কার্তিক ঠাকুরের সারপ্রাইজ অভিযান
কার্তিকের বায়না ও বন্ধুদের গোপন সভা
গঙ্গার ধারের চায়ের দোকানে বিকেলবেলায় রোদ ঢলে পড়েছে। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে দিতেই জয়, রনি, পিঙ্কি আর টিয়া মিলে একটা গোপন আলোচনা সারছিল। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু: আকাশ আর আহানা।
আকাশ আর অহনার বিয়ে হয়েছে মোটে চার মাস। পাড়াতুতো প্রেম গড়িয়ে বিয়ে হলেও, গত চার মাসে আকাশ তার বিবাহিত জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে এমন কিছু গোপন তথ্য বন্ধুদের ফাঁস করেছে, যা শুনে জয়দের পেটে খিল ধরে যায়। আর তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিজ্ঞা ছিল—যখনই আকাশের বিয়ে হবে, কার্তিক পুজোয় এমন এক কাণ্ড ঘটাতে হবে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে।
“এই বছর! এই বছরই আমাদের ফাইনাল ম্যাচ,” চায়ের কাপটা টেবিলে ঠক করে নামিয়ে বলল জয়, দলের সবচেয়ে উৎসাহী সদস্য। “আকাশটা ভেবেছে, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে আরামে সংসার করবে? নো ওয়ে!”
রনি, একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের। সে বলল, “আরে বাবা, শুধু কার্তিক বসিয়ে দিলেই তো হবে না। একটু নতুনত্ব চাই। গত বছর তো পল্টুদের বাড়িতে শুধু একটা চিঠি দিয়ে এসেছিলি, সেটা ফ্লপ! আকাশের বাড়িতে তো তার ঠাকুমা আছে, যিনি আবার ‘সময়মতো ঘুম না হলে’ রেগে যান।”
পিঙ্কি, দলের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, একটা দুষ্টু হাসি হাসল। “এইবার ফ্লপ হবে না। আমার মাথায় একটা হাই-ভোল্টেজ আইডিয়া এসেছে।”
সবাই উৎসুক চোখে পিঙ্কির দিকে তাকালো।
পিঙ্কি তার মোবাইল স্ক্রল করতে করতে বলল, “কার্তিক ঠাকুরকে কথা বলাতে হবে।”
“মানে?” জয় প্রায় চায়ের কাপ ফেলে দিচ্ছিল।
“মানে খুব সোজা। আমরা কার্তিক ঠাকুরের পাশে বা পেছনে একটা পুরোনো ছোট স্পিকার বসাব, যেটা একটা ব্লুটুথ বক্সের মতো দেখতে। আমি আর টিয়া বাইরে একটা সেফ ডিস্টেন্সে মাইক্রোফোন বা ওয়াকি-টকি নিয়ে বসে থাকব। আর যেই ওরা দরজা খুলবে, অমনি কার্তিক ঠাকুর নিজের মুখেই বায়না ধরবে।”
রনি আনন্দে লাফিয়ে উঠল। “অসাধারণ! এটা হবে হিট! আর ঠাকুমা যদি শুনতে পান, তাহলে তো কথাই নেই! ভাব, মধ্যরাতে কার্তিক ঠাকুর আকাশকে বলছে—ও বাবা, আমায় ঘরে তোলো, আমার শীত করছে!”
জয় বলল, “কিন্তু ঠাকুর কেন বসানো হয়, সেটা তো মনে রাখতে হবে। নতুন দম্পতি, মানে—” সে একটা দুষ্টু হাসি হাসল—”আমরা কার্তিকের তরফ থেকে ভবিষ্যতের জন্য ‘আগাম অর্ডার’ দেব। চিঠিটা আমি লিখব—ভাল মন্দ খাবারের তালিকা, অহনার পছন্দের নতুন শাড়ি আর আকাশের জন্য কড়া কফি মেশিনের আবদার থাকবে। আর শেষ লাইনে একটা খেলনা মোটরগাড়ি তো মাস্ট।”
টিয়া, যে এতদিন চুপ ছিল, বলল, “আর একটা কাজ করতে হবে। ঠাকুরের সঙ্গে একটা পুরনো ক্যাসেট বক্স বা ছোট একটা উপহারের বাক্সে মাইক্রোফোন ও স্পিকারের সেটআপটা রাখব। যাতে মনে হয়, ওটাই বুঝি কার্তিকের ‘বিশেষ সরঞ্জাম’।”
পরিকল্পনা চূড়ান্ত হতে বেশি সময় লাগল না।
দায়িত্ব বন্টন:
- রনি: সবচেয়ে ‘ভারী’ আর ‘দুঃখী দুঃখী’ দেখতে কার্তিক ঠাকুর কেনা। (কারণ, ঠাকুমা যেন সহজেই বিরক্ত হন!)
- পিঙ্কি ও টিয়া: কথা বলানোর প্রযুক্তি (স্পিকার, ব্যাটারি, ওয়াকি-টকি সেটআপ) এবং গোপনীয় স্থান খোঁজা।
- জয়: বায়না চিঠি লেখা এবং সবার জন্য পোশাক কোড নির্ধারণ (কালো টি-শার্ট, যাতে অন্ধকারে মিশে যাওয়া যায়)।
সেদিন রাতেই রনি ঠাকুর দেখতে গেল। সে শহরের সবচেয়ে পুরোনো মৃৎশিল্পীর কাছে গিয়ে এমন এক কার্তিক মূর্তি খুঁজে বের করল, যা দেখতে বেশ বড়সড়, একটু বেশিই রাজকীয়, আর ভারে অসম্ভব ভারী। রনির মনে হলো, এই কার্তিককে মাঝরাতে ছাদে ওঠাতে গেলে আকাশ আর অহনার বন্ধুদেরই কোমরে ব্যাথা হবে। “এই ভারই তো আসল মজা!” মনে মনে ভাবল রনি।

পরের রাতে, অর্থাৎ কার্তিক পুজোর ঠিক আগের রাতে, সব সরঞ্জাম তৈরি। জয় বায়না চিঠি ভাঁজ করে পকেটে রেখেছে। পিঙ্কি শেষবারের মতো মাইকের সাউন্ড চেক করে নিল।
সবাই এবার আকাশের বাড়ির দিকে চলল। এই রাতের জন্য তাদের স্লোগান: “কার্তিক ঠাকুর কি জয়! এবার মজা হবে!”
তারা জানত না, এই ‘মজা’ শুধু আকাশ আর আহানার জন্যই নয়, স্বয়ং ঠাকুমার জন্যও এক অপ্রত্যাশিত মধ্যরাতের সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।
মধ্যরাতে কার্তিকের করুণ আর্তি
রাত তখন দুটো পঁয়ত্রিশ। গোটা পাড়া গভীর ঘুমে ডুবে। আকাশের বাড়িটা পুরনো ধাঁচের, দোতলা। নিচে আকাশ, অহনা আর আকাশের মা থাকেন। ওপরের তলায় থাকেন আকাশের ঠাকুমা, নিরুপমা দেবী—যিনি সময়ের এক চুল এদিক-ওদিক সহ্য করতে পারেন না। নিরুপমা দেবীর ঘুম খুব হালকা এবং তিনি মনে করেন, রাত দুটো মানেই ‘অসভ্যতা’ করার সময় নয়।
জয়, রনি, পিঙ্কি আর টিয়াসহ ছয়জনের একটি দল নিঃশব্দে পাঁচিল টপকে বা পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ল। তাদের লক্ষ্য: ড্রয়িংরুমের সামনের বারান্দা বা হলঘর।
“সাবধানে রনি, ঠাকুর যেন না পড়ে যায়,” ফিসফিস করে বলল জয়। রনি ঘাড়ে করে সেই বিশাল, ভারি কার্তিক ঠাকুরকে বয়ে আনছিল।
ঠাকুরকে কোনোমতে এনে বসানো হলো ড্রয়িংরুমের ঠিক বাইরে মূল দরজার সামনে, একটি সুন্দর লাল শালুর ওপর। পিঙ্কি চটজলদি কার্তিকের ডানদিকে রাখা ছোট বাক্সটির আড়ালে তার স্পিকার সেটআপটি বসিয়ে দিল। টিয়া একটা নিরাপদ দূরত্বে পাঁচিলের আড়ালে লুকিয়ে বসে পড়ল, তার হাতে ওয়াকি-টকি সেট, কানে হেডফোন।
“সব সেট,” পিঙ্কি সংকেত দিল।
জয় তখন তার কাজ শুরু করল। কার্তিকের হাতে সযত্নে রোল করা বায়না-চিঠিটা গুঁজে দেওয়া হলো। সামনে রাখা হলো একজোড়া শিশুর মোজা, একটা কাঠের ঘোড়া আর সিঁদুর কৌটো।
সবাই এবার লুকিয়ে পড়ল ঝোপের আড়ালে। জয় তার মোবাইল বের করে আকাশের নম্বরে দ্রুত একটা টেক্সট পাঠাল: “দরজা খোল। বাইরে জরুরি সারপ্রাইজ।” এবং ফোন বন্ধ করে দিল।
আকাশ আর অহনা, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। মেসেজের টোন বাজতেই অহনার ঘুম ভেঙে গেলো।
“কে মেসেজ করলো মাঝরাতে? এই অসময়ে!” অহনা বিরক্তির সুরে বলল।
আকাশ চোখ কচলে ফোন দেখল। “ইশশ! জয়… নিশ্চয়ই কোনো ফালতু মজা! দাঁড়াও, দেখি কীসের সারপ্রাইজ।”
আকাশ নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোতেই দেখতে পেল দরজা ভেজানো। সে আস্তে করে দরজাটা খুলল।
দরজা খুলতেই আকাশ হকচকিয়ে গেলো। সামনে বিরাট এক কার্তিক ঠাকুর, হাতে চিঠি, আর পাশে শিশুদের খেলনা। সে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না।
ঠিক সেই মুহূর্তে, স্পিকার সেটআপ অন করলো পিঙ্কি। টিয়া ওয়াকি-টকির মাইক্রোফোনটা মুখের কাছে নিয়ে করুণ কণ্ঠে বলল:
“ও মা, ও মা গো! অহনা মা… আমায় কি ভেতরে নেবে না?”
আকাশ প্রায় লাফিয়ে উঠল। কার্তিক ঠাকুর কথা বলছে! ভয়ে, বিস্ময়ে তার চোখ কপালে।
ভিতর থেকে অহনা তখনও জানতে চাইছিল, “আকাশ, কী দেখছো? কিছু বলছো না কেন?”
পিঙ্কি তখন তার কণ্ঠস্বর বদলে আরও করুণ করে বলল:
“ও বাবা, ও বাবা আকাশ! আমার না খুব ঠাণ্ডা লাগছে গো। এই অসময়ে বাইরে বারান্দায় বসিয়ে রেখেছো? আমি তোমায় আশীর্বাদ দিতে এসেছি! আর তোমরা আমায় কষ্ট দিচ্ছো?”
অহনা আর থাকতে না পেরে ছুটে এলো। কার্তিক ঠাকুরকে দেখে তার হাসি পেলেও, কথাটা শুনে সে ভয়ে জমে গেলো। “আকাশ! একি! ঠাকুর কথা বলছেন?”
এদিকে ওপরের তলাতেও এই চাপা আর্তি পৌঁছে গেছে। নিরুপমা দেবীর ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি শোবার ঘর থেকে ক্রুদ্ধ স্বরে ডাক দিলেন, “আকাশ! এতো রাতে কিসের আওয়াজ! কার গলা? এত ঢং কেন?”
টিয়া এবার ঠাকুমার উদ্দেশে আরও জোরে বলল:
“ও দিদা, ও দিদা! আমি তোমার নাতি কার্তিক। আমায় ঘরে তোলো গো! আমার ভীষণ ঠাণ্ডা লেগেছে। আর কাল আমার জন্মদিনে পেট ভরে ভালো ভালো খাবার চাই!”
ঠাকুমার কানে ‘ঠাণ্ডা’ আর ‘নাতি’ শব্দগুলো যেতেই তার ধৈর্যচ্যুতি হলো। “ওহ্! আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাণ্ডজ্ঞান নেই! মাঝরাতে এইসব ফাজলামো!”
আকাশ দ্রুত কার্তিকের চিঠিটা হাতে নিয়ে অহনাকে টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। “চুপ! এটা জয়দের কাজ! কোনোমতে তাড়াতাড়ি ঘর বন্ধ করো। ঠাকুমা এবার নিচে এলে আর রক্ষে থাকবে না!”
বন্ধুরা লুকিয়ে হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। তাদের মিশন সম্পূর্ণ সফল।
বাইরে থেকে টিয়ার শেষ ফিসফিসানি ভেসে এলো: “মনে রেখো বাবা-মা, কার্তিক কোনো বায়না শুনতে ভুল করে না! ভালো ভালো খাবার চাই!”
ঠাকুমার অগ্নি দৃষ্টি ও নিদ্রাহীন রাত
আকাশ আর অহনা হাঁপাতে হাঁপাতে দরজা বন্ধ করল। তাদের হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো।
“এ কী কাণ্ড! তুমি জানো জয়রা কতদূর যেতে পারে?” অহনা এখনও উত্তেজনায় কাঁপছে। “আমি তো সত্যিই মনে করেছিলাম ঠাকুর কথা বলছেন!”
আকাশ হেসে প্রায় লুটিয়ে পড়ল। “আর ঠাকুমা? তুমি শুধু ওঁর চিৎকারটা শোনোনি! ‘ও দিদা, আমি তোমার নাতি কার্তিক’—জয়দের মাথায় শয়তানি ছাড়া আর কিছু নেই। পিঙ্কি নিশ্চয়ই ঐ স্পিকারের কাজটা করেছে।”
আকাশ ঘরের দরজাটা ভালো করে লক করল। তারা জানে, মধ্যরাতে নিরুপমা দেবী নিচে নেমে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
এদিকে, ওপরের তলায় নিরুপমা দেবী ক্রোধে ফুঁসছেন। তিনি নিজে শোবার ঘর থেকে বারান্দায় এলেন, কিন্তু দেখলেন কেউ নেই। শুধু দরজার সামনে কার্তিকের বিশাল মূর্তি।
“ছ্যা ছ্যা! আজকালকার সভ্যতা! মধ্যরাতে কার্তিক এনে বসানো হয়েছে, আর সে নাকি কথা বলছে! ‘ঠান্ডা লেগেছে’! ঠাট্টা করার জায়গা পায় না!” ঠাকুমা গজগজ করতে করতে নিচে নামলেন।
আকাশ আর অহনা ঘরের ভেতরে সিঁড়িতে ঠাকুমার ভারী পায়ের শব্দ পেল। তারা নিঃশব্দে বিছানায় শুয়ে পড়ল, ঘুমানোর ভান করে।
নিরুপমা দেবী দরজার সামনে কার্তিককে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মূর্তিটি সত্যিই রাজকীয়, কিন্তু এই অসময়ে এই ধরনের কাণ্ডকারখানা তার মোটেই পছন্দ নয়। তিনি কার্তিকের হাতে থাকা চিঠিটা দেখলেন, কিন্তু খুললেন না। তিনি বরং কার্তিককে ভালো করে লক্ষ করলেন।
“হুহ্! এত বড় ঠাকুর, আর ভারে তো মনে হচ্ছে গোটা পরিবার বসানো হয়েছে। এদের মাথায় শুধু ফাজলামো,” বিড়বিড় করতে করতে ঠাকুমা কার্তিককে সামান্য সরিয়ে ভেতরে রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু রনির নির্বাচন সার্থক—ঠাকুর এত ভারী যে নিরুপমা দেবী একা একটুও নড়াতে পারলেন না।
বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, “থাক তুই সেখানেই! কাল সকালে তোর ব্যবস্থা হচ্ছে।”
এরপর তিনি ঠাকুরকে ফেলে আসা খেলনাগুলো, শাঁখা-সিঁদুরের কৌটোটা আর বিশেষ বাক্সটা দেখলেন। বাক্সটা নিয়ে ঠাকুমার একটু সন্দেহ হলো। তিনি সেটি হাতে নিতেই খেয়াল করলেন, বাক্সটা সামান্য উষ্ণ। “এ আবার কী! এতে কি ধুনো দেওয়া হয়েছে? এইজন্যেই কি গরম? এইজন্যেই বুঝি ঠাকুর বলছিল, ‘ঠাণ্ডা লেগেছে’?” তিনি বাক্সটা নিয়ে সোজা রান্নাঘরে গেলেন এবং গ্যাস ওভেনের পাশে একটু দূরে রেখে এলেন, যেন ঠাকুমা ভাবলেন, “বেচারা ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে, একটু গরম পাক।”
(আসলে বাক্সের ভেতরে ব্যাটারি আর ব্লুটুথ সংযোগ চলার কারণে তা সামান্য গরম ছিল, যা নিরুপমা দেবীর মনে ভুল ধারণা তৈরি করল।)
ঠাকুমা আবার ওপরে চলে গেলেন।
আকাশ আর অহনা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, কার্তিক এখনও বারান্দাতেই, কিন্তু ঠাকুমা যাওয়ার আগে কার্তিকের মাথায় একটা পুরনো শাল চাপিয়ে দিয়ে গেছেন!

অহনা আর হাসি থামাতে পারল না। “ওহ্ মাই গড! ঠাকুমা সত্যিই ভেবেছেন ঠাকুরের ঠাণ্ডা লেগেছে! আর স্পিকারের বাক্সটাকে গরম রাখার জন্য গ্যাসের পাশে রেখে এসেছেন!”
আকাশ দ্রুত চিঠিটা খুলে নিলো। চিঠিটা পড়ে দুজনের মুখে হাসি আর বিরক্তি, দুটোরই মিশ্রণ দেখা গেলো।
সংক্ষিপ্ত বায়না পত্র (কার্তিক ঠাকুরের নির্দেশ):
- পেটপুজো মহারাজা: দুপুরে পাঁচ কিলো চালের বিরিয়ানি (সাদা আলুর বদলে মাটন দেওয়া আলুর আবদার)।
- পোশাক আপগ্রেড: আহানা মা’র জন্য একটা নতুন জরিপাড়ের শাড়ি এবং আকাশ বাবার জন্য একটা কফি মেকার, যাতে সে বন্ধুদের আড্ডা দেওয়ার সময় দ্রুত কফি বানাতে পারে।
- আমার খেলনা: একটি ছোট রিমোট কন্ট্রোল মোটরগাড়ি (আসলে জয় ব্যবহার করবে)।
- উপহার ফিরতি: কাল সন্ধেবেলা এই সব বায়না মিটিয়ে বন্ধুদের ভোজ দিতে হবে, অন্যথায় কার্তিক ঠাকুরের অভিশাপ…
“শোনো, ভোর পাঁচটাতেই বাজারে যেতে হবে। বিরিয়ানি, কফি মেকার, আর হ্যাঁ… ঠাকুমা যদি শাড়িটা দেখেন, তাহলে তো কেলো! এখনই কাজের লোক বা কাকিমার সাহায্য চাইতে হবে,” আকাশ বলল।
নিদ্রাহীন চোখে, মধ্যরাতের দুষ্টুমি আর ভোরের প্রস্তুতির মাঝে আকাশ আর অহনার রাতটা কাটল। তাদের নতুন দাম্পত্য জীবনে এ এক মজাদার চ্যালেঞ্জ।
ভোরের বাজার এবং অহনার রন্ধনশালা
ভোর তখন পাঁচটা। শীতের কুয়াশার চাদর এখনও পুরোপুরি সরে যায়নি। আকাশ, সামান্যও না ঘুমিয়ে, নিঃশব্দে বিছানা ছাড়ল। পাশে অহনা আধো-জাগা চোখে তাকালো।
“উঠছো? বাজারের জন্য?” অহনা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
“আর বলো না! পাঁচ কিলো চাল, মাটন, আদা-রসুন… আর জয়দের বায়নার তালিকা তো ভুললে চলবে না। কফি মেকার, নতুন শাড়ি—এই সব ক’টা বাজেটে কী করে ঢুকবে, সেটা ভাবছি,” আকাশ কপালে হাত দিয়ে বলল।
অহনা ততক্ষণে উঠে পড়েছে। “আরে বাবা, এটা চ্যালেঞ্জ! শোনো, বাজারটা তুমি সেরে এসো। আমি ততক্ষণে মা আর কাজের লোকটাকে ডেকে বিরিয়ানির সবজি আর মশলার কাজটা শুরু করি। আর হ্যাঁ, স্পিকার বক্সটা আর শালটা সাবধানে রাখো। ঠাকুমা যেন ব্যাপারটা না বোঝেন।”
আকাশ বাজারে যাওয়ার আগে বারান্দায় উঁকি মারল। কার্তিক ঠাকুর এখনও শাল মুড়ি দিয়ে সেখানেই বসে আছেন। স্পিকারের বাক্সটা উধাও!
সে দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, নিরুপমা দেবী তখনও ওঠেননি, কিন্তু তার মা রান্নার লোক নন্দর সঙ্গে হালকা কথাবার্তা বলছেন। স্পিকারের বাক্সটা গ্যাস ওভেনের পাশে সাবধানে রাখা আছে। আকাশ দ্রুত বাক্সটা সরিয়ে তার নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখল।
“এত ভোরে কী করছিস আকাশ?” রান্নাঘরের দরজা দিয়ে আকাশের মা মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন।
“আসলে মা, কাল রাতে… মানে, জয়রা কার্তিক ঠাকুর বসিয়ে দিয়েছে। আর তাদের বায়না হয়েছে, আজ দুপুরে তাদের ভূরিভোজ করাতে হবে। তা না হলে নাকি তারা পুরো পাড়ায় দুর্নাম করে দেবে,” আকাশ হাসার চেষ্টা করে মিথ্যেটা বলল।
মা হেসে ফেললেন। “ওহ্! নতুন বিয়ে হলে তো এসব হবেই! ঠিক আছে, আমি নন্দর সঙ্গে মিলে যতটা পারি সাহায্য করে দিচ্ছি। অহনাকে বলো যেন তাড়াহুড়ো না করে।”
আকাশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মায়ের সমর্থন পেয়ে তার মনোবল বাড়লো। সে দ্রুত বাজারে ছুটল। মাটন, সুগন্ধি চাল, আর অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে তাকে কিনতে হলো একটা নতুন, ঝলমলে জরিপাড়ের শাড়ি এবং বন্ধুদের আড্ডার জন্য একটা ঝকঝকে কফি মেকার।
সকাল সাতটা নাগাদ আকাশ বাজার সেরে ফিরল, হাতে বাজারের ব্যাগ আর অন্য হাতে বায়নার জিনিসপত্র।
“এই নাও তোমার শাড়ি, আর এই নাও বন্ধুদের কফি মেকার। আর মোটরগাড়ি? সেটা আমি পরে নেব, জয়কে দিয়ে দেবো!” আকাশ ঠাট্টা করেঅহনার হাতে শাড়ির প্যাকেট তুলে দিল।
অহনা হেসে বলল, “দাঁড়াও, এখন এসব দেখার সময় নেই। ঠাকুরকে তো এখনও ঘরে তোলা হয়নি! আগে চলো ঠাকুমার চোখ এড়িয়ে ওনাকে ঘরে তুলি।”
মা এসে তাদের সাহায্য করলেন। রনির আনা ভারি কার্তিক ঠাকুরকে কোনোমতে তিনজনে ধরাধরি করে ঘরের এক কোণে প্রতিষ্ঠা করা হলো। ঠাকুরের গায়ে এখনও ঠাকুমার দেওয়া শাল জড়ানো আছে।
নিরুপমা দেবী সকালের চা খেতে নিচে এলেন। ড্রয়িংরুমে কার্তিককে দেখে তিনি শুধু একবার “হুঁ” বলে পাশ কাটালেন। তিনি বিরক্তি চাপা দিয়ে শুধু বললেন, “পূজা হবে তো ঠিকমতো? নাকি শুধু খাওয়াদাওয়ার জন্যই সব?”
“অবশ্যই হবে ঠাকুমা। সব ব্যবস্থা করছি,” আকাশ দ্রুত উত্তর দিল।
এরপর শুরু হলো অহনার রন্ধনশালা অভিযান। এক দিকে বিশাল হাঁড়িতে সুগন্ধি চালের বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে, আর অন্যদিকে মা আর নন্দর সঙ্গে মিলে সে মিষ্টি আর স্ন্যাকস বানাচ্ছে। আহানা খুবই ভালো রাঁধে, কিন্তু পাঁচ কিলো বিরিয়ানি রান্না করা তার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। রান্নার গন্ধে গোটা বাড়িতে উৎসবের আমেজ শুরু হয়ে গেলো।
কিন্তু অহনার আসল চিন্তা ছিল জয়দের দুষ্টুমি নিয়ে। সে জানত, আজকের ভোজ শুধু খাওয়া নয়, এটা ছিল তাদের নতুন জীবন শুরু করার একটা উদযাপন, যেখানে দুষ্টু বন্ধুরা সব হাসি-ঠাট্টা আর আনন্দের মধ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে থাকবে।
পুজো, ভোজ ও হুল্লোড়ের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ
বেলা গড়াতে শুরু করেছে। আকাশের বাড়িতে এখন আর মধ্যরাতের সেই চাপা উত্তেজনা নেই, বরং উৎসবের এক উন্মাদনা। নিরুপমা দেবী মুখ ভার করে থাকলেও, নাতবউ আহানার আন্তরিকতা এবং মিষ্টির গন্ধে তার কঠোরতা কিছুটা কমেছে।
ঠিক দুপুর বারোটায়, আকাশের বন্ধুরা হাজির। জয়, রনি, পিঙ্কি, টিয়া এবং আরও জনা পাঁচেক বন্ধু, সবাই প্রায় একই কালো টি-শার্ট পরে এসেছে। তাদের চোখে দুষ্টুমির ছাপ স্পষ্ট।
তারা ঘরে ঢুকেই কার্তিক ঠাকুরকে দেখল। ঠাকুরকে দেখে সবাই সশব্দে হেসে উঠল। পিঙ্কি দেখল, তার স্পিকারের বাক্সটা উধাও, আর কার্তিকের গায়ে এখনও ঠাকুমার দেওয়া শাল জড়ানো!
“অহনা বৌদি , কেমন হলো আমাদের সারপ্রাইজ?” জয় হাসতে হাসতে অহনাকে জিজ্ঞেস করল।
অহনা একটা শুকনো হাসি দিয়ে বললো, “তোমাদের সারপ্রাইজের জন্য কাল রাতে ঠাকুমার মুখ দেখতে পারোনি! আর সারারাত আমরা ঘুমাইনি! তোমাদের বায়না পূরণ করতে আজ সকাল থেকে আমার যুদ্ধ চলছে।”
জয় এক ঝলক ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে দেখল, নিরুপমা দেবী তেতো মুখে একটা চেয়ারে বসে আছেন, কিন্তু মাঝে মাঝে লুকিয়ে বিরিয়ানির গন্ধ শুঁকছেন।
আকাশ তখন বলল, “শোনো, তোমরা আগে পুজোটা সারো। আমি তোমাদের জন্য কফি মেকারটা সেট করছি। আর হ্যাঁ, কার্তিকের জন্য আনা রিমোট কন্ট্রোল মোটরগাড়িটা কিন্তু ঠাকুরকে দেওয়ার পরই তোমরা হাত দিতে পারবে।”
এরপর শুরু হলো পুজো। নিয়ম মেনে নতুন দম্পতি আকাশ আর অহনা একসঙ্গে কার্তিক ঠাকুরের পূজা করল। রনি আর জয় মিলে শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে এমন এক আবহ তৈরি করল, যেন সত্যিই তাদের বাড়িতে কার্তিক ঠাকুর স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছেন।
পুজো শেষে, এবার বায়না মেটানোর পালা।
অহনা আর আকাশের মা মিলে বিরাট আকারের বিরিয়ানির হাঁড়িটা মাঝখানে রাখলেন। সুস্বাদু মাটন বিরিয়ানির গন্ধ পুরো বাড়ি ভরে গেলো। আহানা তার হাতে বানানো মিষ্টি আর চপ-কাটলেটের প্লেটগুলো সাজিয়ে দিল।
বন্ধুরা গোল হয়ে বসতেই শুরু হলো চূড়ান্ত হই-হুল্লোড়।
“অহনা বৌদি , তোমার হাতের রান্না সত্যি অসাধারণ!” জয় এক থালা বিরিয়ানি শেষ করে বলল। “এই বিরিয়ানিই আমাদের পুরস্কার! কাল রাতে ঠাকুরকে কষ্ট দিয়ে আনার কষ্ট আজ সার্থক হলো।”

রনি বলল, “শুধু খাওয়াদাওয়া নয়! শাড়ির কী হলো? কফি মেকারের কী হলো? আর আমার খেলনা মোটরগাড়ি?”
আকাশ হেসে উঠে অহনাকে বলল, “দেখো, তোমার শাড়িটা কেমন হয়েছে! আর কফি মেকারটা এখনই চালু করো!”
অহনা তার নতুন জরিপাড়ের শাড়িটা বন্ধুদের দেখাল। শাড়িটা দেখে টিয়া আর পিঙ্কি দারুণ খুশি হলো। তারপর আকাশ কফি মেকারটা অন করে বন্ধুদের গরম কফি পরিবেশন করল।
পিঙ্কি তখন হেসে ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখুন দিদা, কার্তিক ঠাকুর কিন্তু শুধু ফাজলামো করতে আসেননি, উনি দেখেন যেন বৌদি ভাইয়ের কফি খাওয়ার শখটা পূরণ হয় কি না!”
ঠাকুমা এতক্ষণ কঠোর মুখ করে ছিলেন। কিন্তু বন্ধুদের এই আন্তরিক হুল্লোড়, আর আহানার যত্ন দেখে তিনি আর থাকতে পারলেন না। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “হয়েছে হয়েছে, হয়েছে তোমাদের ফাজলামো। তবে নাতবউয়ের রান্নাটা সত্যিই খুব ভালো হয়েছে। আর হ্যাঁ, স্পিকারের বাক্সটা, যেটা এত ঠান্ডা লাগছিল, সেটা আমি গ্যাসের পাশে রেখেছিলাম। এখন কেমন আছে তোমাদের কার্তিক?”
ঠাকুমার এই কথা শুনে বন্ধুরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। জয় বুঝতে পারল, তাদের প্রযুক্তির দুষ্টুমি সামান্য হলেও ঠাকুমাকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছিল।
অহনা হেসে এসে ঠাকুমার হাত ধরল। “আমরা দু’জনে জানি ঠাকুমা, এই সব আনন্দ আর ভালোবাসার জন্যই। আসলে কার্তিক ঠাকুর এভাবেই আমাদের জীবনে আরও বেশি আনন্দ আর আশীর্বাদ নিয়ে আসেন।”
বিকেলের দিকে, পেট ভরে খাওয়া শেষে, নতুন কফি মেকারের কফি পান করতে করতে বন্ধুরা বিদায় নিলো। তারা যাওয়ার আগে আকাশ আর অহনাকে আগামী বছর আবার এমন সারপ্রাইজ দেওয়ার হুমকি দিয়ে গেলো।
সবাই চলে যাওয়ার পর, আকাশ অহনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই সব ফাজলামোর মধ্যে আজকের দিনটা আমাদের নতুন জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে রইল। কার্তিক ঠাকুরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
অহনা হাসতে হাসতে বলল, “আর ধন্যবাদ তোমার বন্ধুদের, যারা আমাদের জীবনের এই অধ্যায়টাকে এত মজার করে তুলল।”
বারান্দায় কার্তিক ঠাকুর তখনও বসে, তাঁর মুখে যেন এক নীরব হাসি। তিনি যেন বলছেন, “নতুন জীবন হোক শুভ আর হাসি-ঠাট্টায় ভরা।”
