পেত্নীর মাছ চুরি
|

১৪ ভুতের গল্প সিরিজ – দ্বিতীয় গল্প

পেত্নীর মাছ চুরি ও প্রতিশোধ

নিশ্চিন্দিপুরের নীরব অভিশাপ

নিশ্চিন্দিপুর। নামটা যতটাই শান্তিদায়ক, গ্রামের ভেতরের পরিবেশ ততটাই থমথমে। গ্রামটির এক প্রান্তে, ঘন জঙ্গলের কিনারা ঘেঁষে একটা বিশাল পুকুর। স্থানীয়রা একে বলে ‘সায়র’। এই সায়রের জলে নাকি রাতের বেলা মাছের খেলা দেখা যায়—এতই মাছ যে, জলের উপরে তাদের লম্ফন পরিষ্কার শোনা যায়। কিন্তু কেউ সেই সায়রে মাছ ধরতে সাহস দেখায় না। কারণ, এই সায়র জুড়ে রয়েছে এক ভয়াবহ কিংবদন্তী, এক পেত্নীর মাছ চুরি ও প্রতিশোধের গল্প

কিংবদন্তী অনুযায়ী, প্রায় সত্তর বছর আগে এই গ্রামেরই এক নিরূপমা কুমারী কন্যা ছিল—নাম মাধবী। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। সায়র পাড়ের সেই পুরোনো বটগাছটার নিচে ছিল তাদের ছোট্ট বাড়ি। মাধবীকে সবাই ভালোবাসত, কিন্তু তার কপালে সুখ সইল না। বিয়ের দিন সকালে, সায়রের ঘাটে স্নান করতে গিয়ে সে পা পিছলে ডুবে যায়। তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, মাধবী অবিবাহিত অবস্থায় অপঘাতে মারা গিয়েছিল, তাই সে মুক্তি পায়নি। তার আত্মা ওই সায়র এবং তার আশেপাশের অঞ্চল আঁকড়ে ধরে আছে। তবে, মাধবী সাধারণ পেত্নী নয়। তার একটি অদ্ভুত অভ্যেস—সে সায়রের মাছ রক্ষা করে। মাঝরাতে যদি কেউ মাছ চুরি করতে আসে, তবে সেই পেত্নী এসে তাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করে। গ্রামের মানুষ মাধবীকে ভালোবেসে ডাকত ‘মাধবীলতা’। কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেই মাধবীলতা এক ভয়ানক প্রেতিনীতে পরিণত হয়।

গল্পটা শুরু হয়েছিল নিধু মাঝির শেষ রাতের অভিজ্ঞতা দিয়ে। নিধু মাঝি ছিল গ্রামের সেরা মাছচোর, তার কাছে মাছ চুরি করাটা ছিল শিল্পের মতো। তার লোভ ছিল মারাত্মক। সে জানত সায়রের গল্প, কিন্তু মাছের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল সব ভয়ের ঊর্ধ্বে।

এক ঘোর অমাবস্যার রাতে, যখন আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা, নিধু মাঝি তার জাল আর টর্চ নিয়ে সায়রের দিকে রওনা হলো। গ্রামের রাস্তায় তখন পিনপতন নীরবতা। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর মাঝেমধ্যে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া।

সায়রের পাড়ে এসে নিধু দেখল, জল স্থির, শান্ত। কিন্তু জলের গভীর থেকে মাঝে মাঝে বড় মাছের ভেসে ওঠার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। নিধু সাবধানে তার জাল ফেলল। প্রথম টানেই জাল ভর্তি বড় আকারের রুই, কাতলা। নিধুর চোখে লোভের ঝিলিক।

petnir mach churi 1

“মাধবীলতা হোক বা ব্রহ্মদৈত্য, মাছ যখন এত, তখন ঝুঁকি তো নিতেই হবে!”—মনে মনে ভাবল নিধু।

দ্বিতীয়বার জাল ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় তার কানে এলো একটি মিষ্টি, করুণ কান্নার সুর। সুরটা যেন জলের নিচ থেকে ভেসে আসছে। নিধু প্রথমে পাত্তা দিল না, ভাবল মনের ভুল।

কিন্তু কান্নাটা ক্রমশ তীব্র হতে লাগল, যেন কেউ জলে ডুবে যাওয়ার আগে শেষ চেষ্টা করছে। নিধু টর্চ জ্বেলে জলের দিকে তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না।

হঠাৎ, সায়রের স্থির জলটা প্রচণ্ড বেগে আলোড়িত হয়ে উঠল। নিধুর মনে হলো, কেউ যেন জলের নিচে থেকে তার জাল ধরে টানছে। নিধু সর্বশক্তি দিয়ে জালটা ধরে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু সে পারল না। জাল ছিঁড়ে গেল, আর মাছগুলো যেন অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।

তারপর নিধু যা দেখল, তাতে তার গলার স্বর আটকে গেল। সায়রের পাড়ে, বটগাছটির নিচে, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ভিজে সাদা শাড়ি, চুল খোলা, মুখটি চাঁদের ক্ষীণ আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে। তার মুখটা যেন ভেজা মাটি দিয়ে তৈরি, আর চোখ দুটো জ্বলে উঠছে দুটো জোনাকির মতো।

“তুই আমার মাছ চুরি করতে এসেছিস, নিধু?”—স্বরটি ছিল হিমশীতল, যেন বরফ গলা জল।

নিধু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু তার কন্ঠস্বর বের হলো না। সে শুধু দেখল, মেয়েটি এক পলকে তার সামনে চলে এলো। তার হাতটি ছিল অস্বাভাবিক লম্বা, এবং তার নখগুলো ছিল বঁটির ফলার মতো তীক্ষ্ণ।

সে রাতে নিধু মাঝি কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল, কিন্তু সে মাছচুরি করতে এসেছিল বলে পেত্নী তার প্রতিশোধ নিয়েছিল ভিন্নভাবে। গ্রামের মানুষ পরদিন সকালে নিধুকে খুঁজে পেল, কিন্তু সে ছিল উন্মাদ। সে কেবলই জল, মাছ আর সাদা শাড়ির কথা বলত। নিধুর জিভ কাটা ছিল, যেন সে আর কখনো মাছের কথা মুখে না আনতে পারে।

নিধুর এই পরিণতি গ্রামে মাধবীলতার কিংবদন্তী আরও ভয়াবহ করে তুলল। সায়রের ধারে দিনের বেলাও আর কেউ পা মাড়াত না।

শহরের গবেষক এবং অলৌকিক চ্যালেঞ্জ

এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর। নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম তখন আরও জনমানবশূন্য। সেই সময়ে, কলকাতার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব এবং পুরাণ বিশেষজ্ঞ, ড. শুভ্র সেনগুপ্ত, এই কিংবদন্তী নিয়ে গবেষণা করতে এলেন। শুভ্রবাবু বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে বিশ্বাসী, কিন্তু লোককথার গভীরে লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক সত্য খুঁজে বের করাই তাঁর নেশা।

শুভ্রবাবুর সঙ্গে ছিলেন তার সহকারী, রমা। রমা গ্রামের মেয়ে, তবে যুক্তিবাদী এবং সাহসী।

“স্যার, এই সায়রের গল্পটা কিন্তু ভয়ংকর,” রমা সতর্ক করল। “মাধবীলতাকে নিয়ে গ্রামের মানুষের বিশ্বাস খুব গভীর।”

শুভ্রবাবু হাসলেন। “বিশ্বাস থাকুক রমা, তাতে ক্ষতি নেই। আমরা এখানে ভূত দেখতে আসিনি, এসেছি একটি ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সামাজিক সত্য ও লোককথার উৎপত্তি জানতে। একজন অবিবাহিত মেয়ের অপঘাতে মৃত্যু, তার সম্পত্তির প্রতি আসক্তি—এগুলো মানসিক বিকার বা পরিবেশগত ভয়ের ফসল হতে পারে।”

শুভ্রবাবুরা গ্রামের বাইরে একটি পুরোনো টিনের চালার বাড়িতে আস্তানা গাড়লেন। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সেই সায়র।

প্রথম কয়েকদিন তারা দিনের বেলায় সায়র পাড়ে জরিপ চালালেন। দেখলেন, সায়রের জল এতটাই পরিষ্কার যে, নিচে মাছের আনাগোনা স্পষ্ট দেখা যায়। সত্যি, মাছের প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো। কিন্তু পুকুরের চারিদিকে এক ধরনের চাপ চাপ নীরবতা, যা সাধারণ পুকুর পাড়ের পরিবেশের সাথে মেলে না।

ষষ্ঠ দিনে শুভ্রবাবু তার মূল পরিকল্পনাটি রমাকে বললেন।

“রমা, আমরা জানি ব্রহ্মদৈত্য জ্ঞানীর কাছে আসে, কিন্তু এই পেত্নী আসে মাছচোরদের কাছে। এর মানে, তার অভিশাপ কেবল লোভী মানুষের উপর কাজ করে। আমরা তাকে দেখতে পাব না, কারণ আমরা মাছচোর নই। কিন্তু আমি তার অস্তিত্বের প্রমাণ চাই, সে যে শুধু মনের ভয় নয়, তা প্রমাণ করতে চাই।”

“কী করতে চান, স্যার?” রমা জিজ্ঞেস করল, তার চোখে সামান্য ভয়।

“মাছ চুরি! আমরা প্রতীকী মাছ চুরি করব। তবে আমরা জেলে বা লোভী মানুষ নই, আমরা গবেষক। এতে হয় সে আমাদের সামনে আসবে, অথবা তার অলৌকিক প্রভাব আমাদের গবেষণার যন্ত্রপাতি ধরতে পারবে।”

রমা দ্বিধা করল, “কিন্তু স্যার, নিধু মাঝির পরিণতি…”

“নিধু মাঝি লোভী ছিল, রমা। আমরা সৎ উদ্দেশ্যে এই কাজ করছি। আর তাছাড়া, নিধু মাঝি ছিল গরিব। আমার বিশ্বাস, এই পেত্নীর অভিশাপ শুধু লোভের ওপর নয়, ক্ষমতা আর সামাজিক বৈষম্যের ওপরেও এক প্রতিশোধ ছিল।”

পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেই রাতেই তারা সায়র পাড়ে গেলেন। রাত তখন দেড়টা। শুভ্রবাবু সায়রের পাড়ে একটি শক্তিশালী ক্যামেরা সেট করলেন যা অত্যন্ত কম আলোতেও ছবি তুলতে সক্ষম। আর রমা একটি লম্বা রশি দিয়ে, যেখানে সামান্য মাছের টোপ লাগানো ছিল, সেটা জলে ফেলল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কোনোমতে একটি মাছ ধরা, যাতে পেত্নী তাদের উপস্থিতি টের পায়।

রশি ফেলার কয়েক মিনিট পর, সায়রের পাড়ে জমাট বাঁধা নীরবতা হঠাৎ ভেঙে গেল। প্রথমে এলো একটি মিষ্টি ফুলের গন্ধ, যা মাধবীলতার কথা মনে করিয়ে দিল। এরপর সেই করুণ কান্নার সুর, যা নিধু মাঝির জীবনে অভিশাপ এনেছিল।

শুভ্রবাবু ক্যামেরার দিকে তাকালেন, রমা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন।

কান্নাটি যখন তীব্র হয়ে উঠল, তখন তারা অনুভব করলেন সায়রের জল থেকে উঠে আসা এক তীব্র, অস্বাভাবিক শীতলতা। শুভ্রবাবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বৈজ্ঞানিক যুক্তি নয়, এবার তার মনে ভয় জন্মালো।

ঠিক সেই মুহূর্তে রমা চিৎকার করে উঠল, “স্যার! রশি… রশি নড়ছে!”

রশিটি প্রচণ্ড শক্তিতে টান খাচ্ছে। রমা ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারল না। রশিটি সায়রের গভীরে টেনে নিয়ে গেল কোনো এক অদৃশ্য শক্তি। কিন্তু রমা মাছের টোপে কোনো মাছ ধরেননি। তার হাতে লেগে ছিল সেই তীব্র শীতলতার অনুভূতি।

শুভ্রবাবু দ্রুত ক্যামেরা চেক করলেন। ক্যামেরার ডিসপ্লেতে কেবল গাঢ় কালো, কিন্তু তার মাঝে কিছু সাদা, আবছা ধোঁয়ার মতো আকৃতির দ্রুত চলাচল ধরা পড়েছে। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।

তারা যখন ফিরে আসার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তখন একটা শব্দে তারা চমকে উঠলেন। শব্দটা আসছিল বটগাছটার পেছন থেকে—যেন শুকনো কাঠ ভাঙার শব্দ। শুভ্রবাবু টর্চ জ্বেলে দেখলেন, বটগাছটির নিচে একটি ছোট, পুরোনো মাটির হাঁড়ি পড়ে আছে।

“এ কী?” শুভ্রবাবু কাছে গেলেন। হাঁড়ির ভেতরে সামান্য মাটি ও একটি পুরোনো, মরচে পড়া লোহার আংটি।

রমা ফিসফিস করে বলল, “এটা… এটা কি মাধবীলতার কোনো স্মৃতি?”

শুভ্রবাবু আংটিটা হাতে নিলেন। সেটি ছিল অসম্ভব ঠান্ডা, আর হাতে নিতেই তার মনে এক অদ্ভুত কষ্ট ও অতৃপ্তির অনুভূতি জাগল, যেন কারও দীর্ঘদিনের দুঃখ তাঁর মনে প্রবেশ করেছে।

পেত্নীর আসল অভিশাপের অনুসন্ধান

পরের দিন, শুভ্রবাবু এবং রমা হাঁড়ি আর আংটি নিয়ে গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি, আশি বছরের বুড়ি কাকিমার কাছে গেলেন। কাকিমা মাধবীর সমসাময়িক ছিলেন।

কাকিমা হাঁড়ি ও আংটি দেখে কেঁদে উঠলেন। “মাধবীলতা! এ তার স্মৃতি!”

কাকিমার কাছ থেকে তারা মাধবীর আসল গল্প জানতে পারলেন। মাধবীকে কোনো মাছচোর আক্রমণ করেনি। মাধবীকে সায়রের জলে ফেলে খুন করা হয়েছিল।

“কিন্তু কে খুন করেছিল, কাকিমা?” শুভ্রবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

কাকিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তার নিজের বাগদত্তা। রথবাড়ির জমিদারপুত্র। মাধবীকে সে বিয়ে করতে চায়নি, কারণ তার উচ্চশিক্ষিত একজন মেয়ে পছন্দ ছিল। কিন্তু মাধবী ছিল জেদি। সে এই গ্রামের সায়রের মাছ বেচে বিয়ের যৌতুক জমিয়েছিল। বিয়ের আগের দিন বাগদত্তা তাকে বলে, ‘তোমার এই সামান্য মাছের পয়সার যৌতুক আমার চাই না। তোমার সায়রও তোমার থাক, আর তোমার সায়রের মাছও তোমার থাক।’ এরপর সে মাধবীকে আঘাত করে সায়রে ফেলে দেয়।”

শুভ্রবাবু চমকে উঠলেন। “আর এই হাঁড়ি আর আংটি?”

petnir mach churi 3

“এই হাঁড়িতে ছিল মাধবীর জমানো টাকা—মাছ বেচে যা পেয়েছিল। আর আংটিটা তার বিয়ের আংটি। মৃত্যুর আগে সে হাঁড়িটা বটগাছের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। তার আত্মা শান্তি পায়নি, কারণ তার লোভী বাগদত্তার কথাগুলো তাকে অপমান করেছিল। সে সায়রের মাছকে তার সম্মান ভেবেছিল, যা তাকে রক্ষা করতে হবে।”

শুভ্রবাবু এবার বুঝতে পারলেন—পেত্নীর প্রতিশোধ মাছচোরদের উপর নয়, বরং সেই লোভী মানসিকতার উপর, যারা সাধারণ মানুষের সম্পদকে তুচ্ছ করে এবং তাদের জীবন নিয়ে খেলা করে। নিধু মাঝি মাছচোর ছিল, কিন্তু আসলে সেও ছিল লোভী। পেত্নী কেবল লোভীদেরই খুঁজে বের করে।

সন্ধ্যা নামল। শুভ্রবাবু ও রমা সেই বটগাছের কাছে ফিরে এলেন।

“স্যার, মাধবীলতা তো তাহলে আসলে একজন নিরীহ আত্মার প্রতীক, যে তার নিজের শেষ অবলম্বনকে রক্ষা করতে চায়,” রমা বলল।

“ঠিক তাই, রমা। তার প্রতিশোধ মাছের ওপর নয়, লোভের ওপর। আর এখন সেই লোভটা কেবল অর্থ বা মাছের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এখনকার লোভ আরও সূক্ষ্ম। এখন আমরা কী করব?”

শুভ্রবাবু পকেট থেকে সেই মরচে পড়া আংটিটি বের করলেন। “মাধবীকে মুক্তি দিতে হবে। এই আংটি ও তার জমানো পুঁজি ছিল তার শেষ আশা, যা তাকে অপমানের প্রতিশোধ নিতে বাধা দিচ্ছিল।”

শুভ্রবাবু সায়রের পাড়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন। তিনি আংটিটা সায়রের জলের কাছে নিয়ে গেলেন।

“মাধবীলতা,” শুভ্রবাবু শান্ত স্বরে ডাকলেন। “আমরা জানি তুমি কেন শান্তি পাওনি। তোমার প্রতি হওয়া অন্যায়ের আমরা সাক্ষী। তোমার শেষ সম্বল আর তোমার অপমান, দুটোই আমরা সম্মান করি। এবার তুমি মুক্ত হও।”

তিনি আংটিটি জলে ফেলে দিলেন। ছোট একটি ‘ঝপাং’ শব্দ হলো।

ঠিক তখনই, বটগাছের ডাল থেকে এক প্রচণ্ড দমকা বাতাস এলো। বাতাসের সাথে মিশে এলো সেই করুণ কান্নার সুর, কিন্তু এবার তাতে কোনো ক্রোধ ছিল না, ছিল গভীর বেদনা আর কষ্টের এক শেষ রেশ।

প্রতিশোধের নতুন রূপ

শুভ্রবাবু এবং রমা সায়রের পাড়ে বসেছিলেন অনেকক্ষণ। চারদিক শান্ত হয়ে এলো। কান্নার সুর থেমে গেছে। তাদের মনে হলো, মাধবীর আত্মা বুঝি এবার মুক্তি পেল।

কিন্তু শুভ্রবাবু জানেন, লোককথার আত্মা এত সহজে মুক্তি পায় না।

হঠাৎ, রমা চাপা স্বরে চিৎকার করে উঠল, “স্যার! দেখুন!”

শুভ্রবাবু তাকালেন। সায়রের স্থির জলে একটি মাছ, বিশাল রুই মাছ, উল্টো হয়ে ভেসে উঠেছে। মাছটির সারা শরীরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু তাতে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।

শুভ্রবাবু দেখলেন, জলের নিচে মাছের ছায়াগুলো যেন আরও অস্থির হয়ে উঠেছে।

“মুক্তি পায়নি, রমা,” শুভ্রবাবু ফিসফিস করে বললেন। “শুধু তার প্রতিশোধের ধরণ বদলে গেছে। সে এখন শুধু মাছচোরদের নয়, লোভী সমাজের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়।”

তিনি পুঁথি ঘেঁটে জানতে পেরেছিলেন, অপঘাতে মৃত ব্রাহ্মণের বা কুমারী আত্মার শক্তি কেবল তার মৃত্যুর কারণের সঙ্গেই যুক্ত থাকে না, বরং তার জীবনের অপূর্ণ বাসনা এবং শেষ অভিশাপের সঙ্গেই মিশে থাকে। মাধবীলতার শেষ অভিশাপ ছিল: “আমার সম্বল যারা কেড়ে নেবে, তাদের ঘর শূন্য হবে।”

পরের দিন সকালে গ্রামে এক ভয়াবহ খবর ছড়িয়ে পড়ল। রথবাড়ির বর্তমান জমিদারপুত্র, যিনি দেশের বাইরে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন, আগের রাতেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় সব হারিয়েছেন। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট শূন্য, ব্যবসা তলানিতে, এবং সে নিজেই পঙ্গু হয়ে দেশে ফিরছেন।

গ্রামের মানুষজন শিউরে উঠল। তাদের মনে হলো, মাধবীলতা তার প্রতিশোধের পালা শেষ করেছে। কিন্তু শুভ্রবাবু বুঝতে পারলেন, এটা কেবল শুরু। মাধবীর প্রতিশোধের দৃষ্টি এখন আর শুধু মাছচোর বা রথবাড়ির দিকে নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা সমাজের সেইসব মানুষদের ওপর, যারা লোভকে প্রশ্রয় দেয়।

শুভ্রবাবু রমাকে বললেন, “মাধবী শুধু তার অপমান আর পুঁজির প্রতিশোধ নিতে চায়নি। সে চেয়েছিল তার সম্মান। আর সে এখন তার প্রতিশোধের ক্ষেত্র বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পুকুর তার আশ্রয় নয়, তার অভিশাপের উৎস।”

petnir mach churi 5

তারা সেই বটগাছের কাছে ফিরে গেলেন। মাটির হাঁড়িটা এখনো সেখানে পড়ে ছিল, কিন্তু ভেতরে কোনো মাটি বা আংটি ছিল না। শুভ্রবাবু খেয়াল করলেন, হাঁড়ির ভেতরের অংশে পুরোনো কয়লার মতো কিছু দিয়ে কিছু লেখা রয়েছে।

শুভ্রবাবু সেটা দেখলেন। লেখা ছিল: “লোভীর গৃহ রিক্ত হবে, জ্ঞানীর সম্মান অক্ষত রবে।”

এই ছিল মাধবীর অভিশাপের শেষ বাক্য। সে কেবল লোভীদেরই শিকার করবে, যারা সম্পদ কুক্ষিগত করে। আর এই ব্রহ্মদৈত্যের গল্পের মতো, যারা সৎ ও জ্ঞানী—তাদের সে কখনো আক্রমণ করবে না।

সমাপ্তি এবং চিরন্তন সত্য

শুভ্রবাবু ও রমা নিশ্চিন্দিপুরে আরও কয়েক দিন থাকলেন। তারা দেখলেন, গ্রামের যারা প্রকৃত অর্থে গরিব ও সৎ, তারা সায়রের মাছ ধরে দিব্যি জীবিকা নির্বাহ করছে। কিন্তু যারা ধনী, লোভী বা অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করত, তাদের জীবনে কোনো না কোনো বিপর্যয় নেমে আসছে। কারো ব্যবসায় লোকসান, কারো বা স্বাস্থ্যের চরম অবনতি।

মাধবীলতার পেত্নী এখন আর কেবল সায়রের মাছ চুরি বা প্রতিশোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সে পরিণত হয়েছে এক অদৃশ্য সামাজিক ন্যায়ের শক্তিতে, যা লোভী এবং অসৎদের শাস্তি দেয়। তার অভিশাপ এখন গ্রামটিকে রক্ষা করছে, এক ভয়ানক উপায়ে।

একদিন মাঝরাতে, শুভ্রবাবু লাইট বন্ধ করে সায়রের পাড়ে বসেছিলেন। তিনি তার ল্যাপটপে তার গবেষণার রিপোর্ট লিখছিলেন। আকাশে চাঁদ ছিল না, চারপাশে শুধু শেয়ালের ডাক।

হঠাৎ, তার মনে হলো, কেউ যেন ঠিক তার পেছনে নিঃশ্বাস ফেলছে। বাতাস ঠান্ডা হয়ে গেল, আর সেই মিষ্টি ফুলের গন্ধটা আবার ভেসে এলো।

শুভ্রবাবু পিছন ফিরে তাকালেন। বটগাছের ছায়ায়, সাদা শাড়ি পরা একটি আবছা মানবাকৃতি। কিন্তু এবার সেই মূর্তির চোখ জোনাকির মতো জ্বলে উঠছে না। সে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

শুভ্রবাবু স্থির হয়ে বসে রইলেন। তিনি জানতেন, মাধবী তাকে ভয় দেখাতে আসেনি।

দীর্ঘ নীরবতার পর, একটি ক্ষীণ, প্রায় বাতাসের ফিসফিসানির মতো শব্দ শোনা গেল, “তুমি জ্ঞানী… তুমি লোভী নও… তোমার প্রয়োজন নেই… ভয় পেও না… তুমি মুক্ত…”

শুভ্রবাবু উত্তর দিলেন, “আমি ভয় পাই না, মাধবী। আমি কেবল সত্যকে জানতে চেয়েছিলাম।”

উত্তর শুনে মূর্তিটি ধীরে ধীরে বাতাসের সাথে মিশে গেল। কেবল তার ছেড়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাস শুভ্রবাবুকে ছুঁয়ে গেল।

পরের দিন সকালে, শুভ্রবাবু এবং রমা নিশ্চিন্দিপুর ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিলেন। রমা জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আপনি কি এই পেত্নীর কথা রিপোর্টে লিখবেন?”

শুভ্রবাবু হেসে বললেন, “আমি লিখব, রমা। তবে কেবল ‘ভূতের গল্প’ হিসেবে নয়। আমি লিখব, কিভাবে মানুষ তার সামাজিক অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে কিংবদন্তী ও অলৌকিকতাকে ব্যবহার করে। আমি লিখব, কিভাবে একটি অপঘাতে মৃত কুমারী আত্মা তার লোভী সমাজকে শাস্তি দিতে এবং তার আত্মসম্মান ফিরিয়ে আনতে এক চিরন্তন অভিশাপে পরিণত হলো।”

মাধবীলতার গল্প হয়তো শুধু একটি ভূতের গল্প নয়। এটি ছিল একটি গভীর সামাজিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যা মৃত্যুর পরেও মুক্তি পেতে চায়নি। পেত্নীর মাছ চুরি ও প্রতিশোধের গল্পটি ছিল আসলে সমাজের লোভের প্রতি এক নীরব ও ভয়ানক প্রতিবাদ। আর সায়রের জল এখনও স্থির। মাছের প্রাচুর্য এখনও সেখানে বিদ্যমান। কারণ, পেত্নী এখন শুধু লোভী সমাজের প্রতীক্ষায় আছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *