ফোঁটা ফোঁটা ভালোবাসা
অচেনা সঙ্গী, ভেজা সকাল
বর্ষার সকাল। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম যেন ভিজে উঠেছে আকাশের অবিরাম ঝরনায়। ছাতার নিচে ছুটে চলা মানুষের ভিড়, কোলাহলের ভেতরেও বৃষ্টির গন্ধে বাতাস যেন অন্যরকম হয়ে উঠেছে। ট্রেনের বাঁশি বাজছে দূরে, কোথাও গরম চায়ের ভাঁপ মিশছে বাতাসে, আর ভিজে রেলের লোহার গন্ধ মিলে গেছে কোলাহলের সঙ্গে।
মাধুরী ধীরে ধীরে কামরার জানলার পাশে গিয়ে বসলেন। ভিজে শাড়ির আঁচল সামলে ব্যাগটা কোলে রাখলেন। জানলার ওপাশে বৃষ্টির ফোঁটা কাঁচে গড়িয়ে পড়ছে একটার পর একটা। ফোঁটার সেই টুপটাপ শব্দ যেন ট্রেন ছাড়ার আগেই এক অচেনা ছন্দ তুলেছে।
হাওড়ার এই ভিড় আর হইচইয়ের ভেতরে একা বসে থাকতে থাকতে মাধুরীর চোখ হঠাৎ স্থির হলো পাশের আসনে। সেখানে এসে বসেছে এক তরুণ। বয়স বেশি নয়—চব্বিশ-পঁচিশ হবে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, হাতে ধরা একটা মোটা বই, আর ব্যাগটা সযত্নে পাশে রেখেছে। তার ভঙ্গিতে অদ্ভুত এক শান্ত ভাব, যেন ভিড়ভাট্টার মাঝেও কোথাও অন্য জগতে ডুবে আছে।
প্রথম কয়েক মিনিট দু’জনের মধ্যে নিস্তব্ধতা। শুধু ট্রেনের লোহার শব্দ আর জানালায় বৃষ্টির ঝমঝমানি। কখনো মাধুরী চোখ তুলে তাকান, আবার জানালার দিকে ফিরিয়ে নেন। ঈশানও মাঝে মাঝে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে, আবার অচেনা কৌতূহলে মাধুরীর দিকে তাকায়। দুজনের মধ্যে সেই অচেনা দ্বিধার নীরবতা যেন বৃষ্টির শব্দে আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে।
হঠাৎ ঈশানই প্রথম নীরবতা ভাঙল। মৃদু কণ্ঠে বলল—
—“বৃষ্টিতে ভ্রমণের মজা আলাদা, তাই না?”
প্রশ্নটা হঠাৎ শুনে মাধুরী খানিকটা অবাক হয়ে তাকাল। চোখে অচেনা বিস্ময়, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পর আস্তে বলল—
—“হয়তো।”
এই ছোট্ট ‘হয়তো’-তেই যেন নতুন এক গল্পের সূচনা হল।
ট্রেন হুইসেল দিয়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। জানলার পাশে ভিজে দৃশ্যগুলো একটার পর একটা পিছিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিভেজা মাঠ, গাছপালা, ছুটে চলা মানুষের ছায়া—সব যেন সিনেমার পর্দায় ভেসে যাচ্ছে। মাধুরী তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে, অথচ তার কানে বাজতে থাকল পাশের আসনে বসা তরুণের কণ্ঠস্বর।
ঈশান বইয়ের ভেতর থেকে বুকমার্ক সরিয়ে রাখল। হাসল হালকা করে।
—“আমি ঈশান। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করি। ভ্রমণে গেলে বই ছাড়া চলেই না।”
মাধুরী একটু দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিলেন—
—“আমি মাধুরী। কলকাতায় থাকি। খুব বেশি ভ্রমণের সুযোগ হয় না। তবে… আজ মনে হলো, বেরনো দরকার।”

দুজনের কথায় আর কোনো জটিলতা নেই। বরং যেন সহজ স্রোতের মতো এগিয়ে যেতে লাগল। বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজতে ভিজতে প্ল্যাটফর্ম পেছনে ফেলে ট্রেন ছুটছে, আর তার সঙ্গে ছুটছে দু’জন অচেনা মানুষের অদ্ভুত সংযোগ।
মাধুরী খেয়াল করলেন, ঈশানের চোখে এক ধরনের প্রশান্তি আছে। হয়তো বই পড়ার অভ্যাস থেকেই, কিংবা হয়তো ভেতরের এক অদৃশ্য স্বপ্নবাজি। অপরদিকে ঈশান বুঝতে পারল, মাধুরীর কণ্ঠে এক অদ্ভুত সুর আছে, যা তাকে আরও কথা বলার জন্য টানছে।
তাদের কথোপকথন খুব গভীর কিছু নয়—হালকা, সরল। কখনো বৃষ্টি নিয়ে, কখনো ভ্রমণ নিয়ে, কখনো বা একেবারে ছোটখাটো প্রসঙ্গ। অথচ প্রতিটি শব্দ যেন ভিজে ট্রেনযাত্রায় আলাদা একটা উষ্ণতা এনে দিল।
জানালার কাঁচে জমে থাকা ফোঁটাগুলো গড়িয়ে পড়ছে নিচে। যেন প্রতিটি ফোঁটা তাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া অনিশ্চয়তাকে মুছে দিয়ে এগিয়ে যেতে বলছে। বাইরে বর্ষার রঙ, ভেতরে এক অচেনা আলাপের প্রথম আঁচ।
মাধুরীর মনে হঠাৎ একটা প্রশ্ন ভেসে উঠল—এই অচেনা যাত্রাসঙ্গী কি কেবল আজকের ভ্রমণসঙ্গী হয়ে থাকবে? নাকি বৃষ্টির মতোই নিঃশব্দে তার জীবনের ভেতরে ঢুকে পড়বে অদৃশ্যভাবে?
ট্রেন তখন ছুটে চলেছে বৃষ্টিভেজা বাংলার বুক চিরে। দুই অচেনা মানুষ, দুই অচেনা আসন, অথচ এক সকাল—যা হয়তো তাদের চিরকালের জন্য মনে গেঁথে থাকবে।
বৃষ্টিফোঁটার কথোপকথন
ট্রেন তখন গতি পেয়েছে। কামরার ভেতর হালকা দুলুনি, জানলার কাঁচে এখনও বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ করে পড়ছে। বাইরে সবুজ মাঠ, দূরে কুয়াশায় ঢাকা গাছপালা, আর কদাচিৎ দেখা যাচ্ছে ভিজে পথ ধরে হাঁটা মানুষ। প্রতিটি দৃশ্য যেন বৃষ্টির রঙে আঁকা একেকটা জলরঙের ছবি।
ঈশান বইটা বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দিল। তারপর হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল—
—“আসলে আমি বরাবরই মনে করি, বৃষ্টি মানুষকে কাছাকাছি আনে। অচেনাদেরও।”
মাধুরী ভ্রু তুলে তাকালেন। খানিকটা অবাক হলেও চোখে একটা মৃদু হাসির ছায়া।
—“কাছাকাছি আনে? মানে?”
ঈশান একটু ভেবে বলল—
—“ভাবুন তো, আজ যদি রোদেলা দিন হতো, আমরা হয়তো এভাবে কথাই বলতাম না। আপনি জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতেন, আমি বইয়ে ডুবে যেতাম। কিন্তু এই বৃষ্টি—এ যেন আমাদের দুজনকে এক ছাদের নিচে দাঁড় করিয়ে দিল।”
মাধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। ট্রেনের আওয়াজে তার চুপ করে থাকা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন—
—“হয়তো আপনি ঠিকই বলছেন। বৃষ্টির মাঝে মানুষ একধরনের ভিন্ন মেজাজে থাকে। হয়তো একটু নরম হয়ে যায়, একটু খোলামেলা হয়।”
ঈশান হেসে ফেলল।
—“ঠিক তাই। তাই তো এত অচেনা হয়েও আমরা কথা বলছি। আমার তো মনে হচ্ছে, এই যাত্রাটা শুধু গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য নয়, বরং একটা অদ্ভুত আলাপের জন্যও।”
মাধুরী চুপচাপ জানালার বাইরে তাকালেন। কাঁচে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটায় তাঁর মুখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে লুকিয়ে থাকা চিন্তাগুলোও যেন ঠিক সেভাবেই ঝাপসা হয়ে রইল।
হঠাৎ ঈশান জিজ্ঞেস করল—
—“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
—“শান্তিনিকেতন। ছোটবেলা থেকে দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময় হয়ে উঠছিল না। আজ সুযোগ হলো।”
ঈশানের চোখ যেন ঝলমল করে উঠল।
—“ওহ, শান্তিনিকেতন! আমি তো কয়েকবার গিয়েছি। ও জায়গায় একটা অন্যরকম টান আছে। লাল মাটি, শাল-পিয়ালের বন, আর কবিগুরুর ছায়া—সব মিলিয়ে মনে হয়, সময় থেমে গেছে।”
মাধুরীর ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল।
—“তাহলে তো আপনিই আমার গাইড হয়ে যেতে পারেন।”

ঈশান একটু হেসে বলল—
—“হতে পারি বটে, তবে ভয় হয়—আপনার ধৈর্য আছে তো? আমি একটু বেশি কথা বলি।”
এই কথাতেই দু’জনের মধ্যে হেসে ওঠা। যেন এতক্ষণে বরফ ভেঙে গেল। হাসিটা যতটা সহজ, তার ভেতরে ততটাই গভীর।
বৃষ্টি আরও জোরে পড়তে শুরু করল। জানালার বাইরে সব ঝাপসা হয়ে গেছে। যেন পৃথিবীটা এক অচেনা পর্দার আড়ালে ঢাকা। আর সেই ঝাপসার ভেতরে দু’জন অচেনা মানুষ কথোপকথনে বুনতে শুরু করল এক অদ্ভুত সংযোগ।
কিছুক্ষণের মধ্যে চা-ওয়ালা এসে পড়ল। কাঁচের গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের গন্ধে যেন পুরো কামরা ভরে গেল। ঈশান মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল—
—“চা খাবেন?”
মাধুরী একটু ভেবে হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। দু’জনের হাতে তখন গরম চায়ের কাঁচের গ্লাস। বাইরের ভিজে আবহে চায়ের উষ্ণতা যেন আলাদা মাত্রা যোগ করল।
মাধুরী বললেন—
—“অদ্ভুত না? এই ভিড়, এই কোলাহল, এই অনিশ্চিত বৃষ্টি—সব মিলিয়েই যাত্রার একটা বিশেষ রূপ তৈরি হয়।”
ঈশান এক চুমুক দিয়ে উত্তর দিল—
—“হ্যাঁ, আর সেই রূপটাই মনে থেকে যায়। আসলে জীবনে কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো কোনো পরিকল্পনায় তৈরি হয় না। কেবল হঠাৎ ঘটে যায়।”
চোখাচোখি হলো দু’জনের। কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু সেই মুহূর্তে যেন হাজারটা কথা লুকিয়ে রইল।
বৃষ্টির ফোঁটা তখনও গড়িয়ে পড়ছে জানালার কাঁচ বেয়ে। প্রতিটি ফোঁটা যেন বলছে—এই যাত্রা শুধু গন্তব্য নয়, বরং এক অচেনা সংযোগের গল্প।
চোখের অদ্ভুত মিলন
ট্রেন ছুটছে। জানালার বাইরে বর্ষার ভেজা গাছপালা, ধানক্ষেত আর দূরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ যেন একাকার হয়ে গেছে। কামরার মধ্যে ভিড় আছে, কেউ কথা বলছে, কেউ চা-দাবার সঙ্গী নিয়ে ব্যস্ত, আবার কোথাও শিশুর কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। তবে ঈশান আর মাধুরীর চারপাশ যেন অন্য এক জগৎ।
দু’জনের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক নীরব বৃত্ত। চোখের খেয়ালে বিন্দু মাত্র স্পর্শ, হালকা হাঁসি, কেবল ছোট ছোট কথার মধ্যেই কিছু একটা বেড়ে উঠেছে—অচেনা, অথচ গভীর।
হঠাৎ ঈশান চুপচাপ হয়ে বসে থেকে বলল—
—“মাধুরী, তুমি কি ভাগ্যে বিশ্বাস করো?”
প্রশ্নটা অপ্রত্যাশিত। মাধুরী চোখ মেলেই তাকালেন। ধীরে বললেন—
—“ভাগ্যে… ঠিক কি বলব জানি না। তবে মনে হয়, কিছু কিছু দেখা, কিছু কিছু মানুষ কাকতালীয় নয়। জীবনের কোনো নির্দিষ্ট খাতা আছে, যেটা ধীরে ধীরে খোলা হয়।”
ঈশান হেসে মাথা নেড়ে বলল—
—“ঠিক তাই। যেমন আজকের এই ট্রেনের যাত্রা—আমাদের দেখা কেবল কাকতালীয় বলা যাবে না।”
মাধুরীর বুকের ভেতর হঠাৎ একটা অদ্ভুত শিহরণ উঠল। তার চোখ জানালার বাইরে থাকলেও মন পুরোপুরি ঈশানের কথায় আটকে গেছে।
ঠিক সেই সময় ট্রেন টানেলের ভেতরে ঢুকল। চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে ভিজে হাওয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। সেই অন্ধকারে দু’জনের চোখ একে অপরের চোখে আটকে গেল। হঠাৎ সব শব্দ মিলিয়ে গেল—শুধু হৃদস্পন্দনের, চোখের কথা শোনা যাচ্ছে যেন।
টানেল পার হয়ে আলো ফিরতেই দু’জনই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মুখে লাজুক হাসি, চোখে একটা অদ্ভুত ঝিলিক। ভিতরে মনে হলো, তারা একে অপরের দিকে আরও কাছে চলে এসেছে, অচেনা হলেও ঘনিষ্ঠ এক অনুভূতির জন্ম হয়েছে।
মাধুরী ধীরে স্বরে বলল—
—“কখনো কখনো মনে হয়, আমরা অনেকদিন ধরে কাউকে চিনি, অথচ বাস্তবে আজই প্রথম দেখা।”
ঈশান মৃদু হেসে বলল—
—“হয়তো তাই। নাম-পরিচয় কম গুরুত্বপূর্ণ, অনুভূতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
বাইরের বৃষ্টি আরও জোরে ঝরছে। কিন্তু ট্রেনের ভেতরে, এই ছোট্ট কামরার মধ্যে, দু’জন অচেনা মানুষের চোখে চোখ মিলনের এই মুহূর্ত যেন সময়কে থামিয়ে দিয়েছে।
মাধুরীর বুকের ভেতরে হঠাৎ একধরনের অচেনা আনন্দ, একধরনের অদ্ভুত শান্তি। ঈশানও হঠাৎ বুঝতে পারল, এক সাধারণ বৃষ্টিভেজা যাত্রা কেবল দেখা নয়, একটি অদ্ভুত সংযোগও তৈরি করতে পারে।
ট্রেনের দুলুনি, জানালার ফোঁটা, বাইরের ভিজে মাঠ—সব মিলিয়ে একটি মুহূর্ত তৈরি করেছে, যা হয়তো জীবনে চিরকাল মনে থাকবে।
মাধুরী জানালার দিকে তাকিয়ে বলল—
—“এই যাত্রার শেষটা কি আসলে গন্তব্যের জন্য, নাকি এই সংযোগের জন্য?”
ঈশান হেসে বলল—
—“আমার মনে হয়, সংযোগটাই আসল। আর সেটা থামবে না, শুধু আমাদের স্মৃতির মধ্যে বয়ে যাবে।”
শেষ স্টেশনের আগে
ট্রেন এখন ক্রমশ ধীরে চলছে। জানালার বাইরে বৃষ্টি থেমে থেমে পড়ছে, তবে ভেজা মাটির গন্ধ আর বাতাসে মিশে থাকা আর্দ্রতা যেন আরও কাছের করে তুলছে ঈশান আর মাধুরীকে। কামরার মধ্যে নীরবতা, কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরে কথার এক অদ্ভুত সুর বাজছে।
মাধুরী ধীরে ব্যাগ ঠিক করে কাঁধে ঝুলিয়ে বলল—
—“ঈশান, মনে হচ্ছে এই যাত্রার শেষটা আসছে। এমন মানুষকেও আমরা খুব অল্প সময়ে চিনে ফেলি, কিন্তু দেখা হবে কি আবার, তা ঠিক জানি না।”
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে বলল—
—“হয়তো দেখা হবে না, তবে মনে থাকবে। যেমন আজকের এই মুহূর্ত।”
মাধুরীর মনে অদ্ভুত এক হালকা কষ্ট হলো। ভেতরের অনুভূতি বলছে—এই দেখা হয়তো শেষ নয়, কিন্তু বাস্তবতা আর ট্রেনের গতি মনে করাচ্ছে শীঘ্রই আলাদা হতে হবে।
ট্রেনের কামরা থেকে দূরে যাত্রীরা ধীরে ধীরে নামছে। ভিড়ের মধ্যে দু’জনের চোখ মিলছে, কেউ কথা বলছে না। শুধু নীরবতা, জানালার ধারে ফোঁটার ঝমঝম, আর ট্রেনের হালকা ঠক ঠক—এই শব্দগুলোই এখন তাদের কথাবার্তা।
মাধুরী ধীরে স্বরে বলল—
—“আসলে আজকের দিনটা খুব দ্রুত কেটে গেল।”
ঈশান হেসে বলল—
—“হ্যাঁ, সত্যিই। কিন্তু মনে থাকবে। কখনো ভুলবে না।”
মুহূর্তগুলো এতটাই নীরব, এতটাই গভীর, যেন সময় স্থির হয়ে গেছে। বাইরের বৃষ্টি, প্ল্যাটফর্মের ভিড়, ট্রেনের গতি—সব মিলিয়ে যেন এই বিদায়ের মুহূর্তকে আরও স্পর্শকাতর করে তুলেছে।
মাধুরী জানালার দিকে তাকিয়ে আরেকবার বলল—
—“আপনি কি মনে করেন, আমাদের দেখা কেবল এই ট্রেনের জন্যই, নাকি কোনো অদৃশ্য কারণে?”
ঈশান হালকা হাসল।
—“আমার মনে হয়, কিছু মানুষের সাথে সংযোগ এমনই হয়—অপেক্ষার দরকার হয় না। ঠিক যেমন এই যাত্রা।”
ট্রেনের ধাক্কা আর জানালার ফোঁটার শব্দ তাদের চারপাশে ঘিরে রাখল। তারা জানে, এই মুহূর্তই শেষের শুরু। কিন্তু মনে হলো, কিছু একটা অদ্ভুত বন্ধন তৈরি হয়েছে যা দূরত্ব, সময় বা পরিস্থিতি ছাপিয়ে বাঁচবে।
মাধুরী ধীরে নামল। প্ল্যাটফর্ম ভিজে, কিন্তু মনে হলো পৃথিবী যেন স্থির। ঈশান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। মাধুরীও হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানাল।
বৃষ্টির হালকা ঝাপটা, ভেজা পাথরের গন্ধ, ট্রেনের ধাক্কা—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করল। মনে হলো, আজকের দেখা শুধু একবারের নয়, বরং মনে থাকবে চিরকাল।
বিদায়ের বৃষ্টিঘন মুহূর্ত
স্টেশন পৌঁছল। ট্রেন ধীরে ধীরে থেমে চলেছে। প্ল্যাটফর্ম ভিজে, বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ। হালকা বৃষ্টি এখনও পড়ছে, কিন্তু সেই ঝাপসা ভেজা আবহ যেন আরও কাছে টানে দু’জনকে—ঈশান আর মাধুরীকে।
মাধুরী ধীরে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ঈশানের দিকে তাকাল। দু’জনের চোখে অনেক অমীমাংসিত কথা। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়—ঈশানও তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না, শুধু চোখের আলাপ।
মাধুরী হঠাৎ কণ্ঠে কেঁপে কেঁপে বলল—
—“আবার দেখা হবে কি?”
ঈশান কিছুক্ষণ নীরব। তারপর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হেসে হাত নাড়ল। মাধুরীও হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল।
ট্রেন ধীরে ধীরে ছাড়তে শুরু করল। ভেজা প্ল্যাটফর্মের পাথরের গন্ধ, বৃষ্টির হালকা ঝাপটা, ট্রেনের ধাক্কা—সব মিলিয়ে তৈরি হলো এক অদ্ভুত আবহ। মনে হলো, আজকের দেখা শুধু একবারের নয়, বরং মনে থাকবে চিরকাল।
মাধুরী নামার সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যাটফর্মের ধূলিমাখা জল আর বৃষ্টির ফোঁটা তাকে ছুঁয়ে যায়। ভেতরের এক অদ্ভুত শিহরণ, ঈশানের চোখে চোখ রেখে যাওয়া সেই মুহূর্তের স্মৃতি—সব মিলিয়ে মনে হলো, সময়ও যেন থেমে গেছে।

ঈশান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল। তার হালকা হাসি, মৃদু কণ্ঠস্বর—সব মিলিয়ে মনে হলো এই সংযোগ ভিজে আকাশের নিচে আরও গভীর হয়ে গেছে। দু’জন জানে, হয়তো পরবর্তী দেখা হবে না, কিন্তু আজকের অনুভূতি হৃদয়ে চিরদিনের জন্য গেঁথে গেছে।
বৃষ্টির ফোঁটা আর বাতাসের সঙ্গে এই বিদায় যেন এক মৃদু সুরে গাইছে—যেখানে নেই কোনো শব্দ, নেই কোনো নাম, শুধুই অনুভূতির গভীরতা।
মাধুরী ধীরে ধীরে স্টেশন থেকে হেঁটে গেল। ঈশান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ধীরে ধীরে চলে গেল, কিন্তু দু’জনের ভেতরে জন্মানো আলো নিভে যায়নি। বর্ষার আকাশ যতই অন্ধকার হোক, হৃদয়ের ভেতরের সেই আলো চিরদিন জ্বলতে থাকবে।
সমাপ্তি? হয়তো না। হয়তো এটি কেবল এক শুরুর অপেক্ষা। বর্ষার সেই ভেজা সকাল, ট্রেনের কামরার নীরবতা, চোখে চোখের মিলন—সব মিলিয়ে তৈরি হলো এক স্মৃতি, যা চিরকাল ভাসবে মনে।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			