নীল খামের চিঠি
কফি হাউসের সেই বৃষ্টিভেজা বিকেল
অনির্বাণের জীবনের সবথেকে রঙিন অধ্যায়টা শুরু হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায়, আর শেষ হয়েছিল ঠিক সেখানেই, তবে এক ধূসর বিকেলে।
কলকাতা তখন বর্ষায় ভিজেছে। ট্রামলাইনের ওপর জল জমেছে, আর ছাতার জঙ্গল পেরিয়ে কফি হাউসের দোতলায় জানলার ধারের টেবিলটা দখল করা তখন একটা যুদ্ধজয়ের সমান। অনির্বাণ তখন সবে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করছে। স্বভাববশতই সে একটু লাজুক, নিজের জগতে থাকতেই ভালোবাসে। কবিতা লেখা চিঠি লেখা তার একমাত্র পেশা ও নেশা। আর ঠিক তার উল্টো মেরুর মানুষ ছিল অবন্তিকা। ঝোড়ো হাওয়ার মতো তার উপস্থিতি। সে কথা বলত না, যেন কথার ফুলঝুরি ছোটাত।
সেদিনও বাইরে তুমুল বৃষ্টি। অবন্তিকা ভিজে চুপচুপে হয়ে কফি হাউসে ঢুকল। অনির্বাণ আগেই পৌঁছে গিয়েছিল, হাতে সুনীলের কবিতার বই। অবন্তিকা এসেই বইটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলল, “সারাদিন শুধু এই বিষাদের পদ্য পড়লে জীবনটা কিন্তু পানসে হয়ে যাবে অনিদা!”
অনির্বাণ হেসেছিল। সেই হাসিটা ছিল আশ্বস্ত হওয়ার হাসি। অবন্তিকা থাকলে তার বিষাদগুলোও কেমন যেন রঙিন হয়ে উঠত। তাদের বন্ধুত্বটা ঠিক প্রেম ছিল না, আবার শুধু বন্ধুত্বও ছিল না। একটা ধূসর এলাকা, যেখানে অনুভূতিরা কথা বলত, কিন্তু শব্দরা ছিল নীরব।
অনির্বাণ জানত, অবন্তিকা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। সে জার্নালিজম নিয়ে পড়ছে, তার ইচ্ছে দিল্লির কোনো বড় মিডিয়া হাউসে কাজ করার। আর অনির্বাণ? সে তো উত্তর কলকাতার পুরোনো বাড়ির নোনা ধরা দেওয়ালে আটকে থাকা এক মধ্যবিত্ত স্বপ্ন। সে চেয়েছিল একটা ছোটো কলেজের প্রফেসরি, আর বিকেলে কবিতা লেখা।
সেদিন কফির ধোঁয়ায় অবন্তিকা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। জানলার বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল, “জানো অনি, কলকাতাটা বড্ড মায়ার শহর। কিন্তু এই মায়া মানুষকে এগোতে দেয় না। পা জড়িয়ে ধরে।”
অনির্বাণের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সে বুঝল, এই শহরের মায়া হয়তো অবন্তিকাকে আটকাতে পারবে না। সে বলল, “মায়া তো শিকল নয় অবন্তিকা, মায়া হলো নোঙর। ঝড় এলেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে দেয় না।”
অবন্তিকা অনির্বাণের চোখের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত করুণা ছিল। সে বলল, “সবাই নোঙর চায় না অনি, কেউ কেউ শুধু পাল তুলে ভাসতেও চায়।”
সেদিন বৃষ্টি থামেনি। কিন্তু অনির্বাণের মনে এক দীর্ঘ খরার পূর্বাভাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল, তাদের এই কফি হাউসের বিকেলগুলো খুব দ্রুতই স্মৃতির পাতায় বন্দি হতে চলেছে।
দূরত্বের প্রথম পদক্ষেপ
মাস ছয়েক পরের কথা। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। অনির্বাণ প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও বড় খবর হলো অবন্তিকার চাকরি হয়েছে। দিল্লিতে। দেশের অন্যতম বড় নিউজ চ্যানেলে।
খবরটা শুনে অনির্বাণ খুশি হয়েছিল, সত্যিই হয়েছিল। কিন্তু সেই খুশির আড়ালে যে গভীর হাহাকার ছিল, তা সে কাউকে বুঝতে দেয়নি। সেদিন তারা গঙ্গার ঘাটে বসেছিল। প্রিন্সেপ ঘাটের সেই চেনা বেঞ্চ। গঙ্গার হাওয়া তখন বেশ ঠান্ডা।

অবন্তিকা খুব উত্তেজিত হয়ে তার নতুন জীবনের পরিকল্পনার কথা বলছিল। কোথায় থাকবে, কেমন কাজ হবে, নতুন জগত। অনির্বাণ শুধু শুনছিল। সে ভাবছিল, এই মেয়েটি কি একবারও ভাবছে না, তাকে ছাড়া অনির্বাণের বিকেলগুলো কেমন হবে?
হঠাৎ অবন্তিকা চুপ করে গেল। অনির্বাণের হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে বলল, “তুমি কিছু বলছ না যে?”
অনির্বাণ ম্লান হাসল। বলল, “পাখি উড়তে শিখলে আকাশের দিকেই তাকায়, মাটির দিকে নয়। আমি খুশি, খুব খুশি।”
“কিন্তু আমি যে তোমাকে মিস করব অনি,” অবন্তিকার গলায় কি একটু কাঁপা সুর ছিল? নাকি ওটা অনির্বাণের ভ্রম?
“মিস তো করবেই। কিন্তু ব্যস্ততা সব ভুলিয়ে দেয় অবন্তিকা। দেখবে নতুন শহরে, নতুন বন্ধুদের ভিড়ে এই উত্তর কলকাতার গলি আর অনির্বাণকে ঝাপসা মনে হবে।”
অবন্তিকা রেগে গিয়েছিল সেদিন। বলেছিল, “তুমি আমাকে এত স্বার্থপর ভাবো?”
অনির্বাণ উত্তর দেয়নি। সে জানত, এটা স্বার্থপরতা নয়, এটাই জীবনের নিয়ম। স্রোতের ধর্মই বয়ে যাওয়া।
যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এল। অনির্বাণ ঠিক করেছিল, সে স্টেশনে যাবে না। বিদায় দৃশ্য তার সহ্য হয় না। কিন্তু মন মানল না। হাওড়া স্টেশনের সেই বিশাল ঘড়িটার নিচে দাঁড়িয়ে যখন সে অবন্তিকাকে দেখল, তখন তার মনে হলো সময় যেন থমকে গেছে।
অবন্তিকার দুচোখে জল। সে অনির্বাণের কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, “চিঠি লিখো অনি। ইমেল নয়, হোয়াটসঅ্যাপ নয়। আমি তোমার হাতের লেখা চিঠি চাই।”
অনির্বাণ কথা দিল। ট্রেন যখন হুইসেল দিয়ে ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল, অনির্বাণ হাত নাড়ল না। সে শুধু পকেটে রাখা সেই ছোটো নীল খামটার ওপর হাত রাখল, যেটার ভেতরে তার না বলা কথাগুলো লেখা ছিল। কিন্তু সেই চিঠিটা সে অবন্তিকাকে দিতে পারেনি। সাহস হয়নি। যদি বন্ধুত্বের বাঁধনটাও ছিঁড়ে যায়!
ট্রেনটা মিলিয়ে গেল দিগন্তে। অনির্বাণ একা দাঁড়িয়ে রইল কোলাহলপূর্ণ স্টেশনে। তার মনে হলো, সে আজ থেকে এই ভিড়ের মধ্যেও ভীষণ একা।
নীরবতার দেওয়াল
প্রথম এক বছর যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। অবন্তিকা চিঠি লিখত, অনির্বাণও উত্তর দিত। অবন্তিকার চিঠিতে থাকত দিল্লির ব্যস্ততা, অফিসের পলিটিক্স, আর উইকেন্ডের পার্টির গল্প। আর অনির্বাণের চিঠিতে থাকত কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গন্ধ, গঙ্গার ঘাটের হাওয়া, আর তার নতুন লেখা কবিতার লাইন।
কিন্তু ধীরে ধীরে চিঠির দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করল। অবন্তিকার ব্যস্ততা বাড়ল। ফোনের ওপারে তার গলাটা কেমন যেন যান্ত্রিক শোনাত। “অনি, খুব কাজের চাপ, পরে কথা বলব”—এই বাক্যটা শুনতে শুনতে অনির্বাণ অভ্যস্ত হয়ে গেল।
অনির্বাণ তখন একটা কলেজে আংশিক সময়ের অধ্যাপনা শুরু করেছে। তার জগৎটা ছোটো। সে বুঝল, অবন্তিকার জগতটা এখন আর তার নাগালের মধ্যে নেই। তাদের দুটি সমান্তরাল রেখা আর কখনো মিলবে না।
একদিন রাতে অবন্তিকা ফোন করল। অনেকদিন পর। গলায় বেশ উচ্ছ্বাস। “অনি! একটা দারুণ খবর আছে। আমি প্রমোশন পেয়েছি। আর… আমি রাহুলকে বিয়ে করছি। আমাদের অফিসেরই সিনিয়র এডিটর।”
অনির্বাণের হাতে ধরা চায়ের কাপটা কেঁপে উঠল। চা ছলকে পড়ল টেবিলে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “বাহ! খুব ভালো খবর। অভিনন্দন অবন্তিকা।”
“তুমি আসবে তো? আগামী মাসে বিয়ে। দিল্লিতেই হবে।”
অনির্বাণ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “আমার সেমিস্টার এক্সাম চলছে রে, ছুটি পাব না। তুই তো জানিস।”
অবন্তিকা হয়তো বুঝতে পেরেছিল, হয়তো পারেনি। সে বলল, “চেষ্টা করো প্লিজ। তুমি না থাকলে আমার খুব খারাপ লাগবে।”

ফোনটা রাখার পর অনির্বাণ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অমাবস্যার রাত। আকাশটা নিকষ কালো। সে ভাবল, কেন সে কষ্ট পাচ্ছে? সে তো জানত অবন্তিকা তার নয়। তবুও, কোথাও একটা সুতোর মতো আশা ছিল। আজ সেই সুতোটাও ছিঁড়ে গেল।
সেই রাতে অনির্বাণ তার ডায়েরিতে লিখল— “কিছু বিচ্ছেদ ঘোষিত হয় না। কোনো ঝগড়া হয় না, কোনো বিদায় সম্ভাষণ হয় না। শুধু দুজন মানুষ দুটো আলাদা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এত দূরে চলে যায় যে, আর ফিরে তাকালেও কাউকে দেখা যায় না। এই নীরব বিচ্ছেদই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।”
সেদিন থেকে অনির্বাণ চিঠি লেখা বন্ধ করে দিল।
স্মৃতির শহরে একলা পথিক
পাঁচ বছর কেটে গেছে।
অনির্বাণ এখন পুরোদস্তুর অধ্যাপক। তার চশমার ফ্রেমটা মোটা হয়েছে, চুলে দু-একটা পাকা রূপোলি রেখা। সে এখন বেশ নামকরা কবিও। তার কবিতার বই ‘নীল খামের সমাধি’ পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলেছে। লোকে বলে, তার কবিতায় এক অদ্ভুত হাহাকার আছে, যা বুকের ভেতরটা মুচড়ে দেয়। তারা জানে না, এই হাহাকার কাল্পনিক নয়, এ এক জীবন্ত দহন।
অবন্তিকার সাথে তার আর কোনো যোগাযোগ নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝে মাঝে তার ছবি ভেসে ওঠে। অবন্তিকা এখন মা হয়েছে, তার হাসিখুশি সংসার। অনির্বাণ সেই ছবিগুলোতে ‘লাইক’ দেয় না, শুধু দূর থেকে দেখে। সে চায় না তার উপস্থিতির কোনো চিহ্ন অবন্তিকার সাজানো সংসারে পড়ুক।
অনির্বাণ বিয়ে করেনি। মা অনেকবার বলেছেন, আত্মীয়রা চাপ দিয়েছে। কিন্তু অনির্বাণ হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। সে বলে, “আমার কবিতাই আমার সংসার।” আসলে সে কাউকে তার একাকীত্বের ভাগ দিতে চায়নি। সে জানত, অবন্তিকার জায়গাটা অন্য কেউ নিতে পারবে না, আর কাউকে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয় করে ঠকানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।
কলকাতার রাস্তাগুলো এখন অনেক বদলে গেছে। কফি হাউসের সেই আড্ডা আর নেই, পুরোনো বন্ধুরা যে যার জীবনে ব্যস্ত। অনির্বাণ মাঝে মাঝে একা গিয়ে সেই জানলার ধারের টেবিলে বসে। এক কাপ ব্ল্যাক কফি আর একটা বই।
একদিন কফি হাউসে বসেই সে একটা চিঠি লিখল। সেই নীল খামের চিঠির উত্তর, যা সে পাঁচ বছর আগে লিখতে চেয়েছিল।
“প্রিয় অবন্তিকা, জানি তুই ভালো আছিস। ভালো থাকাই তোর স্বভাব। আজ হঠাৎ খুব বৃষ্টি পড়ছে কলকাতায়। ঠিক সেই দিনের মতো। মনে আছে? তুই বলেছিলি মায়া মানুষকে এগোতে দেয় না। আজ মনে হচ্ছে তুই ঠিকই বলেছিলি। আমি এগোতে পারিনি রে। আমি সেই বৃষ্টির দিনেই আটকে আছি। তোর মনে কি পড়ে আমাকে? হয়তো না। পড়ার কথাও নয়। তুই পাল তুলে ভেসে গেছিস, আর আমি নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু জানিস, এই দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেও একটা শান্তি আছে। আমি তোর সুখের খবর পাই, তাতেই আমার আনন্দ। তোর হাসিটা যেন অমলিন থাকে। ভালো থাকিস। —তোর অনিদা”
চিঠিটা সে পোস্ট করেনি। ভাঁজ করে ডায়েরির ভেতরে রেখে দিল, যেখানে আরও শত শত না পাঠানো চিঠি জমা হয়ে আছে।
একটি অসমাপ্ত উপন্যাসের শেষ
হঠাৎ একদিন অনির্বাণের কলেজে একটি সাহিত্য সেমিনার হলো। প্রধান অতিথি হিসেবে দিল্লি থেকে এক বিশিষ্ট সাংবাদিক এলেন। নাম দেখে অনির্বাণ চমকে উঠল না, বরং এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অবন্তিকা সেনগুপ্ত।
সেমিনার হলে ঢুকেই অবন্তিকার চোখ পড়ল মঞ্চের এক কোণে বসে থাকা অনির্বাণের ওপর। সময় অবন্তিকাকে আরও সুন্দরী করেছে, চশমায় তাকে আরও বুদ্ধিমতী দেখাচ্ছে। কিন্তু তার চোখের কোণে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
অনুষ্ঠান শেষে অবন্তিকা নিজেই এগিয়ে এল। “কেমন আছো অনিদা?”
সেই পরিচিত ডাক। পাঁচ বছরের ব্যবধান এক মুহূর্তে মুছে গেল। অনির্বাণ হাসল, সেই ম্লান হাসি। “ভালো আছি। তুই কেমন?”
“চলছে,” অবন্তিকা বলল। “তোমার বই আমি পড়েছি। ‘নীল খামের সমাধি’। কবিতাগুলো… বড্ড কষ্টের। কার জন্য লেখা?”
অনির্বাণ অবন্তিকার চোখের দিকে তাকাল। সেখানে কি আজ কোনো অনুশোচনা আছে? নাকি শুধুই কৌতূহল? সে বলল, “সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেই অবন্তিকা। কিছু উত্তর না জানাই ভালো।”
“একবার কফি হাউসে যাবে? প্লিজ?” অবন্তিকার গলায় সেই আবদার।
তারা গেল। সেই একই টেবিল। কিন্তু সেই আগের উত্তেজনা নেই। মাঝখানে অনেকগুলো বছরের নীরবতা। কফি এল। ধোঁয়া উঠছে।
অবন্তিকা হঠাৎ বলল, “জানো অনি, আমি অনেক কিছু পেয়েছি। নাম, যশ, টাকা। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি। ওই বৃষ্টির দুপুরের নিশ্চিন্ত হাসিটা আর পাই না।”
অনির্বাণ চুপ করে শুনছিল। সে বুঝতে পারছিল, অবন্তিকা সুখী, কিন্তু তৃপ্ত নয়।
অবন্তিকা আবার বলল, “সেদিন স্টেশনে তুমি আমাকে একটা চিঠি দিতে চেয়েছিলে না? আমি দেখেছিলাম তোমার পকেটে একটা নীল খাম। কেন দাওনি?”
অনির্বাণ অবাক হলো। অবন্তিকা লক্ষ্য করেছিল! সে মৃদু হেসে বলল, “ওটা চিঠি ছিল না অবন্তিকা, ওটা ছিল একটা মুক্তিপত্র। তোমাকে তোমার স্বপ্নের কাছে মুক্তি দেওয়ার অঙ্গীকার। দিলে হয়তো তুমি পিছুটান অনুভব করতে। আমি চাইনি আমার ভালোবাসা তোমার ওড়ার পথে বাধা হোক।”
অবন্তিকার চোখে জল এসে গেল। সে হাত বাড়িয়ে অনির্বাণের হাতটা ধরল। বলল, “তুমি বড্ড বোকা অনি। বড্ড বোকা।”

সন্ধ্যা নামছে। অবন্তিকাকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। তার ফ্লাইট। ফিরে যেতে হবে তার বাস্তবতায়। অনির্বাণ তাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিল। জানলা দিয়ে অবন্তিকা বলল, “আবার দেখা হবে অনি।”
অনির্বাণ জানে, এই ‘দেখা হওয়া’ আর হবে না। বা হলেও, তা এমনই আনুষ্ঠানিক হবে। ট্যাক্সিটা চলে গেল। অনির্বাণ আবার একা।
কিন্তু আজ তার আর কষ্ট হচ্ছে না। আজ সে অনুভব করল, বিরহ মানে শুধু বিচ্ছেদ নয়। বিরহ মানে হলো ভালোবাসার এক অন্য রূপ, যা কাছে না থেকেও আজীবন আগলে রাখে। অবন্তিকা তার নেই, কিন্তু অবন্তিকার স্মৃতি, সেই বৃষ্টির দুপুর, সেই হাসি—সবটাই তো তার। এই সম্পদটুকু তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
অনির্বাণ আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ কেটে গিয়ে একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। সে বিড়বিড় করে বলল, “ভালো থাকিস অবন্তিকা। আমার অসমাপ্ত পান্ডুলিপির নায়িকা হয়েই থাকিস।”
সেদিন রাতে অনির্বাণ আর কোনো বিষাদের কবিতা লিখল না। সে শুধু তার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখল— “ভালোবাসা মানেই পাওয়া নয়, ভালোবাসা মানে হলো প্রিয় মানুষটাকে তার আকাশের ঠিকানায় উড়তে দেওয়া, এমনকি যদি সেই আকাশ আমার না হয়।”
