প্রিয়তমা

“প্রিয়তমা” – Part 2

বিচ্ছেদ

ভালোবাসা যত গভীর হয়, বিচ্ছেদের ভয় ততটাই তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
রণজয় আর মেঘলার দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতো কেটে যাচ্ছিল।
সকাল মানে মেঘলার হাসি, বিকেল মানে দু’জনের আড্ডা, আর সন্ধ্যা মানে একে অপরের কণ্ঠে মিশে থাকা ক্লান্তির মিষ্টি সুর।

কিন্তু কেউ জানত না—সময় নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে, তাদের প্রিয়তমা গল্পে এক অপ্রত্যাশিত মোড় নিয়ে।

সেই দিনটা ছিল ডিসেম্বরের এক ঠান্ডা সকাল।
কলেজের শেষ সেমেস্টারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে আগেই।
রণজয় ক্যান্টিনে বসে গরম চা খাচ্ছিল, হঠাৎ মেঘলা দৌড়ে এলো—মুখে উদ্বেগ, চোখে জল।

“রণজয়… বাবা ট্রান্সফার হয়ে গেছেন। আগামী সপ্তাহেই আমাদের দিল্লি যেতে হবে।”

রণজয়ের হাত থেকে কাপটা পড়ে গেল, গরম চা টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।
কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিল না।
“মানে? এত তাড়াতাড়ি?”

মেঘলা মাথা নিচু করল, “চেষ্টা করেছি থামাতে, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না।”

ওদের মাঝে যেন হঠাৎই এক অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে গেল।
একদিকে বাস্তবতা, অন্যদিকে ভালোবাসা।

রণজয় চুপচাপ তাকিয়ে থাকল ওর দিকে।
বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না।
মেঘলার চোখে জল চিকচিক করছে, ঠোঁট কাঁপছে।

“তুমি জানো, আমি থাকতে চাই… কিন্তু পারছি না,” বলল মেঘলা।
রণজয়ের গলায় আটকে গেল শব্দ, “তাহলে?”
“তাহলে আমরা কি…?”
ওর বাক্যটা শেষ হলো না।

বাতাস ভারী হয়ে উঠল, চারপাশ নিস্তব্ধ।
টেবিলের ওপর পড়ে থাকা কফির দাগটা যেন ওদের সম্পর্কেরই প্রতীক—একটা অদ্ভুত দাগ, যা হয়তো মুছবে না, আবার আগের মতোও থাকবে না।

বিদায়ের দিনটা এলো অদ্ভুত তাড়াহুড়োয়।
কলকাতার হাওড়া স্টেশন—ভিড়, ধোঁয়া, হুইসেল, হুল্লোড়।
কিন্তু রণজয় আর মেঘলার চোখে কেবল নীরবতা।

ট্রেন ছাড়ার আগে মেঘলা বলল,
“আমি চিঠি লিখব, ফোন করব, তুমি রাগ করবে না।”
রণজয় মৃদু মাথা নেড়ে বলল, “আমি রাগ করতে পারি না তোমার ওপর প্রিয়তমা।”

priyotoma 5

একটু থেমে ওর কণ্ঠ নরম হয়ে এলো,
“তুমি আমার গল্পের শেষ লাইন, মেঘলা।
ভুলে থাকা সম্ভব নয়… আর যদি কখনো ভুলেও যাই, সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় শাস্তি।”

মেঘলা হেসে ফেলল, সেই হাসিতে ছিল কান্না, ছিল ভালোবাসা, ছিল এক অদ্ভুত শান্তি।
ট্রেনের ইঞ্জিন তখন সিটি দিচ্ছে, প্ল্যাটফর্ম কাঁপছে।
ও বলল, “আমায় প্রতিশ্রুতি দাও, তুমি লিখবে।”

রণজয় উত্তর দিল না। শুধু বলল,
“আমি লিখব, যতদিন বাঁচব। আর প্রতিটা লেখার নাম হবে—প্রিয়তমা।”

ট্রেন চলতে শুরু করল।
হাওয়ায় উড়ে গেল মেঘলার শাড়ির আঁচল, রণজয়ের মুখে লাগল একফোঁটা চোখের জল।
ওর বুকের ভেতরটা যেন শূন্য হয়ে গেল।

তারপর অনেক দিন কেটে গেল।
রণজয় কলেজ শেষ করল, চাকরি পেল, জীবনের ব্যস্ততায় ডুবে গেল।
কিন্তু প্রতিদিন রাতে ডেস্কের ওপর রাখত সেই নীল কভার দেওয়া নোটবুকটা—যেটা একদিন মেঘলাকে দিয়েছিল।
ওর লেখা কবিতার শেষ পাতায় একটা লাইন লেখা ছিল—

“তুমি ফিরে আসবে, আমি জানি।”

কখনো কখনো হঠাৎ হাওয়ায় মেঘলার গন্ধ ভেসে আসে মনে হয়,
কখনো হঠাৎ ট্রামে কারো হাসি শুনে মনে হয়, “এটা ও-ই।”
কিন্তু পিছন ফিরে তাকালে থাকে শুধু ফাঁকা রাস্তা, আর অদৃশ্য স্মৃতি

রণজয় এখন কবিতা লেখে পেশাদারভাবে।
ওর লেখা ছাপা হয়, মানুষ ভালোবাসে, কিন্তু ওর কাছে সব কবিতাই এক—সবই মেঘলার গল্প।

কখনো কখনো কেউ জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি কাউকে ভালোবেসেছিলে?”
রণজয় মৃদু হাসে, চোখ নামিয়ে বলে,
“একজন ছিল… আমার প্রিয়তমা।”

🌧️ বিচ্ছেদ কখনও সম্পর্ক ভাঙে না, শুধু তাকে অদৃশ্য করে দেয়।
যারা সত্যিই ভালোবাসে, তারা হারিয়েও থেকে যায় — হৃদয়ের গভীরে, শব্দের মাঝে, নীরবতার ভেতর।

প্রত্যাবর্তন

বহু বছর পেরিয়ে গেছে।
কলকাতার হাওয়ায় এখন একটু ধোঁয়া, একটু একঘেয়েমি, আর অনেকটা একাকিত্ব মিশে আছে।
রণজয় এখন একজন প্রতিষ্ঠিত কবি।
ওর বইয়ের নাম “প্রিয়তমা” — হ্যাঁ, সেই নামটাই, যা একদিন স্টেশনে মেঘলাকে বলেছিল।

প্রতিদিন ওর বইমেলায় মানুষ আসে, হাততালি দেয়, অটোগ্রাফ চায়।
কিন্তু রণজয়ের চোখ খোঁজে কেবল একজনকেই — মেঘলা।
যে একদিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, “চিঠি লিখব…”
কিন্তু সেই চিঠি আর আসেনি।

এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা

সেই দিনও ঠিক আগের মতোই বৃষ্টি হচ্ছিল।
রণজয় কফি হাউসের কোণে বসে ছিল, সামনে ধোঁয়া ওঠা কাপ, পাশে পুরনো ডায়েরি।
হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ—
“তুমি এখনও চা খাও এত আস্তে?”

bristi veja chithi 4

রণজয় চমকে তাকাল।
সামনে দাঁড়িয়ে মেঘলা।
একই চোখ, একই হাসি, শুধু সময় একটু ছাপ ফেলেছে।

মুহূর্তের জন্য রণজয় বিশ্বাসই করতে পারছিল না।
কত বছর পরে দেখা, অথচ মনে হলো—কালই তো কথা হয়েছিল শেষবার!

🌧️ স্মৃতির ভেতর ভেজা

“তুমি… কবে এলে?”
রণজয়ের গলা কাঁপছিল।

“দিল্লি থেকে ফিরেছি কিছুদিন হলো।
বাবা রিটায়ার করেছেন।
তোমার বই পড়েছি, জানো?
প্রতিটা কবিতায় আমি ছিলাম…”

রণজয় হেসে বলল,
“তুমি তো ছিলে সবখানেই।
শুধু আমি জানতাম না, তুমি ফিরে আসবে কি না।”

মেঘলা জানালার বাইরে তাকাল—বৃষ্টি পড়ছে কাঁচে কাঁচে।
“জীবনটা অনেক গোলমেলে হয়ে গেল, রণজয়।
অনেক কিছু হারিয়েছি… কিন্তু একটা জিনিস আজও অটুট—তুমি।”

রণজয়ের চোখে জল চলে এলো।
ও বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভুলে গেছ।”
মেঘলা মৃদু হেসে বলল,
“ভালোবাসা কি ভুলে থাকা যায়?
ভুলে থাকলে তোমার কবিতায় আমার নাম থাকত না।”

✉️ অপ্রেরিত চিঠি

মেঘলা ব্যাগ থেকে একটা পুরনো খাম বের করল।
“এটা ছিল আমার লেখা প্রথম চিঠি তোমার জন্য।
লিখেছিলাম ট্রেনে বসে, কলকাতা ছাড়ার সময়।
কিন্তু পাঠাতে পারিনি।
আজ দিতে এলাম।”

রণজয় কাঁপা হাতে খামটা নিল।
ওর চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
চিঠিটা খুলে দেখল—

“রণজয়,
যদি কোনোদিন তোমার কবিতায় আমায় পাও,
জেনে নিও—আমি ঠিক আছি।
আর যদি কোনোদিন আমার নামটা আর না লেখো,
তবুও জানবে—আমি তোমায় ভালোবেসেই গেছি।”

রণজয়ের ঠোঁটে একটুকরো হাসি ফুটল।
“তুমি জানো, আমি কখনোই তোমার নাম লেখা থামাইনি।”

❤️ শেষ দৃশ্য

কফি হাউস বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এলো।
বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলো।
দু’জন হাঁটছিল ধীরে ধীরে।

মেঘলা বলল,
“তুমি জানো, আমি আজও তোমার বই পড়লে কাঁদি।”
রণজয় বলল,
“তুমি জানো, আমি আজও প্রতিদিন তোমার নাম লিখে ঘুমাই।”

ওরা থামল রাস্তার মোড়ে।
বৃষ্টির গন্ধে ভরে আছে চারদিক।
মেঘলা হাত বাড়িয়ে বলল,
“চল, আবার শুরু করি?”

priyotoma 6

রণজয় কিছু বলল না—
শুধু ওর হাত ধরল, মুঠোয় শক্ত করে।
চোখে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

“গল্পটা শেষ হয়নি মেঘলা,
শুধু নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে—
প্রিয়তমা – প্রত্যাবর্তন।”

🌧️ শেষ কথা:
ভালোবাসা হারায় না,
সে শুধু অপেক্ষা করে সঠিক সময়ের জন্য।
কখনো বৃষ্টির ফোঁটায়, কখনো চিঠির পাতায়,
আর কখনো এক পুরনো কফির গন্ধে ফিরে আসে—
প্রিয়তমা নাম নিয়ে। ❤️

পুনরায় ভালোবাসা

(ভালোবাসার নতুন ভোর — যেখানে পুরনো হৃদয় নতুন করে স্পন্দিত হয়)

বৃষ্টি থেমে গেছে।
কলকাতার রাস্তাগুলো ভিজে চকচক করছে।
ল্যাম্পপোস্টের নিচে হাঁটছে দু’জন মানুষ — রণজয় আর মেঘলা
তাদের ছায়া জড়িয়ে আছে একে অপরের সঙ্গে, যেন সময়ও থেমে গেছে তাদের জন্য।

রণজয় বলল,
“তুমি জানো, আমি ভাবতাম ভালোবাসা একবার ভাঙলে আর গড়া যায় না।”

মেঘলা হেসে বলল,
“তুমি কবি হয়েও জানো না, কিছু জিনিস ভাঙলে আরও সুন্দর হয়ে ওঠে?”

রণজয় থেমে গেল।
“যেমন?”

মেঘলা তাকাল তার দিকে, চোখে নরম আলো—
“যেমন একটা হৃদয়, যে একবার হারিয়েছে, সে জানে কাকে ধরে রাখতে হয়।”

ওদের কথার মধ্যে নিঃশব্দে বইছে হাওয়া,
বৃষ্টির গন্ধে ভরে আছে চারপাশ।
মেঘলা হাত বাড়িয়ে ধরল রণজয়ের হাত।
সেই স্পর্শে যেন সময় উল্টে গেল তিন বছর পিছনে —
যেখানে ছিল শুধু দু’জন, আর একখণ্ড আকাশ।

নতুন শুরু

পরদিন সকালে তারা দেখা করল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে।
সাদা মার্বেলের পেছনে ছায়া ছায়া আলো, হালকা কুয়াশা।
রণজয় সঙ্গে এনেছিল একটা ছোট খাম।

মেঘলা জিজ্ঞেস করল,
“এটা কী?”

রণজয় বলল,
“আমার শেষ বইয়ের শেষ কবিতাটা…
তোমার জন্য।”

মেঘলা খুলে পড়ল—

‘যদি ফিরে আসো, বৃষ্টি হয়ে এসো,
আমার শূন্য পৃষ্ঠায় শব্দ হয়ে ভিজো,
আমি লিখব শুধু এক নাম—
প্রিয়তমা।’

মেঘলার চোখে জল জমে উঠল।
সে মৃদু স্বরে বলল,
“রণজয়, আমি এবার কোথাও যাচ্ছি না।
আমার ঘর তোমার পাশে।”

রণজয় হেসে বলল,
“তাহলে এবার সত্যি লেখাটা শুরু হলো।”

একসাথে থাকা

দিন কেটে যায়, সময় এগোয়, কিন্তু এবার তারা আলাদা হয় না।
রণজয়ের কবিতা আর মেঘলার হাসি একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে।
তারা ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নেয় গড়িয়াহাটের কাছে —
দু’জনের বই, গাছ, কফি আর সন্ধ্যার গল্পে ভরে ওঠে ঘরটা।

মেঘলা এখন রণজয়ের কবিতার সম্পাদক।
ও বলে, “প্রতি শব্দে আমি তোমায় দেখি।”
রণজয় হেসে বলে, “আর আমি প্রতিটা বাক্যে তোমায় রাখি।”

তাদের সম্পর্ক আর আবেগের মধ্যে এখন কোনো ভয় নেই—
শুধু এক নিঃশব্দ নিশ্চয়তা,
যে ভালোবাসা একদিন হারিয়ে গিয়েছিল,
আজ আবার ফিরে এসেছে নিজের ঠিকানায়।

❤️ শেষ দৃশ্য

একদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল তারা।
আকাশে হালকা রোদ, আর দূরে উড়ছে পাখিরা।

মেঘলা বলল,
“তুমি জানো, আমি মাঝে মাঝে ভাবি—
আমাদের গল্পটা যদি মাঝপথে শেষ হয়ে যেত?”

রণজয় তার দিকে তাকাল।
“তাহলে আমি লিখতাম— ‘অসমাপ্ত প্রিয়তমা’।”

মেঘলা হেসে বলল,
“আর এখন?”

রণজয় মৃদু স্বরে বলল,
“এখন লিখব— ‘চিরন্তন প্রিয়তমা’।”

দু’জন চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।
আকাশে তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে,
আর বাতাসে বাজছে এক অদ্ভুত সুর—
ভালোবাসার, পুনর্জন্মের, আর অনন্ততার।

প্রিয়তমা

ভালোবাসা কখনও মরে না,
সে শুধু অপেক্ষা করে সঠিক সময়ের জন্য।
যখন দুটো হৃদয় আবার একসাথে স্পন্দিত হয়,
তখনই শুরু হয় জীবনের আসল গল্প—
“পুনরায় ভালোবাসা” 💞

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *