খেজুরগাছের ছায়া
|

বটগাছের ছায়া

মেলার আলো ও ছায়া

পূজার আগের রাতে গ্রামের খেজুরগাছের তলায় বসেছে ছোট্ট মেলা। বাতাসে মিষ্টির গন্ধ, নারকেল, রসগোল্লা, পিঠে-পুলি—সব মিলিয়ে যেন স্বপ্নের এক কোণা। মেলার রঙিন বাতির ঝলকানি আর ঢোলের তাল, নারীদের চিৎকার-হাসি, শিশুদের দৌড়ঝাপ—সব মিলিয়ে গ্রামের আকাশ কেঁপে উঠছে।

তবে এই আনন্দের মাঝেই অদ্ভুত কিছু ঘটতে শুরু করে। প্রথমে ছোট ছোট ঘটনা—এক বা দুই শিশুর অদ্ভুত অদৃশ্য হওয়া। সবাই ভেবে নেয়, হয়তো তারা কোথাও খেলা করছে। কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছে, ততই হারানো শিশুর সংখ্যা বাড়ছে।

গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। বুড়ো-বৃদ্ধেরা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
—“বটগাছের বুড়ো আবার দেখা দিয়েছে।”
কেউ কেউ হেসে উড়িয়ে দেয়, কেউ আবার বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু গুজব ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। গ্রামের লোকেরা মনে মনে ভয় পাচ্ছে, রাতের অন্ধকার যেন অদ্ভুতভাবে দীর্ঘ এবং ঘন হয়ে উঠছে।

রিমন, গ্রামের কিশোর, এই রহস্যের দিকে মনোযোগী। সে জানে, শুধুমাত্র সাহস আর সূক্ষ্ম চোখ দিয়ে সত্য বের করা সম্ভব। সে মেলার রঙিন আলো পেছনে ফেলে, মাটির পথ ধরে বটগাছের দিকে এগোতে থাকে।

প্রতিটি পদে শোনা যায় পাতার কষাকষি। মাঝে মাঝে মনে হয়, কেউ তার পিছুটান দিচ্ছে। দূরের অন্ধকারে কেবল চাঁদের হালকা আলো আর বাতাসে কাঁপা কণ্ঠের শব্দ। হঠাৎ, ভেসে আসে একটি শিশুর কাঁপা চিৎকার। রিমনের হৃদয় তীব্রভাবে ধুকছে।

—“এটাই কি সে গোপন রহস্য?”—রিমন নিজেকে প্রশ্ন করে।

রিমন স্থির হয়, সে রাতটা শেষ করবে, যতক্ষণ না রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে। তার সাহস, কৌতূহল, এবং ভয়—সবই একসাথে মিলিয়ে তৈরি করছে এক অদ্ভুত অনুভূতি। রাতের এই অন্ধকার, মেলার আলো, এবং বটগাছের ছায়া—সব মিলিয়ে যেন একটা ভৌতিক নাটক।

অন্ধকারের রহস্য

রিমন বটগাছের কাছে পৌঁছালে রাতের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে গেছে। মেলার আলো দূরে, দূরে ফিকে হয়ে গেছে, আর বাতাসে শোনা যায় কেবল পাতার কষাকষি। প্রতিটি পদে তার হৃদয় দ্রুত ধুকছে, কিন্তু কৌতূহল তাকে থামতে দিচ্ছে না।

মাটিতে হঠাৎ দেখা যায় ছোট ছোট পায়ের ছাপ। এগুলো গ্রামের মূল রাস্তা থেকে শুরু হয়ে বটগাছের দিকে যায়। রিমন বুঝতে পারে, হারানো শিশুদের হয়তো এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। সে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করে।

শরীর জুড়ে শীতের কাঁপুনি, কিন্তু চোখে অদ্ভুত উত্তেজনা। মাঝে মাঝে মনে হয়, অন্ধকারের মধ্যে কেউ পিছুটান দিচ্ছে। কানে ভেসে আসে পাতার শব্দ, হাওয়ার ফিসফিসানি, আর দূরে শিশুর ভয়ঙ্কর কাঁপা চিৎকার।

রিমনের চোখে অন্ধকারের মধ্যে হালকা ছায়া নাচছে। সে দৌড়ানো বা চিৎকার করার চেষ্টা করে না; বরং চুপচাপ এগোতে থাকে, প্রতিটি শব্দ শুনে, প্রতিটি ছায়া লক্ষ্য করে।

হঠাৎ, অদ্ভুত কিছু দেখার আগ্রহে সে কেঁপে ওঠে—ছায়ার ভেতর একটি ঝিলমিল আলো, এবং তার মধ্য দিয়ে কিছু শিশু দাঁড়িয়ে আছে। তারা ভয় পাচ্ছে, কিন্তু কাঁদছে না। রিমনের মনে হয়, এই শিশুরা হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং অদ্ভুত কোনো শক্তির অধীনে রয়েছে।

রিমন আরও এগোতে থাকে। মাটিতে পড়ে থাকা পাতার কষাকষি আর বাতাসের ফিসফিসানি—সবই যেন তাকে সতর্ক করছে। সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, গ্রামজুড়ে ছড়ানো গুজব ও ভয় কেবল মানুষের অজ্ঞতার ফল। সত্যি রহস্য উন্মোচনের জন্য তাকে শুধু সাহসী এবং ধৈর্যশীল হতে হবে।

রিমন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়—সে রাতের শেষ পর্যন্ত এগোবে। সে জানে, বটগাছের ছায়া, অন্ধকারের ভয়, এবং শিশুদের অদ্ভুত অবস্থার সত্য আবিষ্কার না করা পর্যন্ত তার পথ থেমে থাকবে না।

হারানো শিশুদের চিহ্ন

রিমন অন্ধকারে ধীরে ধীরে এগোতে থাকল। বাতাসে পাতার ফিসফিসানি, দূরের মেলার আলো নেভানোর পর মাটির পথ যেন আরও গভীর এবং ভীতিকর হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ধাপে মনে হচ্ছিল, ছায়ার মধ্যে কেউ তাকে অনুসরণ করছে।

হঠাৎ, মাটিতে ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেখা দিল। এগুলো গ্রামের মূল রাস্তা থেকে শুরু হয়ে বটগাছের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রিমনের হৃদয় দ্রুত ধুকছে। সে বুঝতে পারল, হারানো শিশুদের হয়তো কেউ বা কিছু এখানে নিয়ে এসেছে।

রিমন সাহস করে ছাপগুলো অনুসরণ করল। কিছুক্ষণ হেঁটে গেলে সে দেখতে পেল, এক পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরের দরজা অর্ধখোলা। জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো বের হচ্ছে। আলোতে শিশুরা বসে আছে, তাদের চোখে ভয়, কিন্তু কোনো কাঁদার চিহ্ন নেই। তারা যেন চুপচাপ, এক অদ্ভুত শক্তির প্রভাবে স্থির।

রিমন শ্বাস বন্ধ করে জানালার ফাঁক দিয়ে ঝুঁকে দেখতে লাগল। ঠিক তখনই বটগাছের বুড়ো—এক অদ্ভুত রূপে, অন্ধকারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে দীপ্তি, হাতের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে শিশুদের নির্দেশ দিচ্ছে। বুড়োর ছায়া দীর্ঘ, আর গলায় কিছু ফিসফিসানি—যা রিমনের কানে অদ্ভুতভাবে ভেসে আসছে।

khejur gacher chaya 2

রিমন সাহস জোগাল। সে ধীরে ধীরে কুঁড়েঘরের দিকে এগোল। বটগাছের বুড়ো হঠাৎ তাকে লক্ষ্য করল, কিন্তু কোনো আক্রমণ নেই। শুধু সেই রহস্যময় চোখের দীপ্তি, যা রিমনের রোমাঞ্চ আরও বাড়িয়ে দিল।

রিমনের হৃদয়ে দুইটি অনুভূতি—ভয় এবং কৌতূহল একসাথে। সে বুঝতে পারল, শিশুদের ক্ষতি কোনো মানুষের দ্বারা হয়নি। বরং, অদ্ভুত ছায়াময় শক্তি তাদের রক্ষা করছে।

রিমন নীরবে নিজের কাঁপা হাত দিয়ে শিশুরা নিরাপদ আছে কি না তা পরীক্ষা করল। তার কাছে আসার পর শিশুদের চোখে ছোট্ট আস্থা দেখা দিল। তারা ধীরে ধীরে রিমনের দিকে তাকাল, যেন বলছে—“আপনি কি সত্যিই এখানে?”

রিমনের মনে হলো, এই রাতের ভয়, মেলার আনন্দ, আর অন্ধকারের ছায়া—সব মিলিয়ে একটি অদ্ভুত নাটক, যা শুধুমাত্র সাহসী কিশোরই শেষ করতে পারবে।

রিমন স্থির হল—সে বুড়োর রহস্য উন্মোচন করবে, এবং গ্রামবাসীকে সত্যটা জানাবে। কারণ, এই রাতের অন্ধকার ও ভয় শুধুমাত্র মানুষের অজ্ঞতার ফল।

রহস্যের আবরণ উন্মোচন

রিমন স্থির হয়ে দাঁড়াল। বুড়ো-বটগাছের ছায়া, শিশুরা, অন্ধকারের ফিসফিসানি—সব মিলিয়ে যেন এক অদ্ভুত ভয়ঙ্কর পরিবেশ। কিন্তু এবার তার মন স্থির। সে জানে, সাহস আর মনোযোগ থাকলেই রহস্য উন্মোচন সম্ভব।

রিমন ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল। হঠাৎ, সে লক্ষ্য করল—শিশুরা এক অদ্ভুত নিয়মে বসে আছে। তাদের হাত ও চোখ দিয়ে যেন আলো বের হচ্ছে। এই আলো এক রহস্যময় প্রভাব তৈরি করছে, যা গ্রামবাসীর গুজবের “ভয়” তৈরি করেছে।

বটগাছের বুড়ো ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার হাতের অঙ্গভঙ্গি, চোখের দীপ্তি—সবই রিমনের কাছে একটি ভাষা হয়ে গেল। সে বুঝল, বুড়ো আসলে শিশুদের রক্ষা করছে। যারা হারিয়েছে, তারা কোন ক্ষতির মধ্যে নেই। তাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়—এই ছায়াময় শক্তি।

রিমনের হৃদয় আনন্দে কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল, গ্রামবাসীর গুজব ও ভয় কেবল মানুষের অজ্ঞতার ফল। প্রকৃত সত্য হলো—প্রকৃতি, রহস্যময় ছায়া, এবং সাহসী মন মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে।

রিমন আবার শিশুদের দিকে তাকাল। তাদের চোখে ভয় কমে এসেছে। তারা ধীরে ধীরে হাসতে শুরু করল। রিমন জানতে পারল, বুড়ো-বটগাছ তাদেরকে অদ্ভুত অশান্তি থেকে রক্ষা করছে। এই রাতের রহস্যের মূল কথা হলো—ভয়কে বোঝার জন্য সাহস দরকার, এবং সত্য বের করার জন্য ধৈর্য।

রিমন ধীরে ধীরে শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। তারা রিমনের কথা বুঝল এবং তার ওপর আস্থা দেখাল। বুড়ো-বটগাছ তখন নিরব হয়ে দাঁড়াল, যেন বলছে—“সব ঠিক আছে, কেউ আর বিপদে নেই।”

রিমন বুঝল, রাতের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তাকে আরও সাহসী, মননশীল এবং বিচক্ষণ করে তুলেছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—সে শিখেছে, কখনও ভয়কে অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে মানুষ নিজেরই ক্ষতি করে।

আলো ফিরল গ্রামে

ভোরের প্রথম আলো গ্রামের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। মেলার বাতি ফিকে হয়ে গেছে, আর রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। রিমন বটগাছের কাছে দাঁড়িয়ে শিশুদের দিকে তাকাল। তারা এক অদ্ভুত শান্তিতে বসে আছে। ভয় আর আতঙ্ক এখন কেবল স্মৃতি।

শিশুরা ধীরে ধীরে রিমনের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। তাদের চোখে কৌতূহল, আস্থা, এবং কিছুটা আনন্দ ফুটে উঠেছে। রিমন বুঝতে পারল, রাতের ভয়, গুজব, এবং রহস্য—সব মিলিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে।

গ্রামের মানুষরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল। প্রথমে তারা শিশুরা ঠিক আছে কি না তা দেখল, আর তারপর রিমনের সাহসের প্রশংসা করল। বুড়ো-বটগাছ তখন চুপচাপ তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে, যেন সবাইকে নিশ্চয়তা দিচ্ছে—“সব ঠিক আছে।”

রিমনের মনে হলো, এই রাতের অভিজ্ঞতা শুধু ভয়ঙ্কর ছিল না, বরং এক অদ্ভুত আনন্দ, সাহস, এবং উপলব্ধির উৎস। মেলার আনন্দ, গ্রামের মানুষের আস্থা, বটগাছের রহস্যময় ছায়া—সব মিলিয়ে একটি অদ্ভুত বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে।

khejur gacher chaya 1

গ্রামের মানুষরা এবার জানল, প্রকৃত ভয় হলো মানুষের অজ্ঞতা এবং অন্ধ বিশ্বাস। সাহস এবং সচেতন মন থাকলেই অন্ধকারের মধ্যেও আলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রিমন হাসতে হাসতে গ্রামের দিকে ফিরে এল। সে জানে, এই রাত শুধু একটি ভৌতিক অভিজ্ঞতা নয়, বরং জীবনের এক অমূল্য শিক্ষা।

শিশুরা নিরাপদে বাড়ি ফিরে গেল। গ্রামে শান্তি ফিরল। বটগাছের ছায়া আর মেলার আলো যেন এক নতুন বন্ধুত্বের প্রতীক হয়ে রইল। রিমনও নিজেকে আরও শক্তিশালী, সাহসী, এবং বিচক্ষণ মনে করল।

শেষমেষ, গ্রামের মানুষরা আর ভয় পায় না। তারা জানে—সাহস, ভালোবাসা, এবং সচেতনতা মিলিয়ে যে কোনো ভয় কাটানো সম্ভব। আর রিমনের রাতের অভিযান এই সত্যকে স্থায়ীভাবে প্রমাণ করেছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *