“লাস্ট সিন অনলি”
নীল টিকের ওপারে
রিয়া আর আরিয়ান—দু’জনের দেখা হয়েছিল একেবারে হঠাৎ।
একটা অনলাইন বুক রিডিং ক্লাবে, যেখানে নাম-পরিচয় নয়, mattered শুধু বইয়ের প্রতি ভালোবাসা। প্রথমে তারা কেবল বই নিয়ে কথা বলত— কে কোন লেখক পছন্দ করে, কে কোন চরিত্রে নিজেকে খুঁজে পায়। তারপর ধীরে ধীরে আলোচনার বাইরে চলে গেল কথাবার্তা—রাত্রির শেষ মেসেজ, সকালের শুভেচ্ছা, দিনের ছোটখাটো খবর।
রিয়া কখনও ভাবেনি যে একটা স্ক্রিনের ওপাশের মানুষ এতটা কাছের হয়ে উঠতে পারে। আরিয়ান ছিল অন্যরকম—চুপচাপ, মাপা কথা, কিন্তু প্রতিটা শব্দে যেন যত্ন। মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে “typing…” উঠলে রিয়ার বুক কেঁপে উঠত। ও জানত, ওদিকে কেউ একমুঠো সময় নিয়ে ঠিক করছে কীভাবে উত্তর দেবে।
ধীরে ধীরে দিন গড়ালো। “Good morning” থেকে “Good night” পর্যন্ত তারা দু’জন একে অপরের ছায়া হয়ে উঠল। কোনো দাবি ছিল না, ছিল শুধু উপস্থিতি। রিয়া প্রায়ই অবাক হতো—একটা নাম, একটা প্রোফাইল ছবি, একটা নীল টিক , একটা লাস্ট সিন —এইটুকুর মধ্যেই কীভাবে এত গভীর বন্ধন তৈরি হয়!
তারপর একদিন, খুব সাধারণ একটা দুপুরে, আরিয়ান হঠাৎ লিখল—
“I’ll text you soon.”
রিয়া ভেবেছিল, হয়তো অফিসের চাপ, হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যা। অপেক্ষা করতে দোষ কোথায়?
কিন্তু দিন গেল, রাত গেল, নতুন কোনো মেসেজ এল না।
প্রথমে ও প্রতিদিন মোবাইল আনলক করে দেখত—শেষ চ্যাটটা ঠিক সেই জায়গায় থেমে আছে। তারপর দেখতে শিখল ‘লাস্ট সিন’। প্রথমদিকে লেখা থাকত—2 minutes ago, তারপর লাস্ট সিন yesterday, পরে লাস্ট সিন two days ago। ধীরে ধীরে রিয়া বুঝল, এই ‘লাস্ট সিন’ই যেন একটা সম্পর্কের মৃত্যুর তারিখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবু ও চ্যাটটা ডিলিট করেনি। মাঝে মাঝে খুলে দেখত—পুরোনো কথাগুলো, ইমোজিগুলো, ছোটখাটো ঠাট্টা, অকারণ হাসি। একটা সময় বুঝল, মানুষ হারিয়ে গেলেও ‘চ্যাট হিস্ট্রি’ মুছে ফেলা যায় না। ও যেন নিজেরই এক অংশ হয়ে গেছে।
রাতের নীরবতায় মোবাইলের স্ক্রিনে সেই নীল টিক দুটো জ্বলজ্বল করত—যেন দুটি চোখ তাকিয়ে আছে, কিন্তু কিছুই বলছে না।
রিয়া একদিন নোটিফিকেশন অফ করে দিল। ভাবল, হয়তো এতে মন শান্ত হবে। কিন্তু যখনই কেউ “typing…” করত, ওর চোখ খুঁজত—আরিয়ান?

মাস পেরিয়ে বছর গেল। ‘লাস্ট সিন’ ধীরে ধীরে রুটিনের অংশ হয়ে গেল—যেন একটা পুরোনো দেয়ালঘড়ি, যার টিকটিক শব্দ থেমে গেছে কিন্তু দেয়ালে এখনো ঝুলে আছে।
তিন বছর পর, এক সন্ধ্যায়, রিয়া ফোনটা হাতে নিল হঠাৎ করেই। হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই। হোয়াটসঅ্যাপ খুলতেই চোখ আটকে গেল—
সেই পুরোনো নামটা এখন আবার “Online.”
স্ক্রিনে এক মুহূর্ত আলো ঝলমল করল। বুকের ভেতর অচেনা ধকধক।
তিন বছর ধরে নীরব থাকা নামটা ফিরে এসেছে অনলাইনে।
কিন্তু এখন প্রশ্নটা একটাই—
কথা হবে তো?
নাকি আবার সেই নীল টিকের ওপারেই থেমে যাবে সব?
নীরব নোটিফিকেশন
রিয়া সারারাত ঘুমাতে পারেনি।
সেই এক শব্দ—“Online”—মাথার ভেতর বারবার বাজছিল।
তিন বছর পর, এমন এক সময়ে, যখন সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, ঠিক তখনই ও ফিরে এল… না, বলা ভালো, তার নামটা ফিরল স্ক্রিনে।
রিয়া জানত না কী করবে। মেসেজ করবে?
না হয়তো ওর জীবনে এখন অন্য কেউ আছে।
হয়তো ও এখন হাসছে, গল্প করছে, কাউকে বলছে—“পুরোনো চ্যাটগুলো ডিলিট করিনি শুধু অভ্যেসে।”
এইসব ভাবনা ভর করে বসেছিল রিয়ার ঘুমহীন রাতগুলোতে।
ফোনটা মাথার পাশে রেখে শুয়ে থাকত। চোখের পাতা নামলেই মনে হতো—হয়তো এখন ‘typing…’ উঠছে, কিন্তু ও দেখছে না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ ছিল হোয়াটসঅ্যাপ খোলা। কিন্তু স্ক্রিনে সবসময় সেই একই নীরবতা। কোনো নোটিফিকেশন নেই, কোনো পিং নেই—শুধু একটা সবুজ বৃত্ত, যার ভেতর শূন্য আলো।
রিয়া ঠিক মনে করতে পারে না, কবে থেকে নোটিফিকেশনের শব্দটা এত পরিচিত, তবু এত কষ্টের হয়ে উঠল।
আগে প্রতিবার ফোন ভাইব্রেট করলেই মনে হতো, “আরিয়ান?”
এখন প্রতিবার ভাইব্রেট করলেই মনে হয়, “না, অন্য কেউ।”
সে নিজের জীবন এগিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে।
নতুন বন্ধুত্ব, অফিস, কফিশপে হাসাহাসি, নতুন বইয়ের গন্ধ।
কিন্তু কোথাও না কোথাও, প্রতিদিনের রুটিনের মাঝে, একটা ছোট্ট জায়গায় সে আজও অপেক্ষা করে—সেই এক নোটিফিকেশনের।
একদিন অফিসে কাজ করতে করতে রিয়া হঠাৎ দেখে, স্ক্রিনে একটা ছোট্ট ছায়া নড়ে উঠল—
typing…
হৃদপিণ্ড থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য।
ও কি ফিরেছে? তিন বছর পর, হঠাৎ?
কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেটা মিলিয়ে গেল। কোনো শব্দ নেই, কোনো মেসেজও না।
রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল—হয়তো ভুলে গেছে ও, হয়তো কারও সঙ্গে অন্য কথোপকথন শুরু করেছে, অথবা হয়তো ভয় পেয়েছে, ঠিক যেমন সে পায়।
তবু সেদিন রাতে, রিয়া সেই পুরোনো চ্যাটটা খুলে আবার পড়ে।
সেই “I’ll text you soon.”—
মনে হয় যেন শব্দগুলো আজও বেঁচে আছে, কেবল পাঠক নেই।
ও এক মুহূর্তের জন্য টাইপ করতে শুরু করে—
“You’re online…”
তারপর আবার মুছে ফেলে।
না, কোনো শব্দই যথেষ্ট নয় এই তিন বছরের নীরবতার জন্য।

চ্যাটবক্স বন্ধ করার আগে সে শুধু একবার প্রোফাইলটা দেখে নেয়।
নতুন কোনো ছবি নেই। শুধু সেই পুরোনো ভ্রমণের ছবি—নীল আকাশ, পাহাড়, হাসিমুখের এক মানুষ।
রিয়ার মনে হয়, সেই হাসির মধ্যে এখনো একটু আলো বাকি আছে, যেটা তাকে প্রতিদিনের মতো আবার টেনে রাখে জীবনের এপারে।
রাতের দিকে ফোনটা নিজের থেকে দূরে রাখে রিয়া, কিন্তু মন রাখতে পারে না।
প্রতিবার চোখ বন্ধ করলে স্ক্রিনটা ভেসে ওঠে—Online… typing… লাস্ট সিন…
এই তিনটি শব্দই এখন তার জীবনের নতুন কবিতা হয়ে গেছে।
আর পরের দিন সকালে, সূর্যের আলোয় চোখ মেলেই রিয়া প্রথমে ফোনটা তুলে দেখে—
ও অনলাইন নেই।
আবার সেই পুরোনো নীরবতা।
শুধু একটা নাম, আর নিচে লেখা—
লাস্ট সিন today at 2:14 AM.
রিয়া ধীরে ধীরে হাসে, খুব মৃদু, খুব অস্পষ্টভাবে—
যেন নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেয়,
“হয়তো কোনোদিন, হঠাৎ, সেই নোটিফিকেশনটা আবার আসবেই…”
টাইপিং…
তিন বছর নীরব থাকার পর, সেই এক মুহূর্তেই আবার কিছু বদলে গেল।
রিয়া তখন একদম সাধারণ এক বিকেল কাটাচ্ছিল—চা, একটা বই, আর জানলার ধারে নরম রোদ। ফোনে অচেনা একটা পিং।
অজান্তেই চোখ গেল হোয়াটসঅ্যাপে।
আর হঠাৎ… সেই নামটা—আরিয়ান।
স্ক্রিনে ছোট ছোট অক্ষরে ভেসে উঠল—
“typing…”
রিয়ার বুক কেঁপে উঠল।
এই তিন বছর ধরে ঠিক এই শব্দটার জন্যই তো সে অপেক্ষা করেছিল।
এত ছোট একটা শব্দ, অথচ তার ভেতর কত ইতিহাস, কত অসমাপ্ত কথা!
কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই সেটি মিলিয়ে গেল।
কোনো মেসেজ নেই, কোনো ইমোজি নেই।
শুধু নীরবতা, যেন কারও সাহস ফুরিয়ে গেছে।
রিয়া অনেকক্ষণ চেয়ে রইল সেই খালি স্ক্রিনের দিকে।
মনে মনে ভাবল—
“ওরও কি এমন হয়? টাইপ করতে গিয়ে হাত থেমে যায়?”
কী লিখবে ও এখন—“Hi”? “After so long”? নাকি “কেমন আছো”?
এমন কিছুই নেই যা যথেষ্ট হবে তিন বছরের নীরবতা ভাঙার জন্য।
রিয়া এবার নিজেই ফোনটা নামিয়ে রাখল। ভাবল, হয়তো এটা কোনো ভুল, হয়তো ও অন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভুল করে খুলেছিল পুরোনো চ্যাটটা।
কিন্তু মন মানল না।
মন বলল, “না, ও জানত। জানত আমি এখনো আছি।”
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শহরের আলো জ্বলতে শুরু করল। রিয়া ছাদে গিয়ে বসে রইল। আকাশে একটা তারা জ্বলছিল একটানা।
তখনই আবার ফোনটা ভাইব্রেট করল।
স্ক্রিনে লেখা—
Ariaan: “Hey…”
রিয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
তিন বছর ধরে যে শব্দের জন্য অপেক্ষা, সেটাই ফিরে এসেছে, এতটা স্বাভাবিকভাবে!
তবু আঙুলের নিচে কীবোর্ডে টাইপ করল না কিছু।
ওর ভেতরে রাগ, অভিমান, আনন্দ—সব একসঙ্গে লড়ছে।
শেষমেশ, ও শুধু লিখল—
“Hey.”
এরপর একটানা কিছুক্ষণ দু’পাশেই দেখা গেল শুধু—“typing…”,
আবার থেমে গেল।
যেন এক নীরব দ্বিধা, কার আগে কে বলবে কী।
আরিয়ান অবশেষে লিখল—
“Sorry, I disappeared.”
তারপর একটা লম্বা গ্যাপ, তারপর—
“I didn’t mean to.”
রিয়ার চোখে হালকা জল চলে এলো।
ওর ভেতর হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু কোনোটা করল না।
বরং ও লিখল—
“You said you’d text me soon.”
স্ক্রিনে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর আবার “typing…” উঠল।
মনে হচ্ছিল, প্রতিটা অক্ষর যেন সময়ের ভারে চাপা পড়ছে।
“I couldn’t. Life got messy. I thought I’d come back when things were better… but time just kept running.”
রিয়া চুপ করে রইল।
এমন উত্তর কেউ পেতে চায় না, কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল—এই কথাটাই হয়তো সত্যি।
তিন বছর, একটা ছোট্ট বাক্যে মিটে গেল।
ওর আঙুল নিজে থেকেই লিখল—
“It’s okay. I stopped waiting… kind of.”
স্ক্রিনে আরিয়ান আবার টাইপ করল কিছুক্ষণ।
“I saw your last post. You looked happy. I wasn’t sure if I should text.”
রিয়া বুঝতে পারল—এই “typing…” আর সেই “last seen” এর মধ্যে একটা পুরো জীবন কেটে গেছে।
ও হাসল। খুব নরমভাবে।
“You could’ve, anytime.”
তারপর দু’জনেই চুপ।
দীর্ঘ সময় কোনো কথা নেই, শুধু স্ক্রিনে ঝলমল করে সেই নীল টিক।
রিয়ার মনে হচ্ছিল—এই মুহূর্তটাই হয়তো ওদের গল্পের প্রকৃত অধ্যায়, যেখানে ফিরে আসা মানে একটুখানি সাহস আর একটুখানি অনুতাপ।
রাত বাড়ল।
আরিয়ান শেষবার লিখল—
“Can we talk? Tomorrow maybe?”
রিয়া একটু দেরি করল, তারপর লিখল—
“Sure.”
স্ক্রিন নিভে গেল।
নীরবতা ফিরে এলো, কিন্তু এবার তা অন্যরকম।
এই নীরবতার ভেতর একটা নতুন প্রত্যাশা, একটা ধুকপুক করা আশার আলো।
স্ক্রিনের ওপরে লেখা থাকল—
“লাস্ট সিন just now.”
রিয়া মৃদু হেসে ফেলল।
মনে মনে বলল, “এই তো শুরু…”
মেমোরি রিস্টোর
সকালটা অদ্ভুতভাবে শান্ত।
রিয়ার মনে হচ্ছে—রাতের কথোপকথনের পর পুরো পৃথিবীটা যেন একটু বদলে গেছে।
ফোনটা বালিশের পাশে রেখে ঘুমিয়েছিল, তবু রাতভর মনে হচ্ছিল কেউ যেন ওর পাশে নিঃশব্দে বসে আছে, ঠিক সেই আগের দিনের মতো।
আরিয়ান সত্যিই আবার ফিরবে?
ও কি জানে, তিন বছর ধরে প্রতিদিন লাস্ট সিন এই এক শব্দ “Online” দেখে কতোবার রিয়ার বুক ধকধক করেছে?
এই প্রশ্নগুলো উত্তর চায় না—তবু মন চায়।
সকালে অফিসে যাওয়ার পথে, ট্রামে বসে, রিয়া আবার চ্যাটটা খুলে দেখল।
“Sure.”
ওই এক শব্দে কত ইতিহাস জমে আছে!
আরিয়ান এখনো অনলাইন হয়নি। কিন্তু এবার আর তাড়া নেই।
এই প্রতীক্ষারও একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আছে, যেন পুরোনো কফির মতো—তেতো, অথচ আপন।
রাতের দিকে আরিয়ান মেসেজ করল—
“Hey, you free to talk?”
রিয়া অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
তারপর লিখল—
“Yeah. Tell me.”
এরপর ধীরে ধীরে কথাগুলো ফিরতে শুরু করল।
ছোট ছোট মেসেজ—কেমন আছো, কোথায় ছিলে, কী করছো এখন।
একটা সম্পর্ক যেন নতুনভাবে শ্বাস নিতে শুরু করল, ধীরে ধীরে, সাবধানে।
রিয়া জিজ্ঞেস করল—
“তুমি হঠাৎ চলে গেলে কেন?”
আরিয়ান একটু চুপ করল, তারপর লিখল—
“জীবনটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল, রিয়া। বাবার হার্ট অ্যাটাক, চাকরি হারানো, নিজেকে হারিয়ে ফেলা। তখন মনে হয়েছিল কারও সামনে দুর্বল হতে পারব না। তোমার সঙ্গে কথা মানে নিজের ভেতরের সত্যিটা দেখা, আর সেটা করতে পারিনি।”
রিয়ার চোখ ভিজে উঠল।
ও কিছু বলল না, শুধু লিখল—
“তুমি জানো, আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম?”
ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর—
“I know. I saw your statuses sometimes. You were there, between the lines.”
এই এক বাক্যেই রিয়ার তিন বছরের অপ্রকাশিত যন্ত্রণা গলে গেল।
কেউ যে সত্যিই ওর মধ্যে তাকিয়েছিল, সেটা বুঝতে পারল।
তারপর শুরু হলো এক নতুন রুটিন—রাতের গল্প, দিনের ছোট মেসেজ, পুরোনো গান শেয়ার করা।
রিয়া আবার হাসতে শিখল।
আরিয়ান বলল, “তুমি এখনো রবীন্দ্রনাথ পড়ো?”
রিয়া লিখল, “তুমি এখনো পড়ো?”
আর দু’জনেই একই সঙ্গে পাঠাল এক লাইন—
“আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।”
হঠাৎই মনে হলো, সময় যেন কোথাও থেমে গেছে।
তারা আবার ফিরে এসেছে সেই দিনগুলোয়—যেখানে কোনো দাবি নেই, শুধু কথার ভেতর লুকানো যত্ন।
তবে সবকিছুর মাঝেও একটা ভয় ছিল।
রিয়া জানত, সময় বদলায়, মানুষ বদলায়। এই পুনর্মিলন কতদিন টিকবে?
ওর মনে হচ্ছিল—একটা মেমোরি কার্ডের মতো, যেটা বহুদিন পরে আবার লাগানো হয়েছে, আর ছবিগুলো একে একে ফিরে আসছে, কিন্তু কিছু ফাইল এখনো করাপ্ট।
এক রাতে, হঠাৎ আরিয়ান পাঠাল—
“রিয়া, তুমি কখনো ভেবেছো, যদি তখন ফিরে আসতাম, তাহলে কি সব আলাদা হতো?”
রিয়া দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল সেই মেসেজে।
তারপর উত্তর দিল—
“হতো হয়তো। কিন্তু এখন যা আছে, সেটাও অমূল্য।”
আরিয়ান রিপ্লাই দিল না সঙ্গে সঙ্গে।
শুধু দেখা গেল—“typing…”, তারপর আবার থেমে গেল।
মনে হলো, কিছু কথার উত্তর হয়তো কোনোদিনই পাওয়া যায় না।
রিয়া জানল, এটাই জীবনের সত্যি—
সব মেমোরি রিস্টোর হয় না, কিছু কেবল আংশিক ফিরে আসে, বাকি অংশ থেকে যায় স্ক্রিনের ওপারে,
যেখানে লেখা থাকে—
লাস্ট সিন recently.
তবু রিয়ার মুখে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল।
কারণ এইবারের নীরবতাটা আর একলা নয়।
ও জানে, কোথাও না কোথাও, ওর কথাগুলো আবার কারও হৃদয়ে পৌঁছেছে।
লাস্ট সিন অনলি
সময় আবার তার নিজের মতো চলতে শুরু করেছে।
রিয়া আর আরিয়ানের মধ্যে এখন নিয়মিত কথা হয় না—তবু একধরনের নীরব বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে।
তারা জানে, এখন কথার দরকার কম, উপস্থিতিই যথেষ্ট।
রিয়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপে ঢোকে, দেখে—আরিয়ান অনলাইন কিনা।
সবসময় নয়, কিন্তু কখনো কখনো ঠিক দেখা যায় সেই সবুজ আলোটা।
মাঝে মাঝে ওর স্ট্যাটাসে একটা গান, একটা কবিতা, বা কোনো পাহাড়ি দৃশ্য।
রিয়া বুঝে নেয়—ও ভালো আছে, এটাই যথেষ্ট।
তিন বছর আগের সেই ‘লাস্ট সিন’ একসময় ছিল তার জীবনের অভিশাপ।
এখন সেটাই হয়ে উঠেছে এক মধুর স্মৃতি—
কারণ এইবার রিয়া জানে, ভালোবাসা মানেই কথার ঝড় নয়,
বরং কিছু না বলেও বোঝা, কিছু না লিখেও মনের মধ্যে থাকা।
এক বিকেলে, অফিস থেকে ফেরার পথে রিয়া ট্রামে বসেছিল।
আকাশে মেঘ জমেছে, বাতাসে হালকা বৃষ্টি।
হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশন—
Ariaan: “You know, I read that poem you once sent me. Still hits different.”
রিয়া হাসল। তিন বছর আগে পাঠানো একটা কবিতা—
যেটা ও ভেবেছিল, হারিয়ে গেছে চ্যাটের ভেতর।
ওর উত্তর এল ছোট্ট করে—
“Some words don’t fade.”
এরপর আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর দেখা গেল—“typing…”,
পাশাপাশি ছোট একটা মেসেজ—
“Wish we had met once, in real.”
রিয়া দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল সেই কথাটার দিকে।
মনটা ভার হয়ে এল, কিন্তু এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল তার মধ্যে।
ও লিখল—
“Maybe we did, just in a different time.”
এরপর স্ক্রিনে আর কিছু উঠল না।
শুধু সেই পরিচিত নীল টিক, তারপর লেখা—
লাস্ট সিন 10:43 PM.
রিয়া ফোনটা রেখে দিল জানালার পাশে।
বৃষ্টি তখন আরও জোরে পড়ছে, কাঁচে টুপটাপ শব্দ।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, কিন্তু ওর ভেতরে শান্তি।
ও বুঝল, কিছু সম্পর্ক ঠিক ডিজিটাল স্ক্রিনের মতো—
আলো নিভে গেলেও চিহ্ন থেকে যায়।
যেমন থাকে সেই দুই নীল টিক,
যা হয়তো কোনোদিন রিপ্লাই পায় না,
তবু বলে দেয়—
“আমি এখানে ছিলাম।”
রিয়া হালকা হেসে চোখ বন্ধ করল।
মনে মনে ফিসফিস করে বলল, লাস্ট সিন
“এই নীল টিকের ওপারে, কেউ একদিন আবার লিখবে হয়তো—
‘I’ll text you soon…’”
আর সে জানে,
সেই ‘লাস্ট সিন অনলি’ও একধরনের চিরন্তন সংযোগ—
যেখানে ভালোবাসা শেষ হয় না,
শুধু অফলাইন হয়ে যায়।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			