ভোলাবাবুর

ভোলাবাবুর বিয়ের অভিযান

জরুরি নিমন্ত্রণ ও ব্যাগবিভ্রাট

ভোলাবাবু অর্থাৎ শান্তিবাবু হলেন ভুলে যাওয়ার জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। তাঁর ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা এতটাই কিংবদন্তি যে পাড়ার মুদি দোকানদারও তাঁকে জিজ্ঞেস করে, “ভোলাবাবু, তেল না নুন?”। কারণ, তিনি তেল চাইতে গিয়ে নুন কিনেছেন, নুন চাইতে গিয়ে কিনেছেন কেরোসিন।

তবে আজ পরিস্থিতি অন্যরকম। আজ তাঁর ছোট ভাগ্নে রনিতের বিয়ে। এই প্রথম নিজের ভুলো স্বভাবের কারণে তাঁর মনে একটু ভয় ঢুকলো। কারণ রনিতের বাবা কড়াভাবে বলে দিয়েছেন, “ভোলা, এইবার যেন কোনও ভুল না হয়। ঠিকানা একদম মুখস্থ করে যাও!”

volababur biye 4

শান্তিবাবু তাঁর প্রিয় ডায়েরি খুলে দেখলেন, যেখানে ঠিকানাটা খুব বড় করে লেখা: “শ্যামবাজার, আনন্দ ভবন ব্যাঙ্কোয়েট, সন্ধে ৭টা।”

বিয়েতে পরার জন্য নতুন পাঞ্জাবি পরে, চশমা চোখে দিয়ে তিনি তৈরি হলেন। এখন দরকার কেবল ট্রেন বা বাসের টিকিট। তিনি তাড়াহুড়ো করে তাঁর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে টিকিট বের করতে গিয়ে ভুল করে ধরে নিলেন একটি পুরনো ঘোড়দৌড়ের টিকিট। বহু বছর আগে কেনা, কিন্তু টিকেটের ছাপ এবং কাগজের রংটা ট্রেনের টিকিটের মতোই!

তিনি ব্যাগ গোছাতে বসলেন। ব্যাগে রাখলেন জলের বোতল, চশমার বাক্স, আর গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল। কিন্তু তিনি ভুলে গেলেন, জলের বোতলটা আসলে তাঁর এক বন্ধুর ফুটো হয়ে যাওয়া ফ্লাস্ক, চশমার বাক্সটা হল আসলে লবণদানি, আর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটিতে আছে তাঁর বাড়ির পুরনো ইলেকট্রিক বিল! কিন্তু তিনি প্রতিটি জিনিসের দিকে তাকিয়ে গভীর স্বস্তির হাসি হাসলেন: “সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে।”

সন্ধ্যা নামার আগেই তাঁকে রওনা হতে হবে। তিনি গেট খুলে রাস্তায় পা বাড়ালেন। কিন্তু কোথায় যাবেন? রনিতের বাবার সাবধানবাণী মনে আসতেই তিনি আবার ডায়েরি খুললেন।

“শ্যামবাজার…” তিনি বিড়বিড় করলেন, “…হ্যাঁ, শ্যামবাজার। এখন খালি মনে রাখতে হবে, আগে উত্তর, না আগে দক্ষিণ!” এই ভেবে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন ঠিক উল্টো দিকে, যেদিকে শ্যামবাজার নয়, বরং পাড়ার গলির মোড়ে আজ সন্ধ্যায় রয়েছে এক রাজনৈতিক জনসভা!

নেতার মঞ্চে ভোলাবাবু

ভোলাবাবু ‘শ্যামবাজার’ ভেবে যখন হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার মোড়ে এসে পৌঁছালেন, তখন চারদিকে প্রচুর ভিড়। মাইক বাজছে, ব্যানার টাঙানো, আর উজ্জ্বল আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। তিনি ভাবলেন, “আহা, ভাগ্নের বিয়ে বলে কথা! কত আয়োজন!”

আসলে এটি ছিল একটি স্থানীয় নেতার নির্বাচনী সভা। সাদা পাঞ্জাবি পরা শান্তিবাবুকে দেখে মঞ্চের ভলান্টিয়াররা ভাবলেন, ইনি হয়তো কোনো বরিষ্ঠ নেতা, যাঁকে সভার প্রধান বক্তা হিসেবে আনা হয়েছে। ভুলোবাবু ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাসতে হাসতে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভলান্টিয়াররা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে চেয়ারে বসালেন।

ভোলাবাবু ঘড়ি দেখলেন—সন্ধে সাড়ে সাতটা। “ঠিক সময়েই এসেছি,” ভেবে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

volababur biye 3

কিছুক্ষণ পর সভার সঞ্চালক মাইকে ঘোষণা করলেন, “এবার আমাদের মাঝে আসবেন আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, শ্রদ্ধেয় শান্তিবাবু! তিনি আপনাদের আশীর্বাদ করবেন!”

ভোলাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। মাইকের সামনে গিয়ে ঘোড়দৌড়ের টিকিটটাকে বিয়ের কার্ড ভেবে একবার চোখ বোলালেন। তারপর গম্ভীর মুখে বলতে শুরু করলেন:

“ভাইসব! আমি আজ এখানে এসেছি এক আনন্দঘন মুহূর্তে, আমার ভাগ্নে রনিত এবং তার নববিবাহিত স্ত্রী রানিকে আশীর্বাদ করতে। যদিও জানি, জীবনটা একটা কঠিন রেসের মাঠ! তাই, এই নতুন জুটিকে বলছি— দৌড়াও! শুধু দৌড়াও! জীবনের বাজি জেতার জন্য আজ থেকে দু’জনেই ঘোড়া। তবে মনে রাখবে, পুরোনো ঘোড়াকে (শ্বশুরমশাইকে) যেন ভুলো না। আর রানি, সংসার জীবনে যদি কখনও মন খারাপ হয়, শুধু এক চিমটি নুন নিয়ে মুখে দিয়ে দিও! সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ভোলাবাবুর নুনের কথা শুনে সবাই অবাক। কারণ, তিনি যে লবণদানিটা ব্যাগে ভরে এনেছিলেন, সেটাকেই তিনি ‘সুখের মন্ত্র’ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। জনসভায় এমন বিদঘুটে উপদেশ শুনে জনতা হাসিতে ফেটে পড়ল। নেতা ও সঞ্চালক লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন।

অবস্থা বেগতিক দেখে এক ভলান্টিয়ার কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, আপনি কি ভুল করে অন্য কোথাও এসেছেন? এটা তো সভার মঞ্চ।”

ভোলাবাবু তখন খেয়াল করলেন চারদিকে কোনো বর-কনে নেই, শুধু কিছু তেতে-থাকা জনতা আর লাল-সবুজ পতাকা। “ওহ! এটা তো আনন্দ ভবন নয়,” বলে তিনি মাথা চুলকালেন। মঞ্চ থেকে নেমে তিনি ছুটতে শুরু করলেন।

ভুল বাড়িতে ভুল খাবার

ভোলাবাবু জনসভা থেকে পালিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি ধরলেন। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেন, “ভাই, আনন্দ ভবনে চলো! জলদি করো, নইলে নুনগুলো সব গলে যাবে!” (তিনি তাঁর লবণদানি-রূপী চশমার বাক্স নিয়ে চিন্তিত)।

ট্যাক্সি দশ মিনিটের মধ্যেই একটি বড় বাড়ির সামনে থামল। বাড়ির গেটে বড় করে লেখা: “স্বাগতম।”

“আরে, এই তো আনন্দ ভবন!” শান্তিবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু আসলে এটা ছিল পাড়ার এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সদ্য-প্রয়াত মায়ের শ্রাদ্ধের ভোজের অনুষ্ঠান। লোকজনের ভিড় দেখে তিনি ভাবলেন, ‘বিয়েতে এত কম লোক কেন?’

ভিতরে গিয়ে দেখলেন, সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে এবং বেশ গম্ভীর পরিবেশে নিরামিষ খাবার খাচ্ছে। শান্তিবাবু ভাবলেন, “রণিত বুঝি খুব ধার্মিক পরিবেশে বিয়ে করছে। তাই আলো নেই, জোরে গানও বাজছে না।”

volababur biye2

তিনি সোজা গিয়ে এক কোণে বসে পড়লেন। খাবার পরিবেশন করা হলে তিনি দেখলেন পাতে নিরামিষ ডাল, ভাজা আর বাঁধাকপির তরকারি। শান্তিবাবু হতাশ হয়ে গেলেন। ভাগ্নের বিয়েতে এরকম নীরস মেনু দেখে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না।

পাশে বসা এক ভদ্রলোককে ফিসফিস করে বললেন, “কী মশাই, এটা কেমন বিয়ে? কলাপাতা, নিরামিষ? একটা মাংসের ঝোলও নেই? আমার ভাগ্নের বিয়েতে এমন কৃপণতা! ছি ছি!”

ভদ্রলোক তখন শান্তভাবে বললেন, “শান্তিবাবু, আপনি একটু ভুল করছেন। এটা বিয়ে নয়, এটা শ্রাদ্ধের ভোজ।”

এই কথা শুনে শান্তিবাবুর হাত থেকে নুনের প্যাকেট (তাঁর চশমার বাক্স) ফসকে পড়ল। তিনি আতঙ্কে টেবিল ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠলেন, “এ কী কাণ্ড! আমি শ্রাদ্ধের ভোজ খাচ্ছি? ওহ! আমি তো ভেগাস (Las Vegas)-এর রেসের টিকিট দিয়ে এসেছি, এখন যদি আমার আত্মা শান্ত হয়ে যায়?”

শান্তিবাবু তৎক্ষণাৎ উঠে দৌড়ালেন। বাড়ির কর্তা তাঁকে দেখে “কে আপনি? কেন এমন করছেন?” বলে ধাওয়া করলেন। কিন্তু ভুলোবাবু তখন হাওয়ার বেগে গেটের বাইরে।

ট্যাক্সি বিভ্রাট ও গোপন রহস্য ফাঁস

বাইরে এসে ভোলাবাবু হতাশ হয়ে বসলেন। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, তাঁর ব্যাগে একটা ফাইল আছে। সেটি আসলে ইলেকট্রিক বিলের ফাইল, কিন্তু তিনি ভাবলেন, এই ফাইলে নিশ্চয়ই বিয়ের সঠিক ঠিকানা আছে।

ফাইলটি বের করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, সেটি বিলের কাগজ নয়, বরং তাঁর বন্ধু অসীমের একটা পুরোনো প্রেমপত্র! অসীম একবার চিঠিটা শান্তিবাবুকে দিয়েছিল জরুরি কথা বলার জন্য, আর ভোলাবাবু সেটাকেই বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথি ভেবে ব্যাগে ভরেছিলেন।

ভোলাবাবু চিঠিটিকে বিয়ের কার্ড ভেবে পড়তে লাগলেন। তাতে লেখা: “প্রিয় পারুল, আমি জানি, এই বিয়েটা আমরা কেউই মানতে পারছি না। কিন্তু…”

volababur biye1

ভোলাবাবু স্তব্ধ! তিনি ভাবলেন, “সর্বনাশ! রনিতের কোনো গোপন প্রেমিকা আছে! আর তারা পালিয়ে যাচ্ছে! এই ফাইলটা রনিত লুকিয়েছিল নিশ্চয়ই!”

তিনি আবার একটি ট্যাক্সি ধরলেন। ড্রাইভারকে বললেন, “সোজা আনন্দ ভবন, এক্ষুনি! আমার ভাগ্নের সর্বনাশ হচ্ছে, তাকে বাঁচাতে হবে!”

ট্যাক্সি চলল। অস্থির হয়ে ভোলাবাবু তাঁর ফুটো হয়ে যাওয়া ফ্লাস্ক থেকে জল খেতে গিয়ে দেখেন, সব জল ফ্লাস্কের ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে গেছে। রেগে গিয়ে তিনি ফুটো ফ্লাস্কটি ড্রাইভারের সিটের পিছনের জানালায় ছুড়ে মারলেন।

একটু পরে যখন তারা আনন্দ ভবনের কাছাকাছি পৌঁছাল, তখন দেখা গেল, গেটে বরযাত্রীর গাড়ি এসে গেছে। ভোলাবাবু ট্যাক্সি থেকে নেমেই সোজা গেটে দাঁড়িয়ে থাকা রনিতের বাবা (তাঁর কড়া মেজাজের দাদা)-এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

শান্তিবাবু উত্তেজিত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “দাদা! বাঁচাও! রনিত ভুল করছে! দেখো এই কার্ড! ও পারুলকে ভালোবাসে! এই বিয়ে বন্ধ করো!”

রণিতের বাবা চিঠিটি নিয়ে পড়েই অবাক! এটি রণিতের নয়, তাঁর বন্ধু অসীমের। কিন্তু রনিতের হবু শাশুড়ি দূর থেকে ভোলাবাবুর উত্তেজনা লক্ষ্য করলেন। তিনি ভাবলেন, এ নিশ্চয়ই বরপক্ষের কেউ, যিনি বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছেন।

চূড়ান্ত গন্তব্য: শেষ হাসি

রণিতের বাবা চিৎকার করে বললেন, “শান্তা! এ কী করছিস তুই? এটা রনিতের চিঠি নয়, এটা অসীমের! তুই সব ভুলে যাস কেন?”

এই সময় রনিতের হবু শাশুড়ি এগিয়ে এসে বললেন, “কী ব্যাপার? বিয়ে কি বন্ধ হবে? কীসের পারুল?”

শান্তিবাবু তখন চরম বিভ্রান্ত। তিনি দেখলেন, গেটের সামনে রনিত বরবেশে দাঁড়িয়ে আছে, হাসিমুখে। হঠাৎ শান্তিবাবুর মনে পড়ল, তিনি তো একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সঙ্গে করে এনেছেন!

দৌড়ে গিয়ে তিনি ব্যাগ থেকে তাঁর ফুটো হয়ে যাওয়া ফ্লাস্কটি (যেটি তিনি একটু আগে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন) খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু না পেয়ে তিনি তাঁর সেই লবণদানি-রূপী চশমার বাক্স বের করলেন।

ভোলাবাবু হবু শাশুড়িকে দেখিয়ে বললেন, “দিদি, দেখুন! আমি রনিতের জন্য সুখের নুন এনেছি। এক চিমটি নিলেই সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে!”

রণিতের বাবা হাঁটুতে মাথা ঠুকে বসলেন। সবাই হাসতে শুরু করল। ভুলের স্রোতে ডুবে থাকা শান্তিবাবু এবার নিজেই ভুলের কারণ হয়ে হাসি ফোটাচ্ছেন।

সবাই যখন হাসাহাসি করছে, তখন রনিত এগিয়ে এলো। সে জানত তার কাকা ভুলো, তাই সব ক্ষমা করে দিল। সে কাকার হাত ধরল এবং তাঁকে বিয়ের আসরে নিয়ে গেল।

বর-কনে যখন মালাবদল করছে, ভোলাবাবু তখন আনন্দে আত্মহারা। তিনি দেখলেন, বর-কনেকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য একটি সুন্দর উপহারের বক্স রাখা আছে। তাঁর মনে পড়ল, তিনি তো কোনো উপহার আনেননি!

ঠিক তখনই মনে পড়ল তাঁর ব্যাগের শেষ জিনিসটার কথা—সেই পুরোনো ঘোড়দৌড়ের টিকিট!

ভোলাবাবু সানন্দে উপহারের বাক্সে টিকিটটি ঢুকিয়ে দিলেন। আর বিড়বিড় করলেন: “শুভ বিবাহ! দৌড়াও, ঘোড়া!

উপসংহারে, ভোলাবাবুর ভুলের ফলে যে হাস্যরসের সৃষ্টি হলো, তা পরিবেশকে আরও আনন্দময় করে তুলল। তাঁর ভুলো মন হয়তো সমাজের চোখে ত্রুটি, কিন্তু তাঁর সরলতা আর আন্তরিকতা সেই ত্রুটিকে ছাপিয়ে গিয়ে এক অনাবিল আনন্দের উৎস হয়ে উঠলো।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *