স্কন্ধকাটার রেললাইন
পতিরাম স্টেশনের অভিশাপ
পাহাড়তলি স্টেশন থেকে পতিরামের দিকে যাওয়া রেলপথটা অদ্ভুত। তার চারপাশে ঘন জঙ্গল, আর রেললাইনটা যেন অজগর সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নিচে নেমে গেছে। স্থানীয়রা এই রেলপথকে “স্কন্ধকাটার রেললাইন” নামে ডাকে। প্রায় সত্তর বছর আগে এই লাইনে এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছিল। এক মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে কয়েকশো মানুষের মৃত্যু হয়। সেই দুর্ঘটনায় একজন লোক নাকি মাথা হারিয়েই মারা গিয়েছিল, আর তার দেহটা কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রামবাসীরা বলে, সেই মাথা হারানো লোকটার আত্মা আজও নাকি রাতের বেলায় রেললাইনে হেঁটে বেড়ায়, ট্রেনের যাত্রীদের ভয় দেখায়।
গল্পটা শুরু হয়েছিল পতিরাম স্টেশনের নতুন স্টেশনমাস্টার অনিরুদ্ধ মুখার্জিকে দিয়ে। অনিরুদ্ধবাবু একজন নিষ্ঠাবান রেলকর্মী, কিন্তু যুক্তিবাদী। ভূত-প্রেত বা কুসংস্কারের উপর তার কোনো বিশ্বাস ছিল না। তিনি সদ্য বদলি হয়ে এই প্রত্যন্ত স্টেশনে এসেছেন। তার স্ত্রী রাধা এবং পাঁচ বছরের মেয়ে টুপুরকে নিয়ে তিনি স্টেশনের কোয়ার্টারে বসবাস শুরু করেছেন।
প্রথম দিন থেকেই অনিরুদ্ধবাবু স্টেশনের অদ্ভুত নীরবতা এবং স্থানীয়দের মুখে স্কন্ধকাটার গল্প শুনতে লাগলেন। স্থানীয় চা বিক্রেতা ফটিকবাবু, যিনি স্টেশনের পুরোনো কর্মচারী, তিনি অনিরুদ্ধবাবুকে সতর্ক করলেন।
“সাবধানে থাকবেন স্যার,” ফটিকবাবু বললেন। “এই লাইনটা ভালো না। রাতের বেলায় কেউ একা একা লাইনের ধারে যায় না। স্কন্ধকাটা আসে।”
অনিরুদ্ধবাবু হাসলেন। “ওসব কুসংস্কার, ফটিকবাবু। মাথা হারানো মানুষ হাঁটবে? অসম্ভব।”
ফটিকবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “আপনি নিজে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, স্যার।”
অনিরুদ্ধবাবু তার কথা পাত্তা দিলেন না। তিনি রাতে স্টেশন পরিদর্শনে গেলেন। তখন রাত প্রায় বারোটা। স্টেশনে তখন পিনপতন নীরবতা। শুধু দূর থেকে কুকুরের ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। অনিরুদ্ধবাবু টর্চ জ্বেলে রেললাইন ধরে হাঁটতে লাগলেন। তার মনে সামান্য ভয় ছিল না।
রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি দেখছেন, লাইনের দু’পাশে পুরোনো, ভাঙা শেয়ালকাঠির বেড়া, আর দূরে ঘন জঙ্গলের নিস্তব্ধতা। বাতাস বেশ ঠান্ডা।
হঠাৎ, তার কানে এলো একটি ছন্দবদ্ধ শব্দ—যেন কেউ খালি পায়ে রেললাইনের স্লিপারের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে। শব্দটা প্রথমে ক্ষীণ ছিল, কিন্তু ক্রমশ কাছে আসতে লাগল।
অনিরুদ্ধবাবু টর্চ জ্বেলে সামনের দিকে তাকালেন। কিছুই দেখতে পেলেন না। তিনি ভাবলেন, হয়তো হাওয়ার শব্দ বা কোনো জন্তু জানোয়ার।
কিন্তু শব্দটা ক্রমশ স্পষ্ট হলো। এবার অনিরুদ্ধবাবু শুনলেন, যেন কেউ ভারী পায়ে ধীরগতিতে হেঁটে আসছে। শব্দটা পরিচিত, কিন্তু অদ্ভুত। যেন কোনো মানুষ হাঁটছে, কিন্তু সে মানুষটার কোনো ওজন নেই।
অনিরুদ্ধবাবু আবার টর্চ জ্বেলে দেখলেন। তখন তার চোখে পড়ল এক ভয়ংকর দৃশ্য।
রেললাইন ধরে একটি মানবাকৃতি এগিয়ে আসছে। তার পরনে ছেঁড়া পোশাক, কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর হলো তার কাঁধের উপরে কোনো মাথা নেই। মানবাকৃতিটি তার হাত দুটি তার বুকের উপর ভাঁজ করে রেখেছে, আর ধীরগতিতে অনিরুদ্ধবাবুর দিকে এগিয়ে আসছে।
অনিরুদ্ধবাবুর গলার স্বর আটকে গেল। তিনি ভয় পেয়ে চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু তার কন্ঠস্বর বের হলো না। তার হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল।
স্কন্ধকাটা! ফটিকবাবু ঠিকই বলেছিলেন!
মানব আকৃতিটি তার সামনে চলে এলো। অনিরুদ্ধবাবু অনুভব করলেন এক তীব্র, হিমশীতল বাতাস তাকে ঘিরে ধরেছে। মানবাকৃতিটির কাঁধের উপর থেকে একটি পচা, লোহার গন্ধ ভেসে আসছিল, যেন অনেক দিনের পুরোনো মরচে পড়া লোহার গন্ধ।
অনিরুদ্ধবাবু দেখল, মানবাকৃতিটির বুক থেকে একটি লালচে আভা বেরোচ্ছে। তার মনে হলো, মানবাকৃতিটি যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু তার কোনো মাথা না থাকায় সে কথা বলতে পারছে না।
অনিরুদ্ধবাবু দ্রুতগতিতে সেখান থেকে পালিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হলেন। তার পেছনে সেই ছন্দবদ্ধ হাঁটার শব্দ তখনও শোনা যাচ্ছিল। তিনি স্টেশনে ফিরে কোনোমতে কোয়ার্টারে ঢুকলেন। রাধা তখন ঘুমিয়ে ছিল।
অনিরুদ্ধবাবু সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না। তার মনে হলো, তার কোয়ার্টারের জানালার বাইরে সেই মাথা হারানো মানুষটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তার দিকে তাকিয়ে আছে।
পরের দিন সকালে, অনিরুদ্ধবাবু ফটিকবাবুকে ডেকে পাঠালেন। “ফটিকবাবু, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। আমি স্কন্ধকাটাকে দেখেছি।”
ফটিকবাবু কেবল গম্ভীর মুখে বললেন, “বলেছিলাম না স্যার? এই লাইনটা ভালো না।”
অনিরুদ্ধবাবু এবার ভূত-প্রেত বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। তার বিজ্ঞানমনস্ক মন আজ হেরে গিয়েছিল এক অচেনা, অলৌকিক শক্তির কাছে।
টুপুরের স্বপ্ন ও অভিশপ্ত বগি
অনিরুদ্ধবাবুর জীবনে এবার নতুন আতঙ্ক শুরু হলো। তিনি স্টেশনে থাকতে ভয় পাচ্ছেন। তার মেয়ে টুপুর, যে খুবই নিষ্পাপ ও চঞ্চল ছিল, সেও কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছে। রাতের বেলা টুপুর প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। সে ঘুমের ঘোরে আবছা গলায় বলে, “মাথা নেই… মাথা নেই…।”
রাধা চিন্তিত হলো। “কী হয়েছে টুপুরের? ও কেন এমন স্বপ্ন দেখছে?”
অনিরুদ্ধবাবু রাধাকে স্কন্ধকাটার গল্পটা বলতে পারলেন না, কারণ সে ভয় পাবে। কিন্তু তার মনে হলো, স্কন্ধকাটা যেন টুপুরের স্বপ্নেও প্রবেশ করেছে।
অনিরুদ্ধবাবু এবার স্টেশনের পুরোনো নথিপত্র ঘাঁটতে লাগলেন। তিনি সেই সত্তর বছর আগের দুর্ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ খুঁজে বের করলেন। রিপোর্টে লেখা ছিল, মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে যাত্রীবাহী ট্রেনের একটি বগি পুরোপুরি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। সেই বগিতেই একজন রেলকর্মী ছিলেন, যার নাম ছিল মনোজ। মনোজবাবুই ছিলেন সেই দুর্ঘটনায় মাথা হারানো মানুষ। তার দেহ পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু মাথা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মনোজবাবু ছিলেন একজন সিগনালম্যান, তিনি প্রতিদিন এই লাইন দিয়ে যাতায়াত করতেন। তার বাড়ি ছিল পাহাড়তলি স্টেশনের কাছে। দুর্ঘটনার দিন তার ডিউটি ছিল পতিরাম স্টেশনে।
অনিরুদ্ধবাবু আরও একটি বিষয় জানতে পারলেন। মনোজবাবু মারা যাওয়ার আগে নাকি তার পরিবারকে একটি শাঁখের বাক্স পাঠিয়েছিলেন, যেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিল। কিন্তু সেই বাক্সটি তার পরিবারের কাছে পৌঁছায়নি। ধারণা করা হয়, সেই বাক্সটি দুর্ঘটনার সময় রেললাইনের কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল।

অনিরুদ্ধবাবু এবার মনোজবাবুর গল্পটা বুঝতে পারলেন। মনোজবাবু কেবল মাথা হারানো মানুষ নন, তিনি ছিলেন একজন অতৃপ্ত আত্মা, যার পরিবারকে রক্ষা করার একটি শেষ ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল। তিনি তার মাথা এবং সেই বাক্সটির খোঁজে এখনও রেললাইনে হেঁটে বেড়ান।
এক রাতে, টুপুর আবার চিৎকার করে উঠল। “বাবা! মাথা নেই! ওর কাছে একটা বাক্স আছে!”
অনিরুদ্ধবাবু চমকে উঠলেন। টুপুর কীভাবে জানল বাক্সের কথা?
তিনি টুপুরকে জিজ্ঞেস করলেন, “টুপুর, তুমি কী দেখেছো?”
টুপুর বলল, “আমি স্বপ্নে দেখেছি, একজন লোক মাথা নেই। সে রেললাইনে হাঁটছে। তার হাতে একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স।”
অনিরুদ্ধবাবু এবার নিশ্চিত হলেন। স্কন্ধকাটা টুপুরের স্বপ্নেও আসছে, তার মাধ্যমে সে যেন তার বার্তা দিতে চাইছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, অনিরুদ্ধবাবু ফটিকবাবুকে নিয়ে সেই দুর্ঘটনাস্থলে গেলেন। তখন দিনের আলো, কিন্তু সেই স্থানটি ছিল কেমন যেন থমথমে। লাইনের দু’পাশে তখনও পুরোনো ট্রেনের ভাঙা অংশ পড়ে ছিল।
তারা রেললাইন ধরে হাঁটতে লাগলেন। ফটিকবাবু বললেন, “স্যার, অনেকে বলে, স্কন্ধকাটা তার মাথা খুঁজে বেড়ায়। যদি মাথা খুঁজে পায়, তবে তার আত্মা মুক্তি পাবে।”
অনিরুদ্ধবাবু তার কথা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। তিনি এবার মনোজবাবুর হারিয়ে যাওয়া বাক্সটির খোঁজে লাইনের আশেপাশে তল্লাশি চালালেন।
হঠাৎ, অনিরুদ্ধবাবু দেখতে পেলেন, লাইনের ধার ঘেঁষে থাকা একটি ঝোপের মধ্যে কিছু একটা ঝকমক করছে। তিনি ঝোপের কাছে গেলেন। সেখানে একটি ছোট, জং ধরা লোহার বাক্স পড়ে আছে। বাক্সটির গায়ে মনোজবাবুর নাম লেখা।
অনিরুদ্ধবাবু বাক্সটি হাতে নিলেন। বাক্সটি ছিল অস্বাভাবিক রকম ঠান্ডা। তিনি সাবধানে বাক্সটি খুললেন। ভেতরে কিছু পুরোনো ছবি, চিঠি এবং কিছু জং ধরা রেলের যন্ত্রাংশ। কিন্তু তার মাঝে একটি শাঁখের টুকরা ছিল।
অনিরুদ্ধবাবু শাঁখের টুকরাটা হাতে নিলেন। তার মনে হলো, মনোজবাবু তার পরিবারের কাছে একটি শেষ বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। সেই শাঁখের টুকরাটা ছিল তার ভালোবাসার প্রতীক।
সেদিন রাতে অনিরুদ্ধবাবু কোয়ার্টারে ফিরে এলেন। তার মনে হলো, মনোজবাবুর আত্মা যেন তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
কিন্তু অনিরুদ্ধবাবু জানেন, স্কন্ধকাটা শুধু তার বাক্স খোঁজে না, সে তার মাথাও খোঁজে। আর তার অভিশাপ শুধু লোভী বা অসৎ মানুষের উপর নয়, বরং সেইসব মানুষের উপর, যারা তার পরিবারকে তার বার্তা পৌঁছাতে বাধা দিয়েছে।
রাতের ট্রেন ও অলৌকিক সাক্ষ্য
অনিরুদ্ধবাবু মনোজবাবুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, তিনি পাহাড়তলি স্টেশনের কাছে মনোজবাবুর একমাত্র জীবিত মেয়ে, রিনা দেবীর খোঁজ পেলেন। রিনা দেবী এখন বৃদ্ধা, কিন্তু তার বাবার স্মৃতি তার মনে আজও জীবন্ত।
অনিরুদ্ধবাবু রিনা দেবীর কাছে সেই বাক্সটি এবং শাঁখের টুকরাটি নিয়ে গেলেন। রিনা দেবী বাক্সটি দেখে কেঁদে উঠলেন। “বাবা! এটা বাবার বাক্স!”
রিনা দেবী বললেন, মনোজবাবু তাকে খুব ভালোবাসতেন। দুর্ঘটনার আগের দিন তিনি রিনাকে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে একটা উপহার পাঠাব, রিনা। সেটা তোমার কাছে পৌঁছলে বুঝবে, আমি তোমার কাছেই আছি।”
সেই শাঁখের টুকরাটা ছিল সেই উপহার। মনোজবাবু রিনার বিয়ের জন্য একটি শাঁখা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তিনি করে যেতে পারেননি।
অনিরুদ্ধবাবু রিনা দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তিনি জানতেন, মনোজবাবুর আত্মা তার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে চায়।
সেদিন রাতে, অনিরুদ্ধবাবু একটি বিশেষ মালবাহী ট্রেন চালাচ্ছিলেন। ট্রেনটি পতিরাম স্টেশন থেকে পাহাড়তলি স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। অনিরুদ্ধবাবু তার কেবিনে একা ছিলেন। তিনি মনোজবাবুর সেই বাক্সটি তার সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যাতে সে তার পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারে।
রাত তখন প্রায় দুটো। ট্রেনটি যখন স্কন্ধকাটার রেললাইনের উপর দিয়ে যাচ্ছিল, তখন অনিরুদ্ধবাবু অনুভব করলেন, তার ট্রেনের স্পিড কমে গেছে। ট্রেনটি যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির দ্বারা আটকানো হচ্ছে।

তিনি জানালার বাইরে তাকালেন। আকাশে চাঁদ ছিল না, চারপাশে শুধু ঘন অন্ধকার। রেললাইন ধরে ঘন কুয়াশা নেমে এসেছে। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে অনিরুদ্ধবাবু দেখল, সেই মাথা হারানো মানবাকৃতিটি ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মানব আকৃতিটি তার হাত দুটি তার বুকের উপর ভাঁজ করে রেখেছে, আর ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার শরীর থেকে একটি লালচে আভা বেরোচ্ছে। অনিরুদ্ধবাবুর মনে হলো, মানবাকৃতিটি যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে।
অনিরুদ্ধবাবু দ্রুত ট্রেন থামালেন। ট্রেনটি লাইনের মাঝখানে থেমে গেল।
তিনি কেবিন থেকে নামলেন। তিনি জানতেন, তাকে স্কন্ধকাটার মুখোমুখি হতে হবে। তিনি সেই বাক্সটি হাতে নিলেন।
“মনোজবাবু,” অনিরুদ্ধবাবু শান্ত স্বরে ডাকলেন। “আমি আপনার পরিবারের কাছে আপনার বার্তা পৌঁছে দিতে এসেছি। আপনার মেয়ে আপনার অপেক্ষায় আছে।”
মানব আকৃতিটি তার দিকে এগিয়ে এলো। অনিরুদ্ধবাবু অনুভব করলেন এক তীব্র, হিমশীতল বাতাস তাকে ঘিরে ধরেছে। মানবাকৃতিটির বুক থেকে সেই লালচে আভা আরও তীব্র হয়ে উঠল।
মানব আকৃতিটি তার হাত দুটি অনিরুদ্ধবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিল, যেন সে বাক্সটি চাইছে।
অনিরুদ্ধবাবু বাক্সটি মানবাকৃতিটির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মানবাকৃতিটি বাক্সটি হাতে নিল। তার হাত থেকে এক তীব্র শীতলতা অনিরুদ্ধবাবুকে ছুঁয়ে গেল।
এরপর যা ঘটল, তা অনিরুদ্ধবাবু তার জীবনেও ভুলতে পারবেন না।
মানব আকৃতিটি বাক্সটি হাতে নিয়ে তার বুকের উপর রাখল। তার বুক থেকে বেরোনো লালচে আভা আরও তীব্র হয়ে উঠল, আর মানবাকৃতিটির শরীর থেকে একটি উজ্জ্বল সাদা আলো বেরোতে লাগল। আলোটি এত তীব্র ছিল যে, অনিরুদ্ধবাবুর চোখ বন্ধ হয়ে গেল।
আলো নিভে যাওয়ার পর, অনিরুদ্ধবাবু চোখ খুললেন। মানব আকৃতিটি সেখানে নেই। কেবল রেললাইনের উপর একটি ছোট, কাঠের বাক্স পড়ে আছে। আর সেই বাক্সটির পাশে একটি পুরোনো, জং ধরা রেলের যন্ত্রাংশ।
অনিরুদ্ধবাবু যন্ত্রাংশটি হাতে নিলেন। যন্ত্রাংশটির উপর লেখা ছিল: “মনোজ – রেলম্যান”।
তিনি বুঝতে পারলেন, মনোজবাবু তার পরিবারের কাছে তার শেষ বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন, আর তার আত্মা মুক্তি পেল।
অভিশাপের শেষ যাত্রা
অনিরুদ্ধবাবু বাক্সটি এবং মনোজবাবুর যন্ত্রাংশটি হাতে নিয়ে ট্রেনের কেবিনে ফিরে এলেন। তিনি ট্রেন চালু করলেন। ট্রেনটি আবার পাহাড়তলি স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলল।
তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছিল। তিনি স্কন্ধকাটার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
ট্রেনটি যখন পাহাড়তলি স্টেশনে পৌঁছাল, তখন সকাল হয়ে গেছে। রিনা দেবী স্টেশনে অনিরুদ্ধবাবুর অপেক্ষায় ছিলেন। অনিরুদ্ধবাবু রিনা দেবীর কাছে বাক্সটি এবং যন্ত্রাংশটি তুলে দিলেন।
রিনা দেবী বাক্সটি হাতে নিয়ে কেঁদে উঠলেন। “বাবা! এটা বাবার বাক্স! এটা বাবার শেষ স্মৃতি!”
তিনি যন্ত্রাংশটি হাতে নিয়ে তার বুকে রাখলেন। “আমি জানি বাবা, তুমি আমার কাছেই আছো।”
অনিরুদ্ধবাবু রিনা দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তিনি জানতেন, মনোজবাবুর আত্মা তার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছে, আর তার অভিশাপ শেষ হয়েছে।
কিন্তু স্কন্ধকাটার গল্পটা তখনও শেষ হয়নি। কারণ, রেললাইনে এখনও মাথা হারানো মানুষের আত্মারা হেঁটে বেড়ায়, যারা তাদের প্রিয়জনদের কাছে তাদের শেষ বার্তা পৌঁছাতে চায়।
অনিরুদ্ধবাবু পতিরাম স্টেশনে ফিরে এলেন। ফটিকবাবু তাকে দেখে হাসলেন। “কী স্যার? স্কন্ধকাটাকে কি মুক্তি দিতে পেরেছেন?”
অনিরুদ্ধবাবু হাসলেন। “হ্যাঁ, ফটিকবাবু। আমি পেরেছি। মনোজবাবু তার পরিবারের কাছে তার শেষ বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছেন।”
ফটিকবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “তবুও সাবধান থাকবেন স্যার। এই লাইনে কেবল মনোজবাবু একা নন। আরও অনেক আত্মা আছে, যারা মুক্তি পেতে চায়।”
অনিরুদ্ধবাবু জানতেন, ফটিকবাবু ঠিকই বলেছেন। রেললাইনটা ছিল অভিশাপের, কিন্তু একই সাথে ছিল ভালোবাসার মিলনক্ষেত্র। যেখানে বিচ্ছিন্ন আত্মারা তাদের প্রিয়জনদের কাছে তাদের শেষ বার্তা পৌঁছাতে চায়।
সেদিন রাতে, অনিরুদ্ধবাবু তার কোয়ার্টারে ফিরে এলেন। রাধা এবং টুপুর তখন ঘুমাচ্ছিল।
অনিরুদ্ধবাবু জানালার বাইরে তাকালেন। আকাশে চাঁদ ছিল না, চারপাশে শুধু ঘন অন্ধকার। রেললাইনের উপর কুয়াশা নেমে এসেছে।

তিনি দেখল, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একটি আবছা মানবাকৃতি এগিয়ে আসছে। মানবাকৃতিটির কাঁধের উপর কোনো মাথা নেই। তার হাত দুটি তার বুকের উপর ভাঁজ করা, আর ধীরগতিতে অনিরুদ্ধবাবুর কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে আসছে।
অনিরুদ্ধবাবুর মনে হলো, স্কন্ধকাটা আবার ফিরে এসেছে।
কিন্তু এবার তার মনে কোনো ভয় ছিল না। তিনি জানতেন, স্কন্ধকাটা তাকে ভয় দেখাতে আসেনি। সে এসেছিল তার কাছে তার শেষ বার্তা পৌঁছাতে।
অনিরুদ্ধবাবু জানালার কাছে গেলেন। মানবাকৃতিটি তার কোয়ার্টারের জানালার সামনে এসে থামল। তার বুক থেকে সেই লালচে আভা বেরোচ্ছে।
এবার অনিরুদ্ধবাবু শুনলেন, মানবাকৃতিটির বুক থেকে একটি ক্ষীণ, বাতাসের ফিসফিসানির মতো শব্দ শোনা গেল, “আমি মুক্তি চাই… আমি মুক্তি চাই…”
অনিরুদ্ধবাবু বুঝলেন, মনোজবাবু একাই মুক্তি পাননি। আরও অনেক আত্মা আছে, যারা মুক্তি পেতে চায়।
নতুন স্টেশনমাস্টার ও অনন্ত যাত্রা
অনিরুদ্ধবাবু এবার স্টেশনের পুরোনো নথিপত্র ঘাঁটতে লাগলেন। তিনি সেই দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া অন্যান্য রেলকর্মীদের তালিকা খুঁজে বের করলেন। তারা সবাই ছিল পতিরাম স্টেশনের কর্মী। তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন।
অনিরুদ্ধবাবু এবার প্রতি রাতে রেললাইনে হেঁটে যেতেন। তিনি তার সাথে মনোজবাবুর বাক্সটি এবং মনোজবাবুর যন্ত্রাংশটি নিয়ে যেতেন। তিনি জানতেন, এই জিনিসগুলিই স্কন্ধকাটার আত্মার কাছে তার শেষ বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যম।
প্রতি রাতে তিনি রেললাইনে হেঁটে যেতেন। তিনি দেখতেন, বিভিন্ন মাথা হারানো মানবাকৃতি তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের বুক থেকে লালচে আভা বেরোচ্ছে। তারা সবাই তাদের পরিবারের কাছে তাদের শেষ বার্তা পৌঁছাতে চায়।
অনিরুদ্ধবাবু তাদের কাছে মনোজবাবুর বাক্সটি এবং মনোজবাবুর যন্ত্রাংশটি দেখাতেন। তিনি তাদের কাছে মনোজবাবুর গল্প বলতেন, কীভাবে মনোজবাবু তার পরিবারের কাছে তার শেষ বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।
অনিরুদ্ধবাবু জানতেন, তিনি একা সব আত্মাকে মুক্তি দিতে পারবেন না। কিন্তু তিনি চেষ্টা করবেন।
স্কন্ধকাটার রেললাইন এখন আর কেবল অভিশাপের নয়, তা পরিণত হয়েছে ভালোবাসার মিলনক্ষেত্রে। যেখানে বিচ্ছিন্ন আত্মারা তাদের প্রিয়জনদের কাছে তাদের শেষ বার্তা পৌঁছাতে চায়।
এক বছর পর, অনিরুদ্ধবাবু পতিরাম স্টেশনে তার বদলির আদেশ পেলেন। তিনি এবার পাহাড়তলি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার হিসেবে কাজ করবেন। রাধা এবং টুপুর খুব খুশি হলো।
অনিরুদ্ধবাবু পতিরাম স্টেশন ছাড়ার আগে ফটিকবাবুকে ডেকে পাঠালেন। “ফটিকবাবু, আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু এই লাইনে এখনও অনেক আত্মা আছে, যারা মুক্তি পেতে চায়।”
ফটিকবাবু হাসলেন। “স্যার, আপনি যা করেছেন, তা কেউ করেনি। আপনি স্কন্ধকাটার অভিশাপ থেকে এই স্টেশনকে মুক্তি দিয়েছেন।”
অনিরুদ্ধবাবু জানতেন, তিনি মুক্তি দেননি। তিনি কেবল তাদের পথ দেখিয়েছেন।
অনিরুদ্ধবাবু তার কোয়ার্টারে ফিরে এলেন। রাধা এবং টুপুর তখন ট্রেনে উঠছিল।
অনিরুদ্ধবাবু জানালার বাইরে তাকালেন। আকাশে চাঁদ ছিল না, চারপাশে শুধু ঘন অন্ধকার। রেললাইনের উপর কুয়াশা নেমে এসেছে।
তিনি দেখল, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একটি আবছা মানবাকৃতি এগিয়ে আসছে। মানবাকৃতিটির কাঁধের উপর কোনো মাথা নেই। তার হাত দুটি তার বুকের উপর ভাঁজ করা, আর ধীরগতিতে অনিরুদ্ধবাবুর কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে আসছে।
এবার অনিরুদ্ধবাবু শুনলেন, মানবাকৃতিটির বুক থেকে একটি ক্ষীণ, বাতাসের ফিসফিসানির মতো শব্দ শোনা গেল, “ধন্যবাদ… ধন্যবাদ…”
অনিরুদ্ধবাবু বুঝতে পারলেন, স্কন্ধকাটা তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
অনিরুদ্ধবাবু হাসলেন। তিনি জানতেন, তার কাজ শেষ হয়নি। তার নতুন স্টেশনেও হয়তো এমন অনেক আত্মা আছে, যারা মুক্তি পেতে চায়।
স্কন্ধকাটার রেললাইন এখন আর কেবল অভিশাপের নয়। এটি পরিণত হয়েছে একটি চিরন্তন সত্যের প্রতীক। যেখানে বিচ্ছিন্ন আত্মারা তাদের প্রিয়জনদের কাছে তাদের শেষ বার্তা পৌঁছাতে চায়, আর অনিরুদ্ধবাবুর মতো মানুষ তাদের সেই পথে সাহায্য করে।
আর পতিরাম স্টেশনের সেই রেললাইনটি আজও নীরব। মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে সেখানে শোনা যায় সেই ছন্দবদ্ধ হাঁটার শব্দ। স্কন্ধকাটার যাত্রা আজও চলছে, কারণ মুক্তি পেতে চাওয়া আত্মার সংখ্যা অনন্ত।
