ভুলুর বিবাহ অভিযান

“ভুলুর বিবাহ অভিযান”

বাংলার ছোট্ট একটি গ্রাম—শালবন। এ গ্রামটার নাম শুনলেই সকলে মনে করে, ওখানে নিশ্চয়ই খুব শান্তিপ্রিয়, গম্ভীর, ভদ্র মানুষদের বসবাস। কিন্তু শালবনের বাসিন্দারা জানে, শান্তি সেখানে টেকসই নয়, কারণ আছে এক এবং অদ্বিতীয় ভুলু মণ্ডল

ভুলু গ্রামে জন্মেই যেন ঘোষনা দিয়েছিল,
“আমি শান্তি আনব না, আমি হাসি-ঠাট্টা আনব!”

খুব বেশি পড়াশোনা করেনি, কিন্তু শোনে অনেক “আইডিয়া” মাথায় খেলে বেড়ায়। আর সেই আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গ্রামজুড়ে হাসির ঝড় তোলে। এ কারণেই সবাই তাকে ভালোবেসে “ভুলু” বলে ডাকে।

কিন্তু এবার ভুলুর মাথায় উঠেছে এক নতুন চিন্তা— বউ চাই!

ভুলুর ঘোষণা

একদিন গ্রামের চায়ের দোকানে বসে সবাই আড্ডা মারছে। হঠাৎ ভুলু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
—”শোন, শোন! তোমরা সবাই আজ সাক্ষী থাকো। আমি ঠিক করেছি, এবার আমি বিয়ে করব।”

চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া হরিদাস কাকু হেসে বললেন,
—”ওরে বাবা! কে বিয়ে করবে তোকে? যে ছেলে একদিনে তিনবার মোজা হারায়, সে কি সংসার সামলাতে পারবে?”

সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

ভুলু বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
—”তুমি জানো না কাকু, আমি একদিন বড়লোক হবো। তখন লোকে লাইনে দাঁড়িয়ে আমার বউ হতে চাইবে।”

চায়ের দোকানের মালিক গোপাল ঠোঁট কামড়ে হাসি চাপতে চাপতে বলল,
—”তাহলে আগে একটা কাজ খুঁজে নে। বউ তো চাকরির সার্টিফিকেটও চায়!”

প্রস্তাবের বাজার

বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ভুলু কেমন যেন এক অদ্ভুত উদ্যমে ভরে গেল। প্রথমেই গেল বিয়ের মধ্যস্থতাকারী—মহিলা কল্যাণ সমিতির দিদিমণি শেফালি আপার কাছে।

শেফালি আপা ভুলুকে দেখে অবাক,
—”তুই এখানে? তুই কি সত্যিই বিয়ে করতে চাস?”

ভুলু গম্ভীর গলায় বলল,
—”হ্যাঁ আপা। আমি শুধু বউ চাই না, আমি চাই একজন ‘স্মার্ট বউ’।”

শেফালি আপা হেসে উত্তর দিলেন,
—”ঠিক আছে। তুই তালিকা দে, কেমন বউ চাই?”

ভুলু এক লম্বা লিস্ট বের করল—
১. রান্না জানবে,
২. সিনেমা দেখতে ভালোবাসবে,
৩. রাগ করলে চেঁচাবে না,
৪. আমার কৌতুক শুনে হাসবে,
৫. আর সবচেয়ে বড় কথা—আমার আইডিয়া শুনে না বলবে না।

শেফালি আপা হেসে গড়াগড়ি খেয়ে গেলেন।
—”রে বাবা! এমন বউ যদি কোথাও থাকে, তবে তোকে না দিয়ে উনাকে প্রেসিডেন্ট করে দেওয়া উচিত!”

প্রথম প্রার্থী

কিছুদিন পর খবর এল, পাশের গ্রামের ললিতা নামের এক মেয়ে ভুলুর সাথে দেখা করতে রাজি।

ভুলু তার সেরা জামা পরে হাজির। ললিতা গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল,
—”আপনি কাজ করেন কি?”

ভুলু একটু ভেবে বলল,
—”কাজ? মানে বড় কাজ না। তবে গ্রামের সবার হাসির কাজ আমিই করি।”

ললিতা চোখ বড় বড় করে তাকাল। তারপর শান্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল।

ভুলু দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
—”হুঁ, হাসি বোঝার ক্ষমতা নেই মেয়েটার। এটা আমার সাথে মানাবে না।”

ভুলুর বিজ্ঞাপন

ললিতার ঘটনা ফ্লপ হতেই ভুলু নতুন আইডিয়া বের করল। সে গ্রামের দেওয়ালে দেওয়ালে বিজ্ঞাপন লিখে দিল—

“যুবক সুন্দর, হ্যান্ডসাম, হাসিখুশি। রান্না না জানলেও খেতে ওস্তাদ। স্ত্রী চাই, অতি জরুরি।”

লেখা দেখে পুরো গ্রাম হেসে লুটোপুটি। এমনকি হাটে গিয়ে ছাগল বিক্রি করতে আসা লোকজনও বিজ্ঞাপন পড়ে হাসতে লাগল।

একদিন এক বৃদ্ধা এসে ভুলুকে বললেন,
—”বাবা, তুমি চাইলে আমার ছোট বোনের নাতনিকে দিতে পারি। তবে মেয়ে একটু মোটা, আবার খুব খায়।”

ভুলু চটপট বলল,
—”খাবার ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। তবে শর্ত একটাই—সে যেন আমার হাসিতে হেসে ওঠে।”

কিন্তু দেখা করতে গিয়েই বিপদ। মেয়ে তাকে প্রথম দেখেই জিজ্ঞেস করল,
—”আপনি কত টাকা রোজগার করেন?”

ভুলু তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। উত্তর দিল,
—”রোজগার করি না, তবে হাসির রোজগার করি।”

তারপর? গল্প শেষ! মেয়েটি আর ফেরেনি।

হঠাৎ দেখা

ঠিক যখন ভুলু বউ খোঁজার দৌড়ে একেবারে হাল ছাড়তে বসেছে, তখনই ঘটল অদ্ভুত ঘটনা।

একদিন গ্রামে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এলো পাশের শহরের কিছু ছেলে-মেয়ে। সেখানে ভুলুর সাথে পরিচয় হল রুবি নামের এক মেয়ের। রুবি হাসিখুশি, একটু দুষ্টু স্বভাবের।

ভুলু তাকে দেখে প্রথমেই নিজের কৌতুক শুনিয়ে ফেলল। আশ্চর্য ব্যাপার, রুবি হেসে গড়াগড়ি খেয়ে গেল।

ভুলুর চোখ চকচক করে উঠল।
—”এটাই তো! যাকে আমি খুঁজছিলাম!”

ভুলুর পরীক্ষা

ভুলু রুবিকে পরীক্ষা নিতে লাগল।
—”শোন, আমি একদিন যদি হঠাৎ ট্রেনে চড়ে কোথাও হারিয়ে যাই, তখন কি করবে?”

রুবি হেসে উত্তর দিল,
—”তাহলে আমি নিজেই ট্রেনে উঠে তোমাকে খুঁজে বের করব।”

ভুলুর মন ভরে গেল।

আবার জিজ্ঞেস করল,
—”আমি যদি একদিন রান্না করতে গিয়ে সব ভেজাল পাকাই?”

রুবি বলল,
—”তাহলে আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে হেসে খাবো।”

ভুলু আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মনে মনে ঠিক করল—এই মেয়েকেই বিয়ে করবে।

গ্রামে হইচই

ভুলুর বিয়ে ঠিক হতেই পুরো শালবন গ্রাম উত্তেজনায় ভরে গেল। সবাই বলাবলি করতে লাগল—
—”আরে, ভুলুরও বউ হচ্ছে!”

চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পুকুর ঘাট পর্যন্ত আলোচনার বিষয় শুধু এই একটাই।

বিয়ের দিন ভুলু নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসে আছে। তার মুখে সেই চিরচেনা হাসি। আর গ্রামের সবাই হেসে কুটিপাটি হচ্ছে—কারণ এ যেন শুধু বিয়ে নয়, একটা উৎসব!

হাসির সংসার

বিয়ের পর রুবি যখন ভুলুর ঘরে এলো, সবাই ভেবেছিল—হয়তো এবার ভুলু বদলে যাবে।

vulur bibaha avijan 1

কিন্তু না!
ভুলু যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেল—হাসি, কৌতুক, আর অদ্ভুত আইডিয়ায় ভরা।

তবে এবার পার্থক্য একটাই—এখন তার পাশে আছে রুবি, যে তার প্রতিটি কাণ্ডে হেসে ওঠে।

গ্রামের মানুষরা বলে,
—”ভুলুর জীবনে রুবি এসেছে মানে, শালবন গ্রামে হাসির রানি নেমেছে!”

সমাপ্তি

আজও ভুলু মণ্ডলের বাড়ি থেকে হাসির কলরব শোনা যায়।
গ্রামবাসী বলে,
“যে গ্রামে ভুলু আছে, সে গ্রামে দুঃখ বেশি দিন থাকতে পারে না।”

ভুলু নিজে বলে—
—”বউ পাওয়া মানে শুধু সংসার নয়, মানে একজন সঙ্গী পাওয়া, যে তোমার হাসিতে হাসবে আর কাঁদলে চোখ মুছিয়ে দেবে।”

আর এভাবেই শালবন গ্রাম ভুলু ও রুবির সংসারে রঙিন হয়ে থাকে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *