ভোরের দৌড়, জীবনের ডাক

“অহংকারের মূল্য” – প্রথম পর্ব

ভোরের দৌড়, জীবনের ডাক

ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি মাটিতে নামেনি।
দূর থেকে ভেসে আসছে কোনো মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর পাখির ডাক।
উত্তর কলকাতার এক শান্ত পাড়ায় প্রতিদিনের মতোই সকাল শুরু হয় ডা. আরিন্দম সেনের জন্য।
চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের এই মানুষটি শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পেডিয়াট্রিক সার্জন।
যতই ব্যস্ত দিন যাক, সকালবেলার দৌড় আর কফির কাপ—এই দুটো তিনি কোনোদিনও মিস করেন না।

আজও তাই।
গ্রে ট্র্যাকস্যুট পরে পার্কে ঢুকলেন তিনি, গলায় হেডফোন, মুখে হালকা হাসি।
“এটা আমার মেডিটেশন টাইম,”—প্রায়ই সহকর্মীদের বলেন তিনি।

ahankarer mullya prt1 p 5

দৌড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে মোবাইল ঘড়িতে নজর রাখছিলেন—৭টা ১০।
হাসপাতালে রাউন্ড আছে ৯টায়।
সময় যথেষ্ট, ভাবছিলেন তিনি।

কিন্তু নিয়তি তখন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক তার সামনে—অদৃশ্য এক বাঁকে।

দৌড় শেষ করে পার্কের বেঞ্চে বসে জুতো খুলছিলেন, এমন সময় মোবাইলটা হালকা কেঁপে উঠল।
স্ক্রিনে হাসপাতালের নাম—“City Children’s Care”

“এই সময় কল?”—বিরক্ত না হলেও অবাক হলেন।
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো আতঙ্কিত গলা—
“স্যার! এমারজেন্সি কেস এসেছে। বারো বছরের একটা মেয়ে, বিরল হার্ট ডিজঅর্ডার। ব্লিডিং কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। ICU রেডি করছি, কিন্তু অপারেশন ছাড়া ওর বাঁচার উপায় নেই। আমরা জানি শুধু আপনি পারবেন, স্যার!”

আরিন্দমের শরীর হঠাৎ টানটান হয়ে গেল।
“আমি এখনই রওনা দিচ্ছি। OT তৈরি রাখো।”
এক মুহূর্ত দেরি না করে ব্যাগটা তুলে নিলেন।

সকালের সেই শান্ত দৃশ্য যেন মুহূর্তেই হারিয়ে গেল তার চোখের সামনে।

রাস্তা ধরে দ্রুত হাঁটছেন।
গাড়ি নিতে গেলেও সময় লাগবে, তাই ভেবেছেন ট্যাক্সি বা অটো ধরবেন।
কিন্তু রাস্তায় তখনও ভিড় কম, তাই একটু তাড়াহুড়ো করেই এক মোড় ঘুরতেই—
একটা চিৎকার।

“এই! চোখ নেই নাকি আপনার?”

এক ঝলক আলো, এক বিকট ব্রেকের শব্দ—আর তারপর ধপ করে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ।

ভোরের দৌড়, জীবনের ডাক

ডা. আরিন্দম হোঁচট খেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে গেছেন।
সামনে চকচকে এক নীল গাড়ি, আর তার জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসছে এক নারী—
লম্বা হিল, চোখে সানগ্লাস, হাতে দামি পারফিউমের গন্ধ মাখা রুমাল।

“আপনি কি অন্ধ নাকি? আমার গাড়িটা দেখেছেন একবার? নতুন কেনা! এখন পুরো কাদা মেখে দিলেন!”

আরিন্দম ব্যথা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালেন, মুখে ক্লান্ত তবু বিনয়ী সুর—
“ম্যাডাম, আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি একজন ডাক্তার, একটা জরুরি কেসে যাচ্ছি, দয়া করে—”

“ডাক্তার না প্রেসিডেন্ট, তাতে আমার কী যায় আসে?”—মহিলা গর্জে উঠলেন।
“গাড়িটা কেমন করে ময়লা করলেন দেখেছেন? আপনার মতো লোকেদের তো কোনো শিষ্টাচারই নেই!”

আরিন্দম মৃদু স্বরে অনুরোধ করলেন,
“ম্যাডাম, আমার ফোনটা একটু দরকার… রোগীটা বাঁচবে না, যদি আমি এখন না পৌঁছাই।”

“একটা মিনিট!”—মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আমার গাড়ি পরিষ্কার না করে আপনি কোথাও যাবেন না। আমি আমার স্বামীকে ডাকছি!”

রাস্তার পাশের কয়েকজন লোক জড়ো হল।
কেউ ফিসফিস করে বলল, “ডাক্তারবাবু মনে হচ্ছে… দেখুন, কতটা শান্তভাবে বলছেন।”
কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না।
কারণ মহিলা এমন এক প্রভাবশালী দাপটে কথা বলছিলেন, যেন গোটা রাস্তাই তার ব্যক্তিগত প্রপার্টি।

“এই যে, আমার গাড়িতে কাদা পড়েছে—আপনি এখনই কাপড় দিয়ে মুছুন!”
“ম্যাডাম, দয়া করে আমাকে যেতে দিন। আমি পরে ক্ষতিপূরণ দেব। দয়া করে!”

কিন্তু মহিলা তাতে কর্ণপাত করলেন না।
বরং গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে ওয়াটার বটল বের করে এনে গাড়িতে জল ঢালতে লাগলেন।

ahankarer mullya prt1 p 2

“এইভাবে ঘষুন!”—চিৎকার করলেন তিনি।
আরিন্দম নিঃশব্দে হাতের রুমাল দিয়ে গাড়ির পাশে ময়লা মোছেন।
তার চোখে কষ্ট, কিন্তু তাতে একফোঁটা ক্রোধও নেই।
শুধু একটা ফোন—যেটা বেজেই চলেছে—তাকাতে চাইছেন, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছেন না।

“এইভাবে নয়! ভালো করে পরিষ্কার হচ্ছে না!”—
মহিলা এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন।
“আপনার কোট দিয়ে মুছুন!”
“ম্যাডাম, আমি অনুরোধ করছি…”
“চুপ! আমার গাড়ির দাম জানেন? ত্রিশ কোটি! আপনি তো মাটির মানুষ, জানবেন না।”

রাস্তায় উপস্থিত লোকেরা হতভম্ব।
তাদের কেউই কিছু বলতে পারছে না।

আরিন্দম নিঃশব্দে কোট খুলে গাড়ি মুছলেন।
জল গড়িয়ে পড়ছে, ধুলা-মাটি মিশে গেছে তার আঙুলে।

অয়নের আগমন

ঠিক তখনই গাড়ি থামিয়ে এক তরুণ ডাক্তার এগিয়ে এল—
“স্যার! আপনি?”
সে অয়ন—আরিন্দমের জুনিয়র।

“কি হচ্ছে এখানে?”
“ওহ, আপনি নিশ্চয়ই ওনার পরিচিত? তাইলে নিয়ে যান, নাহলে আমি পুলিশ ডাকব!”—চেঁচিয়ে উঠলেন মহিলা।

অয়ন হতবাক।
“ম্যাডাম, উনি ডা. আরিন্দম সেন! শহরের সেরা শিশু সার্জন! উনি এখন একটা এমারজেন্সি কেসে যাচ্ছেন!”

“ডাক্তার হোন আর দেবতা, গাড়িটা কিন্তু আমার নোংরা করেছেন।”
“ম্যাডাম, এটা তো দুর্ঘটনা—আপনি চাইলে আমি গাড়ি পরিষ্কার করিয়ে দেব। উনি সত্যিই—”

“চুপ! আপনি আর কথা বলবেন না।”
মহিলা ফোনে স্বামীকে কল করলেন—
“হ্যাঁ, সুনীত! এসো, একজন মানুষ আমার গাড়ি নোংরা করেছে। না, আমি ছাড়ছি না।”

কিছুক্ষণ পরেই আসে কালো স্যুট পরা এক লোক, চোখে রাগের আগুন।
“এই যে আপনি, আমার বউকে অপমান করছেন?”

অয়ন প্রতিবাদ করে—“না স্যার, আপনি ভুল বুঝছেন।”
“চুপ থাকো! আমি পুলিশের কাছে অভিযোগ করব। আর আপনি”—সে আরিন্দমকে উদ্দেশ করে—“আপনি ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবেন, না হলে এখানেই দাঁড়াবেন।”

আরিন্দম অবিশ্বাসে তাকালেন।
“আমি বলেছি, এখনই একটা বাচ্চা মরতে বসেছে। আমার এক মিনিটও নেই।”
“তাহলে আমাদের সময় নষ্ট করার জন্য আরও ৫ লাখ দেবেন।”

এই সময় হাসপাতালে থেকে আবার ফোন আসে—
“স্যার, মেয়েটার হার্টবিট ড্রপ করছে!”

আরিন্দম ফোন তুলতে গেলে লোকটা সেটাও কেড়ে নিল।
“না, প্রথমে আমার টাকা দিন। তারপর যা খুশি করুন।”

রাস্তার মানুষ নীরব।
একজন সাহস করে বলে উঠল, “দাদা, ওকে যেতে দিন… ও তো ডাক্তার—”
লোকটা বন্দুক বের করে বলল,
“চুপ! কেউ নড়বেন না।”

চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
আরিন্দমের মুখে নিঃশব্দ কষ্ট।
“আমি আমার বাড়ি বিক্রি করব, কিন্তু মেয়েটাকে আগে বাঁচাতে দিন।”

লোকটা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “তিন মাস সময়। এখন যান।”

আরিন্দম দৌড়ে রওনা দিলেন।
পায়ের নিচে কাদা, মুখে ঘাম, কিন্তু চোখে একটাই প্রতিজ্ঞা—
“মানুষের জীবন বাঁচানোই আমার ধর্ম।”

হাসপাতালের করিডরে পৌঁছতেই সবাই দৌড়ে এল।
অয়নও ছুটে এসেছে, চোখে জল।
“স্যার, আপনি ঠিক আছেন?”
“সময় পেয়েছি তো?”
“কষ্টে পেলেও পেয়েছেন, স্যার।”

অপারেশন থিয়েটারের আলো জ্বলল।
ডা. আরিন্দম মাস্ক পরে ঢুকলেন।
দরজার বাইরে মেয়েটির দাদু কাঁপা হাতে প্রার্থনা করছেন।
“ভগবান, ওকে বাঁচিও। আমি সব হারাতে রাজি।”

ahankarer mullya prt1 p 1

ক্যামেরা ফোকাস হয় অপারেশন থিয়েটারের লাল আলোয়—
Surgery in Progress
আর দূরে রাস্তায় সেই অহংকারী মহিলা এখনো জানে না,
যার ওপর সে গাড়ির কাদা ফেলেছিল,
সে-ই তার জীবনের সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা হতে চলেছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *