শাঁকচুন্নীর হাতের শাঁখা

শাঁকচুন্নীর হাতের শাঁখা

নতুন বউয়ের আগমন ও পুরোনো অভিশাপ

ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন জমিদার বাড়ি, ‘শ্যামসুন্দর মহল’। মহলের বর্তমান উত্তরসূরি দেবরাজ চৌধুরী। তার একমাত্র ছেলে, রায়, শহরের নামকরা আর্কিটেক্ট। জমিদারির ঐতিহ্য আর শহরের আধুনিকতার মিশেলে বেড়ে ওঠা রায় ভালোবেসে বিয়ে করেছে শহরেরই এক কলেজ শিক্ষিকা, স্নেহা বসুকে। শাঁখা সিঁদুর পরে নতুন বৌ কে ভারি মিষ্টি লাগছিলো। স্নেহা বুদ্ধিমতী, আধুনিক মনস্ক, কিন্তু ঐতিহ্য আর প্রথাকে সম্মান করতে জানে।

বিয়ের পর রায় এবং স্নেহা শ্যামসুন্দর মহলে ফিরল। জমিদার বাড়িটি অনেক পুরোনো, প্রায় আড়াইশো বছরের। তার বিশাল দরজা, উঁচু ছাদ, আর ঠান্ডা পাথরের মেঝেতে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করে। বাড়ির ভেতর ঢুকতেই স্নেহার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে অনুভব করল এক চাপা অস্থিরতা, যেন মহলের প্রতিটি ইট দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

গ্রামের বয়স্ক মহিলারা, বিশেষ করে দেবরাজের পিসিমা রত্নমালা দেবী, নতুন বউকে নিয়ে খুব সতর্ক ছিলেন। পিসিমা পুরোনো দিনের মানুষ, ভূতে বিশ্বাসী। তিনি স্নেহার কপালে একটি সিঁদুরের টিপ দিয়ে বললেন, “সাবধানে থেকো বউমা। এই বাড়িতে অনেক পুরোনো কাহিনি আছে। বিশেষ করে, নতুন বউদের জন্য এ বাড়ির বাতাসটা ভারী থাকে।”

স্নেহা প্রথমে পিসিমার কথাটাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু রাতে যখন সে রায়ের সাথে নিজের ঘরে গেল, তখন তার মনে হলো পিসিমার কথাগুলো যেন বাতাসে মিশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তাদের ঘরের পাশেই জমিদার বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো এবং বন্ধ ঘরটি। সে ঘরটি নাকি প্রায় একশো বছর ধরে তালাবন্ধ।

পরদিন সকালে, জমিদার বাড়ির বিভিন্ন প্রথা পালন করা হচ্ছিল। নতুন বউ হিসেবে স্নেহার প্রথম কাজ ছিল জমিদার বাড়ির কুলদেবী শ্যামসুন্দরী দেবীর মন্দিরে পুজো দেওয়া। মন্দিরে যাওয়ার পথে, স্নেহা দেখল, বাড়ির দেয়ালের কোনায়, ছাদে—সবখানেই ছোট ছোট শঙ্খের টুকরা লাগানো। সে অবাক হলো।

“পিসিমা, এত শাঁখের টুকরা কেন?” স্নেহা জিজ্ঞেস করল।

রত্নমালা দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বউমা, এটা আমাদের পুরোনো প্রথা। এ বাড়িতে একজন শাঁকচুন্নী বাস করে।”

শাঁকচুন্নী! স্নেহা চমকে উঠল। সে শুনেছিল, শাঁকচুন্নী হলো সেই বিবাহিতা মহিলার ভূত, যে নিজের অপঘাতে মৃত্যু বা অতৃপ্ত বাসনার কারণে নতুন বউদের জীবন চুরি করতে চায়, তাদের শাঁখা পরে তাদের মতো জীবন যাপন করতে চায়।

“প্রায় একশো বছর আগে, এই বাড়িরই একজন নতুন বউ, মাধুরী, বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ পর রহস্যজনকভাবে মারা যায়। তার দেহ পুকুরে পাওয়া যায়, কিন্তু তার হাতের শাঁখা জোড়া অক্ষত ছিল। এরপর থেকে, প্রতিবার যখন এই বাড়িতে নতুন বউ আসে, তখনই কোনো না কোনো অশুভ ঘটনা ঘটে। অনেকে বলে, শাঁকচুন্নী মাধুরী সেই নতুন বউদের উপর ভর করে তাদের জীবন কেড়ে নিতে চায়, তাদের হাতের শাঁখা জোড়া ছিনিয়ে নিতে চায়।”

স্নেহা ভয় পেল। সে আধুনিক মনস্ক হলেও, এই পরিবেশ আর পুরোনো কাহিনি তার মনে ভয়ের সঞ্চার করল।

সেদিন রাতে, স্নেহা যখন তার শাঁখা পরে শুতে গেল, তখন তার মনে হলো যেন তার শাঁখা জোড়া অস্বাভাবিক রকম ঠান্ডা। সে পাশ ফিরে রায়কে জড়িয়ে ধরল। রায় তখন ঘুমিয়ে ছিল।

হঠাৎ, তাদের ঘরের বন্ধ দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। দু’বার।

“কে?” স্নেহা জিজ্ঞেস করল। কোনো উত্তর এলো না।

রায় তখনো ঘুমিয়ে। স্নেহা ভাবল, হয়তো মনের ভুল। কিন্তু আবার টোকা পড়ল। এবার আরও স্পষ্ট।

স্নেহা উঠে গিয়ে দরজা খুলল। বাইরে কেউ নেই। কেবল দীর্ঘ, অন্ধকার করিডোর। করিডোরের শেষ প্রান্তে থাকা সেই বন্ধ ঘরের দিকে তার চোখ পড়ল। বন্ধ ঘরের নিচে থাকা দরজার ফাঁক দিয়ে একটি লালচে আভা বেরোচ্ছে। স্নেহার গা ছমছম করে উঠল।

সে দ্রুত দরজা বন্ধ করে রায়ের কাছে ফিরে এলো। “রায়, ওঠো! কেউ যেন দরজায় টোকা দিচ্ছিল!”

রায় ধড়মড় করে উঠল। “কে? পিসিমা হয়তো…”

“না, রায়। পিসিমা তো এত রাতে আসবেন না। আর তার চেয়েও বড় কথা, সেই বন্ধ ঘরের নিচ থেকে লাল আলো আসছিল।”

রায় তার কথা বিশ্বাস করল না। “ওসব তোমার মনের ভুল, স্নেহা। তুমি নতুন পরিবেশে এসে ভয় পাচ্ছো। ওটা হয়তো পুরোনো ঘরের ভেতরে কোনো ছিদ্র দিয়ে বাইরের আলো বা কিছু বিচ্ছুরিত হচ্ছে।”

রায় স্নেহা কে সান্ত্বনা দিল, কিন্তু স্নেহার মনে ভয় বাসা বেঁধেছিল। সে সারা রাত ঘুমাতে পারল না। তার শাঁখা জোড়া যেন আরও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।

আয়নার মায়া ও শাঁখার মারণফাঁদ

পরদিন সকালে স্নেহা আয়নায় নিজেকে দেখল। তার চোখে গভীর কালি, মুখটা ফ্যাকাশে। সে ভাবল, হয়তো ঘুমের অভাবে এমনটা হয়েছে।

সারাদিন ধরে বাড়ির কাজ আর প্রথা পালনের মধ্য দিয়ে কাটল। বিকেলের দিকে দেবরাজ রায় ও স্নেহা কে নিয়ে গেলেন পারিবারিক লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিটা বিশাল, পুরোনো বইয়ে ঠাসা। দেবরাজ রায় বললেন, “এই লাইব্রেরিতে আমাদের পরিবারের প্রায় সব ইতিহাস লেখা আছে। যদি কখনো কিছু জানতে চাও, এখান থেকে পাবে।”

স্নেহা লাইব্রেরিতে থাকা বইগুলো ঘাঁটতে লাগল। একটি পুরোনো, চামড়ায় বাঁধানো বই তার চোখে পড়ল। বইটির নাম, ‘শঙ্খ পুরাণ ও রত্নালঙ্কার’। সে কৌতূহলবশত বইটি খুলল।

বইটির একটি অধ্যায়ে ‘শাঁকচুন্নী’ সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে লেখা আছে: শাঁকচুন্নী নতুন বধূর হাতের শাঁখা পছন্দ করে। সে বউয়ের শরীরে প্রবেশ করে, তার জীবন চুরি করে, আর তার শাঁখা নিয়ে নিজের অতৃপ্ত সাধ পূরণ করে। শাঁকচুন্নীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে, তার পছন্দের জিনিস—অর্থাৎ শাঁখা—কে রক্ষা করতে হবে, এবং তাকে কোনোভাবে আটকে রাখতে হবে।

স্নেহার মনে শঙ্কা বাড়ল। সে বইয়ের পাতা ওল্টাতে থাকল। একটি পাতায়, একটি ছবি আঁকা ছিল—একজন বিবাহিতা মহিলা, তার হাত দুটি তার বুকের উপর ভাঁজ করা, আর তার হাতের শাঁখা জোড়া জ্বলছে। ছবিটির পাশে লেখা ছিল: মাধুরী, শ্যামসুন্দর মহলের প্রথম শাঁকচুন্নী।

স্নেহা শিউরে উঠল। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই সেই মাধুরী! সে লাইব্রেরির বন্ধ ঘরটির দিকে তাকাল, যেখানে আলো জ্বলেছিল।

সেদিন রাতে, স্নেহা তার শাঁখা খুলে রাখল। তার মন অস্থির। রায় তখন গভীর ঘুমে।

হঠাৎ, সে দেখল, ঘরের ভেতরে তার শাঁখা জোড়া আপনাআপনি নড়ছে। শাঁখা জোড়া বিছানা থেকে উঠে ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যখানে ভাসতে শুরু করল। বাতাসে এক মিষ্টি ফুলের তীব্র গন্ধ।

স্নেহা ভয়ে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলার স্বর আটকে গেল। সে দেখল, শাঁখা জোড়া ভাসতে ভাসতে ঘরের মাঝখানে থাকা একটি পুরোনো আয়নার সামনে গিয়ে থামল। আয়নার কাঁচটি তখন ঘোলাটে ছিল, কিন্তু শাঁখা জোড়া সামনে আসতেই আয়নাটি পরিষ্কার হয়ে উঠল।

sakchunnir hater sankha 4

আয়নার ভেতরে, স্নেহা দেখল, একটি নারীর আবছা প্রতিচ্ছবি। তার মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু তার চোখের স্থান থেকে দুটি তীব্র, রক্তলাল আভা বেরোচ্ছে। নারীর হাত দুটি তার বুকের উপর ভাঁজ করা, ঠিক যেন সেই বইয়ের ছবির মতো।

শাঁকচুন্নী!

আয়নার ভেতরের নারীটি স্নেহার দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিল। তার হাতের নখগুলো ছিল বঁটির ফলার মতো তীক্ষ্ণ, আর তার মুখের কোনায় একটি বীভৎস হাসি। সে যেন আয়নার ভেতর থেকে স্নেহার শাঁখা জোড়াকে ডাকছে।

স্নেহা তার চোখের সামনে দেখল, শাঁখা জোড়া ধীরে ধীরে আয়নার দিকে এগোচ্ছে। শাঁখা জোড়া আয়নার কাঁচ ছুঁতেই, আয়নার ভেতরে থাকা নারীর প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে তখনো হাসছে।

স্নেহা এবার চিৎকার করে উঠল, “না!”

চিৎকার শুনে রায় ধড়মড় করে উঠল। “কী হয়েছে, স্নেহা?”

স্নেহা কেবল আয়নার দিকে আঙুল দেখাল। রায় আয়নার দিকে তাকাল। আয়নাটি তখনো ঘোলাটে, আর তার ভেতর থেকে কোনো নারীর প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে না। শাঁখা জোড়া তখনো ভাসছে না, বরং টেবিলের উপরে স্থির হয়ে আছে।

“কিছু নেই তো, স্নেহা,” রায় বলল। “তুমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছো?”

স্নেহা বিশ্বাস করতে পারল না। সে তো স্পষ্ট দেখল! রায় তাকে জড়িয়ে ধরল।

কিন্তু স্নেহার মনে হলো, আয়নার পেছনে থাকা দেয়ালে, একটি অশরীরী হাসি যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

পিসিমার সতর্কতা ও গোপন পুঁথি

পরদিন সকালে, স্নেহা পিসিমা রত্নমালা দেবীর কাছে গেল। সে তাকে গত রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।

পিসিমা চোখ বন্ধ করে শুনলেন। “আমি জানতাম, বউমা। আমি জানতাম। মাধুরী তার পথ খুঁজে পেয়েছে।”

“কিন্তু আমি কী করব, পিসিমা? আমি তো কোনো মাছচোর নই, কোনো লোভীও নই। আমি কেন তার শিকার হব?”

“মাধুরী মাছচোরদের বা লোভীদের শাস্তি দেয় না, বউমা। সে কেবল সেইসব নতুন বউদের উপর প্রতিশোধ নেয়, যাদের জীবন সে নিজে বাঁচতে পারেনি। সে তোমার সুখ কেড়ে নিতে চায়, তোমার শাঁখা চুরি করে তোমার মতো সুখী হতে চায়।”

পিসিমা একটি পুরোনো, জীর্ণ কাঠের সিন্দুক খুললেন। সিন্দুকের ভেতরে একটি ছোট, কালো কাপড়ে মোড়া পুঁথি ছিল। পুঁথিটি অনেক পুরোনো, তার ভাষা বোঝা কঠিন।

“এটা মাধুরীর নিজের হাতে লেখা পুঁথি, বউমা,” পিসিমা বললেন। “এটা আমি অনেক গোপন করে রেখেছিলাম। এতে মাধুরীর শেষ ইচ্ছা আর তার আত্মার শান্তি পাওয়ার উপায় লেখা আছে।”

পুঁথিতে লেখা ছিল, মাধুরীকে খুন করা হয়েছিল। সে জমিদার বাড়ির এক পরিচারকের সাথে প্রেম করত, কিন্তু তার বাবা-মা তাকে জমিদারের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। যখন মাধুরী রাজি হয়নি, তখন তার স্বামী তাকে হত্যা করে সায়রে ফেলে দেয়। মাধুরী মারা যাওয়ার আগে, তার হাতে থাকা শাঁখা জোড়া ভেঙে দিয়েছিল, যা সে তার সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে পরেছিল। কিন্তু তার স্বামী সেই শাঁখা জোড়া জোর করে তার হাতে পরিয়ে সায়রে ফেলে দেয়। মাধুরীর আত্মা শান্তি পায়নি, কারণ তার শাঁখা জোড়া ছিল অপমানের প্রতীক, ভালোবাসার নয়।

“তাহলে, শাঁকচুন্নী মাধুরীর আত্মা সেই শাঁখা জোড়াকেই অভিশাপ হিসেবে ব্যবহার করছে?” স্নেহা জিজ্ঞেস করল।

“ঠিক তাই, বউমা। মাধুরী নতুন বউদের উপর ভর করে তাদের জীবন চুরি করতে চায়, তাদের হাতের শাঁখা জোড়া ছিনিয়ে নিয়ে নিজের অতৃপ্ত সাধ পূরণ করতে চায়। আর সেই শাঁখা জোড়া হলো তার শৃঙ্খল।”

sakchunnir hater sankha 3

পুঁথিতে একটি সমাধানও লেখা ছিল: “শাঁখা ভাঙলে মুক্তি, শাঁখা পরলে বিনাশ।”

“কিন্তু আমি কী করে তার শৃঙ্খল ভাঙব?” স্নেহা জিজ্ঞেস করল।

পিসিমা একটি মন্ত্র লিখলেন। “এই মন্ত্রটি তোমাকে রক্ষা করবে, বউমা। এই মন্ত্রটি তোমাকে মাধুরীর শৃঙ্খল ভাঙতে সাহায্য করবে। কিন্তু তোমাকে তোমার শাঁখা খুলে ফেলতে হবে, আর সেই শাঁখা জোড়া জমিদার বাড়ির পুরোনো মন্দিরের নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। যেখানে মাধুরীর ভালোবাসার মন্দির ছিল, যেখানে সে তার প্রেমিকের সাথে দেখা করত।”

স্নেহা এবার বুঝতে পারল, তাকে কী করতে হবে।

সেদিন রাতে, স্নেহা তার শাঁখা জোড়া খুলে ফেলল। শাঁখা জোড়া খুলে ফেলতেই তার শরীর থেকে যেন এক শীতল আবেশ দূর হয়ে গেল। তার মন শান্ত হলো।

রায় তখন ঘুমিয়ে ছিল। স্নেহা সাবধানে ঘর থেকে বের হলো। পিসিমা তাকে সেই মন্দিরের পথ দেখালেন। মন্দিরটি জমিদার বাড়ির পেছনের দিকে, ঘন জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত।

মন্দিরে ঢোকার আগেই, স্নেহা দেখল, সেই বন্ধ ঘরটি খোলা। তার ভেতর থেকে লালচে আলো বেরোচ্ছে। স্নেহা ভয় পেল না। সে জানত, মাধুরী তাকে পরীক্ষা করছে।

মন্দিরের ভেতরে, কুলদেবী শ্যামসুন্দরী দেবীর মূর্তি শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। মন্দিরের মেঝেতে একটি পুরোনো শঙ্খ পড়ে ছিল, যা অনেক বছর ধরে কেউ ছুঁয়ে দেখেনি। স্নেহা পুঁথির মন্ত্রটি উচ্চারণ করল।

“ওঁ শঙ্খধারিনী বিঘ্ননাশিনী হ্রীং হ্রীং নমঃ। অপঘাতে মৃত মাধুরী, লভ মুক্তি, দেহতত্ত্বং পরমং শান্তি।”

মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সাথে সাথে, শঙ্খটি আপনাআপনি নড়ে উঠল। মন্দির জুড়ে এক তীব্র কম্পন শুরু হলো। শাঁখা জোড়া স্নেহার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল, আর তার উপর থেকে সাদা ধোঁয়া বেরোতে লাগল।

মাধুরীর আত্মা যেন এক তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল।

অভিশাপের শেষ আর্তনাদ

মন্দির জুড়ে তীব্র কম্পন, আর সেই সাদা ধোঁয়ার মধ্যে থেকে যেন মাধুরীর করুণ মুখটা আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। তার চোখ থেকে জল ঝরছে, মুখে এক গভীর যন্ত্রণার ছাপ। সে যেন ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু তার কন্ঠস্বর বেরোচ্ছে না।

স্নেহা জানে, মাধুরীর আত্মা তার শৃঙ্খল ভাঙতে চাইছে। তার হাতের শাঁখা জোড়াই ছিল তার অভিশাপের কারণ, যা তার সত্যিকারের ভালোবাসাকে অপমান করেছিল। সে শাঁখা জোড়া ভেঙে নিজের মুক্তি চায়, তার সত্যিকারের ভালোবাসার স্বীকৃতি চায়।

স্নেহা পুঁথির মন্ত্রটি আরও জোর দিয়ে উচ্চারণ করল। তার কন্ঠস্বরে ভয় নয়, ছিল গভীর সহানুভূতি।

“ওঁ শঙ্খধারিনী বিঘ্ননাশিনী হ্রীং হ্রীং নমঃ। অপঘাতে মৃত মাধুরী, লভ মুক্তি, দেহতত্ত্বং পরমং শান্তি।”

মন্ত্রটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে, মন্দির জুড়ে একটি তীব্র বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো। শাঁখা জোড়া মেঝের উপর ভেঙে গেল, আর তার টুকরোগুলো বাতাসে মিশে গেল। সাদা ধোঁয়া ধীরে ধীরে উধাও হয়ে গেল।

মন্দির শান্ত হলো। কম্পন থেমে গেল। কুলদেবী শ্যামসুন্দরী দেবীর মূর্তিটি শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল।

স্নেহা তার বুকের উপর হাত রাখল। তার মন শান্ত হলো। মাধুরীর আত্মা মুক্তি পেল।

কিন্তু মুক্তি পাওয়ার আগে, সেই শঙ্খটি থেকে একটি মৃদু আলো ঝলকে উঠল। আলোর মধ্যে থেকে মাধুরীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, এবার তাতে কোনো ক্রোধ বা যন্ত্রণার ছাপ নেই, ছিল কেবল এক গভীর স্বস্তি।

“ধন্যবাদ, বউমা… ধন্যবাদ… তুমি আমার শৃঙ্খল ভেঙে দিলে… তুমি আমাকে মুক্তি দিলে… এখন তুমি সুখী হও… তোমার শাঁখা… তোমার ভালোবাসার প্রতীক… সুরক্ষিত থাকবে…”

কন্ঠস্বরটি ধীরে ধীরে বাতাসে মিশে গেল। শঙ্খটি নিভে গেল। মন্দির আবার শান্ত, নীরব।

sakchunnir hater sankha 2

স্নেহা বুঝল, মাধুরী তাকে তার সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য আশীর্বাদ করে গেল। সে মুক্তি পেয়েছিল, শাঁখার অভিশাপ থেকে।

সেদিন সকালে, স্নেহা ফিরে গেল রায়ের কাছে। রায় তখন ঘুম থেকে উঠেছিল।

“কোথায় ছিলে, স্নেহা?” রায় জিজ্ঞেস করল।

“আমি মাধুরীকে মুক্তি দিতে গিয়েছিলাম, রায়,” স্নেহা শান্ত স্বরে বলল।

রায় অবাক হলো। “তুমি কী বলছো?”

স্নেহা তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। রায় প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না। কিন্তু যখন সে স্নেহার চোখে দেখল এক অদ্ভুত শান্তি আর দৃঢ়তা, তখন তার মনেও সন্দেহ দূর হলো।

“তাহলে, শাঁকচুন্নীর অভিশাপ শেষ?” রায় জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, রায়,” স্নেহা বলল। “মাধুরীর আত্মা মুক্তি পেয়েছে। এখন এই বাড়ি অভিশাপমুক্ত।”

তারা দুজনেই পিসিমা রত্নমালা দেবীর কাছে গেলেন। পিসিমা সব শুনে কাঁদতে শুরু করলেন। “মাধুরী আমার বোন ছিল, বউমা। আমি জানতাম সে মুক্তি পাবে। তুমি তাকে মুক্তি দিলে।”

পিসিমা স্নেহাকে একটি নতুন শাঁখা দিলেন। “এই শাঁখা জোড়া তুমি পরো, বউমা। এটা আশীর্বাদের শাঁখা।”

স্নেহা শাঁখা জোড়া পরল। এবার তার হাতে শাঁখা জোড়া ঠান্ডা নয়, উষ্ণ মনে হলো। তাতে যেন ভালোবাসার ছোঁয়া লেগেছিল।

নতুন সূর্যোদয় ও শঙ্খের প্রতীক

সেদিন সকালে শ্যামসুন্দর মহলের উপর নতুন সূর্য উঠল। বাড়ির প্রতিটি কোণায় যেন এক নতুন প্রাণ সঞ্চার হলো। বন্ধ ঘরটি এখন আর বন্ধ নেই। দেবরাজ রায় সেই ঘরটি খোলার নির্দেশ দিলেন।

ঘরের ভেতরে কোনো ভয়ানক কিছু ছিল না, ছিল শুধু ধুলায় ঢাকা পুরোনো আসবাবপত্র আর একটি বিশাল, জং ধরা সিন্দুক। সিন্দুকটি খোলা হলো, ভেতরে পাওয়া গেল কিছু পুরোনো অলংকার আর মাধুরীর হাতে লেখা একটি চিঠি।

চিঠিতে মাধুরী লিখেছিল: আমার সত্যিকারের ভালোবাসা আর শঙ্খ ছিল আমার জীবন। কিন্তু আমাকে জোর করে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। আমার শঙ্খের উপর অভিশাপ নেমে এসেছিল। আমি চাই, এই বাড়ির নতুন বউয়ের শঙ্খ যেন সুরক্ষিত থাকে, তার ভালোবাসা যেন অমর হয়।

স্নেহা চিঠিটা পড়ে কেঁদে ফেলল। মাধুরীর যন্ত্রণা সে বুঝতে পারল।

পরের দিন, রায় এবং স্নেহা কুলদেবী শ্যামসুন্দরী দেবীর মন্দিরে পুজো দিতে গেল। মন্দিরের ভেতরে একটি নতুন শঙ্খ রাখা হয়েছিল, যা উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছিল।

পিসিমা বললেন, “এই শঙ্খটি মাধুরীর আত্মার আশীর্বাদ, বউমা। এটা তোমাকে রক্ষা করবে।”

স্নেহা সেই শঙ্খটি হাতে নিল। শঙ্খটি উষ্ণ মনে হলো, যেন তাতে জীবন ছিল।

শ্যামসুন্দর মহলে আর শাঁকচুন্নীর কোনো অশুভ ছায়া দেখা গেল না। নতুন বউরা নির্ভয়ে তাদের শাঁখা পরে মহলে বসবাস করতে লাগল। মাধুরীর অভিশাপ শেষ হয়েছিল, আর তার আত্মা মুক্তি পেয়েছিল।

কিন্তু শাঁকচুন্নীর গল্পটি মানুষের মনে রয়ে গেল, এক নীরব সতর্কবার্তা হিসেবে। ভালোবাসাকে অস্বীকার করলে, মানুষের আত্মাকে অসম্মান করলে, তা মৃত্যুর পরেও পিছু ছাড়ে না। আর সেই শাঁখা জোড়া, যা ছিল অপমানের প্রতীক, তা এখন পরিণত হলো ভালোবাসার আশীর্বাদে।

স্নেহা তার শাঁখা জোড়া পরে নতুন জীবন শুরু করল। সে জানত, মাধুরীর আত্মা তাকে সবসময় পাহারা দেবে, তার ভালোবাসাকে সুরক্ষিত রাখবে। আর শ্যামসুন্দর মহল এক নতুন সূর্যোদয়ের সাক্ষী হলো, যেখানে শাঁকচুন্নীর হাতের শাঁখা আর অভিশাপের নয়, ভালোবাসার প্রতীক হয়ে রইল।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *