প্রতিশোধের অগ্নিশিখা
|

প্রতিশোধের অগ্নিশিখা

মানুষ যখন অন্যায়ের বোঝা বহন করতে করতে ভেঙে পড়ে, তখন হয় সে নীরব আত্মসমর্পণ করে, নয়তো অগ্নিশিখার মতো জ্বলে ওঠে। এই গল্প সেই জ্বলে ওঠার কাহিনি—এক নারীর, যাকে সমাজ ভেবেছিল ভঙ্গুর, অথচ সে-ই হয়ে উঠল প্রতিশোধের অগ্নিদেবী।

ভাঙনের শুরু

মেদিনীপুর জেলার প্রান্তিক এক গ্রাম। চারদিকে ধানক্ষেত, বেতগাছ আর কাঁচা রাস্তার ধুলো। এই গ্রামেই জন্মেছিল নন্দিতা। ছোটোবেলা থেকেই সে আলাদা ছিল। বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা তার প্রিয় কাজ, আর ফাঁকে ফাঁকে গলা ছেড়ে গান গাইত।
পাড়ার মানুষ তাকে বলত—“এই মেয়েটার চোখে বড় স্বপ্ন আছে।”

নন্দিতার বাবা সজন কান্তি ছিলেন সাধারণ কৃষক। দিনরাত খেটে সংসারের অন্ন যোগাতেন। মা কেয়া দেবী ছিলেন নিঃশব্দ গৃহবধূ, সারাদিন খাওয়া, রান্না আর সংসারের টুকিটাকি কাজেই ডুবে থাকতেন। সংসারে বিলাসিতা ছিল না, কিন্তু ভালোবাসার অভাব ছিল না।

নন্দিতা ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো। স্কুলের শিক্ষকেরা বলতেন—“মেয়েটাকে যদি এগোতে দাও, অনেক দূর যাবে।”
নন্দিতারও স্বপ্ন ছিল, সে বড় হয়ে শিক্ষক হবে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে বই তুলে দেবে।

কিন্তু সমাজের চোখে মেয়েদের স্বপ্ন তেমন দামি নয়। মেয়ের বয়স আঠারো হতেই গ্রামের গিন্নিরা কেয়া দেবীকে কানে কানে বলতে লাগল—
“এখনই বিয়ে দিয়ে দাও। বেশি পড়াশোনা মেয়েদের মানায় না। মেয়েমানুষ ঘরে থাকলেই মানায়, স্কুল-কলেজে নয়।”

pratisodh er agni sikha 1

কেয়া দেবী স্বামীকে বোঝালেন—
“লোকের কথা বলছে, মেয়েকে বিয়ে না দিলে অপবাদ হবে।”

অভিমান আর অসহায়তার মাঝেই সজন কান্তি শেষমেশ নতি স্বীকার করলেন।

শিগগিরই পাকা কথা হল। পাশের গ্রামের ব্যবসায়ী রঘুনাথ ঘোষ, বয়সে নন্দিতার চেয়ে অনেক বড়, কিন্তু ধনী এবং প্রভাবশালী। গ্রামের মানুষ বলল—“এই জুটিই ভালো। মেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে।”

নন্দিতা বিয়ের দিন কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, তার ডানা কেটে নেওয়া হচ্ছে। বুকের ভেতরে জমে থাকা স্বপ্নগুলো কেউ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বাবার চোখে উদ্বেগ, মায়ের চোখে ভয় দেখে সে চুপ করে রইল।

বিয়ের রাতেই নন্দিতা বুঝল—তার সামনে যে পথ খুলে যাচ্ছে, সেটি কোনো ফুলে মোড়া রাস্তা নয়, বরং কাঁটা আর অন্ধকারে ভরা।

দম বন্ধ হওয়া দিনগুলো

বিয়ের পর প্রথম কয়েকটা দিন নন্দিতা ভেবেছিল—হয়তো নতুন পরিবেশের অচেনাত্বই তার অস্বস্তির কারণ। হয়তো সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শিগগিরই সে বুঝল, রঘুনাথের আসল মুখটা অন্যরকম।

রঘুনাথ বাইরে থেকে ভদ্রলোক—মন্দিরে যায়, পুজো দেয়, পাড়ায় দান-খয়রাতও করে। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ হলেই সে একেবারে অন্য মানুষ। সামান্য ভুলেও তার চোখ রাঙানি, গলা চড়া, কখনো হাত তোলা।

নন্দিতা যদি একটু গান গাইত, রঘুনাথ তেতে উঠত—
“এগুলো আবার কী? বউয়ের কাজ ঘর সামলানো, গান গেয়ে চেঁচামেচি নয়।”

ধীরে ধীরে গানের সুর মিলিয়ে গেল, হাসি মিলিয়ে গেল।
তবুও নন্দিতা মন শক্ত করল। সে ভাবত, সংসার মানেই হয়তো কিছু ত্যাগ, কিছু সমঝোতা।

বছর দুইয়ের মাথায় তার কোলে এল সন্তান—একটি পুত্রসন্তান। ছেলেটি জন্মের পরই নন্দিতার জীবনে নতুন আলো ফুটল। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও খুশি হল। কিন্তু রঘুনাথের স্বভাব বদলাল না।

প্রথমে সামান্য রাগ-চড়চাপড়েই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু একসময় ব্যবসায় লোকসান খাওয়ার পর থেকে রঘুনাথ মদের নেশায় ডুবে যেতে লাগল। নেশা করলে সে হয়ে উঠত উন্মাদ। কখনো থালা-বাসন ছুড়ে মারত, কখনো অকারণে নন্দিতাকে টেনে হিঁচড়ে মারধর করত।

শ্বশুরবাড়ির অন্যরা সব দেখত, কিন্তু চুপ থাকত। কেউ প্রতিবাদ করত না।
গ্রামের লোকেরাও জানত, কিন্তু ভয়ে বা সামাজিক চাপে মুখ বন্ধ রাখত।

নন্দিতা এ অবস্থায় শুধু তার শিশুপুত্রকে আঁকড়ে বাঁচতে শিখল। প্রতিদিন রাতের শেষে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বলত—
“তুই আমার আলো। তুই থাকলেই আমি বাঁচতে পারি।”

pratisodh er agni sikha 2

তার নিজের চোখের জল সে লুকিয়ে রাখত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রতিদিন একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছিল।

চরম বিশ্বাসঘাতকতা

নন্দিতার ছেলে তখন মাত্র পাঁচ বছরের। গোলগাল মুখ, চঞ্চল চোখ, সারাক্ষণ মায়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করত। তার হাসিই ছিল নন্দিতার একমাত্র ভরসা। সংসারের সব দুঃখ, শ্বশুরবাড়ির সব যন্ত্রণা ভুলে যেতে সে ছেলেটির মুখের দিকে তাকালেই বুক ভরে উঠত।

কিন্তু সুখ যেন বেশিদিন তার কপালে লেখা ছিল না।

সেদিন সন্ধ্যায় রঘুনাথ আবারও ব্যবসায় লোকসান খেয়ে মাতাল হয়ে ফিরেছিল। বাড়ি ঢুকেই গলা চড়িয়ে গালাগালি শুরু করল।
“সব আমার সর্বনাশ! আমার ঘরে অশুভ বউ ঢুকেছে বলেই আজ আমি শেষ!”

নন্দিতা চেষ্টা করল শান্ত করতে। কিন্তু রঘুনাথ তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
হঠাৎ সে চোখ রাঙিয়ে শিশুটির দিকে তাকাল।
“এই ছেলে! আমার অমঙ্গলও তোর জন্য!”

নন্দিতা আঁতকে ছেলেকে আঁকড়ে ধরল। কিন্তু মাতাল রঘুনাথ ছেলেটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
“চুপ কর, হারামজাদা!” বলে সে ছেলেকে ধাক্কা মারল।

নন্দিতা বুকের ভেতর চিৎকার করে উঠল—
“না! ওকে হাত দিস না!”

সে ছেলেকে আড়াল করার চেষ্টা করল। কিন্তু রঘুনাথ তাকে জোরে ঠেলে ফেলে দিল।
অসহায় শিশুটি ধাক্কায় মাটিতে আছড়ে পড়ল। মাথায় আঘাত লাগল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নন্দিতার কানে শোনা গেল নাড়িভুঁড়ি কাঁপানো নীরবতা—ছেলেটি নড়ছে না, তার ছোট্ট বুক ওঠানামা করছে না।

আতঙ্কে সবাই ছুটল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার এলেন। কয়েক মিনিটের চিকিৎসার পর তিনি মাথা নাড়লেন।
“আমরা দুঃখিত। শিশুটিকে আর বাঁচানো গেল না।”

নন্দিতা নির্বাক হয়ে গেল। কান্নাও যেন শুকিয়ে গেল।
তার চোখ স্থির হয়ে রইল ছেলের নিথর শরীরে।

মুহূর্তটিতে মনে হল, তার বুকের ভেতর সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
সে ধীরে ধীরে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল—
“তুই আমার প্রাণ ছিলি। আজ তুই চলে গেলি। কিন্তু শোন, আমি তোকে অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া মানুষটাকে ছাড়ব না।”

তার চোখে তখন আর জল ছিল না। শুধু দপদপে আগুন।

আগুনে রূপান্তর

ছেলের মৃত্যুর পর গ্রামের আকাশ যেন হঠাৎ রঙ হারিয়ে ফেলল। ঘরে কান্নার শব্দ নেই, শুধু হাহাকারমাখা নীরবতা। লোকজন এসে সান্ত্বনা দিলেও নন্দিতার মুখে কোনো উত্তর ছিল না। তার চোখে অশ্রু নয়, বরং অগ্নিশিখার মতো এক দৃষ্টি।

রঘুনাথ প্রথমে কিছুটা অপরাধবোধের ভান করেছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আবার আগের মতো হয়ে গেল। মদ খাওয়া, চিৎকার, গালাগালি—সব আগের মতোই চলতে লাগল। যেন ছেলের মৃত্যু কেবল নন্দিতার দুঃখ, তার নয়।

এক রাতে নন্দিতা একা বসে ছেলের ছোট জামাটা বুকে চেপে রাখল। চারপাশ অন্ধকার, কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয় তার মুখটা যেন অন্য কারও মুখ হয়ে উঠেছিল। ঠোঁট কামড়ে সে নিজের মনে বলল—

“আমি অনেক সহ্য করেছি। স্বপ্ন ভাঙার বেদনা, লাঞ্ছনার বেদনা, আর আজ সন্তানের মৃত্যু। আর নয়। এবার আমি বাঁচব, তবে প্রতিশোধ নিতে। তোকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমি থামব না, রঘুনাথ।”

পরদিন ভোরে নন্দিতা এক আশ্চর্য সিদ্ধান্ত নিল। ভোরের আলো ফোটার আগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। পায়ে শুধু একজোড়া স্যান্ডেল, হাতে ছোট্ট ঝোলা। নিজের গ্রাম, নিজের অতীত, নিজের সমস্ত দুঃখকষ্ট পিছনে ফেলে সে পা বাড়াল শহরের দিকে।

প্রথম কিছুদিন কলকাতায় তার জীবন ছিল অমানবিক কষ্টে ভরা। লোকের বাড়ি ঝি-এর কাজ করত, সেলাই শিখল, রাতে টিউশনি করে কিছু টাকা জমাত। কখনো পেট ভরে খেতে পেত না, কখনো রেলস্টেশনের বেঞ্চে ঘুমাত।

কিন্তু নন্দিতা ভাঙল না। সে জানত, তার লক্ষ্য শুধু বেঁচে থাকা নয়—নিজেকে গড়ে তোলা, শক্ত করা, প্রতিশোধের আগুনে আরও তেজী হওয়া।

দিনের পর দিন কেটে গেল।
সে সেলাই মেশিন কিনল, কাজ বাড়ল। টাকায় প্রাইভেট টিউটর রেখে আবার পড়াশোনা শুরু করল। স্কুলের সনদ পেল, কলেজে ভর্তি হল। রাত জেগে পড়াশোনা করত, দিনে কাজ করত।

এদিকে নিজের সুরক্ষার জন্য আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিল। কিছুদিন পর সে এক এনজিও-তে কাজ শুরু করল, যেখানে নির্যাতিতা নারীদের সাহায্য করা হত। সেই কাজেই তার আত্মা যেন নতুন করে জেগে উঠল।

দশ বছরের মধ্যে এক গৃহবধূ থেকে সে হয়ে উঠল দৃঢ়, শিক্ষিত, সমাজকর্মী নারী—নন্দিতা সেনগুপ্তা
এখন তার পরিচিতি শহর জুড়ে। সে মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলা তোলে।

কিন্তু তার বুকের ভেতরে জমে থাকা আগুন এখনো নিভে যায়নি।
সে জানত—এই লড়াই কেবল সমাজের জন্য নয়, ব্যক্তিগত প্রতিশোধও বাকি।
আর সেই প্রতিশোধের লক্ষ্য একটাই নাম—রঘুনাথ ঘোষ

প্রতিশোধের ছক

দশ বছর পরেও নন্দিতার ভেতরের আগুন নিভল না। বরং সময় তাকে আরও ধারালো করে তুলেছে প্রতিশোধের অগ্নিশিখা। সমাজকর্মী হিসেবে এখন তার নামডাক হয়েছে। কিন্তু অন্তরের গভীরে যে শপথ সে নিয়েছিল, তা প্রতিদিন তাকে তাড়া করে ফিরত—
“রঘুনাথকে ধ্বংস করতে হবে।”

একদিন হঠাৎ খবর পেল, রঘুনাথ এখনো গ্রামে টিকে আছে। ব্যবসা প্রায় ডুবন্ত, কিন্তু মদের নেশা আর দাপট আগের মতোই আছে। গরিব চাষিদের জমি দখল করছে, মেয়েদের হয়রানি করছে, টাকায় প্রভাব খাটাচ্ছে।

নন্দিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“এখনও বদলায়নি সে। তাহলে এবার আমাকেই ওর সর্বনাশ ঘটাতে হবে।”

প্রথম পদক্ষেপ

সে গ্রামে থাকা কিছু পুরনো পরিচিতকে দিয়ে খবর জোগাড় করল। ব্যবসার হিসেব, কালো টাকা, বেআইনি জমি দখলের নথি—সব ধীরে ধীরে হাতে আসতে লাগল।
রাতে ঘরে বসে সে প্রতিটি কাগজ গোছাতে থাকত।
“এবার সময় এসেছে তোকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর।”

দ্বিতীয় পদক্ষেপ

নন্দিতা তার এনজিও-র মাধ্যমে নারী নির্যাতনের অভিযোগগুলো সামনে আনল। অনেক গৃহবধূ, যারা এতদিন ভয়ে মুখ খোলেনি, তারা নন্দিতার পাশে এসে দাঁড়াল।
“আপনি আমাদের সাহস দিয়েছেন, দিদি। আমরা এবার সত্য বলব।”

এই সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সে থানায় কেস করল। কোর্টেও মামলা দায়ের হল।

বাধা

কিন্তু রঘুনাথও কম চতুর নয়। টাকার জোরে আইনজীবী কিনে নিল, সাক্ষীদের ভয় দেখাল। কোর্টে মামলাগুলো বারবার পিছোতে লাগল।
লোকেরা বলতে লাগল—
“রঘুনাথকে কিছু করা যাবে না। টাকার ক্ষমতার কাছে আইনও হেরে যায়।”

কিন্তু নন্দিতা হাল ছাড়ল না।
তার চোখে তখন দৃঢ় সংকল্প—
“শুধু আইনের পথে নয়, আমি ওকে সব দিক থেকে ভেঙে দেব। টাকা, ক্ষমতা, অহংকার—সবকিছু আমি কেড়ে নেব।”

তৃতীয় পদক্ষেপ

সে সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। কাগজপত্র, ঘুষখোরির তথ্য, কালোবাজারি—সব মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিল।
পরদিনই সংবাদপত্রে বড় হেডলাইন বেরোল—
“গ্রামীণ ব্যবসায়ী রঘুনাথ ঘোষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ।”

গ্রামে আলোড়ন পড়ে গেল। ব্যাংক তার ঋণ বন্ধ করে দিল। ব্যবসার সঙ্গীরা মুখ ফিরিয়ে নিল।

রঘুনাথ বুঝতে পারল, কেউ তাকে টার্গেট করেছে।
কিন্তু সে জানত না, অন্ধকার থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এক নারী—যে একসময় তার ঘরের মধ্যে লাঞ্ছিত হয়েছিল, আজ যে অগ্নিশিখায় রূপ নিয়েছে।

আগুনে আগুন

রঘুনাথের দিনগুলো এখন আগের মতো ছিল না। জীবনটা নাম শুধুই—ঘর-দোকান-মদের চাকা। ব্যবসায় একের পর এক আঘাত—ক্লায়েন্টদের বিশ্বাস কেটে গিয়েছে, ব্যাংক ধীরে ধীরে দুরত্ব রাখছে, বাঁশি বাজানোর মতো লোকখানিও নেই। লোকালয়ে চেনা মানুষগুলোর চোখে কোনো রূপ ছিল না, শুধু কৌতূহল আর কিছুর পরিণতিতে হাহাকার।

প্রথম কয়েকদিন সে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল—এগুলো কেবল অদূরদর্শী লোকালয়ের কথা, সময়মত সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন ব্যাংক কর্মকর্তা তার দরজা তালাবদ্ধ করে দিল, তখন ভয়টা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। মানুষ বলত—“এই বিরুদ্ধে তো আর কেউ কিছু করতে পারবে না।” অথচ রাতের অন্ধকারে সে বুঝতে পারত, কোথাও কেউ তাকে কাঁধ চাপছে না।

নন্দিতা ছায়ার মতো কাজ চলছিল। তিনি মিডিয়ার হেডলাইনে ঠাঁই দিয়ে নেমে আসেননি কেবল। তিনি গ্রাম-কলোনির প্রান্তে, জমি-দালালের লেনদেনে, মাতাল ও ক্ষমতাবান লোকদের গোপন কক্ষেও ঢুকেছিলেন—শহরের অধার্মিক জায়গা থেকে শুরু করে গ্রামের গলিপথ পর্যন্ত। তিনি সেখানে সাক্ষ্য জোগাড় করলেন, শাস্তিমূলক কাগজপত্র পেলেন, জোরালো ছবি ও তথ্য—সবই একসঙ্গে জোট বেঁধে রঘুনাথকে ঘিরে ফেলল।

শুরুতে রঘুনাথ পাগলের মতো প্রতিরোধ করতে চাইল। টাকায় মানুষ কিনল, হুমকি দিল, মামলা পিছিয়ে দিতে ভুগল। কিন্তু একের পর এক লোক মুখ খুলল। যে লোকেরা আগে ওর পাশে দাঁড়াত, তারা এখন কাঁধ সরিয়ে নিল—কারণ ওদের জীবনেও নষ্ট হতে বসেছে, এবং নন্দিতার কাছে তাদেরও কিছু গোপন কথা ছিল।

একদিন রাতে, গ্রামের এক ছোট্ট মন্দিরের সামনেই, কয়েকজন লোক রঘুনাথকে কড়া বক্তব্য দিল—“তুমি যে ভালো ছিলে না, সেটা সবাই জানে। আজকে তোমাকে নিজেরই কাজের ফল ভোগ করতে হবে।” তারা শুধু কথা বলল না; তাদের হাতে ছিল কাগজের বান্ডিল—অর্থ লেনদেনের রেকর্ড, জমির বেআইনি দলিল, সরকারের অনুমোদনবিহীন চুক্তির নকল।

রঘুনাথ চিনতে পারল, তার কাজগুলো শুধু আর গোপন রাখা যায় না। তার ধন-শক্তি ক্ষয় হতে লাগল, সামাজিক মর্যাদা লুটে গেল। ব্যবসার দরজা বন্ধ হতে লাগল, ক্রেতারা পিছিয়ে গেল।

নন্দিতা কখনোই ব্যক্তিগত আঘাত-প্রতিঘাতের পথে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। কিন্তু এখন তিনি বুঝলেন, আগুনে আগুন জ্বালিয়েই পুরোনো এই কুঠোরকে ভেঙে ফেলা যাবে। তিনি আর বাধ্য হলেন না কেবল আইনের কাগজে ভর করেই বসে থাকতে; তিনি মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত করলেন, সাংবাদিকদের হাত ধরলেন, আর সিস্টেমের ফাঁক খুঁজে বের করে সেগুলোতে আলোকপাত করলেন।

রঘুনাথের জীবন ছোট ছোট টুকরো টুকরো হয়ে পড়তে লাগল। যারা একসময় তার ভয়ে তালগোল পাকান, তারা এখন মুখ কুবো করে চলছে—বেআইনি কাজে নাম ধরে স্বাক্ষ্য দিচ্ছে, তাদের জমি ফেরত নিচ্ছে, দোকানগুলো তালাবদ্ধ করছে। গ্রামে এক রকম স্থিরতা নেমে এল—যেখানে আগে ছিল অবিচারের বাতাবরণ, এখন সেখানে রণে মুক্তির অনুভূতি ঘনীভূত হতে লাগল।

শেষ মুখোমুখি

এক রাতে রঘুনাথ মাতাল হয়ে নিজের বাড়ির আঙিনায় বসেছিল।
অন্ধকার থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল নন্দিতা।

রঘুনাথ স্তম্ভিত।
“তুই! এতদিন পর? এখানে কেন এসেছিস?”

নন্দিতা শান্ত গলায় বলল—
“তুই আমার সন্তানকে মেরেছিলি। আমাকে জীবন্ত মৃত বানিয়েছিলি। আজ আমি ফিরেছি, তোর সর্বনাশ দেখতে।”

রঘুনাথ চিৎকার করে বলল—
“সব তুই করেছিস! আমার ব্যবসা, আমার টাকা—সব শেষ হয়ে গেছে তোর জন্য!”

নন্দিতা এগিয়ে এল, চোখে জ্বলন্ত শিখা।
“এটাই প্রতিশোধ। আমি তোকে হাতে মারিনি, কিন্তু তোর অহংকার, তোর ক্ষমতা, তোর সবকিছু কেড়ে নিয়েছি।”

প্রতিশোধের অগ্নিশিখা

রঘুনাথ ভয়ে পিছু হটতে লাগল। হঠাৎ তার বুক চেপে এল। মদে জর্জরিত শরীর হার মানল। সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

প্রতিশোধের আলোর জ্বলা

রঘুনাথ মারা গেল। কেউ বলল হার্ট অ্যাটাক, কেউ বলল শত্রুর কাজ।
কিন্তু নন্দিতা জানত—এ ছিল ভাগ্যের আদালত, যেখানে সে ন্যায় পেয়েছে।

গ্রামে লোকেরা অবাক হয়ে দেখল—নন্দিতা এখন নারী সংগঠনের নেত্রী। সে গ্রামে স্কুল বানাল, মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করল।
সে বলত—
“নারী মানে দুর্বল নয়। যে অন্যায় সহ্য করে, সে দুর্বল। যে প্রতিবাদ করে, সে-ই শক্তি।”

নন্দিতার প্রতিশোধ শুধু ব্যক্তিগত ছিল না। সে নিজের যন্ত্রণা দিয়ে এক নতুন সমাজ গড়ল।
যে নারী একদিন ভাঙা ছিল, আজ সে হয়ে উঠল অনুপ্রেরণা।

তার গল্প শিখিয়ে গেল—
“যখন এক নারী জেগে ওঠে, তখন অন্যায়ের সমস্ত দুর্গ ভেঙে পড়ে।”

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *