অগ্নিকুণ্ডের কালো ছায়া
অগ্নিকুণ্ডের অভিশাপ
পাহাড়ঘেরা ছোট্ট গ্রাম পাহাড়তলি। দিনভর পাখির ডাক, ঝরনার কলকল ধ্বনি আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় এই গ্রাম যেন স্বর্গের মতো শান্ত। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই গ্রাম যেন নিঃশব্দ হয়ে যায়। যেন কোনো অদৃশ্য ভয় গ্রামটিকে গ্রাস করে নেয়।
গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ভগ্নপ্রায় প্রাচীন স্থাপনা—শূলেশ্বর মন্দির।
মন্দিরটি এখন কেবল ধ্বংসস্তূপ, ভাঙা পাথর, জংধরা শিলালিপি আর আগাছায় ঢাকা চত্বর।
তবে মন্দিরের সবচেয়ে ভয়ংকর অংশটি হলো—তার মাঝখানে থাকা বিশাল অগ্নিকুণ্ড।
লোকমুখে শোনা যায়, বহু শতাব্দী আগে এখানে মহাযজ্ঞ হত। রাজার সৈন্য, পুরোহিত আর গ্রামের মানুষ মিলে দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দিত। অগ্নিকুণ্ডের আগুন নাকি তখন আকাশ পর্যন্ত ছুঁয়ে যেত।
কিন্তু একদিন, এক অজানা আগুন মন্দিরকে গ্রাস করে ফেলে। কেউ জানে না আগুন কোথা থেকে এসেছিল। মন্দির ধ্বংস হয়, অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। সেই দিনের পর থেকে মন্দির আর কখনো পূজার আলো দেখেনি।
গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে—অগ্নিকুণ্ডের আগুনে যারা প্রাণ হারিয়েছিল, তাদের আত্মা শান্তি পায়নি। তাই রাত নামলেই অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে ভেসে ওঠে কালো ছায়া।
গ্রামের বৃদ্ধরা বলেন—
— “যদি কেউ সেখানে আগুন জ্বালায়, তবে সেই রাতেই কালো ছায়া তার সামনে দাঁড়াবে। আর পরদিন সকালে তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
এই ভয়কে কুসংস্কার ভেবে একসময় কয়েকজন সাহস করে মন্দিরে গিয়েছিল। কেউই আর ফিরে আসেনি।
তারপর থেকে গ্রামবাসীরা শপথ নিয়েছে—সূর্য ডোবার পর ওই পথে কেউ পা রাখবে না।
কয়েক বছর আগে গ্রামের এক রাখাল ছেলে, নাম গোপাল, বন্ধুদের চ্যালেঞ্জে সাহস করে অগ্নিকুণ্ডে আগুন জ্বালিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে দেখা গিয়েছিল আগুনের লেলিহান শিখা।
কিন্তু সকালে যখন লোকেরা মন্দিরে গেল, গোপালের কোনো দেহ তারা খুঁজে পেল না।
শুধু পাওয়া গেল তার ছেঁড়া, ঝলসানো কাপড়—অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে ছড়িয়ে ছিল সেগুলো।
সেই দৃশ্য দেখে গ্রামবাসীরা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে।
বৃদ্ধরা তখন ঘোষণা দিলেন—
“এটা কোনো কুসংস্কার নয়, অভিশাপ। শূলেশ্বর মন্দিরে রাতের পর যে যাবে, সে আর বেঁচে ফিরবে না।”
সেই দিন থেকে শূলেশ্বর মন্দির গ্রামবাসীর চোখে হয়ে উঠল অভিশপ্ত স্থান।
গ্রামটিতে যখন রাত নামে, তখন নীরবতার ফাঁক দিয়ে যেন ভেসে আসে কারও কান্না, কারও হাহাকার।
অনেকে বলে, বাতাসে এখনো পোড়া মাংসের গন্ধ ভেসে বেড়ায়।
আর দূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, অন্ধকারে ঢাকা শূলেশ্বর মন্দির—
যেন প্রতিদিন অপেক্ষা করে আছে নতুন এক শিকারীর জন্য…
ঋজুর আগমন
কলকাতার নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ঋজু মুখার্জি।
শহুরে আড্ডা, বইয়ের লাইব্রেরি আর গবেষণার ঘরে দিন কেটে যায় তার। কিন্তু তার আগ্রহ সবসময় অজানা ইতিহাস আর লোককথায়।
যখনই সে শুনতে পায় কোনো অদ্ভুত কিংবদন্তি বা রহস্যময় স্থানের নাম, তখনই তার ভিতরের কৌতূহল জেগে ওঠে।
সম্প্রতি এক বন্ধুর কাছ থেকে সে শোনে শূলেশ্বর মন্দির আর তার অভিশপ্ত অগ্নিকুণ্ডের গল্প।
বন্ধু মজা করে বলেছিল—
— “ঋজু, তুই যদি এতই কৌতূহলী, তবে একবার গিয়ে দেখে আয়। হয়তো তোর ডায়েরির জন্য নতুন ইতিহাস পেয়ে যাবি।”
এই কথাটাই যেন তার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিল।
সে সিদ্ধান্ত নিল—যে করেই হোক পাহাড়তলি গ্রামে গিয়ে শূলেশ্বর মন্দিরের সত্য উদঘাটন করবে।
গ্রামের পথে
অগাস্ট মাসের ভিজে দুপুরে সে পাহাড়তলি পৌঁছল।
বাস থেকে নামতেই চারপাশে কুয়াশা আর স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়া তাকে ঘিরে ধরল।
গ্রামের মানুষজন দূর থেকে তাকাচ্ছিল, যেন শহুরে এই লোকের আগমন তাদের পছন্দ হচ্ছে না।
ঋজু একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিল। সেই ঘরটা ভাড়া দিল গ্রামের প্রধান, বৃদ্ধ রঘুনাথ দত্ত।
রঘুনাথ প্রথমে তাকে সতর্ক করলেন—
— “বাবা, গবেষণার নামে ওই মন্দিরের দিকে যেও না। শূলেশ্বর দেবতার রোষ ভয়ংকর। যাদের হারিয়েছি, তাদের আমরা আর কখনো ফেরত পাইনি।”
ঋজু হেসে উত্তর দিল—
— “আমি দেবতার অভিশাপ খুঁজতে আসিনি, ইতিহাস খুঁজতে এসেছি। যদি সত্যিই কিছু ঘটে থাকে, তবে তার দলিল থাকবে। আর যদি না ঘটে থাকে, তবে এটাও জানাটা জরুরি।”
বৃদ্ধ আর কিছু বললেন না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।
রাতের প্রথম অভিজ্ঞতা
ঋজু সেদিন রাতে জানালার ধারে বসে নিজের ডায়েরিতে লিখছিল।
ঠিক তখনই দূর পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত সুর—কান্নার মতো, আবার হাহাকারের মতো।
সে খেয়াল করল, গ্রামের লোকজন দরজা-জানালা শক্ত করে আটকে রেখেছে।
পুরো গ্রাম যেন অদৃশ্য ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে গেছে।
ডায়েরিতে সে লিখল—
“আজ প্রথম দিন পাহাড়তলিতে। মানুষের চোখে ভয় স্পষ্ট। রাতে বাতাসে ভেসে আসা কান্নার শব্দ সত্যিই অস্বাভাবিক। শূলেশ্বর মন্দিরে কালই যাব।”
ঋজুর চোখে একফোঁটা ভয় নেই, বরং অদ্ভুত এক উত্তেজনা।
কিন্তু সে জানে না—
কাল থেকেই তার সামনে উন্মোচিত হবে এক ইতিহাস, যেখানে লুকিয়ে আছে মৃত্যু, বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতিশোধের কালো ছায়া।
প্রথম রাত
পরদিন বিকেলেই ঋজু বেরিয়ে পড়ল শূলেশ্বর মন্দিরের দিকে।
গ্রামের মানুষজন কেউই তার সঙ্গে যেতে রাজি হল না।
এক বৃদ্ধা তাকে দেখে ফিসফিস করে বলল—
— “ওই পথে গেলে আর ফেরা নেই বাবু, শুনে রেখো।”
ঋজু মুচকি হেসে উত্তর দিল—
— “আমি সত্য খুঁজতে এসেছি, ভয় পেতে নয়।”
মন্দিরে প্রবেশ
পাহাড়ি পথ পেরিয়ে সূর্য যখন ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ছে, তখন ঋজু পৌঁছল মন্দিরের সামনে।
ভগ্নপ্রাচীর, শ্যাওলা জমে থাকা পাথরের দেয়াল, আর ভাঙা প্রতিমা—সব মিলিয়ে জায়গাটা ভয়ঙ্কর লাগছিল।
জঙ্গলের ভেতর থেকে পেঁচার ডাক ভেসে আসছিল, মাঝে মাঝে হাওয়ার ঝাপটায় শুকনো পাতার খসখস শব্দ যেন অশুভ বার্তা দিচ্ছিল।
মন্দিরের ভেতরে ঢুকতেই তার চোখে পড়ল সেই অগ্নিকুণ্ড।
বিরাট এক পাথরের গর্ত, চারপাশে কালচে দাগ, যেন আগুনে পোড়া মানুষের চিহ্ন আজও রয়ে গেছে।
ঋজুর বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি শুরু হল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে ডায়েরিতে লিখল—
“অগ্নিকুণ্ড এখনো ভয়ঙ্কর। বাতাসে পোড়া গন্ধ স্পষ্ট।”
তারপর সে ব্যাগ থেকে শুকনো কাঠ বের করে অগ্নিকুণ্ডে সাজিয়ে দিল।
দেশলাই জ্বালাতেই আগুন দপ করে লেলিহান শিখা তুলল।
আগুনের আলোয় মন্দিরের দেয়ালে ছায়ারা নড়াচড়া করছে—যেন জীবন্ত।
ঠিক তখনই হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল।
আকাশে মেঘ জমল, চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
আগুনের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে যেন একটা আকৃতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে।
ঋজু চোখ কুঁচকে তাকাল—
হ্যাঁ, ওটা একটা ছায়া!
কোনো মানুষের মতো অবয়ব, কিন্তু চোখ নেই, মুখ নেই—শুধু ঘন কালো অন্ধকার।
ভয়ংকর মুহূর্ত
ঋজু ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল।
ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অগ্নিকুণ্ডের দিক থেকে, যেন আগুনের ভেতর থেকে জন্ম নিচ্ছে।
তার কানে ভেসে এল এক ফিসফিসানি—
“কেন তুমি আগুন জ্বালালে? এখানে কারো প্রবেশের অধিকার নেই…”
ঋজু শিউরে উঠল।
সে কাঁপতে কাঁপতে ক্যামেরা বের করল, ছায়ার ছবি তুলতে চাইলো।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—ক্যামেরায় কেবল খালি অগ্নিকুণ্ড আর আগুন ধরা পড়ল, ছায়ার কোনো অস্তিত্ব নেই!
এবার ছায়াটা একেবারে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
অদৃশ্য অথচ ভারী কোনো চাপ যেন তার বুক চেপে ধরছে।
হাওয়ায় ভেসে আসছে পোড়া মাংসের গন্ধ, আর মন্দিরের দেয়াল থেকে যেন কিসের যেন কান্নার শব্দ উঠছে।
ভয়ে ঋজুর মাথা ঘুরে গেল, চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল।
শেষবার সে দেখল, অগ্নিকুণ্ডের আগুনে কালো ছায়াটা হাত বাড়িয়ে তার দিকে আসছে…
তারপরই অন্ধকার।
অভিশপ্ত প্রেমের গল্প
ঋজু যখন আবার জ্ঞান ফিরে পেল, তখন সে শূলেশ্বর মন্দিরের অগ্নিকুণ্ডের সামনে নয়—
বরং গ্রামের এক কুঁড়েঘরের খাটে শুয়ে।
চারপাশে কয়েকজন গ্রামের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তাদের চোখে আতঙ্ক স্পষ্ট।
বৃদ্ধ গ্রামপ্রধান রঘুনাথ দত্ত ধীরে ধীরে বললেন—
— “তুমি ভাগ্যবান ছেলে। অগ্নিকুণ্ডের ছায়া থেকে সবাই ফিরে আসতে পারে না।”
ঋজু কষ্ট করে উঠে বসল। তার চোখে তখনো সেই কালো ছায়ার স্মৃতি স্পষ্ট।
সে জোর দিয়ে বলল—
— “আমি কিছু দেখেছি। ওটা সত্যি… কেবল গল্প নয়।”
রঘুনাথ নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন।
তারপর তিনি এক পুরনো কাহিনি শোনাতে শুরু করলেন—
সেই কাহিনি
শতাব্দী আগে রাজা শূলেশ্বর এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
রাজ্যের সমৃদ্ধি, দেবতার আশীর্বাদ আর ক্ষমতার জন্য এখানে প্রায়ই মহাযজ্ঞ হত।
সেই সময়েই রাজপুত্র অদ্রিত প্রেমে পড়েন এক সাধারণ মেয়ের—
তার নাম ছিল মহুয়া।
সাধারণ পরিবারের মেয়ে হলেও তার সৌন্দর্য, সরলতা আর গান রাজপুত্রকে মুগ্ধ করেছিল।

কিন্তু রাজপরিবার এ সম্পর্ক মানতে পারেনি।
রাজপুত্রকে সতর্ক করা হয়েছিল, কিন্তু সে কিছুতেই পিছু হটেনি।
তখন রাজপুরোহিতরা এক ষড়যন্ত্র রচনা করল।
এক রাতে যজ্ঞের সময়, পুরোহিতরা ঘোষণা করল—
“দেবতা রুষ্ট হয়েছেন। রাজ্য রক্ষার জন্য বলি চাই।”
বলি হিসেবে বেছে নেওয়া হয় মহুয়াকে।
রাজপুত্র প্রাণপণে প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
মহুয়াকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অগ্নিকুণ্ডের সামনে।
শেষ মুহূর্তে মেয়েটি চিৎকার করে উঠেছিল—
— “এই অন্যায় আমি মেনে নেব না! আমি ফিরে আসব… আগুনের মধ্যেই আমার আত্মা থাকবে, আর তোমাদের শান্তি আমি কখনো দেব না!”
তারপর তাকে জীবন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়।
চারপাশে আগুনের লেলিহান শিখা, চিৎকার, আর ধোঁয়ার ভেতর থেকে ভেসে এসেছিল অভিশাপের শপথ।
অভিশাপের সূচনা
সেই রাতের পর থেকে যজ্ঞ আর সফল হয়নি।
মন্দিরে একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে।
আগুনে হঠাৎ ছায়া দেখা যায়, মানুষের গায়ে পোড়ার দাগ পড়ে, আবার কেউ কেউ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়।
গ্রামবাসীরা তখন থেকেই বিশ্বাস করে—
অগ্নিকুণ্ডে এখনো মহুয়ার আত্মা বন্দি।
সে প্রতিটি আগুন জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে, আর কাউকে না কাউকে নিজের সঙ্গে টেনে নেয়।
ঋজুর উপলব্ধি
কাহিনি শুনে ঋজু স্তব্ধ হয়ে গেল।
এখন সব পরিষ্কার—
যে কালো ছায়া সে দেখেছিল, সেটি আসলে মহুয়ার প্রতিশোধস্পৃহ আত্মা।
সে নিজের ডায়েরিতে লিখল—
“অগ্নিকুণ্ডের রহস্য কেবল ইতিহাস নয়, এটি এক অভিশপ্ত প্রেমের গল্প। প্রেম যা স্বীকৃতি পায়নি, আর তাই পরিণত হয়েছে অভিশাপে।”
কিন্তু ঋজুর মন তখনো একটাই প্রশ্নে জর্জরিত—
এই অভিশাপ কি ভাঙা সম্ভব? নাকি মহুয়ার আত্মা চিরকাল অগ্নিকুণ্ডেই বন্দি থাকবে?
কালো ছায়ার শেষ পরিণতি
রাত্রি গভীর।
শূলেশ্বর মন্দির তখন অন্ধকারে ঢাকা।
শুধু বাতাসে ভেসে আসছে এক অদ্ভুত শীতল গন্ধ, যেন ছাই মিশ্রিত ধোঁয়া।
ঋজু হাতে এক প্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিকুণ্ডের সামনে।
তার চোখে ভয় নেই, বরং অদম্য দৃঢ়তা।
গ্রামপ্রধান রঘুনাথের দেওয়া পুরোনো পুঁথি থেকে সে জানতে পেরেছে—
অভিশাপ ভাঙার একমাত্র উপায় হলো সেই অসমাপ্ত প্রেমকে মুক্তি দেওয়া।
অদ্রিত ও মহুয়ার ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে হবে, তাদের মিলন ঘটাতে হবে প্রতীকীভাবে।
ছায়ার আবির্ভাব
ঋজু প্রদীপটা অগ্নিকুণ্ডে রাখতেই হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল।
এক অদ্ভুত দমকা হাওয়া চারদিক আচ্ছন্ন করল।
ধোঁয়ার ভেতর থেকে ভেসে উঠল কালো ছায়া।
কানে ভেসে এল করুণ চিৎকার—
— “আমি প্রতারিত… আমি হারিয়েছি সবকিছু…”
ঋজু সাহস করে এগিয়ে বলল—
— “মহুয়া! তোমার প্রেম সত্যি ছিল, তোমার আত্মত্যাগ বৃথা নয়। এই অভিশাপ ভেঙে তুমি মুক্তি পেতে পারো।”
ছায়া যেন থমকে গেল।
আগুনের শিখার ভেতর ভেসে উঠল এক মেয়ের অবয়ব—কষ্টে ভরা চোখ, কিন্তু গভীরে লুকিয়ে আছে এক অসীম আকাঙ্ক্ষা।
প্রেমের প্রতীকী মিলন
ঋজু তখন রাজপুত্র অদ্রিতের ব্যবহার করা এক পুরোনো রুপোর আংটি বের করল—
যা গ্রামপ্রধান রঘুনাথ তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
সে আংটিটি অগ্নিকুণ্ডের ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে বলল—
— “আজ থেকে তোমার প্রেম অস্বীকৃত নয়। আজ এই মন্দিরে অদ্রিত আর মহুয়ার মিলন হলো।”
আঙুল থেকে আংটি পড়তেই আগুনের শিখা অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেল।
মেয়েটির কালো ছায়া ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে সাদা আলোর কণায় মিলিয়ে গেল।
শুনতে পাওয়া গেল এক দীর্ঘশ্বাস—
— “মুক্তি… অবশেষে মুক্তি…”
অভিশাপের অবসান
পরদিন সকালে গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখল—
শূলেশ্বর মন্দির আর ভয়ের স্থান নয়।
অগ্নিকুণ্ড নিস্তব্ধ, চারপাশে শান্তি।
রঘুনাথ কেঁদে বললেন—
— “বছরের পর বছর পর আজ আমাদের গ্রাম অভিশাপমুক্ত হলো।”
ঋজু ডায়েরিতে লিখল—
“প্রেমকে কখনো দমন করা যায় না। নিষিদ্ধ প্রেম যদি অস্বীকৃত হয়, তবে সে অভিশাপ হয়ে ফিরে আসে। আর সম্মান পেলে, সে হয়ে ওঠে মুক্তির পথ।”
শেষ দৃশ্য
ঋজু মন্দির থেকে বেরিয়ে পাহাড়তলির দিকে হাঁটতে লাগল।
দূরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে।
তার মনে একটাই উপলব্ধি—
ভালোবাসার শক্তি অগ্নিকুণ্ডের আগুন থেকেও প্রখর।