অচেনা নম্বরের ফোন
হঠাৎ বাজা ফোন
কলকাতার রাত। অক্টোবরের হালকা হাওয়া বইছে জানলার ফাঁক দিয়ে। বাইরের রাস্তায় কোথাও দূরে কুকুর ডাকছে, আবার হঠাৎ করে এক-দু’টো ট্যাক্সির হর্ন কানে ভেসে আসছে। অরিত্রর মাথাটা ক্লান্তিতে ঝিমঝিম করছিল। সারা দিন অফিসে প্রেজেন্টেশনের দৌরাত্ম্যে সে প্রায় ভেঙে পড়েছে।
বাড়ি ফিরে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল সে।
আলমারির পাশে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা আধো আলো ছড়াচ্ছিল। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা। সাধারণত ওই সময়ে কেউ ফোন করে না। হঠাৎ করেই টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা কেঁপে উঠল।
স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক অচেনা নম্বর— +91 8697…
অরিত্র একটু ভুরু কুঁচকালো। এত রাতে কে ফোন করবে? বন্ধু-বান্ধব তো সবার নম্বর সেভ করা। তবুও খানিক ইতস্তত করে ফোনটা কানে তুলল।
“হ্যালো?”—অরিত্রর কণ্ঠে বিরক্তি মিশে গেল।
ওপাশে এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর খুব আস্তে, চাপা স্বরে ভেসে এল এক প্রশ্ন—
“তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?”
অরিত্র হঠাৎ কেঁপে উঠল। স্বরটা যেন কোথাও শোনা। কিন্তু মনে করতে পারছে না ঠিক কে।
“কে আপনি? নাম বলুন তো!”—তার গলা খানিক কাঁপছিল।
কোনও উত্তর এল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফোনটা কেটে গেল।
অরিত্র বিস্ময়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। কল লিস্টে সেই নম্বরটা ঝলমল করছে।
তার বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে ধড়ফড় করতে লাগল। এত রাতে কেউ এমন অচেনা নম্বর থেকে ফোন দিয়ে যদি এভাবে কথা বলে, তার মানে কী হতে পারে?
সে ভাবল হয়তো কেউ প্র্যাঙ্ক করছে। আবার মনে হল—স্বরটার মধ্যে যেন এক অদ্ভুত পরিচিত ছোঁয়া আছে, যেটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
জানলার বাইরের কালো আকাশটা যেন আরও অন্ধকার হয়ে উঠল। দূরে ট্রেনের হুইসেল বাজল। অরিত্র অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সেই মুহূর্তে তার ভেতরে কেমন এক শূন্যতা নেমে এল। মনে হল, আজ রাতের এই ফোন কল কোনও সাধারণ ঘটনা নয়—এ যেন এক অদ্ভুত ইঙ্গিত, এক অচেনা রহস্যের দরজা খুলে যাচ্ছে সামনে।
সে তখনও জানত না—এই অচেনা নম্বরের কল তার জীবনকে আমূল বদলে দেবে।
অচেনা কণ্ঠস্বর
সারারাত ঘুম এল না অরিত্রর। বিছানায় শুয়ে বারবার ফোনটা হাতে নিয়ে অচেনা নম্বরটার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রতিবারই মনে হচ্ছে, আবার বুঝি বেজে উঠবে।
কিন্তু না—আর কোনও কল এল না।
সকালে অ্যালার্ম বাজার আগেই চোখ খুলে যায় তার। আয়নায় নিজের মুখ দেখে চমকে উঠল—চোখের নিচে কালি, গাল শুকনো, যেন কয়েক রাতের ঘুম একসঙ্গে হারিয়ে গেছে। অফিসে যেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়েই বেরোল।
দিনভর সহকর্মীরা খেয়াল করল অরিত্র আজ কেমন যেন অস্থির। মিটিং চলাকালীন সে কয়েকবার মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখল, যেন আবার বাজবে সেই নম্বর।
কিন্তু সারা দিন নীরব ফোনটাই তার সঙ্গ দিল।
রাত ন’টার পর বাসায় ফিরে একটু হালকা হতে চেষ্টা করছিল সে। টিভি চালিয়ে দিল, কিন্তু মন বসল না।
ঠিক দশটা নাগাদ আবার ফোনটা কেঁপে উঠল।
একই নম্বর!
অরিত্রর হাত ঘেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড দোটানায় কাটল, তারপর কাঁপা হাতে কলটা রিসিভ করল।
ওপাশ থেকে ঠাণ্ডা, চাপা গলায় শোনা গেল—
“অরিত্র…”
গলার স্বর শুনেই বুক ধড়ফড় করে উঠল। এ কণ্ঠস্বর অচেনা নয়, বরং ভীষণ পরিচিত।
অরিত্র হঠাৎই ফিসফিস করে বলল—
“কে? তুমি কে?”
ওপাশ থেকে উত্তর এল—
“আমি ফিরেছি। তুমি কি ভেবেছিলে সব শেষ হয়ে গেছে? তোমার কাছে আমার হিসেব এখনও বাকি।”
কথাগুলো যেন ছুরি দিয়ে বুকে আঁচড় কাটল।
“হিসেব? কিসের হিসেব?”—অরিত্রর কণ্ঠ কেঁপে যাচ্ছিল।
কোনও উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে গেল।
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর যেন ঘরের চারদিক থেকে অদৃশ্য চাপা হাসি ভেসে আসতে লাগল। অরিত্র ঘামতে শুরু করল। মনে হল, শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।
তার মনের ভেতরে বারবার একটাই নাম ঘুরপাক খেতে লাগল—রুদ্র।
তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনার কথা হঠাৎ ঝড়ের মতো ফিরে এল মাথায়।
সেই রাত, সেই গাড়ি, সেই ঝগড়া… আর রুদ্রর নিথর দেহ।
অরিত্রর গলা শুকিয়ে গেল। ফোনটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে জানালার দিকে তাকাল। বাইরে চাঁদ মেঘে ঢাকা, যেন রাতও আজ অদ্ভুত অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সে নিজের মনে ফিসফিস করে বলল—
“না, এটা হতে পারে না। মৃত মানুষ ফিরে আসে না… আসতে পারে না।”
কিন্তু বুকের গভীরে কোথাও এক ভয়াবহ প্রশ্ন কাঁপতে লাগল—
তাহলে এই কণ্ঠস্বরটা এলো কোথা থেকে?
অতীতের অগ্নিশিখা
অরিত্র বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু মন যেন বারবার ফিরে যাচ্ছিল অতীতে। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পাচ্ছিল কয়েক বছর আগের সেই দিনগুলো।
বন্ধুত্বের শুরু
রুদ্র আর অরিত্র—শৈশবের বন্ধু। একসঙ্গে পড়াশোনা, খেলাধুলো, পাড়ার ক্লাব থেকে পিকনিক—সব জায়গাতেই ছিল তাদের যুগলবন্দি।
রুদ্র ছিল অরিত্রর থেকে একেবারেই ভিন্ন স্বভাবের। অরিত্র শান্ত, অন্তর্মুখী আর পড়াশোনায় ভালো, আর রুদ্র ছিল দারুণ মিশুকে, প্রাণখোলা, একদম সবার প্রাণকেন্দ্র।
তাদের দুজনের বন্ধুত্ব যেন সবার কাছে ঈর্ষার বিষয় হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু জীবনের পাতায় নতুন এক চরিত্র এসে ঢোকার পরেই সেই বন্ধুত্বে চির ধরতে শুরু করেছিল।
ইশিতার আগমন
কলেজে প্রথম দিনেই ইশিতাকে দেখে দু’জনেই অবাক হয়েছিল। সাদা সালোয়ারে উজ্জ্বল মুখ, চুলে বাতাসের হালকা খেলা—সে যেন স্বপ্নের মতো।
প্রথম থেকেই রুদ্র ইশিতাকে পছন্দ করে ফেলে। হাসি-ঠাট্টা, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা—সব জায়গায় রুদ্র তার কাছে থাকার চেষ্টা করত।
অন্যদিকে অরিত্র চুপচাপ দূর থেকে তাকিয়ে থাকত, কিন্তু ধীরে ধীরে ইশিতার সাথে পড়াশোনার অজুহাতে এক অদ্ভুত টান তৈরি হল।
ইশিতা অনুভব করল অরিত্রর ভেতরের গভীরতা, তার সংযত অথচ আন্তরিক মনোভাব।

কিছুদিনের মধ্যে অরিত্র ও ইশিতার মধ্যে একটা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়ে গেল।
রুদ্রর অভিমান
রুদ্র বিষয়টা টের পেয়ে গিয়েছিল।
“তুই জানিস অরিত্র, আমি ওকে কতটা পছন্দ করি। তবুও তুই?”
অরিত্র অসহায় কণ্ঠে বলেছিল—
“রুদ্র, আমি কখনও চাইনি এমন হোক। কিন্তু সম্পর্ক জোর করে হয় না। ইশিতা আমাকে বেছে নিয়েছে।”
রুদ্র চুপ করে গিয়েছিল। তবে সেই চুপ করে থাকা আসলে ঝড়ের আগের নীরবতা ছিল।
তার চোখে বন্ধুত্বের জায়গায় জমতে শুরু করল হিংসা, আক্রোশ আর ভেতরে ভেতরে আগুনের শিখা।
সেই ভয়ঙ্কর রাত
তিন বছর আগে, শীতকালের এক সন্ধ্যা। ইশিতা, অরিত্র আর রুদ্র একসঙ্গে বেরিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল শহরের বাইরে একটু ঘুরে আসা।
কিন্তু গাড়ির ভেতরেই শুরু হয় তর্ক।
রুদ্র উত্তেজিত কণ্ঠে বলে—
“তুই আমার থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নিলি অরিত্র। বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, এমনকি ইশিতাকেও!”
অরিত্র তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। ইশিতা কেঁদে ফেলেছিল।
কিন্তু রুদ্রর হাত স্টিয়ারিংয়ের উপর শক্ত হয়ে উঠছিল। উত্তেজনা আর রাগে সে গাড়ি দ্রুত চালাচ্ছিল।
হঠাৎ এক বাঁকে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারাল।
এক বিকট শব্দ, চাকা ঘর্ষণের চিৎকার—আর সবকিছু মুহূর্তে অন্ধকার।
চেতনা ফেরার পর অরিত্র দেখেছিল, সে আর ইশিতা আহত অবস্থায় বেঁচে আছে।
কিন্তু রুদ্র… রুদ্র আর নেই।
অমোঘ ছাপ
সেদিনের পর থেকে অরিত্রর ভেতরে অপরাধবোধ পাথরের মতো চেপে বসেছে।
যদিও পুলিশ রিপোর্টে লেখা হয়েছিল “অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ”, কিন্তু অরিত্র জানত, সেই রাতের ঝগড়া, সেই আগুনে ভরা কথা—সবই পরোক্ষে দায়ী।
আর সবচেয়ে বড় কথা, রুদ্রর শেষ চাহনি আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
সেই স্মৃতির আগুন কখনও নিভল না।
আর আজ রাতের ফোন কল যেন আবার সেই শিখাগুলোকে দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে তুলেছে।
অরিত্র জানালার বাইরে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল—
“রুদ্র… যদি সত্যিই তুই হয়ে থাকিস, তবে কী চাইছিস আমার কাছ থেকে?”
ফোনের দাপট
অরিত্রর জীবন যেন ধীরে ধীরে এক অচেনা ঘূর্ণাবর্তে ঢুকে যাচ্ছিল।
সেই প্রথম রাতের ফোন কলের পর থেকে এখন প্রায় প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ে ফোন আসতে লাগল। কখনও রাত দশটা, কখনও আবার সাড়ে দশটা।

ফোন বাজলেই বুক ধকধক করে উঠত।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে দ্বিধায় থাকত—কলটা রিসিভ করবে কি না। কিন্তু প্রতিবারই ভয়, কৌতূহল আর অপরাধবোধ মিলেমিশে তাকে কল ধরতে বাধ্য করত।
পুনরাবৃত্ত কণ্ঠস্বর
ওপাশ থেকে সবসময় একই স্বর। ঠাণ্ডা, চাপা, আর যেন বুকের ভেতর কাঁপন ধরানো—
“অরিত্র… পালিয়ে বাঁচতে পারবি না।”
অথবা—
“যা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিস, সেটাই চাই।”
অরিত্র ভয়ে কেঁপে উঠত।
সে কয়েকবার চিৎকার করে বলেছিল—
“তুই কে? কী চাইছিস আমার থেকে?”
কিন্তু প্রতিবারই সেই রহস্যময় কণ্ঠস্বর কিছু না বলে হঠাৎ কল কেটে দিত।
ঘুমহীন রাত
ক্রমে অরিত্রর রাতের ঘুম একেবারেই হারিয়ে গেল।
চোখের নিচে গাঢ় কালি জমে উঠল।
অফিসে কাজে মন বসত না। সহকর্মীরা তার অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করলেও কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পেত না।
কখনও কখনও মনে হত, সে হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছে।
ফোনটা হাতে নিলেই যেন বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে যেত।
কয়েকবার ভেবেছিল নম্বরটা ব্লক করে দেবে, আবার মনে হত—যদি সত্যিই রুদ্র হয়? যদি তার কিছু বলার থাকে?
এই দ্বন্দ্ব তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিচ্ছিল।
অদ্ভুত ঘটনা
একদিন অফিস থেকে ফিরে সে দেখল দরজার নিচে গুঁজে দেওয়া একটা সাদা খাম।
খামের ভেতরে শুধু একটা লাইন লেখা—
“হিসেব এখনো মেটেনি।”
অরিত্রর হাত কাঁপতে লাগল। কে এল বাড়ি পর্যন্ত? প্রতিবেশীরা কিছু টের পেল না কেন?
সেদিন রাতেই ফোন এল।
ওপাশ থেকে স্বর ভেসে এল—
“তুই কি ভাবিস, আমি দূরে আছি? আমি খুব কাছেই আছি, অরিত্র।”
ফোনটা কেটে যাওয়ার পর অরিত্রর মনে হল, ঘরের ভেতরে কোথাও যেন অদৃশ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে।
অসহায় অরিত্র
অবশেষে সে আর সহ্য করতে পারল না।
চুলে হাত বুলিয়ে নিজেই নিজেকে বলল—
“না, এভাবে চলতে পারে না। যদি কেউ আমার সঙ্গে মানসিক খেলা খেলছে, তবে তার মুখোশ খুলতেই হবে। আর যদি সত্যিই রুদ্র…”
কথা শেষ করতে পারল না। বুকটা হুহু করে উঠল।
সেই রাতে বিছানায় শুয়ে অরিত্রর মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—
এই খেলার শেষ কোথায়?
ইশিতার প্রত্যাবর্তন
অরিত্রর জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো দিন কাটছিল। প্রতিদিন রাতেই অচেনা নম্বরের কল, রহস্যময় স্বর, আর সেই ভয়াবহ বার্তা—“হিসেব এখনও মেটেনি।”
সে যেন ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য খাঁচার ভেতর বন্দি হয়ে যাচ্ছিল।
এমন সময় হঠাৎই একদিন দুপুরে অফিসে বসে থাকতে থাকতে ফোনে একটা মেসেজ এল।
প্রেরকের নাম দেখেই অরিত্রর বুক কেঁপে উঠল—ইশিতা।
তিন বছর ধরে যার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, আজ হঠাৎ করে তার মেসেজ!
মেসেজে লেখা—
“অরিত্র, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। জরুরি।”
আকস্মিক দেখা
সেই সন্ধ্যায় শহরের এক নিরিবিলি ক্যাফেতে দেখা হল তাদের।
অরিত্র ভেতরে ঢুকেই তাকাল, কোণের টেবিলে বসে আছে ইশিতা। আগের মতোই শান্ত মুখ, তবে চোখে ক্লান্তির ছাপ।
অরিত্র বসতেই ইশিতা ধীরে বলল—
“অনেকদিন পর দেখা হল।”
অরিত্র চুপ করে রইল। কণ্ঠ থেকে কথা বেরোচ্ছিল না।
ইশিতা গ্লাসের জল চুমুক দিয়ে বলল—
“তুমি কি ভেবেছিলে আমি চিরকাল চুপ থাকব? অরিত্র, এই ফোন কলগুলো… শুধু তোমার কাছে আসছে না। আমার কাছেও আসছে।”
একই রহস্য
অরিত্র বিস্মিত হয়ে তাকাল তার দিকে।
“কি বলছিস? তোর কাছেও?”
ইশিতা মাথা নেড়ে বলল—
“হ্যাঁ। প্রায় এক মাস ধরে মাঝেমাঝেই আসছে। একই কণ্ঠস্বর, একই হুমকি। বলছে—‘তুমি আমার সবকিছু নষ্ট করেছ।’ আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, কেউ হয়তো আমাকে ভয় দেখাতে চাইছে। কিন্তু যখন জানলাম তুইও একই নম্বর থেকে কল পাচ্ছিস, তখন আর সন্দেহ রইল না—এখানে কিছু অদ্ভুত ঘটছে।”
অরিত্রর শরীর কাঁপতে লাগল।
“মানে… রুদ্র?”
ইশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“মৃত মানুষ ফোন করে না। আমি জানি। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, ও যেন সত্যিই ফিরে এসেছে… শুধু আমাদের তাড়া করার জন্য।”
অতীতের ক্ষত
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ বসে রইল। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল কাচে।
অরিত্র নিচু গলায় বলল—
“তুই কি এখনও আমাকে দোষী ভাবিস, ইশিতা?”
ইশিতা দীর্ঘক্ষণ নীরব থেকে উত্তর দিল—
“দোষী হয়তো তোকে একাই বলা যায় না। সেদিন রুদ্রর রাগ, আমাদের ভুল বোঝাবুঝি—সব মিলেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল। তবু স্বীকার করতেই হবে, আমাদের কারও ভেতরেই সেই রাতের ক্ষত সেরে ওঠেনি।”
অরিত্রর বুক ভারি হয়ে গেল।
তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। যেন অতীতের অগ্নিশিখা আবার সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
নতুন সিদ্ধান্ত
শেষমেশ ইশিতা বলল—
“শুধু ভয়ে ভয়ে বাঁচলে হবে না। এই নম্বরটা কার, তার সত্যিটা আমাদের বের করতে হবে। অন্যথায় এই কল আমাদের জীবনের শেষ অবধি তাড়া করবে।”
অরিত্র ধীরে মাথা নেড়ে বলল—
“ঠিক বলেছিস। যত দুঃখই হোক, অতীতকে মুখোমুখি না করলে মুক্তি নেই।”
সেই মুহূর্তে দুজনের চোখে ভেসে উঠল একই সংকল্প—
যে-ই হোক, যত বড় রহস্যই হোক, এবার সত্যিটা জানা চাই।
অচেনা সত্যের মুখোমুখি
অরিত্রর মাথাটা যেন ঝনঝন করে বাজছিল। রিমির সেই শেষ মেসেজ, অচেনা নম্বরের কল, আর রাতের অন্ধকার তাকে এক অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। যত টুকরো ঘটনা একে একে মিলতে শুরু করল, তার বুকের ভেতর চাপা ভয় আর অনুশোচনা একসাথে ধাক্কা দিতে লাগল।
সেদিনকার দুর্ঘটনা—যেটা সে এতদিন ভুলতে চেয়েছিল—আসলে রিমির জীবনে এক অমোচনীয় দাগ কেটে গিয়েছিল। অরিত্র ভেবেছিল, সে-ই একমাত্র দায়ী; কিন্তু সত্যিটা ছিল আরও জটিল। দুর্ঘটনার দিন রিমি একা ছিল না, সঙ্গে ছিল সায়ন—অরিত্রর একসময়ের বন্ধু। আর সায়নের বেপরোয়া ড্রাইভিং-ই তাদের জীবন তছনছ করেছিল।
অচেনা নম্বরের কণ্ঠটা তাই এতদিন ধরে তাকে টেনে এনেছিল। রিমি বেঁচে ছিল, কিন্তু অন্য শহরে চলে গিয়েছিল, তার সব অতীত ভেঙে নতুন জীবন বানানোর চেষ্টা করেছিল। আর এখন, দীর্ঘ বছর পর, সে অরিত্রকে জানাতে চেয়েছিল সত্যিটা—যেন অরিত্র নিজের অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হতে পারে।
ফোনটা আবার বেজে উঠল।
অরিত্র ধীরে ধীরে রিসিভ করল। ওপাশে রিমির কণ্ঠ।
— “অরিত্র, আমি প্রতিশোধ নিতে চাইনি। শুধু চাইছিলাম তুমি জানো সত্যিটা। তুমি দায়ী ছিলে না একা।”
অরিত্রর গলা কেঁপে গেল।
— “রিমি… আমি তো ভেবেছিলাম তোমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি।”
— “কেউ কাউকে হারায় না অরিত্র। সময় শুধু দূরে সরিয়ে দেয়।”
লাইনটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। জানালার বাইরে ভোরের আলো ফুঁড়ে আসছিল। দীর্ঘ অন্ধকারের পর প্রথম সূর্যের কিরণ যেন তার ভেতরেও আলো জ্বালল।
অরিত্র বুঝল, কিছু সম্পর্ক শেষ হয় না, কেবল রূপ বদলায়। আর কিছু সত্য, যত দেরিতেই সামনে আসুক, তা মানুষকে মুক্তি দেয়।

 
		 
			 
			 
			 
			 
			