আকাশ যদি নামতো

‘আকাশ যদি নামতো’

ধুসর বিকেল, নীরবতার দেওয়াল

শহরতলির এই ছোট্ট লাইব্রেরিটা ছিল নন্দিনীর কাছে এক সুরক্ষিত আশ্রয়। পুরনো বইয়ের মলাট আর ধুলো মেশানো গন্ধ – এই গন্ধেই যেন তার অভিমানী মন শান্তি পেত। বাইরে আকাশে বৃষ্টি নামলে ভিজে কাঠের জানলায় যে জলবিন্দুগুলো জমে উঠত, ঠিক সেইভাবেই নন্দিনীর ভেতরে জমে ছিল এক বছরের অব্যক্ত কষ্ট।

নন্দিনীর অভিমান তীব্র, কিন্তু সে কোনোদিন তা চিৎকার করে প্রকাশ করেনি। তার অভিমান ছিল নিঃশব্দ নদীর মতো—বাইরে শান্ত, ভেতরে গভীর স্রোত। তার সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্কের শেষ দিনটা নন্দিনী এখনও মনে রেখেছে। অর্জুন সেদিন বলেছিল, “এত সিরিয়াস কেন হও, নন্দিনী? একটা সামান্য কথা নিয়ে এভাবে মন খারাপ করার কী আছে?” অর্জুনের কাছে সেটা ছিল ‘সামান্য কথা’, কিন্তু নন্দিনীর সংবেদনশীল মনে তা গভীর আঘাত হেনেছিল। সেই মুহূর্ত থেকেই তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য, অথচ শক্ত দেওয়াল।

আজও দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। আষাঢ় মাস শেষ হতে চললেও আকাশের মন এখনও ভার। এই সময়টাতেই অর্জুন আসে।

লাইব্রেরির বাঁ দিকের গলিতে অর্জুনের একটা ছোট ফটোগ্রাফি স্টুডিও। আজকাল সে স্টুডিওতে খুব কম থাকে। তার নতুন রুটিন হলো – বিকেলে লাইব্রেরির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া, কফি শপে একটু থামা, তারপর লাইব্রেরির পাশের বেঞ্চটায় বসে থাকা। সে জানে, নন্দিনী তাকে দেখছে। কাঁচের জানলার ওপার থেকে নন্দিনীর নীরব উপস্থিতিই যেন তার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।

অর্জুন আসলে একজন ভবঘুরে শিল্পী। তার চোখে এই শহরের প্রতিটি ফ্রেমই কাব্যিক। অথচ, নন্দিনীর ফ্রেমটাতেই শুধু তার ছবি ঝাপসা। সে প্রতিদিন আসে এই আশায়, যদি নন্দিনী একবারের জন্য তাকে চোখ তুলে দেখে, যদি তার নামের পাশে রাখা কফির কাপটা আজ সে তুলে নেয়।

এই নীরবতা অর্জুনকে অস্থির করে তোলে। প্রথম প্রথম সে মেসেজ করত, ফোন করত। নন্দিনী উত্তর দিত না। তারপর সে সরাসরি লাইব্রেরিতে এসে কথা বলার চেষ্টা করেছে। নন্দিনী তখন লাইব্রেরির অন্য প্রান্তে চলে যেত, অথবা মৃদু স্বরে বলত, “আপনার বিলটা বাকি আছে, অর্জুন বাবু। সময় পেলে দিয়ে যাবেন।” এই দূরত্ব, এই শীতলতা রুদ্রের সহজ, আবেগপ্রবণ মনকে দগ্ধ করে দিত।

আজ আকাশে বৃষ্টির তোড় কিছুটা বেড়েছে। অর্জুন লাইব্রেরির বেঞ্চে বসে, ভেজা ছাতাটা পাশে রাখা। তার হাতে একটি পুরোনো পত্রিকা, কিন্তু চোখ ছিল কাঁচের জানলার দিকে, যেখানে নন্দিনী বই সাজাতে ব্যস্ত। নন্দিনীর পরনে ছিল আকাশি রঙের শাড়ি, যা মেঘলা দিনেও এক চিলতে আলোর মতো লাগছিল। অর্জুন দেখল, নন্দিনী হঠাৎ করেই যেন বই সাজানো থামিয়ে দিলো। তার দৃষ্টি বাইরে আকাশে, তবে অর্জুনের দিকে নয়—শুধু আকাশের বৃষ্টির দিকে।

অর্জুন মনে মনে বলল, ‘তারে বলে দিও, আমার এই অপেক্ষা শুধু সময়ের অপচয় নয়, নন্দিনী। এটা তোমার অভিমানী মনের প্রতি আমার নীরব আত্মসমর্পণ।’

কিন্তু বলার সাহস হলো না। এক বছর ধরে এইভাবেই তাদের সম্পর্ক আটকে আছে – ‘তারে বলে দিও…’– এই অব্যক্ত কথার ভারে। অর্জুন জানে, আজ তার এই পত্রিকা পড়াটা স্রেফ ভান। সে এখানে এসেছে শুধু এইটুকুই দেখতে যে, তার অনুপস্থিতি নন্দিনীর জীবনে সত্যিই কোনো শূন্যতা তৈরি করে কিনা।

হঠাৎই বেঞ্চের কোণে তার হাত লেগে একটি পুরনো, হলুদ হয়ে আসা নোটবুক নজরে এলো। সম্ভবত কোনো পাঠক ভুল করে ফেলে গেছে। অর্জুন সেটা তুলে নিতেই তার ভেতর থেকে একটি ছোট্ট ভাঁজ করা চিরকুট মাটিতে পড়ল। অর্জুন চিরকুটটি তুলে দেখল, সেটা কোনো সাধারণ চিরকুট নয়। এটা নন্দিনীর হাতের লেখা। একটা পুরনো বইয়ের পাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া, যেখানে শুধু একটিই লাইন লেখা ছিল:

“যে কথা বোঝার ছিল না, সে কথা আর শোনারও প্রয়োজন নেই।”

অর্জুনের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এই নোটবুক, এই চিরকুট… এটা নিশ্চয়ই সেই দিনগুলির স্মৃতি বহন করছে যা তাদের এই নীরবতার দেওয়াল তৈরি করেছে। অর্জুন এবার আর নন্দিনীর দিকে তাকাল না। সে নোটবুকটি ব্যাগে ভরে নিল।

এই মুহূর্তে তার আর কফি শপে বা বেঞ্চে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এই নোটবুকই যেন তাকে ডাকছে তাদের সম্পর্কের জট খোলার জন্য। কিন্তু সে জানে না, এই জট খুলতে গেলে নন্দিনীর অভিমানের মুখোমুখি হতে হবে, যা এক কঠিন পরীক্ষা।

অর্জুন ছাতা হাতে উঠে দাঁড়াল। তার যেতে দেখেও নন্দিনী একবারও তাকাল না। সে ধীরে ধীরে হেঁটে স্টুডিওর দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে আকাশে বৃষ্টি তখনও ঝরছে, আর নন্দিনীর অভিমানের দেওয়াল তখনও একইরকম অনড়।

হারানো কথার খাতা

অর্জুন তার স্টুডিওতে ঢুকেই ছাতাটা এক কোণে ছুঁড়ে ফেলল। ভেজা জামা বা ঠান্ডা লাগার ভয় তার ছিল না; তার সমস্ত মনোযোগ এখন সেই হলুদ হয়ে যাওয়া নোটবুকটির ওপর। এই নোটবুকটি হাতে আসার পর থেকেই এক ধরনের অস্থিরতা তাকে গ্রাস করেছে। সে জানে, এই জিনিসটি লাইব্রেরিতে ফেলে যাওয়া হলেও এর মালিক নন্দিনী ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।

নোটবুকটি ছিল এক ধরনের ডায়েরি কাম স্কেচবুক। প্রথম পাতাগুলো উল্টাতেই অর্জুনের হাত কেঁপে উঠলো। ভেতরে নন্দিনীর হাতের সুন্দর, বাঁকা অক্ষরে লেখা ছিল কতশত কবিতা, ছোট ছোট অনুভূতি, আর তার স্বপ্নের স্কেচ—যে স্বপ্নগুলো একসময় তারা দু’জনে মিলে দেখত।

একটি স্কেচের নিচে নন্দিনী তারিখ দিয়েছিল ঠিক সেই দিনটির, যেদিন অর্জুন সেই ‘সামান্য কথা’টি বলেছিল। স্কেচটিতে ছিল একটি ভাঙা মূর্তি, আর তার নিচে লেখা:

“যে ভালোবাসা স্বপ্নকে গুরুত্ব দেয় না, সে ভালোবাসা আসলে আত্মার গভীরে আঘাত করে। ভাঙা কাঁচ আর জোড়া লাগে না, শুধু তার ধারালো কোণগুলো রয়ে যায়।”

অর্জুন বসে পড়ল। তার মনে পড়ে গেল সেই সন্ধ্যাটির কথা। নন্দিনী তখন তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্ট প্রজেক্ট নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিল। সে প্রায় এক বছর ধরে সেই প্রজেক্টটির জন্য কাজ করছিল—গরিব শিশুদের নিয়ে একটি কমিউনিটি আর্ট স্কুল গড়ার স্বপ্ন। সেদিন অর্জুন খুব ক্লান্ত ছিল। কাজের চাপে তার মেজাজ ছিল রুক্ষ। নন্দিনীর উদ্দীপনা দেখে সে হেসে বলেছিল, “বাব্বা, নন্দিনী! এত আবেগ দিয়ে কী হবে? প্র্যাক্টিক্যাল হতে শেখো। ওটা তো স্রেফ একটা এনজিও প্রজেক্ট, তোমার নিজের কেরিয়ার নয়।”

akash jodi namto 2

নন্দিনী কোনো উত্তর দেয়নি সেদিন। শুধু একটি ঠান্ডা, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। অর্জুন সেদিন তার নীরবতার কারণ বোঝেনি। সে ভেবেছিল নন্দিনী হয়তো একটু মন খারাপ করেছে। কিন্তু এখন এই ডায়েরির পাতা উল্টে সে বুঝতে পারল, তার সেই ‘সামান্য কথা’ নন্দিনীর কাছে তার স্বপ্নের মৃত্যু ঘোষণা ছিল। নন্দিনী অভিমান করেনি, সে আহত হয়েছিল। রুদ্রের মন্তব্য তার স্বপ্নের আত্মিক মূল্যকে অস্বীকার করেছিল।

ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল একটি কবিতা, যেন সেই সময়ের নন্দিনীর মনের প্রতিচ্ছবি:

আমার কথা নাই বা বলুক তারে, শুধু বলে দিও—আকাশের সব নীল আসলে সমুদ্রের ধার করা ঋণ। সে যদি জানতে চাইতো, তবে এই মেঘ কেন? তারে বলে দিও, নীরবতাও এক ধরণের উত্তর।

অর্জুন কবিতাটি বারবার পড়ল। ‘তারে বলে দিও’—এই শব্দবন্ধটি যেন তাকেই উদ্দেশ্য করে লেখা। নন্দিনী সরাসরি কিছু বলতে চায় না, কিন্তু সে চায় অর্জুন যেন কোনোভাবে তার মনের ভেতরের কথাটা জানতে পারে। এই নোটবুক, এই কবিতা—সবই যেন নন্দিনীর নীরব আবেদন।

অর্জুনের মনে তীব্র অনুশোচনা হলো। সে এতদিন নন্দিনীর অভিমানকে ভুল বুঝেছে। সে ভেবেছিল নন্দিনী জেদ করছে, কিন্তু আসলে নন্দিনী তার ভালোবাসার কাছে আঘাত পেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল। এই দীর্ঘ এক বছরে সে শুধু ভেবেছে নন্দিনী তার সঙ্গে কেন কথা বলছে না, কিন্তু কেন কথা বলছে না—সেটা বোঝার চেষ্টা করেনি।

বাইরের আকাশে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। স্টুডিওর আলোয় নোটবুকটির পাতাগুলো আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অর্জুন তার সেলফোনটি হাতে নিল। এই মুহূর্তে নন্দিনীকে ফোন করা অর্থহীন। তাকে এমনভাবে নন্দিনীর মুখোমুখি হতে হবে যাতে নন্দিনীর অভিমানের কারণটি সম্পূর্ণভাবে দূর হয়ে যায়।

ঠিক এই সময় অর্জুনের এক পুরোনো বন্ধু, অয়ন, দরজায় কড়া নাড়ল। অয়ন মূলত তাদের দু’জনেরই বন্ধু, এবং এই নীরবতার সাক্ষী।

অয়ন স্টুডিওতে ঢুকেই বলল, “কী রে, মুখটা এমন শুকনো কেন? আর শোন, একটা কথা বলার ছিল… নন্দিনীর জন্য একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে প্রতিষ্ঠিত, ব্যাঙ্গালোরে থাকে। আর শুনলাম, নন্দিনী নাকি প্রায় রাজি।”

অর্জুনের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ‘প্রায় রাজি’। এই নীরবতার দেওয়াল যদি এখন না ভাঙে, তবে হয়তো সব চিরকালের জন্য শেষ হয়ে যাবে। তার হাতে এখন নন্দিনীর অভিমানের কারণ, কিন্তু সময় হাতে নেই।

অন্য পথের আহ্বান

অয়নের কথাগুলো অর্জুনের কানে ধাতব শব্দের মতো বাজতে থাকল। নন্দিনী ‘প্রায় রাজি’। এই দুটি শব্দ অর্জুনের এক বছরের নিশ্চিন্ত অপেক্ষাকে চূর্ণ করে দিলো। এতদিন তার মনে কোথাও একটা বিশ্বাস ছিল—যেহেতু নন্দিনী সরাসরি ‘না’ বলেনি, তাই তাদের মাঝে সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার সুযোগ আছে। কিন্তু এখন সেই সুযোগ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

“প্রায় রাজি? তুই নিশ্চিত?” অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তার কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক রকমের শান্ত।

অয়ন কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। নন্দিনীর মামা-মামীর পছন্দ হয়েছে খুব। আর তুই তো জানিস, নন্দিনী এখন আর কোনো বিষয়ে তর্ক করে না। যা বলে দেওয়া হয়, নীরবে মেনে নেয়। বিশেষত যখন সে তোর ওপর এতটা অভিমানী।”

অর্জুন নোটবুকটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখল। সে জানে, এই মুহূর্তে নন্দিনীর অভিমানের কারণ প্রমাণ করার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার মন পরিবর্তন করা।

“জানিস, অয়ন,” অর্জুন শান্তভাবে বলল, “আমি এতদিন নন্দিনীর অভিমানকে ভুল বুঝেছি। আমি ভেবেছিলাম ও জেদ করছে। কিন্তু আজ বুঝলাম, ও আঘাত পেয়েছিল। আমার বলা সামান্য একটা কথা ওর স্বপ্নকে অপমান করেছিল, আর সেটাই ওকে এমন নীরব করে দিয়েছে।”

অয়ন অবাক হয়ে বলল, “তুই হঠাৎ এমন কথা বলছিস কেন? এক বছর ধরে যা বুঝতে পারিসনি…”

“সময় এসেছে,” অর্জুন অয়নের কথা শেষ করার আগেই বলল, “সময় এসেছে এই দেওয়ালটা ভাঙার। এখন নয়তো আর কোনোদিন নয়।”

অর্জুনের মনে তখন দ্বিধা ও অস্থিরতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। সে কি সরাসরি নন্দিনীকে গিয়ে বলবে যে সে তার নোটবুক পেয়েছে? তাহলে হয়তো নন্দিনী আরও অপমানিত বোধ করবে, মনে করবে অর্জুন তার ব্যক্তিগত পরিসরে প্রবেশ করেছে। নাকি সে নতুন করে আবার ক্ষমা চাইবে? কিন্তু শুধু ক্ষমা চাওয়াটা যথেষ্ট নয়। নন্দিনীকে বোঝাতে হবে, তার সেই স্বপ্নটা আজও কতটা মূল্যবান।

পরের দিন সকাল থেকেই অর্জুন অস্থির হয়ে উঠল। সে লাইব্রেরিতে গেল না। সে জানত, লাইব্রেরির বাইরে তার অপেক্ষা নন্দিনীকে আরও বিরক্ত করে তুলবে। বরং সে তার স্টুডিওতে ফিরে গেল, নন্দিনীর পুরনো নোটবুকটা খুলে বসল। সেই আর্ট প্রজেক্ট, গরিব শিশুদের নিয়ে কমিউনিটি আর্ট স্কুল – সেই স্বপ্নকে কীভাবে পুনরুজ্জীবিত করা যায়, সে ভাবতে শুরু করল।

অর্জুন একজন স্থপতি ও ফটোগ্রাফার। সে দ্রুত নন্দিনীর স্কেচগুলোকে ভিত্তি করে একটি নতুন মডেল এবং কিছু ফটোগ্রাফিক নকশা তৈরি করতে শুরু করল। তার উদ্দেশ্য ছিল, নন্দিনীর হাতে একটি সম্পূর্ণ প্রজেক্ট প্ল্যান তুলে দেওয়া, যা প্রমাণ করবে যে অর্জুন শুধু তার স্বপ্নকেই সম্মান জানাচ্ছে না, বরং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে সেও সমান আগ্রহী।

দু’দিন ধরে অর্জুন না ঘুমিয়ে কাজ করল। তার ক্যামেরার লেন্স নন্দিনীর স্কেচবোর্ড এবং সেই স্বপ্নের মডেলের ওপর স্থির। তৃতীয় দিনে, তার হাতে তৈরি হলো একটি সম্পূর্ণ নীল নকশা, যার শিরোনাম সে রাখল: ‘স্বপ্নকুটির: এক অভিমানী হৃদয়ের উপহার’

এদিকে, লাইব্রেরিতে নন্দিনীর দিনগুলো কাটছিল এক অদ্ভুত শান্তিতে। অর্জুনকে বাইরে অপেক্ষা করতে না দেখে তার মনে এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল—একদিকে যেন এক স্বস্তি, অন্যদিকে এক চাপা শূন্যতা। অভিমানী মন চাইছিল অর্জুন আসুক, কিন্তু বাস্তবের মন তাকে অন্য পথে চালিত করছিল। বিয়ের প্রস্তাবটি মন্দ ছিল না। ছেলে প্রতিষ্ঠিত, জীবনটা হবে স্থির, শান্ত। অন্তত সেখানে তাকে কারও স্বপ্নের ‘গুরুত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন শুনতে হবে না।

বিয়ের খবরটা চূড়ান্ত করার জন্য সেদিন বিকেলে নন্দিনীর মামা-মামীর আসার কথা। নন্দিনী নিজেকে প্রস্তুত করছিল এক নতুন ভবিষ্যতের জন্য, যেখানে অর্জুনের জন্য রাখা তার অভিমান আর কষ্টের কোনো স্থান থাকবে না।

ঠিক সেই মুহূর্তে, লাইব্রেরির দরজা ঠেলে প্রবেশ করল অয়ন। তার হাতে একটি বড় এনভেলপ, আর তার মুখে চাপা উত্তেজনা।

“নন্দিনী,” অয়ন ফিসফিস করে বলল, “তোর সাথে একা কিছু কথা ছিল।”

নন্দিনী বিরক্তি চেপে বলল, “ব্যস্ত আছি, অয়ন। যা বলার তাড়াতাড়ি বল।”

অয়ন এনভেলপটা নন্দিনীর হাতে দিয়ে বলল, “তারে বলে দিও… এর ভেতরে যা আছে, সেটা তোর জন্য অর্জুনের শেষ চেষ্টা। এইটুকু অন্তত দেখ।”

নন্দিনী এনভেলপটি হাতে নিয়ে দেখল, তার ওপর বড় করে লেখা: ‘আকাশ যদি নামতো’। সেই কবিতাটি যা সে অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে তার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখেছিল। নন্দিনীর অভিমানের দেওয়াল যেন হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল। সে জানে, অর্জুন এখন তার ডায়েরির কথা জেনে গেছে। সে কি সত্যিই অর্জুনের শেষ চেষ্টা দেখবে? নাকি আজই সেই অভিমানকে চিরস্থায়ী করে দেবে?

বৃষ্টি থামার আগে

অয়নের হাত থেকে এনভেলপটি নেওয়ার পর নন্দিনীর হাত কাঁপছিল। সে জানে, এই খামটি তার দীর্ঘ এক বছরের নীরবতার ওপর এক প্রবল আঘাত হানতে চলেছে। মামা-মামী আসার সময় হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরই তাকে ফোন করে তার নতুন জীবনের সম্মতি জানাতে হবে।

এই সময় আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। দ্রুত লাইব্রেরির ভেতরের একটি শান্ত কোণে গিয়ে নন্দিনী এনভেলপটি খুলল। ভেতরে ছিল একটি মোটা ফাইল এবং একটি ভাঁজ করা চিঠি।

চিঠি নয়, আগে সে ফাইলের প্রথম পাতাটি দেখল। সেখানে লেখা: ‘স্বপ্নকুটির: এক অভিমানী হৃদয়ের উপহার’। আর নিচে স্বাক্ষর: স্থপতি, অর্জুন রায়।

নন্দিনী অবাক হয়ে ফাইলটি খুলল। ভেতরে তার পুরনো স্কেচ এবং সেই কমিউনিটি আর্ট স্কুলের স্বপ্নের নকশাগুলি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে—আর্কিটেকচারাল প্ল্যান, মডেলের ছবি, বাজেট এস্টিমেট। অর্জুন শুধু তার স্বপ্ন মনে রাখেনি, সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য পরিশ্রম করেছে।

নন্দিনীর চোখ জলে ভরে এলো। তার অভিমান তখন আর শুধু অভিমান নয়, তা এখন অনুশোচনায় পরিণত হচ্ছে। সে এই মানুষটিকে ভুল বুঝেছে। অর্জুনের সেই মন্তব্যটি তার স্বপ্নের গুরুত্বকে অস্বীকার করেনি, বরং সেদিন তার ক্লান্তি এবং রুক্ষতা থেকেই বেরিয়ে এসেছিল।

নন্দিনী এরপর ভাঁজ করা চিঠিটি খুলল। অর্জুন লিখেছে:

“নন্দিনী,

জানি, তুমি হয়তো এখনও কথা বলবে না। এই চিঠিটিও তুমি হয়তো অন্য কারও হাত থেকে নিচ্ছ। কিন্তু ‘তারে বলে দিও’—এই নীরব অনুরোধ আজ আমি ভাঙতে চাই। তোমার হাতে যে নকশাটা দেখছো, তা শুধু একটা প্রজেক্ট প্ল্যান নয়; এটা সেই ‘সামান্য কথা’টার জবাব, যা আমি এক বছর আগে বলেছিলাম। আমার কাছে সেই দিনটা ছিল সামান্য, কিন্তু তোমার কাছে সেটা ছিল তোমার স্বপ্নের অপমান। তোমার ডায়েরি, তোমার অভিমানী চোখ—সব আমাকে বুঝিয়েছে যে আমি শুধু তোমার প্রেমকে ভালোবাসিনি, তোমার ভেতরের শিল্প এবং তোমার স্বপ্নকেও ভালোবাসতে পারিনি।

আমাকে ক্ষমা কোরো না, নন্দিনী। শুধু দেখো, তোমার স্বপ্নটা এখনও বেঁচে আছে। আর এই স্বপ্নটা পূরণ করার জন্যই আমি বেঁচে থাকতে চাই। তোমার জীবন স্থির, শান্ত হোক, আমি চাই। তবে সেই স্থিরতা যদি শুধু আমার অভিমানের জবাব দিতে গিয়ে হয়, তবে তা তোমার জন্য ন্যায্য হবে না।

তোমার মামা-মামী হয়তো আসছেন। আমি জানি আমার সময় শেষ। কিন্তু যাওয়ার আগে শুধু একবার বলো, তোমার অভিমানের দেওয়াল কি সত্যিই এত শক্ত যে, তার ওপার থেকে আমার এই অনুতাপ তুমি দেখতে পাও না?

তোমার জন্য চিরকাল অপেক্ষায়, অর্জুন।”

চিঠির শেষ লাইনটি নন্দিনীর মনে ঝড় তুলল। তার অভিমান ভেঙে খান খান হয়ে গেল। সে দেখল, আর্ট গ্যালারির সামনের রাস্তায় একটি ছায়া। সে দ্রুত জানলার কাছে গেল। বাইরে, আকাশে মুষলধারে বৃষ্টি তখন প্রায় থেমে আসছে। আর ঠিক লাইব্রেরির গেটের বাইরে, ভিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে অর্জুন—অপেক্ষায়, নত মস্তকে।

নন্দিনী আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না। তার নতুন জীবনের প্রস্তাব, তার অভিমান—সব যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। সে দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।

অর্জুন তখনও দাঁড়িয়ে। নন্দিনীকে এভাবে হঠাৎ বেরিয়ে আসতে দেখে সে চমকে উঠল।

“তুমি,” নন্দিনী কথা বলার জন্য হাঁপাতে লাগল, “তুমি এভাবে কেন দাঁড়িয়ে আছো?”

এক বছর পর এই প্রথম তাদের মধ্যে সরাসরি কথা হলো। অর্জুনের চোখে আনন্দ, স্বস্তি এবং ভয় মেশানো ছিল।

“তুমি কেন কথা বলছো?” অর্জুন ফিসফিস করে বলল।

নন্দিনী চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। “কারণ, তুমি প্রমাণ করেছ যে তুমি শুধু আমার প্রেমিক নও… তুমি আমার স্বপ্নের অংশীদার।”

ঠিক তখনই নন্দিনীর মামা-মামী একটি ট্যাক্সি থেকে নামলেন। তাদের মুখে এক ধরনের প্রত্যাশিত হাসি। তারা অর্জুনকে চিনতেন।

“অর্জুন? তুমি এখানে?” নন্দিনীর মামা কিছুটা অবাক হলেন।

নন্দিনী এবার অর্জুনের হাত ধরল। এক বছরের দীর্ঘ নীরবতা যেন আজ একটা শব্দে ভেঙে গেল। সে মামা-মামীর দিকে তাকিয়ে স্থির, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, “তারে বলে দিও… আমি এখন আর শুধু নীরবতার উত্তর দিই না। আমি কথা বলতে শিখেছি।”

আকাশ যদি নামতো

নন্দিনীর স্পষ্ট কণ্ঠস্বর মামা-মামীর চোখে বিস্ময় আর চাপা বিরক্তি নিয়ে এলো। তারা জানতেন, এই নীরব মেয়েটি সহজে তার সিদ্ধান্ত বদলায় না। কিন্তু আজ, নন্দিনীর চোখে যে দৃঢ়তা এবং হাতে অর্জুনের হাত, তা তাদের সমস্ত প্রত্যাশাকে যেন এক মুহূর্তে থামিয়ে দিল।

মামা কিছুটা কঠিন স্বরে বললেন, “নন্দিনী, এসব কী হচ্ছে? তুমি আমাদের সঙ্গে আসো। এই ছেলেটার সঙ্গে তোমার যা সমস্যা, তা মেটানোর বহু সময় তোমরা নষ্ট করেছো।”

নন্দিনী অর্জুনের হাত শক্ত করে ধরল। অর্জুনও তাকে ভরসা জোগাল, কিন্তু পুরো পরিস্থিতি সামলানোর ভার সে নন্দিনীর ওপরই ছেড়ে দিল। এই মুহূর্তটা নন্দিনীর নিজের অভিমানের দেওয়াল ভাঙার মুহূর্ত, অর্জুনের নয়।

নন্দিনী শান্তভাবে বলল, “মামা, আমার সমস্যা কোনো মানুষের সঙ্গে ছিল না, ছিল ভুল বোঝাবুঝির সঙ্গে। যে মানুষটা আমার স্বপ্নের গুরুত্ব বোঝে, আমি তাকে ছাড়া স্থির হতে পারি না।” সে অর্জুনের তৈরি করা নকশার ফাইলটি মামার দিকে বাড়িয়ে ধরল। “আপনারা যে জীবনের নিশ্চয়তা খুঁজছিলেন, সেই নিশ্চয়তা এর চেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না। কারণ এই নিশ্চয়তা শুধু টাকার নয়, এটা ভালোবাসার।”

মামা-মামী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারা বুঝতে পারলেন, নন্দিনীর এই নীরব অভিমান এত সহজে তৈরি হয়নি, আর এখন এই দৃঢ়তা ভাঙাও সম্ভব নয়। বিশেষত যখন অর্জুন তার ভুল স্বীকার করে এত বড় পদক্ষেপ নিয়েছে।

“ঠিক আছে, নন্দিনী,” মামী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। “তোমার জীবন, সিদ্ধান্ত তোমার। কিন্তু পরে যেন অনুশোচনা না হয়।”

“হবে না, মামী। কারণ এই অপেক্ষা আমি নিজের ইচ্ছায় করেছিলাম,” নন্দিনী হাসল। এক বছর পর, তার মুখে সেই পুরনো মিষ্টি হাসিটি ফুটে উঠল, যা অর্জুন এত দিন ধরে দেখতে পায়নি।

মামা-মামী নীরব সম্মতি জানিয়ে, নতুন ভবিষ্যতের প্রস্তাবটি বাতিল হওয়ার হতাশা নিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলেন।

akash jodi namto 3

লাইব্রেরির সামনে তখন শুধু নন্দিনী আর অর্জুন। আকাশে বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেছে। ভেজা মাটির গন্ধ, আর গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল ঝরার শব্দ – এই নীরবতা আগের চেয়ে অনেক বেশি গভীর, কিন্তু এবার সেখানে কোনো অভিমান নেই, আছে কেবল স্বস্তির উষ্ণতা।

অর্জুন নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে রইল। “তুমি কথা বললে! এতদিনে…”

নন্দিনী অর্জুনের বুকে মাথা রাখল। “তারে বলে দিও… এই অপেক্ষাটা আমারও ছিল। আমি চেয়েছিলাম তুমি যেন শুধু আমার অভিমান নয়, আমার কষ্টটা বুঝতে পারো। আমি চাইনি তুমি ক্ষমা চাও, আমি চেয়েছিলাম তুমি যেন আমার স্বপ্নকে আবার গুরুত্ব দাও।”

অর্জুন আলতো করে তার চুল ছুঁয়ে দিল। “আজ বুঝেছি, নন্দিনী। আমার ক্যামেরা যেমন প্রতিটি ফ্রেমকে মূল্য দেয়, তেমনই তোমার আবেগ তোমার জীবনের প্রতিটি স্বপ্নের মূল্য দেয়। আমি আমার ক্লান্তি দিয়ে সেই মূল্যবোধকে অপমান করেছিলাম। আমি কথা দিচ্ছি, ‘স্বপ্নকুটির’ আমরা দু’জনে মিলেই তৈরি করব।”

নন্দিনী চোখ তুলে হাসল। “আর কোনোদিন এমন সামান্য কথা বলে দূরে সরে যেও না। কারণ, আমার অভিমান হয়তো ভাঙতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না।”

সন্ধ্যা নেমে আসছে। লাইব্রেরির ভেতর থেকে মৃদু আলো আসছে। অর্জুন নন্দিনীর কপালে আলতো করে চুমু খেল।

“তারে বলে দিও,” অর্জুন ফিসফিস করে বলল, “বৃষ্টি থামার পর আকাশ যদি নামতো, তবে তা আমাদের এই নীরব ভালোবাসার জন্যেই নামতো।”

তাদের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত অভিমানের দেওয়াল ভেঙে মুক্তি পেল। সেই মুহূর্তে, তারা যেন সেই পুরোনো, ছোটবেলার বন্ধু—যারা এক দীর্ঘ ভুল বোঝাবুঝির পর আবার একে অপরের হাতে হাত রাখল। এই ভালোবাসা, দীর্ঘ নীরবতার পর আরও পরিণত, আরও দৃঢ় হয়ে উঠল।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *