অরুণা
(একটি রূপকথার গল্প)
কোনো এক কল্পলোক। পাহাড়, নদী, জঙ্গল আর প্রাচীন নগরের মিশেলে তৈরি এক বিস্ময়ময় রাজ্য। নাম তার— অভ্রলোক। এই অভ্রলোকে ছিল এক অদ্ভুত নিয়ম—নারীরা কেবল ঘরেই থাকবে, বাইরে যাবার অধিকার নেই, সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার নেই। শত শত বছর ধরে এভাবেই চলছিল জীবন।
কিন্তু ভাগ্যের লেখা বদলাতে এসেছিল এক কিশোরী—অরুণা। তার হাত ধরে শুরু হবে নারীশক্তির জয়যাত্রা।
শৃঙ্খলের ভেতরে আলো
অভ্রলোক রাজ্যের পূর্বপ্রান্তে ছোট্ট এক গ্রামে জন্মেছিল অরুণা। মাটির ঘর, উঠোনে তুলসী গাছ, আর চারদিকে কঠোর নিয়মের বেড়া। জন্মের দিন থেকেই যেন তাকে শেখানো হয়েছিল—
“মেয়ে মানেই নীরবতা, মেয়ে মানেই বাঁধন।”
কিন্তু অরুণার চোখে ছিল অন্যরকম ঝলক। ছোটোবেলায় সে নদীর ধার বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। রাতের তারা দেখে তার মনে হতো—এই আলো কি কেবল পুরুষদের জন্য জ্বলে? মেয়েরা কি কখনো আকাশ ছুঁতে পারে না?
মায়ের স্নেহ তাকে আগলে রাখলেও সমাজের বাঁধন প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে থামাত। স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা হলে পাড়ার লোকজন বলত—
“মেয়েদের লেখাপড়া শোভা পায় না। ঘরের কাজ শিখলেই চলবে।”
অরুণা চুপ থাকত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আগুন জ্বলতে থাকত।
একদিন গভীর রাতে সে স্বপ্ন দেখল। আকাশ থেকে নামলেন এক দেবীসদৃশ নারী—চোখে দীপ্তি, হাতে তলোয়ার। তিনি বললেন—
“অরুণা, তোমার ভেতরে যে আলো আছে, তা যুগ যুগের বাঁধন ভেঙে ছড়িয়ে পড়বে। ভয় পেয়ো না। নারীশক্তি কখনো হার মানে না।”
ঘুম ভাঙতেই অরুণার মনে হলো—এ স্বপ্ন কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়। এটা যেন ভবিষ্যতের পথের ডাক।
রাজদরবারের ঘোষণা
অভ্রলোক রাজ্যের মহারাজ ছিলেন বীরেন্দ্র সিংহ। তার প্রাসাদ ছিল সোনার গম্বুজে মোড়া, চতুর্দিকে সেনাপাহারা, আর ভেতরে ভয়–ভীতির রাজত্ব। তিনি বিশ্বাস করতেন—
“রাজ্য শাসন, যুদ্ধ, শিক্ষা—এসব কেবল পুরুষের অধিকার। নারী শুধু ঘর সামলাবে।”
এই বিশ্বাস থেকেই একদিন তিনি মহাদরবারে একটি কঠিন ঘোষণা দিলেন। প্রাসাদের চত্বরে বাজল ঢাকঢোল, জমায়েত হলো প্রজারা। মহারাজ দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন—
“আজ থেকে অভ্রলোকের কোনো কন্যা সন্তান পড়াশোনা করবে না, শাস্ত্র শিখবে না, যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করবে না। তারা কেবল রাজপ্রাসাদের কাজে নিযুক্ত থাকবে। রাজ্যের প্রতিটি মেয়ে হবে সেবিকা, আর প্রতিটি পুরুষ হবে শাসক।”
প্রজাদের মুখে কোনো প্রতিবাদ নেই। চারদিকে নীরবতা, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল সবাই। শতাব্দীর ভয়ে তারা যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সেই নীরবতা ভাঙল এক কিশোরীর কণ্ঠে।
অরুণা এগিয়ে এসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল—
“মহারাজ, শুধু পুরুষ কেন? নারীরও বুদ্ধি আছে, শক্তি আছে। নারী চাইলে রাজ্য রক্ষা করতে পারে, শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে পারে। আমরা দাসী নই, আমরা মানুষ।”
দরবার স্তব্ধ হয়ে গেল। এভাবে কোনো মেয়ে কথা বলার সাহস করেনি আগে। সভাসদরা ফিসফিস করতে লাগল—“অশুভ! বিদ্রোহের বীজ বুনছে!”
রাজা রুষ্ট হয়ে উঠলেন। তার চোখ লাল, কণ্ঠ বজ্রের মতো—
“একটি মেয়ে রাজদরবারে দাঁড়িয়ে আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে? প্রহরী! তাকে বন্দি করো। অন্ধকূপে ছুড়ে দাও।”
লোহার শিকল পরিয়ে অরুণাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো প্রাসাদের অন্ধকার কারাগারে।
কিন্তু যে চোখ বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছিল, সেই আগুন নিভল না। বরং আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অন্ধকূপের আগুন
প্রাসাদের অন্ধকূপ ছিল ভয়ংকর অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। সেখানে সূর্যের আলো ঢুকত না, শুধু শীতল পাথরের দেয়াল আর লোহার শিকল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদ্রোহীদের ওই কারাগারে ফেলে রাখা হতো।
অরুণাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল প্রহরীরা। মুহূর্তে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু টপটপ করে পানির ফোঁটা পড়ার শব্দ।
প্রথম রাতটা অরুণা শীত, ক্ষুধা আর ভয় নিয়ে কাটাল। কিন্তু ভোরবেলা তার চোখ বন্ধ হতেই অদ্ভুত এক দৃশ্য ভেসে উঠল।
সে দেখল—অন্ধকূপের দেয়াল ভেদ করে এক দীপ্ত আলো আসছে। আলো থেকে বেরিয়ে এল এক নারীমূর্তি। তার চুল বাতাসে উড়ছে, চোখে আগুনের মতো দীপ্তি, হাতে এক স্বর্ণতলোয়ার।

নারীমূর্তি বললেন—
“অরুণা, আমি সেই শক্তি, যাকে যুগের পর যুগ দমিয়ে রাখা হয়েছে। আমি তোমার পূর্বপুরুষী নারীদের রক্তে বহমান আগুন। তুমি যদি সাহস দেখাও, আমি তোমার ভেতরে প্রবেশ করব।”
অরুণা ভয়ার্ত হলেও সাহস জোগাড় করে উত্তর দিল—
“আমি ভয় পাই না। আমি লড়তে চাই। আমাকে শক্তি দাও।”
এক ঝলক আলো অরুণার দেহ ঘিরে ফেলল। মুহূর্তে তার শিরায় বয়ে গেল অদ্ভুত বল। শিকল যেন নিজেরাই ভেঙে পড়ল। তার হাতে চলে এল স্বর্ণতলোয়ার।
অন্ধকূপ তখন আর অন্ধকার রইল না—জ্বলতে লাগল অগ্নিশিখার মতো আলোয়।
অরুণা বুঝল—এখন আর সে একা নয়। তার ভেতরে জেগে উঠেছে যুগযুগান্তরের নারীশক্তি।
বিদ্রোহের শুরু
অরুণার ভেতরে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা আর কোনো প্রাচীর আটকাতে পারল না। অন্ধকূপের দরজা ভেঙে সে বেরিয়ে এলো—হাতে স্বর্ণতলোয়ার, চোখে দীপ্ত সাহস।
প্রহরীরা ছুটে এল তাকে আটকাতে, কিন্তু অরুণার এক আঘাতেই তাদের হাতে ধরা লোহার বর্ম ভেঙে গেল।
প্রহরীরা ভয়ে কেঁপে উঠল—“এ তো আর সাধারণ মেয়ে নয়, এ তো শক্তির অবতার!”
অরুণা পালাল না। সে জানত, একার পক্ষে পুরো রাজ্য বদলানো সম্ভব নয়। তাই সে ছুটে গেল গ্রাম থেকে গ্রামে।
সে নারীদের ডেকে বলল—
“কতদিন আর চুপ করে থাকব? কতদিন অন্যায় সহ্য করব?
আমরা শুধু ঘরের কোণে বাঁধা পুতুল নই, আমরা মানুষ।
আমরা মা, আমরা বোন, আমরা রক্ষক।
সময় এসেছে শৃঙ্খল ভাঙার!”
প্রথমে ভয় পেয়ে অনেকেই চুপ করে রইল। কিন্তু অরুণার চোখের আগুন, তার কণ্ঠের দৃঢ়তা, আর দেবীর আশীর্বাদের আলো ধীরে ধীরে নারীদের ভেতরে সাহস জাগিয়ে তুলল।

কৃষাণীর হাতে কাস্তে, ঘরোয়া নারীর হাতে লাঠি, তরুণীর হাতে আগুনের মশাল—সবাই একত্র হতে লাগল।
নারীরা শপথ নিল—
“আমরা আর কাঁদব না, আমরা লড়ব।”
শত শত নারী অরুণার পাশে দাঁড়াল। সেই রাতেই গ্রামের আকাশে জ্বলে উঠল আগুনের মশাল, আর বাজল বিদ্রোহের ঢোল।
অভ্রলোকের ইতিহাসে এই প্রথম নারীরা মুখ তুলে দাঁড়াল।
অরুণা জানত—এটা কেবল শুরু। সামনে অপেক্ষা করছে রাজপ্রাসাদের সঙ্গে এক ভয়ংকর সংঘর্ষ।
রাজ্যের মহাযুদ্ধ
অভ্রলোক রাজ্যের আকাশে তখন ভয়ের মেঘ জমেছে। মহারাজ বীরেন্দ্র সিংহ খবর পেলেন—
“গ্রাম থেকে গ্রামে নারীরা জড়ো হচ্ছে, অরুণার নেতৃত্বে বিদ্রোহ দানা বাঁধছে।”
রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি হুকুম দিলেন—
“সেনাবাহিনী প্রস্তুত করো। আজ রাতেই বিদ্রোহ দমন করা হবে। এক মেয়ে আমার শতাব্দীর আইন ভাঙবে? অসম্ভব!”
প্রাসাদের ঢাকঢোল বাজল, হাজারো সৈন্য তরবারি ঝলকাতে ঝলকাতে মাঠে নেমে এল।
কিন্তু তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রইল এক অন্য রকম সেনাদল—
হাতে কাস্তে, লাঠি, মশাল, আর চোখে ভয়হীন দীপ্তি নিয়ে শত শত নারী।
তাদের মাঝখানে অরুণা, হাতে দেবীর স্বর্ণতলোয়ার, কণ্ঠে বজ্রনিনাদ—
“আজকের যুদ্ধ কোনো এক নারীর নয়, আজকের যুদ্ধ প্রতিটি নারীর অস্তিত্বের। যে আলো যুগ যুগ ধরে বন্দি ছিল, আজ সেই আলো আকাশে ছড়িয়ে পড়বে!”
যুদ্ধ শুরু হলো।
সৈন্যরা প্রথমে ভেবেছিল, সহজেই নারীদের দমন করা যাবে। কিন্তু তাদের প্রতিটি আঘাতের জবাব এলো আগুন হয়ে।
এক কৃষাণী লাঠি দিয়ে বর্ম ভেঙে দিল, এক তরুণী কাস্তে চালিয়ে সেনার তরবারি ঠেকাল, আর অরুণার একেকটা আঘাতে পুরো ময়দান কেঁপে উঠল।
সেই রাতের আকাশ লাল হয়ে উঠল আগুনের শিখায়, মশালের আলোয়।
পুরুষ সেনারা যখন ভয়ে পিছু হটতে লাগল, অরুণার কণ্ঠ আবার গর্জে উঠল—
“নারী মানেই দুর্বল নয়, নারী মানেই শক্তি। আমরা মা, আমরা স্রষ্টা, আমরা রক্ষকও। আজ থেকে আমাদের কেউ শৃঙ্খলে বেঁধে রাখতে পারবে না!”
রাজা প্রাসাদের বারান্দা থেকে সব দেখলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের জেদ, সাহস, ঐক্য দেখে তার চোখে ভয়ের ছায়া নামল।
প্রথমবার তিনি উপলব্ধি করলেন—শক্তির আসল রূপ লুকিয়ে আছে সেই নারীদের ভেতরেই, যাদের তিনি এতদিন বন্দি করে রেখেছিলেন।
যুদ্ধ শেষ হলে নারীরাই জয়ী হলো। সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করল। প্রজারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল—
“নারীশক্তির জয়! অরুণার জয়!”
অরুণা রাজদরবারে দাঁড়িয়ে মহারাজকে উদ্দেশ করে বলল—
“মহারাজ, আজ থেকে অভ্রলোকে নারী-পুরুষ সমান।
আর কোনো শৃঙ্খল থাকবে না, কোনো বাঁধন থাকবে না।
কারণ নারীশক্তির জয় মানেই মানবতার জয়।”
মহারাজ নিরব হয়ে মাথা নত করলেন। প্রজারা উল্লাসে ফেটে পড়ল।
নতুন ভোর
অভ্রলোক বদলে গেল। মেয়েরা পড়াশোনা শুরু করল, যুদ্ধে যোগ দিল, রাজদরবারে মতামত দিল। সমাজে সমান সম্মান পেল।
অরুণা হয়ে উঠল নারীশক্তির প্রতীক। তার নাম শুনলেই মেয়েরা সাহস পেত, ছেলেরা শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াত।
নারী মানেই শক্তি। নারী মানেই আলো। তাকে অবদমন করা যায় না, কারণ সে-ই ভবিষ্যৎ গড়ে।