। সে তার নিজের খেতের দিকে গেল, যেখানে তার সেই কোদাল বা মাটির পুতুল তৈরি করার আনন্দের স্মৃতিগুলো ছিল। সে অনুভব করল, তার হাতে এখন আর সেই সৃজনশীল জাদু নেই, কিন্তু তার হাতে এখন একটি স্থায়ী শান্তি আছে।
ধ্রুবের স্থায়ী উপহার
ধ্রুব তার খেতের মাঝখানে গিয়ে বসল। সে নিজে খুশি হতে ভুলে গেছে, কিন্তু সে দেখল, চাঁদের আলো যখন তার ফাঁকা হৃদয়ের উপর পড়ল, তখন এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল।
যেহেতু ধ্রুব তার সমস্ত ব্যক্তিগত লোভ, আশা এবং অহংকার ত্যাগ করেছিল, তার হৃদয় একটি নিখাদ আধারে পরিণত হয়েছিল। এখন চাঁদের আলো সেই আধারের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে জমিতে পড়ছিল। এই আলো ছিল সাধারণ চাঁদের আলোর চেয়েও বিশেষ—এটি ছিল নিঃস্বার্থ ত্যাগের আলো।
এই নতুন, পরিবর্তিত আলো যেখানে পড়ল, সেখানকার ফসল শুধু সোনা রংয়ের হলো না, বরং সেই ফসল যে খেল, সেও তার হৃদয়ে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও লোভকে জয় করার শক্তি পেত।
ধ্রুব হয়তো রাজ্যের চোখে বিস্মৃত হয়ে গেল, কিন্তু সে রত্নদ্বীপকে এক স্থায়ী উপহার দিয়ে গেল। সে আর হাসতে পারত না, কিন্তু তার খেতের ফসল এবং তার হাতের ছোঁয়া রাজ্যের মানুষদের হাসি ফিরিয়ে দিল। ধ্রুবের জীবনের গল্প হয়ে উঠল রত্নদ্বীপের সবচেয়ে গোপন এবং পবিত্র শিক্ষা—নিঃস্বার্থ ত্যাগই পৃথিবীতে সত্যিকারের জাদুর জন্ম দেয়, যদিও সেই ত্যাগের মূল্য কেবল ত্যাগ স্বীকারকারীই জানতে পারে।
ধ্রুব বাকি জীবন নিঃশব্দে চাষ করে গেল। তার খেত থেকে সবসময় উজ্জ্বলতম আলো আসত, যা রাজ্যের মানুষদের অন্ধকারেও পথ দেখাত। সে আর কোনোদিন মাটির পুতুল বানায়নি, কিন্তু তার ফাঁকা হৃদয়ের নীরবতা ছিল তার সবচেয়ে বড় শিল্প।
