চোরাবালির ভালোবাসা
স্থিরতার মোহ এবং সুন্দর মুখোশ
অর্ণবের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পরিমাপ করা, প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল নির্ভুল অঙ্কের মতো। বাইশ বছর বয়সে সে যে কর্পোরেট সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখেছিল, ছত্রিশ বছর বয়সে সে সেই সিঁড়ির একেবারে শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল—ধীরে, স্থিরভাবে, কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে। তার কাছে জীবন মানেই ছিল সরলতা, শৃঙ্খলা এবং নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আর তাই, যখন জীবনসঙ্গী নির্বাচনের পালা এলো, অর্ণব খুঁজছিল এমন এক ভালোবাসার নারী, যে তার এই স্থির পৃথিবীতে এক টুকরো শান্ত, অচঞ্চল আকাশ হয়ে থাকবে।
মিহিকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী পরিবেশে—শহরের কোলাহল এড়িয়ে এক ছোট হস্তশিল্প মেলায়। মিহিকা সেখানে নিজের হাতে আঁকা কিছু বিমূর্ত ছবি প্রদর্শন করছিল। অর্ণবের মনোযোগ গেল তার ছবির দিকে নয়, বরং মিহিকার চোখের দিকে। সেই চোখ দুটি ছিল অদ্ভুত শান্ত, যেন তাতে পৃথিবীর কোনো জটিলতা স্পর্শ করেনি। একরাশ ঘন কালো চুল, মিষ্টি হাসি এবং নম্র বাচনভঙ্গি—মিহিকার সমগ্র ব্যক্তিত্বে ছিল এক স্নিগ্ধতা, যা অর্ণবের স্থিরতার ধারণাকে আরও দৃঢ় করে তুলল।
তাদের প্রথম আলাপটি ছিল শিল্পের সরলতা নিয়ে।
“আপনার ছবিগুলো খুব শান্ত,” অর্ণব বলেছিল। “যেন সব কোলাহল বাইরে রেখে এসেছে।”
মিহিকা হেসেছিল। “কোলাহল তো বাইরেই থাকে, অর্ণব দা। ভেতরের দিকটা শান্ত রাখাই আসল শিল্প।”
এই কথাটি অর্ণবের হৃদয়ে গভীর দাগ কাটল। সে যেন তার জীবনের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেল। পরের তিন মাস জুড়ে অর্ণবের সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল কেবল মিহিকা। মিহিকা ছিল এক খোলা বইয়ের মতো। সে তার ছোটবেলার স্বপ্ন, শিল্পকলার প্রতি টান, এবং জীবনকে সাধারণ ছন্দে উপভোগ করার ইচ্ছে—সবটাই খুব সাবলীলভাবে অর্ণবের সামনে তুলে ধরত। মিহিকা জানত কীভাবে কথা বলতে হয়, কখন চুপ থাকতে হয়। সে সবসময় অর্ণবের বড় বড় সাফল্যগুলো নিয়ে গর্ব করত, কিন্তু সেগুলোর প্রতি কোনো লোভ দেখাত না।
অর্ণব একদিন মিহিকাকে বলেছিল, “মিহিকা, আমি জীবনে যা কিছু করি, সবটাই একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য। আমি ঝুঁকি ঘৃণা করি। তুমি আমার জীবনে ঠিক সেই ‘নিরাপত্তা’ আর ‘শান্তি’ এনেছো, যা আমি এতকাল খুঁজছিলাম।”

মিহিকা আলতো করে অর্ণবের হাত ধরে বলেছিল, “অর্ণব দা, আমি জানি তুমি জীবনে কত পরিশ্রম করেছো। আমি শুধু চাই তুমি শান্তিতে থাকো। আমি তোমার জীবনে কোনো অস্থিরতা আনব না, কথা দিচ্ছি।”
মিহিকার এই ‘কথা দিচ্ছি’ শব্দবন্ধটি অর্ণবের কাছে একটি চুক্তিপত্রের মতো মনে হয়েছিল। সে নিশ্চিত হলো—এই মেয়েটিই তার জন্য সঠিক। মিহিকার ভেতরে কোনো গোপন কক্ষ নেই, কোনো জটিলতা নেই। তার ভালোবাসা সরল, তার জীবনবোধ স্বচ্ছ। সে স্থির করল, দ্রুতই মিহিকাকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চায়।
কিন্তু অর্ণব জানত না, মিহিকার চোখ বা হাসি—কোনোটাই তার সরল মনের প্রতীক ছিল না। বাইরের শান্ত সমুদ্রের নিচে যেমন প্রলয় লুকিয়ে থাকে, ঠিক তেমনি মিহিকার স্নিগ্ধ চেহারার নিচে ছিল এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা। মিহিকা অর্ণবের ‘স্থিরতার মোহ’-কে ঘৃণা করত। সে অর্ণবের জীবনে এসেছিল সেই স্থিরতাকে ভেঙে দিয়ে প্রমাণ করার জন্য যে, পৃথিবীতে কোনো বিশ্বাসই নিরঙ্কুশ নয়। ভালোবাসার সম্পর্কও চোরাবালির মতো, উপরে মসৃণ কিন্তু ভেতরে ফাঁদ।
সেই রাতে, অর্ণব যখন মিহিকাকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা ভাবছিল, তখন মিহিকা তার ঘরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাসছিল। এই হাসি ছিল নীরব, শীতল। সে মনে মনে বলছিল, “অর্ণব দা, তুমি তোমার স্থিরতার ওপর বড্ড বেশি ভরসা করো। আমি তোমার সেই ভরসাটাকেই চোরাবালির মতো গ্রাস করে নেব। অপেক্ষায় থাকো।”
অর্ণব তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। সে জানেনা, সে প্রেমের কঠিন বালিতে পা রেখেছে, যা তাকে দ্রুত টেনে নিয়ে যাচ্ছে গভীরে।
অদৃশ্য ফাটল এবং নিয়ন্ত্রণ
অর্ণব এবং মিহিকার সম্পর্কের বয়স তখন প্রায় আট মাস। বাইরে থেকে তাদের সম্পর্কটি ছিল ঈর্ষণীয়। প্রতি সন্ধ্যায় অর্ণব অফিস শেষে ঠিক সময়ে মিহিকার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাত, হাতে থাকত ছোট্ট কোনো উপহার। সপ্তাহান্তে তাদের পরিকল্পনা থাকত সুনির্দিষ্ট; কখনও আর্ট গ্যালারি, কখনও শান্ত কোনো ক্যাফে। অর্ণব তার জীবনের স্থিতিশীলতা মিহিকার মধ্যেও প্রতিস্থাপন করতে চাইছিল, এবং আপাতদৃষ্টিতে মিহিকা সেই ছাঁচে নিজেকে ঢেলে দিচ্ছিল।
কিন্তু চোরাবালি যেমন উপরে শান্ত হলেও নিচে তার প্রকৃতি পাল্টাতে শুরু করে, মিহিকার আচরণেও সূক্ষ্ম পরিবর্তন আসতে শুরু করল। এই পরিবর্তনগুলো ছিল এতটাই সামান্য যে, অর্ণবের মতো সরল বিশ্বাসী মানুষের পক্ষে তা সহজে ধরা কঠিন ছিল।
একদিন সন্ধ্যায় অর্ণব কল করল। ফোনটি রিং হলো, কিন্তু মিহিকা তুলে কেটে দিল। অর্ণব অবাক হলো। মিনিট পাঁচেক পর মিহিকা ফোন করে বলল, “সরি অর্ণব দা, খুব জরুরি একটা আর্ট প্রজেক্টের কাজ করছিলাম। মন দিতে পারছিলাম না।”
অর্ণব বলল, “এত জরুরি কাজ? আমি না হয় পরে ফোন করতাম।”
মিহিকা অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি নিজেই ভাবছিলাম তোমাকে বলি, কিন্তু তুমি যদি ভুল বোঝো! আসলে এটা এত বড় একটা সুযোগ, আমাকে অন্য শিল্পীদের সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। তাই তোমাকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না, ভাবছিলাম তুমি হয়তো ভাববে আমি বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী।”
মিহিকা এমনভাবে নিজেকে চিত্রিত করল যেন সে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য লড়ছে এবং অর্ণব যেন তার পথে বাধা। অর্ণব তৎক্ষণাৎ ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বলল, “আরে না, না! তুমি তোমার কাজ করো। আমি বরং খুশি যে তুমি এত প্যাশনেট।” মিহিকা জিতে গেল। অর্ণব তার কাজের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে মিহিকার ওই মুহূর্তের লুকোচুরিকে উপেক্ষা করল।
এই ঘটনার কিছুদিন পর একদিন দুপুরে অর্ণব অপ্রত্যাশিতভাবে মিহিকার আর্ট গ্যালারির কাছাকাছি গিয়েছিল। সেখানে সে মিহিকাকে তার পুরোনো বন্ধু, রণবীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে দেখল। রণবীরের সঙ্গে মিহিকার সম্পর্ক ছিল কলেজ জীবন থেকে। অথচ মিহিকা অর্ণবকে জানিয়েছিল, রণবীর কেবলই তার “দূরের এক প্রতিবেশী” এবং তাদের মধ্যে খুব একটা কথা হয় না।
অর্ণব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তাদের কাছে যেতেই মিহিকা তড়িৎ গতিতে পরিস্থিতি সামাল দিল। তার চোখে সামান্য উদ্বেগ দেখা গেলেও মুহূর্তে তা ঢেকে গেল এক মিষ্টি, মেকি হাসি দিয়ে।
“আরে অর্ণব দা! দেখো, রণবীরের সঙ্গে দেখা। এর সঙ্গে আমার এখন সম্পর্কটা একটু খারাপ,” মিহিকা দ্রুত রণবীরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “রণবীর, অর্ণব আমার সবথেকে কাছের বন্ধু—মানে, তুমি জানোই, আমার স্পেশাল কেউ।”
এরপর অর্ণবকে ফিসফিস করে বলল, “ওর সঙ্গে আমার কিছুদিন আগে একটা বড় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। তাই তোমাকে বলতে চাইনি। তুমি আবার অন্য কিছু ভেবো না!”
রণবীর সেখান থেকে দ্রুত বিদায় নিল। অর্ণব মিহিকার দিকে তাকিয়ে দেখল তার চোখে জল, কিন্তু অর্ণব জানে না, এই জল ছিল নিছকই অভিনয়। অর্ণব সরলভাবে ধরে নিল, মিহিকা হয়তো তার পুরোনো সম্পর্ক নিয়ে অস্বস্তিতে আছে এবং তার কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিল। সে বরং মিহিকার প্রতি আরও বেশি সহানুভূতিশীল হলো।

মিহিকা তখন অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো? তুমি তো জানো আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চাই না। কিন্তু তোমার এই হঠাৎ এসে পড়া… তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো অর্ণব দা? তুমি কি আমাকে তোমার পছন্দের ছাঁচে বাঁধতে চাইছো? সম্পর্ক তো স্বাধীনতা দেয়, দেয় না?”
মিহিকার এই প্রশ্ন অর্ণবের একেবারে দুর্বল জায়গায় আঘাত করল। অর্ণব সবথেকে বেশি ভয় পেত ‘নিয়ন্ত্রণকারী’ হিসেবে পরিচিত হতে। সে তৎক্ষণাৎ নিজের সন্দেহ মুছে ফেলে মিহিকার সামনে নিজেকে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ করার জন্য আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠল। সে ক্ষমা চাইল। সে মিহিকাকে বোঝাল যে সে তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়।
আসলে মিহিকা এটাই চেয়েছিল। সে অর্ণবের অতিরিক্ত বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তার নিয়ন্ত্রণের প্রবণতাকে আঘাত করল। সে অর্ণবের মনে ঢুকিয়ে দিল যে, তার স্বাধীনতাকে প্রশ্ন করা মানেই ভালোবাসা কমে যাওয়া। অর্ণব তখন থেকে মিহিকার আচরণে অসঙ্গতি দেখলেও নিজের সন্দেহ চেপে যেতে শুরু করল। সে বুঝতে পারল না, তার প্রতিটি ‘বিশ্বাস’ মিহিকার চোরাবালির গর্তকে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছে।
গভীরে ডোবার শুরু
দ্বিতীয় অধ্যায়ের ঘটনার পর অর্ণব নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মিহিকার প্রতি নিবেদিত করে দিল। সে আর প্রশ্ন করত না, শুধু মিহিকার স্বাধীনতা এবং প্রয়োজনকেই বেশি গুরুত্ব দিত। মিহিকা তার এই মানসিক দুর্বলতা পুরোপুরি কাজে লাগালো। অর্ণব এখন মিহিকার কাছে এমন এক নিরাপদ আশ্রয়, যা তার পরীক্ষামূলক খেলার জন্য আদর্শ ক্ষেত্র।
একদিন সন্ধ্যায়, মিহিকা ছিল অস্বাভাবিকভাবে শান্ত এবং বিষণ্ণ। অর্ণব কারণ জানতে চাইলে মিহিকা শুধু বলল, “কিছু পুরোনো জটিলতা আছে, অর্ণব দা। তুমি শুনলে আমাকে ভুল বুঝবে।” এই কথা বলেই সে নিজেকে গুটিয়ে নিল। অর্ণবের ‘ত্রাতা’ হওয়ার মানসিকতা তখন জেগে উঠল। সে জোর করল—মিহিকাকে সবটা খুলে বলতে হবে।
মিহিকা অনেক দ্বিধার পর একটি পুরোনো চিঠি অর্ণবের হাতে তুলে দিল। চিঠিটি ছিল তার কলেজের এক প্রাক্তন প্রেমিকের, যার নাম ছিল দীপ্ত। চিঠিতে দীপ্ত মিহিকার কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য আকুতি জানিয়েছে। চিঠির ভাষা ছিল আবেগপূর্ণ, যেখানে দীপ্ত দাবি করেছে যে সে একটি বড় বিপদে পড়েছে এবং মিহিকা ছাড়া তার আর কেউ নেই। সেখানে উল্লেখ করা ছিল যে, যদি মিহিকা সাহায্য না করে, তবে দীপ্ত তাদের পুরোনো ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের কিছু তথ্য বা ছবি ফাঁস করে দেবে।
অর্ণব চিঠিটি পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার স্থির পৃথিবীতে এমন নাটকীয়তা অপ্রত্যাশিত ছিল। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল দীপ্তর ওপর, মিহিকার ওপর নয়।
মিহিকা তখন চোখ মুছতে মুছতে বলল, “দেখলে তো? আমি তোমাকে বলতে চাইনি কারণ আমি জানি না তুমি এগুলো সহ্য করতে পারবে কিনা। সবাই মনে করে আমি খুব শান্ত, কিন্তু আমার অতীতে অনেক অন্ধকার আছে। আমি তোমার মতো স্থিতিশীল জীবন পাইনি। আমি চাইনি তুমি আমাকে খারাপ ভাবো।”
মিহিকার এই ‘অন্ধকার’ এবং ‘অসহায়তা’-র স্বীকারোক্তি অর্ণবকে দুর্বল করে দিল। সে মিহিকার অতীতকে উপেক্ষা করে বর্তমানের ‘ভালো মানুষ’ মিহিকাকে রক্ষা করতে চাইল। সে ভুলে গেল যে, ভালোবাসার ভিত্তি হওয়া উচিত সততা, অতীতের লুকোচুরি নয়। অর্ণবের কাছে এখন মিহিকার প্রতি তার বিশ্বাস প্রমাণ করার এটাই শেষ সুযোগ।
অর্ণব মিহিকাকে দৃঢ়ভাবে আশ্বাস দিল, “আমি তোমার পাশে আছি, মিহিকা। তোমার অতীতকে আমি ভয় পাই না। তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেব না। বলো, কত টাকা লাগবে?”
মিহিকা প্রথমে রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু অর্ণবের চাপাচাপিতে সে একটি বড় অঙ্কের কথা বলল, যা দীপ্ত দাবি করেছে। অর্ণব মুহূর্তের মধ্যে নিজের একটি বড় ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে দিল। সে দীপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা মিটিয়ে দিতে চাইল, মিহিকার অনুরোধে গোপনে। মিহিকা জানিয়েছিল, সে চায় না এই ঘটনা কেউ জানুক, এতে তার সামাজিক সম্মান নষ্ট হবে।
এই দীপ্ত ছিল মিহিকারই একজন সহ-অভিনেতা। টাকাটা ছিল আসলে অর্ণবের সম্পর্কের প্রতি নির্ভরশীলতা পরীক্ষার একটি অংশ, যা মিহিকার পরিকল্পনার একটি ধাপ মাত্র। অর্ণবের টাকা দেওয়ার পর মিহিকা গভীর সন্তুষ্টি পেল। সে দেখল, অর্ণব নিজের সঞ্চয় এবং নিজের বিচারবুদ্ধিকে উপেক্ষা করে তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সেই রাতে, অর্ণব যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল যে, সে মিহিকাকে রক্ষা করতে পেরেছে, মিহিকা তখন হাসছিল। অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে মিহিকা ফিসফিস করে বলল, “তুমি না থাকলে কী হতো আমার! আমি তোমায় চিরকাল বিশ্বাস করব।”
অর্ণব তৃপ্ত হলো। সে তখন নিজেকে মিহিকার জীবনে ‘ত্রাতা’ হিসেবে দেখছে, ভালোবাসার গভীরতম প্রমাণ হিসেবে তার টাকা খরচ করেছে। সে বুঝতে পারল না, সে এখন চোরাবালির মাঝখানে দাঁড়িয়ে। সে তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস—অর্থ, সঞ্চয় এবং বিচারবুদ্ধি—সবই হারালো। মিহিকার প্রতিটি মিথ্যা তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। অর্ণব তখনো ভাবছে সে মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু সে আসলে আরও বেশি করে ভালোবাসার ফাঁদে জড়িয়ে গেছে, যার নাম মিহিকা দিয়েছে: চোরাবালি।
চূড়ান্ত পতন এবং নির্মম সত্য
দীপ্তকে টাকা দেওয়ার পর অর্ণব কিছুটা শান্তি অনুভব করেছিল, যদিও তার আর্থিক অবস্থা কিছুটা দুর্বল হয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, সে তার ভালোবাসাকে এক কঠিন পরীক্ষা থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু মিহিকার আচরণ আবার পাল্টাতে শুরু করল। সে এখন অর্ণবকে আরও বেশি করে এড়িয়ে যায়। মিহিকার ফোনে প্রায়শই ‘নট রিচেবল’ থাকত, আর দেখা করার সময় সে প্রায়ই দেরি করত বা শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দিত।
অর্ণবের মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সেই পুরোনো সন্দেহ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এবার সে আর মিহিকার মিথ্যে কথায় ভুলতে চাইল না। সে মিহিকার ফ্ল্যাটের কাছে অপেক্ষা করতে শুরু করল।
একদিন সন্ধ্যায়, অর্ণব দেখল মিহিকা তার আর্ট গ্যালারির শিক্ষক, প্রবীর সেনগুপ্তের গাড়িতে উঠছে। প্রবীর সেনগুপ্ত একজন বিত্তশালী ও বিবাহিত ব্যক্তি। অর্ণব জানে, মিহিকা এর আগে প্রবীরের প্রশংসা করত এবং তাকে ‘গুরু’ হিসেবে সম্মান করত। কিন্তু আজ তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল অস্বাভাবিক। গাড়িটি একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে গেল। অর্ণব ধীরে ধীরে পিছু নিল, তার হৃদয়ে তখন শত ভূমিকম্প।
অর্ণব অ্যাপার্টমেন্টের লবিতে মিহিকার জন্য অপেক্ষা করল। প্রায় দু’ঘণ্টা পর মিহিকা যখন প্রবীরের সঙ্গে হাসি-খুশি মুখে বেরিয়ে এলো, অর্ণব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তার চোখে ছিল অবিশ্বাস, ক্রোধ এবং তীব্র যন্ত্রণা।
“মিহিকা!” অর্ণবের গলা কাঁপছিল। “এটা কী হচ্ছে? তোমার জরুরি কাজ কি এখন এই?”
মিহিকা এক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু এবার তার চোখে কোনো ভয় ছিল না, ছিল না কোনো কান্নার অভিনয়। তার চেহারা ছিল শীতল, কঠিন। প্রবীর পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন।
মিহিকা শান্তভাবে অর্ণবের দিকে তাকাল। “হ্যাঁ, অর্ণব দা। এটাই আমার জরুরি কাজ।”
অর্ণব চিৎকার করে উঠল, “কীসের জন্য! তোমার সেই তথাকথিত ব্ল্যাকমেলার, তোমার পুরোনো সম্পর্কের সমস্যা… সব মিথ্যে ছিল? তুমি… তুমি কি এই লোকটির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার জন্য আমাকে ব্যবহার করলে? আমার টাকা, আমার বিশ্বাস… সব কিছু?”
মিহিকার হাসি এবার চরম নিষ্ঠুরতায় মোড়ানো। সে বলল, “না অর্ণব দা। তুমি যা ভাবছো, তা নয়। প্রবীর আমার কোনো নতুন বাগদত্ত নয়। আর দীপ্ত? দীপ্ত ছিল একজন অভিনেতা, যাকে আমি ভাড়া করেছিলাম। তোমার টাকা, তোমার বিশ্বাস—সবই সত্যি ছিল… তবে আমার খেলার অংশ হিসেবে।”
অর্ণবের পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। তার মনে হলো সে যেন সত্যিই কোনো চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। “কী বলছো তুমি? এসব কীসের খেলা?”
মিহিকা শীতল চোখে তার দিকে তাকাল। তার কণ্ঠে ছিল এক নির্মম দার্শনিকতা।
“তুমি তোমার জীবনের স্থিতিশীলতা নিয়ে বড্ড বেশি গর্ব করতে, অর্ণব দা। তুমি বিশ্বাস করতে যে তুমিই তোমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করো, তোমার মতো শান্ত, সরল মেয়েই তোমার জন্য সেরা। কিন্তু আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম—ভালোবাসা একটি মিথ্যা, আর আমি সেই সত্যের চোরাবালি। তুমি এত স্থির, এত নিরাপদ থাকতে চাও যে, আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি তোমাকে ভালোবাসিনি, অর্ণব। আমি তোমার ওই স্থিরতার ধারণাটিকে ঘৃণা করতাম।”
মিহিকা এক পা এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “তুমি এত বোকা কেন? তুমিই তো সুযোগ দিয়েছিলে আমাকে। যখন তোমার সন্দেহ হয়েছিল, তখন তুমি আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাওনি। যখন তোমার অর্থ গেল, তখনো তুমি নিজেকে আমার ত্রাতা ভেবে গর্বিত হলে। তোমার এই অতিরিক্ত বিশ্বাস, তোমার এই ‘নিরাপত্তা’র মোহ—এটাই তোমাকে দুর্বল করেছে। তুমি এত গভীরে তলিয়ে গেলে যে এখন তোমার মুক্তি নেই।”
অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল। সে দেখল মিহিকার আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর, শূন্যতা ভরা মন, যা শুধু ধ্বংস করতে জানে। মিহিকা তার বিশ্বাস ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু সে আসলে অর্ণবকে তার নিজেরই অন্ধ বিশ্বাসের ফাঁদে ফেলেছে।
“তুমি আমার জীবনের সবথেকে বড় দুর্বলতা হয়ে এসেছিলে, অর্ণব। আমার কাজ শেষ। তুমি এখন মুক্ত। তোমার চোরাবালির ভালোবাসা তোমাকে গ্রাস করেছে।” এই কথা বলে মিহিকা তাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে গেল।
অর্ণব সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। টাকা, সম্পর্ক বা বিশ্বাসঘাতকতা—কোনো কিছুই তাকে এতটা আঘাত করেনি। আঘাত করেছিল মিহিকার নির্মম স্বীকারোক্তি এবং তার জীবনের প্রতি তার নিজের অন্ধ বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার কঠিন সত্যটি। সে বুঝতে পারল, সে এমন এক চোরাবালিতে পা রেখেছিল, যার উপরে ছিল কেবল একটি সুন্দর মুখোশ।
তলিয়ে যাওয়া, শূন্যতা ও নির্মম মুক্তি
মিহিকার শেষ কথাগুলো অর্ণবের কানে বিষের মতো বাজতে থাকল। সে তার স্থিরতা ও বিশ্বাসের অহংকার নিয়ে এসেছিল মিহিকার জীবনে, আর মিহিকা সেই অহংকারকেই ভেঙে চুরমার করে দিয়ে চলে গেল। প্রতারিত হওয়ার চেয়েও বেশি কষ্ট দিল মিহিকার সেই নির্মম সত্য—”ভালোবাসা একটি মিথ্যা, আর আমি সেই সত্যের চোরাবালি।”
অর্ণব অফিসে যাওয়া ছেড়ে দিল। তার সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে গেল। মিহিকার জন্য খরচ করা অর্থ ফিরে পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার আত্মবিশ্বাস। সে যখনই কোনো শান্ত মুখ দেখত, তখনই তার মনে পড়ত মিহিকার শীতল হাসি। সে বুঝতে পারল, তার সারাজীবনের অর্জিত ‘নিরাপত্তা’র ধারণা ছিল কাঁচের মতো ভঙ্গুর। মিহিকা তাকে প্রমাণ করে দিয়ে গেল যে, বাইরের সৌন্দর্য এবং ভেতরের শূন্যতা এতটাই মিশে থাকতে পারে যে, তাকে আলাদা করা অসম্ভব।
কয়েক সপ্তাহ ধরে অর্ণব কার্যত গৃহবন্দী হয়ে রইল। সে অনুভব করল সে যেন সত্যি সত্যিই সেই চোরাবালির ভেতরে ডুবে যাচ্ছে—চারপাশে শুধু পাঁক, কোনো অবলম্বন নেই। তার ঘুম আসত না, তার খাদ্যাভ্যাস এলোমেলো হয়ে গেল। সে অনুধাবন করল, মিহিকা শুধু অর্থ বা সময় নয়, তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি কেড়ে নিয়েছে—মানুষের উপর বিশ্বাস। সে আর বিশ্বাস করতে পারত না যে কোনো সম্পর্কই খাঁটি হতে পারে। প্রতিটি হাসি বা ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি তার কাছে কেবলই আরও একটি ফাঁদ বলে মনে হতো।
এক গভীর রাতে, যখন তার মন একেবারে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে, তখন অর্ণবের হঠাৎ মিহিকার একটি কথা মনে পড়ল—”তুমি এখন মুক্ত। তোমার চোরাবালির ভালোবাসা তোমাকে গ্রাস করেছে।”
‘গ্রাস করেছে’—এই শব্দটি তাকে সজাগ করে তুলল। সে মিহিকার খেলার অংশ হতে পারে, কিন্তু সেই খেলায় হেরে গিয়ে মিহিকার দার্শনিকতাকে চিরতরে মেনে নিতে পারে না। মিহিকা চেয়েছিল অর্ণব যেন জীবনের সব স্থিরতা ছেড়ে দেয়, যেন মিহিকার মতোই সেও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সবটাই মিথ্যা।
কিন্তু অর্ণব দেখল, তার এখনো একটি স্থিরতা অবশিষ্ট আছে—সেটি হলো তার নিজের জীবনের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ। মিহিকা তার বিশ্বাস ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু অর্ণবের ভবিষ্যৎ এখনো তার হাতে। সে যদি এই ক্ষত নিয়ে সারাজীবন বসে থাকে, তবে মিহিকার বিজয় সম্পূর্ণ হবে।

পরের দিন সকালে, অর্ণব প্রথমবার ঘর থেকে বের হলো। সে স্থির করল—মিহিকার দেওয়া এই ভয়ঙ্কর শিক্ষাকে সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তা হিসেবে গ্রহণ করবে। সে তার কর্পোরেট জীবন ছেড়ে দিল, যা সে একদিন স্থির ও নিরাপদ মনে করত। সে বুঝল, যে স্থিরতা বাইরে থেকে আসে, তা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।
অর্ণব একটি নতুন জীবন শুরু করল। সে এখন কোনো সম্পর্কে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে না। সে আবেগ নয়, বরং যুক্তি দিয়ে মানুষকে বিচার করে। সে ভালোবাসার গভীরতা বা প্রতিশ্রুতিতে আর মুগ্ধ হয় না, বরং মানুষের আচরণের অসঙ্গতিগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করে। সে জানে, চোরাবালি উপরে দেখতে মসৃণ হলেও ভেতরের সামান্য পরিবর্তনই তার বিপদ বোঝায়।
অর্ণবের নতুন জীবনটি আর আগের মতো ‘স্থির’ নয়, কিন্তু তা ‘সজাগ’। সে শিখেছে, ভালোবাসার সম্পর্কের মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রে ‘স্থিরতা’ নয়, প্রয়োজন হলো ‘সাবধানতা’ এবং ‘সচেতনতা’। মিহিকা তাকে চরম দুঃখ দিয়েছিল, কিন্তু বিনিময়ে এমন এক জ্ঞান দিয়ে গিয়েছিল, যা তাকে আর কোনোদিন কারও ছলনার শিকার হতে দেবে না।
অর্ণবের জীবনে মিহিকা এক স্থায়ী ক্ষত, এক সতর্কবার্তা—যেন নদীর ধারের সেই চোরাবালির চিহ্ন, যা কখনো মুছে যায় না। তবে সেই ক্ষত এখন দুর্বলতার কারণ নয়, বরং পরিণতবোধের প্রতীক। অর্ণব এখন ভালোবাসে, কিন্তু তার চোখের কোণে সর্বদা থাকে চোরাবালির প্রতি এক নির্মম সতর্কতা। সে আর কোনোদিন কোনো মানুষের মুখোশ দেখে তার ভেতরের শূন্যতাকে বিচার করার ভুল করে না।
