বৃষ্টিভেজা চিঠি

“বৃষ্টিভেজা চিঠি”

পুরোনো ডায়েরির ভেতর

(“বৃষ্টিভেজা চিঠি” গল্পের সূচনা)

বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন দুপুর থেকে।
আকাশ যেন নিজের মনের মতো কাঁদছিল—টিপটিপ, অবিরাম।
রক্তিম বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। অফিসে ছুটি, আর বাইরে এত বৃষ্টি যে কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই নেই।
হঠাৎ খেয়াল করল—বইয়ের তাকের ওপর পুরোনো ডায়েরিগুলো ধুলো জমে আছে।
একটা একটা করে নামাতে শুরু করল সে, ভাবল অনেকদিন পরে একটু গোছানো হোক।

পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা পাতা যেন একটু শক্তভাবে আটকে ছিল।
ওটা আলতো করে টানতেই ভিতর থেকে পড়ে গেল একটা খাম।
পুরোনো, হলুদে দাগ ধরা, কোণ একটু ছিঁড়ে গেছে।
খামের ওপর কালি ঝাপসা হয়ে আছে, তবু স্পষ্ট বোঝা গেল কিছু অক্ষর —
“রক্তিমের জন্য – মৈত্রেয়ী”

বৃষ্টিভেজা চিঠি

রক্তিম কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল সেই নামটার দিকে।
মৈত্রেয়ী…
বছর দশেক তো হয়ে গেল এই নামটা শোনা হয়নি।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক থেকে।

চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে গেছে।
বৃষ্টির শব্দ আরও ভারী।
হাত কাঁপতে কাঁপতে খামটা খুলল সে।

ভেতর থেকে একটা পাতলা চিঠি, কাগজের গায়ে পুরোনো আতরের হালকা গন্ধ।
লেখাগুলো খুব সুন্দর, হালকা নীল কালি।
প্রথম লাইনটাই যেন বুকের ভেতর কেমন করে তুলল —

“তুমি যদি কোনোদিন এই চিঠিটা পড়ো, জেনে নিও, আমি তোমায় ভুলিনি…”

রক্তিমের মাথার ভেতর যেন হঠাৎ বাজ পড়ল।
এই চিঠিটা কবে লিখেছিল মৈত্রেয়ী?
আর—এটা এখন এল কোথা থেকে?

তারপর চোখ চলে গেল নিচের দিকে—
তারিখ: ১৫ই আগস্ট, ২০১৩।

রক্তিম স্পষ্ট মনে করতে পারে, ওই বছরই ওরা স্কুল পাশ করেছিল।
ফেয়ারওয়েলের দিন, স্কুলের করিডোরে দাঁড়িয়ে মৈত্রেয়ী কিছু বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল।
তারপরের দিনই ও শুনেছিল, ওর পরিবার হঠাৎ দেশ ছেড়ে চলে গেছে।
কেউ জানত না কোথায়।

আর সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার লেখা চিঠি, দশ বছর পর এসে পড়ল তার হাতে!

বৃষ্টির আওয়াজ বাড়ছে, রক্তিম জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে।
দূরে একটা বিদ্যুতের ঝলকানি—তারপর অন্ধকার।
কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যেও, তার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যায়—
একটা স্কুল ইউনিফর্ম পরা মেয়ের হাসি,
ভেজা চুল থেকে টপটপ জল পড়ছে,
আর কানে ভেসে আসছে—
“রক্তিম, আমার একটা কথা ছিল…”

কিন্তু সেই কথাটা আর কোনোদিন শেষ হয়নি।
হয়তো সেই কথাটার উত্তরই লুকিয়ে আছে এই চিঠির ভেতর।

চিঠির গন্ধে ফিরে দেখা

চিঠিটার কাগজটা নরম, পুরোনো—হালকা ভাঁজ, কোণে একটু ছেঁড়া।
রক্তিম একবার নাকে তুলে ঘ্রাণ নেয়—
বাহ, কী অদ্ভুত!
বছর দশেক আগের কাগজে এখনও যেন সেই একই আতরের গন্ধ লেগে আছে।
হয়তো মৈত্রেয়ী নিজের হাতের গন্ধই রেখে গিয়েছিল।

চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল সে।

“রক্তিম,
যদি কোনোদিন এই চিঠিটা তোমার হাতে পড়ে,
জেনে নিও, আমি তোমায় ভুলিনি।
আমাদের শেষ দিনের বৃষ্টি, সেই ভিজে করিডোর, আর তোমার ভেজা চোখ—সবই আমার মনে আছে।
জানো, আমি বলতে চেয়েছিলাম কিছু, কিন্তু পারিনি।
তাই লিখে রাখলাম, যদি কখনও ভাগ্য তোমার কাছে এই কাগজটা পৌঁছে দেয়…”

রক্তিম থেমে গেল কিছুক্ষণ।
চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে উঠল সবকিছু।

বৃষ্টি বাড়ছে বাইরে।
জানলার কাঁচ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, আর ঠিক সেই জলেই ভেসে উঠছে অতীতের দৃশ্যগুলো।

স্কুলের সেই দিনগুলো…
দুজনের বেঞ্চ আলাদা হলেও চোখের ভাষা এক।
মৈত্রেয়ীর হাসিতে যেন সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যেত।
বিরতির সময় ক্যান্টিনের সামনের মুচমুচে পেঁয়াজি ভাগ করে খাওয়া,
আর টিফিনে তার বানানো আলুভাজা —
সবকিছু যেন এখনো ঘুরে বেড়ায় রক্তিমের মনে।

একদিন বৃষ্টি হচ্ছিল।
স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, সবাই বাড়ি ফিরে গেছে।
কেবল রক্তিম দাঁড়িয়ে ছিল ছাতাবিহীন, গেটের নিচে।
মৈত্রেয়ী এসে বলেছিল—
“তুমি না ছাতা আনো না কেন?”
রক্তিম হেসে বলেছিল, “তুমি থাকলে আর ছাতার দরকার হয়?”

সেই দিন, সেই উত্তরটা শুনে মৈত্রেয়ী কিছু বলেনি,
শুধু চোখ নামিয়ে একবার ভিজে চুল সরিয়ে নিয়েছিল।

চিঠিটায় মৈত্রেয়ী লিখেছিল আরও—

“জানো, আমি খুব ভয় পেতাম বলতে।
যদি তুমি হাসো, যদি দূরে সরে যাও…
কিন্তু আজও মনে হয়, তুমি বুঝেছিলে আমার চুপ করে থাকা কথাগুলো।
আজও বৃষ্টি নামলে মনে হয়, তুমি কোথাও বসে গান শুনছো, হয়তো সেই পুরোনো ‘চাঁদনী রাত’…”

রক্তিম একঝলক হাসল, অথচ চোখের কোণে জল জমে গেল।
ঠিক সেই গানটাই তো ওরা দু’জন মিলে গুনগুন করে গাইত ফেয়ারওয়েলের আগের দিন।

হঠাৎ একটা বিদ্যুতের ঝলকানিতে রুম আলোকিত হয়ে উঠল।
চিঠির শেষ লাইনটা পড়তে পড়তে রক্তিমের বুক কেঁপে উঠল—

“যদি কখনও আবার দেখা হয়,
আমি তোমায় একটা প্রশ্ন করব।
তুমি যদি তখনও উত্তরটা দিতে পারো,
বুঝব ভালোবাসা সত্যিই সময়কে হারাতে পারে।”

আর নিচে ছোট করে লেখা—
“তোমার মৈত্রেয়ী”

রক্তিম চিঠিটা ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখল।
তারপর নিঃশব্দে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

বৃষ্টি থামেনি,
কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এই বৃষ্টি যেন দশ বছরের জমে থাকা কথাগুলো ধুয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে গেল —
এই চিঠিটা এল কীভাবে?
এটা তো কখনোই তার হাতে আসার কথা ছিল না।
তাহলে কে পাঠাল?
আর কেন আজ, এত বছর পরে?

রক্তিম জানত না—এই বৃষ্টিভেজা চিঠিটাই তার জীবনের পুরোনো দরজাগুলো আবার খুলে দেবে।

অনুসন্ধান

চিঠিটা পড়ার পর থেকে রক্তিমের মাথায় কেবল একটাই চিন্তা ঘুরছে —
মৈত্রেয়ী এখন কোথায়?

রাত গড়িয়ে যায়, অথচ তার চোখে ঘুম নেই।
বিছানার পাশে রাখা চিঠিটার দিকে বারবার তাকায়।
বৃষ্টির শব্দ এখনও চলছে, যেন আকাশও থামতে চায় না।

মোবাইল তুলে রক্তিম সার্চ বারে টাইপ করল—
“Maitreyee Roy”
একটার পর একটা প্রোফাইল খুলে দেখে, কিন্তু কারও মুখেই সেই পরিচিত হাসি নেই।
কেউ হয়তো লন্ডনে, কেউ দিল্লিতে, কেউ বিদেশে বিয়ে করে সংসার করছে।
কিন্তু তার মৈত্রেয়ী?
না, কোথাও নেই।

পরদিন সকালে অফিসে গেলেও মন বসে না।
কম্পিউটার স্ক্রিনে প্রেজেন্টেশনের স্লাইড বদলাচ্ছে, আর তার মাথায় ঘুরছে চিঠির শেষ লাইনটা—

bristi veja chithi 3

“যদি কখনও দেখা হয়, আমি তোমায় একটা প্রশ্ন করব…”

“কী প্রশ্ন?”
নিজের মনে নিজেই বলে ওঠে রক্তিম।
কোন প্রশ্নটা সে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল দশ বছর আগে?
আর কী উত্তরই বা দেবে সে এখন?

বিকেলে কাজের অজুহাত দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সোজা চলে যায় পুরোনো স্কুলে।

গেটটা এখন অনেক ছোট লাগে।
রঙও বদলে গেছে, নতুন বিল্ডিং উঠেছে পাশে।
তবু করিডোরে পা রাখতেই মনে হয়—
ঠিক যেন সময় থেমে গেছে সেই জায়গায়।

ওর ক্লাসরুমটা এখন অন্য সেকশন,
তবু জানলার পাশে দাঁড়িয়ে হাওয়ার সঙ্গে চোখ বন্ধ করল রক্তিম।
বৃষ্টির গন্ধ যেন ঠিক আগের মতোই।

হঠাৎ পিছন থেকে এক গলা—
“এই! তুমি কি রক্তিম না?”

রক্তিম ঘুরে দেখে, সায়ন—ওদের ব্যাচের পুরোনো বন্ধু।
দু’জনের মধ্যে হালকা হাসি, নস্টালজিয়া

রক্তিম কিছু না ভেবেই বলে ফেলে,
“তুই জানিস মৈত্রেয়ী কোথায় আছে?”

সায়ন একটু চুপ করে বলে,
“মৈত্রেয়ী? মানে… ও তো দেশ ছেড়ে গেছিল ক্লাস টেনের পর।
কানাডায় থাকে শুনেছিলাম।
তারপর আর যোগাযোগ নেই কারও সঙ্গে।”

“কেউ জানে না ও এখন কী করে?”
রক্তিমের কণ্ঠে অদ্ভুত তাগিদ।

সায়ন কাঁধ ঝাঁকায়,
“না রে, হয়তো কোথাও আছে, হয়তো নতুন কেউ হয়ে গেছে।”

রক্তিম চুপ করে যায়।
কিন্তু মনে মনে একটাই সিদ্ধান্ত নেয় —
ওকে খুঁজবে।
যেভাবেই হোক।

রাতের দিকে আবার বসে ফেসবুকে।
এইবার সার্চ করে “Maitreyee Roy Canada”
একটা প্রোফাইল চোখে পড়ে—প্রাইভেট অ্যাকাউন্ট, প্রোফাইল পিকচারে সাদা বরফের ওপর দাঁড়িয়ে এক মেয়ে, চোখে চশমা, আর মুখে সেই একই হাসি।

হৃদস্পন্দন যেন বেড়ে যায়।
রক্তিম ক্লিক করে, তারপর দেখে—
মেসেজ অপশনটা সক্রিয়।

অনেকক্ষণ ভাবল, তারপর টাইপ করল—

“তুমি কি মৈত্রেয়ী রায়, সেন্ট মেরি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী?”

সেন্ড বাটনে ক্লিক করেই বুক কেঁপে উঠল।
যদি উত্তর না আসে?
অথবা ভুল হয়?

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়, রাত গভীর হয়, ফোন নিঃশব্দ।
রক্তিম জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
বৃষ্টিটা আবার শুরু হয়েছে।
তার মনে হয়, এই শহরের প্রতিটা বৃষ্টি এখন যেন ওর জন্যই নামে।

ঠিক তখনই ফোনে একটা হালকা ভাইব্রেশন।
স্ক্রিনে ভেসে উঠল—
“You have one new message.”

রক্তিম নিঃশব্দে ফোনটা তুলে নেয়।
বার্তাটা মাত্র একটা লাইন —

“তুমি কি এখনও সেই ডায়েরিটা রাখো?”

হৃদয় যেন থমকে যায় মুহূর্তে।
এটা কি… মৈত্রেয়ী?

রক্তিম আঙুল কাঁপতে কাঁপতে টাইপ করল—

“হ্যাঁ, এখনও রেখেছি। আর তোমার চিঠিটাও…”

কিছুক্ষণ পর আবার রিপ্লাই—

“তাহলে দেখা হবে?”

রক্তিম স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাইরে বৃষ্টির শব্দ মিশে যায় তার ধুকপুকানির সঙ্গে।
মনে হয় যেন সময় আবার ঘুরে গেছে সেই স্কুলবেলার দিকে।

বৃষ্টির শহরে পুনর্মিলন

রাতটা রক্তিমের কাছে শেষই হলো না।
চোখে ঘুম নেই, কেবল একটাই প্রশ্ন মাথায়—
“দেখা হবে মানে কী?”

কোথায়? কবে? সত্যিই কি সে—মৈত্রেয়ী?
নাকি কাকতালীয়ভাবে অন্য কেউ?

সকালে জানালার পর্দা সরাতেই দেখতে পেল, আকাশটা আজও ঘন মেঘে ঢাকা।
মনে হলো যেন শহরটা আগেই বুঝে নিয়েছে, আজ একটা গল্পের দিন।

ফোনটা বেজে উঠল ঠিক তখনই।
অচেনা নাম্বার।

রক্তিম কল রিসিভ করল।
ওপাশে নরম গলা—
“তুমি কেমন আছো, রক্তিম?”

এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গেল।
এই গলাটা সে চেনে।
বহু বছর আগে ঠিক এই সুরে একটা মেয়ের কণ্ঠে শুনেছিল “ভালো থেকো”।

“মৈত্রেয়ী?” — গলায় কাঁপুনি।

ওপাশ থেকে হালকা হাসি, “ভাবছিলাম তুমি চিনবে না হয়তো।”

“চিনব না?” — রক্তিমের গলায় হালকা কষ্ট মেশানো হাসি,
“তুমি তো ভুলিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নও।”

কিছুক্ষণের নীরবতা।
তারপর ও বলল,
“আজ বিকেলে শহরের ‘রেইনকাপ’ ক্যাফেটা চেনো?
সেখানে দেখা করব?”

রক্তিম কিছু না ভেবেই বলল, “হ্যাঁ, অবশ্যই।”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।
বৃষ্টি যেন ঠিক সময় মতো এসে পড়েছে, যেমনটা সবসময় হয় যখন ওর মনে হয় কিছু বিশেষ হতে যাচ্ছে।
রাস্তার ধারে ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে রক্তিম তাকিয়ে থাকে সেই কফিশপের দিকে।
“রেইনকাপ”—ছোট, সুন্দর একটা জায়গা, জানলার পাশে বসে কফির সঙ্গে বৃষ্টি দেখা যায়।

bristi veja chithi 4

ভিতরে ঢুকতেই দরজার ঘণ্টা বেজে ওঠে।
গরম কফির গন্ধ, নরম আলো, আর বাইরে অবিরাম বৃষ্টি।

জানলার ধারে বসে কেউ একজন কফির কাপ হাতে তাকিয়ে আছে বাইরে।
হালকা নীল শাড়ি, চুল খোলা, চোখে চশমা।
রক্তিম থেমে যায় দরজার কাছে।

মৈত্রেয়ী তাকায়, চোখে চোখ পড়ে যায়।

দুজনেই চুপ।
মনে হয় সময় যেন থেমে গেছে সেই মুহূর্তে।

রক্তিম ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে।
“অনেক বছর হয়ে গেল,” সে বলে।

মৈত্রেয়ী হেসে বলে, “হ্যাঁ, দশ বছর। অথচ মনে হয় কালকের কথা।”

কিছুক্ষণের নীরবতা—দুজনেই নিজেদের মগে কফি নেড়ে চলেছে, যেন শব্দ দিয়ে অতীতকে জাগাতে ভয় পাচ্ছে।

রক্তিম বলল, “তুমি চিঠিটা লিখেছিলে, কিন্তু পেলাম এখন কেন?”

মৈত্রেয়ী একটু হেসে বলে, “ওটা তো আমি কখনও পাঠাতে পারিনি।
তোমার ফেয়ারওয়েলের পরদিন আমরা হঠাৎ চলে যাচ্ছিলাম।
বাবার ট্রান্সফার হয়েছিল।
চিঠিটা ব্যাগে রেখেছিলাম, দিতে পারিনি।
তারপর একদিন মা সেটা রেখে গিয়েছিল তোমার মায়ের কাছে—পুরোনো বই ফেরত দিতে গিয়ে। হয়তো ডায়েরির ভেতরেই ছিল।”

রক্তিম হালকা হেসে বলল, “তাহলে ভাগ্যই ওটা আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছে।”

মৈত্রেয়ী মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর বলে, “তুমি জানো, আমি ভেবেছিলাম তুমি ভুলে গেছো আমাকে।”

রক্তিম জানলার দিকে তাকিয়ে বলে, “ভুলতে চাইলেও কিছু মানুষকে ভোলা যায় না।
বিশেষ করে, যারা আমাদের ভেতরটা বদলে দেয়।”

বাইরে বৃষ্টি তখন আরও জোরে নামছে।
জানলার কাঁচে জল গড়িয়ে পড়ছে, কফিশপের আলো তাতে প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করছে।
দুজনের মধ্যে যেন এক নিঃশব্দ সেতু তৈরি হচ্ছে।

“তুমি সুখী তো?” — হঠাৎ প্রশ্ন করে মৈত্রেয়ী।

রক্তিম একটু থেমে বলে, “সুখ? জানি না। হয়তো এখন খুঁজে নিচ্ছি।”

মৈত্রেয়ী হালকা হাসে, “আমিও।”

হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকানি।
এক মুহূর্তের আলোয় দুজনেই একে অপরের চোখে তাকায়।
সেই পুরোনো চোখ—যেখানে লুকিয়ে আছে বলা হয়নি এমন শত কথা।

মৈত্রেয়ী ধীরে বলে,
“চিঠিতে বলেছিলাম, যদি দেখা হয়, একটা প্রশ্ন করব…”

রক্তিম মাথা নাড়ে, “মনে আছে।”

“তুমি কি এখনও আমার জন্য বৃষ্টি ভালোবাসো?”

রক্তিম একটু হেসে বলে,
“আমি বৃষ্টি ভালোবাসি না, আমি বৃষ্টিতে তোমায় খুঁজি।”

দুজনের চোখে জল টলমল করে ওঠে।
বাইরে তখন বৃষ্টি থামার নাম নেই।

মৈত্রেয়ী কফির কাপ নামিয়ে বলে,
“সময় কত পাল্টে গেছে, তাই না?”

রক্তিম হেসে বলে, “সময় পাল্টেছে, কিন্তু আমাদের গল্পটা থেমে ছিল, শেষ হয়নি।”

বৃষ্টির রাত গাঢ় হয়।
কফিশপ বন্ধ হতে চলেছে।
দুজনেই জানলার বাইরে তাকায়—রাস্তায় বৃষ্টির আলো, ভিজে শহর, আর তাদের ভেতরে ফিরে আসা বহু পুরোনো ভালোবাসা।

মৈত্রেয়ী ধীরে বলে,
“হয়তো আবার দেখা হবে, হয়তো হবে না।
কিন্তু আজকের এই মুহূর্তটাই যথেষ্ট।”

রক্তিম কিছু বলে না।
চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
তারপর হালকা স্বরে বলে,
“এই বৃষ্টিটা রাখি মনে, শেষবারের মতো।”

দুজনের চোখে শুধু একটুকরো হাসি—
যেটা মিশে যায় বৃষ্টির সঙ্গে, শহরের আলোয়।

অসমাপ্তির পূর্ণতা

রাত্রি নেমে এসেছে।
কফিশপ বন্ধ হয়ে গেছে।
জানলার বাইরে অবিরাম বৃষ্টি।
শহর যেন এক ধরণের নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে।

রক্তিম আর মৈত্রেয়ী একসাথে বসে থাকে।
কফির শেষ চুমুক শেষ হয়েছে, আর দূরে রাস্তার জল কাঁচে ধীরে ধীরে গড়িয়ে যাচ্ছে।

মৈত্রেয়ী ধীরে বলে,
“চিঠিটা… লিখেছিলাম ফেয়ারওয়েলের দিন।
ওদিন কিছু বলার চেষ্টাও করেছিলাম, কিন্তু পারিনি।
আজও মনে আছে সেই ভিজে করিডোর, তোমার ভেজা চুল আর তোমার চোখের সেই অপেক্ষা।”

রক্তিম হাসে, অথচ চোখে জল জমে আসে,
“আমি চিঠি পেয়েছি আজ। মনে হলো, দশ বছর ধরে সেই অপেক্ষাটা কিছুতেই শেষ হয়নি।
আর আজ… আজ মনে হচ্ছে, সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে।”

মৈত্রেয়ী কফি ছেড়ে জানলার বাইরে তাকায়।
“চিঠি এল কেন এখনো, ভাবিনি কখনও।
কিন্তু ভাগ্য… হয়তো ভাগ্যই আমাদের এই মুহূর্ত এনে দিয়েছে।”

রক্তিম মাথা নাড়ে।
“হয়তো। হয়তো ঠিক তাই।
যখন সত্যিই কিছু গুরুত্বপূর্ণ, তখন সময়ও দাঁড়িয়ে থাকে।”

দুজনেই চুপ।
শুধু জানলার বাইরে বৃষ্টির ঝাপসা, আর রাস্তার লাইটে জল গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ।

হঠাৎ মৈত্রেয়ী বলে,
“দশ বছর হলো, কিন্তু তুমি জানো, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
আজও তুমি উত্তর দিতে পারলে… বুঝব সত্যিই আমরা কখনও আলাদা ছিলাম না।”

রক্তিম ধীরে হেসে বলে,
“উত্তর? উত্তরটা তো সবসময় আমার মধ্যে ছিল।
আমি তোমাকে ভোলার চেষ্টা করিনি, আর সম্ভবও নয়।”

মৈত্রেয়ীর চোখে আর্দ্রতা।
“ঠিক বলছো। অনেক কিছু ভুলে গেলেও, কিছুই হারায় না।
আজ আমরা আবার একসাথে। এটুকুই যথেষ্ট।”

bristi veja chithi 5

রক্তিম চুপচাপ মাথা নাড়ে।
বাইরে বৃষ্টি থামছে না।
তবে ভেতরের বৃষ্টি—অপ্রকাশিত অনুভূতির, অশ্রুত কথার—এবার ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে।

দুজনেই জানলার পাশে দাঁড়িয়ে, হাতের মধ্যে হাত মেলিয়েছে।
বছর দশেক ধরে অসমাপ্ত, অজানা প্রেম—এবার পূর্ণতা পেল।

মৈত্রেয়ী হালকা হাসে,
“তুমি জানো, এই বৃষ্টিতে তোমার জন্য অপেক্ষা করার মতো মুহূর্তই ছিল সবচেয়ে সুন্দর।”

রক্তিম হেসে বলে,
“আর আমি বুঝলাম, কিছু গল্প কখনও শেষ হয় না,
তারা শুধু অপেক্ষা করে সঠিক মুহূর্তের জন্য।”

জানলার বাইরে রাস্তায় পাথর ভিজে গেছে, বাতাস ভিজে গেছে,
কিন্তু দুজনের হৃদয়—অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের মধ্যে—শান্তি পেয়েছে।

বৃষ্টি থামবে, তারা জানে।
কিন্তু “বৃষ্টিভেজা চিঠি” আর “অতীতের ভালোবাসা” একসাথে থেকে যাবে—চিরকাল।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *