অভিশপ্ত বইয়ের রহস্য
তালাবদ্ধ দরজা
কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের ব্যস্ততম রাস্তায় পুরোনো এক লাইব্রেরি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দেড়শো বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে। একসময় এখানে প্রতিদিন ভিড় জমত ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক আর সাহিত্যপ্রেমীদের। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে— নতুন প্রযুক্তি, ডিজিটাল বইয়ের ভিড়ে এই লাইব্রেরি যেন একরকম বিস্মৃতপ্রায়। তবুও এর ভেতরে পা রাখলেই মনে হয়, ইতিহাস যেন নীরবে শ্বাস নিচ্ছে প্রতিটি তাকের মাঝে জমে থাকা ধুলোর স্তরে।
এই লাইব্রেরিরই দ্বিতীয় তলায় আছে এক পুরোনো ঘর। কাঠের মোটা দরজা, কালচে তালায় শক্ত করে বাঁধা। কেউ জানে না ভেতরে কী আছে, কবে থেকে তালা পড়েছে, এমনকি কাকে বারণ করা হয়েছিল। পুরোনো কর্মচারীরা ফিসফিসিয়ে বলেন, অনেক আগেই সেখানে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছিল। সে নাকি এক রহস্যময় বই পড়তে গিয়ে উন্মাদ হয়ে যায়। তারপর একদিন সেই ঘরের ভেতর থেকে তার নিথর দেহ উদ্ধার হয়। ঘটনার পর থেকেই ঘরটি সিল করা হয় এবং আর কেউ ভেতরে ঢোকেনি।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝেই পাহারাদাররা দাবি করেন— রাতে টহল দেওয়ার সময় তারা ওই ঘর থেকে মৃদু আলো দেখতে পান। কেমন যেন একটা হলুদাভ আলো, যেন কেউ লণ্ঠন জ্বেলে বসে পড়ছে। আবার শোনা যায় পাতার শব্দ, হালকা কাশির আওয়াজও। অথচ ঘরটা তো তালাবদ্ধ!
সেই লাইব্রেরিতে নতুন এসেছেন অনির্বাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের গবেষক। কৌতূহলই তার আসল দুর্বলতা। পুরোনো নথি, হারিয়ে যাওয়া কাহিনি, অজানা তথ্য ঘেঁটে বেড়ানো তার নেশা। যখন প্রথম দিন সে লাইব্রেরির কর্মচারীদের মুখে ওই ঘরের কথা শোনে, তার বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে।
সেদিন রাতেই, একরকম অকারণে সে আবার লাইব্রেরির সামনে চলে আসে। রাস্তাঘাট তখন নির্জন, হালকা কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। ভেতরে ঢোকার উপায় নেই, তাই সে চারপাশ ঘুরে দেখতে থাকে। হঠাৎই নজরে আসে— দ্বিতীয় তলার ভাঙাচোরা জানালার ফাঁক দিয়ে সত্যিই আলো ছড়িয়ে আসছে!
অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে যায়। গা-ছমছমে ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। সে মনে মনে ভাবে— “এ আলো কি সত্যিই কেবল কাকতালীয়? নাকি কারো উপস্থিতি আছে ভেতরে?”
পরদিন সকালে সে পাহারাদার হরিপদকে জিজ্ঞেস করে। হরিপদ প্রথমে কিছু না বলে চুপ করে থাকে, তারপর নিচু গলায় বলে ওঠে—
“বাবু, ওই ঘরে যেয়েন না। আলো যেমনই দেখুন, শব্দ যেমনই শুনুন… বিশ্বাস করবেন না। যে ঢোকে, সে আর বদলায় না।”
অনির্বাণের চোখে তখন আগুন জ্বলে ওঠে। অজানা রহস্যের টান তার রক্তে খেলা করে। সে সিদ্ধান্ত নেয়— যত ঝুঁকিই থাকুক, ওই ঘরের ভেতরে একদিন না ঢুকলে তার শান্তি নেই।
সেদিন রাতে আবারও অনির্বাণ দাঁড়ায় লাইব্রেরির গেটের সামনে। দূরে কোথাও শাঁখ বাজছে, রাস্তায় বাতির আলো নিস্তেজ হয়ে আছে। আর ঠিক তখনই সে আবারও দেখে— সেই তালাবদ্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে হলুদাভ আলো বেরিয়ে আসছে, ধীর-গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, যেন কেউ পড়ছে কোনো অজানা ভাষার বই।
তার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ বেড়ে যায়। সামনে আসছে এমন এক রহস্য, যা হয়তো তার জীবনকেই বদলে দেবে চিরদিনের জন্য।
নিষিদ্ধ বই
পরদিন সকালে অনির্বাণ আর স্থির থাকতে পারল না। সে সরাসরি লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক নীলমণি বাবুর কাছে গিয়ে জানতে চাইলো,
— “ওই ঘরটা কেন তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে? ভেতরে কী আছে?”
নীলমণি প্রথমে কপাল কুঁচকালেন। তারপর চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে ধীরে ধীরে বললেন,
— “তুমি নতুন এসেছ, তাই জানো না। সেই ঘর বহুদিন আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, ভেতরে কিছু পুঁথি আর অদ্ভুত কয়েকটা বই রাখা আছে। যে বই পড়লে মানুষের মস্তিষ্ক কেমন যেন বদলে যায়। অনেকে বলেছে, ওই বই অভিশপ্ত।”
অনির্বাণ মৃদু হেসে বললো,
— “বই কি কখনও অভিশপ্ত হয় নাকি? ওসব গল্প।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করল, রহস্যটা আরও গভীর।
সেই রাতেই সে চাবির ডুপ্লিকেট বানিয়ে ফেলে। লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেলে, হরিপদ পাহারা দিতে বেরিয়েছে— ঠিক সেই সময় অনির্বাণ নিঃশব্দে তালা খুলে দেয়। কাঠের দরজা ধীরে ধীরে খোলা মাত্রই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক ধরনের স্যাঁতসেঁতে, পুরোনো গন্ধ, যেন বহু বছর ধরে আলোবাতাস প্রবেশ করেনি।
ঘরটা ছোট নয়— চারদিকে আলমারি, ধুলোমাখা বইয়ের স্তূপ, আর মাঝখানে একটি ভারি কাঠের টেবিল। টেবিলের উপর একটা লণ্ঠন রাখা, যদিও কে বা কবে সেটা জ্বালালো, তার কোনো চিহ্ন নেই।
অনির্বাণের চোখ আটকে গেল টেবিলের মাঝখানে রাখা এক মোটা, কালচে-চামড়ার মলাটে বাঁধা বইতে। এর উপর অদ্ভুত প্রতীক আঁকা, যেগুলো সে কোনো ভাষায় চিনতে পারল না। বইটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে, নিঃশব্দে ডাকছে।
সে সাবধানে মলাট খুলতেই বুকের ভেতর শিহরণ খেলে গেল। প্রথম পাতায় লেখা—
“এই বই যে পড়বে, সে আর আগের মতো থাকবে না। অতীতের অন্ধকার তাকে ছুঁয়ে যাবে, ভবিষ্যতের আলোকে গ্রাস করবে।”
অনির্বাণের হাত কাঁপতে লাগল। কিন্তু কৌতূহল তাকে টেনে নিল। কয়েকটা পাতা উল্টাতেই দেখতে পেল— অদ্ভুত কিছু প্রতীক, মন্ত্রের মতো শব্দ, আবার কোথাও কোথাও অচেনা ছবির মতো আঁকিবুকি।
হঠাৎ বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল। লণ্ঠনের আলো কেঁপে উঠল। মনে হলো, বইয়ের ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ গুঞ্জন বেরোচ্ছে— ফিসফিস… ফিসফিস…
অনির্বাণ ভয়ে বইটা বন্ধ করে দিতে চাইল, কিন্তু হাত যেন আটকে গেল। বুকের ভেতর তীব্র ধুকপুক শব্দ। কানে যেন শব্দ ভেসে আসছে—
“পড়ো… আরও পড়ো… আমার গল্প শোনো…”
হঠাৎ ঘরের কোণে কেমন এক ছায়া নড়ল। অনির্বাণ ঘুরে তাকিয়ে দেখল, ম্লান অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা অবয়ব। মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু চোখ জ্বলজ্বল করছে লালচে আগুনের মতো।
অনির্বাণের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল—
এটা কেবল একটা বই নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন এক শক্তি, যা মানুষের হাতের বাইরে।
অজানা ছায়া
অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের ভেতর যেন শিরশিরে ঠাণ্ডা স্রোত বইছে। ছায়াটা নড়ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু মাটিতে তার কোনো প্রতিফলন পড়ছে না। যেন বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝামাঝি এক অস্তিত্ব।
তার ঠোঁট শুকিয়ে গেল, বুক থেকে বেরোল একরাশ ভাঙা স্বর—
— “কে… কে আপনি?”
কোনো উত্তর নেই। শুধু ছায়ার চোখদুটো আরও জ্বলজ্বল করে উঠল। মুহূর্তের মধ্যেই বইয়ের পাতা হাওয়ায় নিজের মতো উল্টাতে শুরু করল। প্রতিটি পাতার সঙ্গে কানে বাজল অচেনা শব্দ, যেন বহু পুরোনো কোনো ভাষার মন্ত্র পাঠ হচ্ছে।
অনির্বাণ কানে হাত চেপে ধরল, কিন্তু শব্দ থামল না। বরং মনে হলো ওই শব্দ সরাসরি তার মগজে ঢুকে যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে এল। মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা যেন কঠিন হয়ে উঠল।
হঠাৎই ছায়াটা এগিয়ে এল। ঠান্ডা হাওয়া কাঁপিয়ে দিল চারপাশ। অনির্বাণ টলতে টলতে টেবিলের উপর ভর দিল। বইয়ের উপর তার হাত পড়তেই বুকের ভেতর এক ঝাঁকুনি অনুভব করল।
চোখের সামনে খুলে গেল অন্য এক দৃশ্য—
সে যেন দাঁড়িয়ে আছে কোনো ভাঙাচোরা প্রাসাদের অন্দরমহলে। চারপাশে ধ্বংসস্তূপ, আগুনে দগ্ধ দেয়াল। আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই একই ছায়ামূর্তি, এবার তার ঠোঁট নড়ছে—
— “তুমি আমাকে মুক্তি দাও।”
অনির্বাণ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
— “তুমি কে? কেন আমাকে ডাকছ?”
ছায়াটা কেঁপে উঠল, স্বর এল ভাঙা ভাঙা—
— “আমি এই বইয়ের ভিতরে বন্দি… বহু বছর ধরে। যে পড়তে সাহস করবে, তাকে আমার গল্প শেষ করতে হবে। না হলে আমি চিরকাল ঘুরে বেড়াব… আর পাঠকও হারিয়ে যাবে আমার সঙ্গে।”
অবাক হয়ে চারপাশ দেখল অনির্বাণ। দৃশ্যটা যেন বাস্তব, অথচ সে জানে, সে এখনও লাইব্রেরির ঘরেই আছে। এটা বইয়ের এক অদ্ভুত ভ্রম— তবুও এত স্পষ্ট, এত বাস্তব!
হঠাৎই সব মিলিয়ে গেল। আবার সে নিজেকে দেখতে পেল সেই ধুলো জমা ঘরে। কিন্তু শরীর ঘামে ভিজে গেছে, কাঁপুনি থামছে না।
সে দ্রুত বইটা বন্ধ করে দিল। ঘরের বাতাস ভারি হয়ে আছে, কিন্তু ছায়ামূর্তি আর নেই।
কিন্তু যাওয়ার আগে ছায়া যেন কানে ফিসফিস করে রেখে গেল—
“তুমি শুরু করেছ… শেষ না করে পালাতে পারবে না।”
অনির্বাণ হোঁচট খেতে খেতে ঘর থেকে বেরোল। দরজায় তালা লাগালেও মনে হলো ভেতর থেকে কারও নিঃশ্বাস পড়ছে, পাতার শব্দ এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তারপর থেকে প্রতিদিন রাতেই অনির্বাণ অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগল। কখনও আগুনে জ্বলতে থাকা মানুষ, কখনও ভাঙা প্রাসাদ, কখনও সেই লালচোখের ছায়া। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলেই শরীর অবশ, চোখের নীচে কালি।
সে বুঝল— বইটা একবার খুলে ফেলার পর আর স্বাভাবিক থাকা সম্ভব নয়। রহস্যটা ভেদ করতে হবে, নইলে ওই ছায়া তাকে ধ্বংস করবে।
অন্ধকারে নামহীন ভয়
দিনের আলোয় অনির্বাণ যতই নিজেকে বোঝাতে চেয়েছে—সব কেবল বিভ্রম, ভয় পেলে চলবে না—রাত নামলেই সেই অজানা আতঙ্ক আবার ছায়ার মতো ঘিরে ধরতে লাগল।
তৃতীয় রাতের ঘটনা যেন তার সহ্যের সীমা ভেঙে দিল।
সেদিন গভীর রাত, বাইরে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। হঠাৎ অনির্বাণের ঘুম ভেঙে গেল এক অদ্ভুত শব্দে। মনে হলো, কেউ ফিসফিস করে ডাকছে তার নাম—
“অনির্ব্ব্বাণ… অনির্ব্ব্বাণ…”
চারদিকে তাকিয়ে দেখল, তার টেবিলের উপর যে বইটা তালা মেরে রেখেছিল, সেটা খোলা পড়ে আছে! অথচ সে তো নিশ্চিত ছিল বইটা লাইব্রেরির ঘরেই রেখে এসেছিল।
পাতাগুলো নিজের মতো উল্টে যাচ্ছে। প্রতিটি পাতার সঙ্গে হঠাৎ কর্কশ শব্দ কানে বাজছে, যেন কেউ নখ দিয়ে কাঁচ ঘষছে।
ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠল, জানলা হঠাৎ নিজে থেকেই খুলে গেল, ঝোড়ো হাওয়ায় কাগজপত্র উড়ে যেতে লাগল। আর সেই হাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে স্পষ্ট দেখা গেল— ছায়াটা দাঁড়িয়ে আছে জানলার ধারে।
চোখদুটো লাল আগুনের মতো, মুখের রেখা অস্পষ্ট, কিন্তু দাঁতের আভা যেন ভয়ানক শ্বাপদীর মতো।
অনির্বাণ বিছানার কোণে সরে গিয়ে চিৎকার করতে গেল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। বুকের ভেতর হিম হয়ে গেছে। ছায়াটা ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল।
অদ্ভুত গন্ধে ভরে গেল চারপাশ— ধোঁয়া, পচা কাগজ আর রক্তমেশানো গন্ধ।
হঠাৎ বইটা তীব্র শব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল। পাতার ভেতর থেকে যেন হাত বেরিয়ে এলো, কালো ছোপ ছোপ আঙুল— সেগুলো এগিয়ে এলো অনির্বাণের দিকে।
সে প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কানে আবার সেই স্বর—
— “তুমি আমাকে মুক্ত করো… নইলে তুমি-ও বন্দি হবে। সময় ফুরিয়ে আসছে।”
ভয়ে আর কৌতূহলে অনির্বাণ বুক কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল—
— “কীভাবে তোমাকে মুক্ত করব?”
সেই ছায়া তখন প্রায় তার মুখের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাড় ঠাণ্ডা শ্বাস পড়ছে তার গালে।
— “আমার গল্প শেষ করো। বইয়ের শেষ পাতায় পৌঁছাও। সেখানে সত্য লুকিয়ে আছে। যদি পারো… তবে বাঁচবে। না হলে তুমি-ও হারিয়ে যাবে আমার সঙ্গে।”
হঠাৎই বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেল। জানলা আবার বন্ধ হয়ে গেল তীব্র শব্দে। ছায়াটা মিলিয়ে গেল, কিন্তু বইটা মেঝেতে খোলা রয়ে গেল— ঠিক শেষ পাতার আগের জায়গায়।
অনির্বাণ বুঝল—এখন আর পালানো যাবে না। সত্যের শেষ অধ্যায় না পড়লে এই দুঃস্বপ্ন কখনও থামবে না। কিন্তু শেষ পাতায় কী আছে? মুক্তি? নাকি মৃত্যু?
সেই প্রশ্ন নিয়েই তার রাত্রি কেটে গেল নির্ঘুম, বুকের ভেতর অচেনা ভয়ের কাঁপুনিতে।
সত্যের উন্মোচন
পরদিন সকালে অনির্বাণ আর সময় নষ্ট করল না। ব্যাগে কিছু দরকারি জিনিস—টর্চ, পানীয় জল, আর একটি পুরোনো লণ্ঠন নিয়ে সে আবার পা রাখল সেই লাইব্রেরির অভিশপ্ত ঘরে।
ঘরের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত সুর, যেন অনেকগুলো মানুষ একসাথে ফিসফিস করছে। অনির্বাণ বুক কাঁপতে কাঁপতে টেবিলের উপর রাখা বইটার দিকে এগোল। বইটা এবার যেন আগেই প্রস্তুত হয়ে আছে— পাতাগুলো খোলা, আর শেষ পাতার দিকে হালকা হাওয়া বইছে।
সে বুক কাঁপতে কাঁপতে বইটা উল্টাতে লাগল। প্রতিটি পাতায় অদ্ভুত প্রতীক, আঁকিবুকি, আর কোথাও কোথাও রক্তমাখা অক্ষর। মনে হচ্ছিল—এই বইটা লেখা হয়নি, বরং রক্ত দিয়ে কেটে কেটে বানানো হয়েছে।
অবশেষে সে পৌঁছে গেল শেষ পাতায়। আর তখনই চারদিক কেঁপে উঠল। বাতাস নিস্তব্ধ, লণ্ঠনের আলো নেভে গেল, ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল।
অন্ধকারের মাঝে ভেসে উঠল সেই লালচোখ ছায়া। এবার তার স্বর স্পষ্ট, গম্ভীর, অথচ ভাঙাচোরা—
— “আমার নাম শম্ভু মুখোপাধ্যায়। একসময় আমি এই শহরের ইতিহাসবিদ ছিলাম। অতিপ্রাকৃতের খোঁজে নেমে পড়েছিলাম। এই বইয়ের পাতায় আমি বন্দি হয়েছি—আমার লোভ আর ভুলের জন্য। আমি চেয়েছিলাম চিরজীবন, আর এই বই তার বিনিময়ে আমাকে দিয়েছে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা। শতাব্দীর পর শতাব্দী আমি বন্দি হয়ে আছি। তোমাকে বেছে নিয়েছে বই, কারণ তুমি পড়তে সাহস করেছ। এখন তোমার হাতে আমার মুক্তি।”
অনির্বাণ কাঁপা গলায় বলল—
— “কীভাবে তোমাকে মুক্তি দেব?”
ছায়াটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগোল। ঘরের চারদিক কেঁপে উঠছে, যেন বইয়ের ভেতর থেকে অসংখ্য অদৃশ্য হাত বেরিয়ে আসছে।

— “শেষ লাইনটা পড়ো। কিন্তু মনে রেখো— শেষ লাইন পড়লেই তুমি সিদ্ধান্ত নেবে, আমাকে মুক্ত করবে নাকি আমাকেই হয়ে যাবে।”
অনির্বাণ কাঁপতে কাঁপতে বইয়ের দিকে তাকাল। শেষ পাতায় কেবল একটি বাক্য লেখা—
“যে পাঠক এই পৃষ্ঠা পড়বে, সে যদি সত্য উচ্চারণ করে— আমি মুক্ত হবো। যদি নীরব থাকে— আমি তার শরীরকে গ্রাস করব।”
অনির্বাণের বুক ধুকপুক করছে। সে বুঝল, তাকে সত্য বলতে হবে। কিন্তু সত্য কী? হঠাৎ তার মনে পড়ল— গবেষণার সময় সে কতবার ভেবেছে, ইতিহাস আসলে মানুষকে শেখায় লোভের মূল্য, ক্ষমতার খেলা, আর মৃত্যুর ভয়।
সে বুক কাঁপতে কাঁপতে চোখ বন্ধ করে বলল—
— “সত্য হলো— মানুষ অমর হতে পারে না। মৃত্যু এড়ানো যায় না। তুমি ভুল করেছিলে।”
এক মুহূর্তের জন্য চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর ভেতর থেকে ভেসে এল এক তীব্র চিৎকার, যেন শত শত বছরের বেদনা একসাথে বিস্ফোরিত হলো। ছায়াটা কেঁপে উঠল, টুকরো টুকরো হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
বইটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। টেবিলের উপর ভেঙে পড়ল ধুলো, শুধু একটা পুরোনো, ক্ষয়ে যাওয়া কলম পড়ে রইল।
অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের ভারি বাতাস হঠাৎ হালকা হয়ে গেল, জানলার বাইরে সকালের আলো ছড়িয়ে পড়ল।
সে বুঝল— অভিশপ্ত বইয়ের রহস্য শেষ হয়েছে। শম্ভু মুখোপাধ্যায়ের আত্মা মুক্তি পেয়েছে।
কিন্তু হেঁটে বেরোনোর সময় তার বুকের ভেতর কেমন একটা ধুকপুকানি টের পেল। আর কানে ভেসে এলো ক্ষীণ এক ফিসফিস—
“তুমি সত্য বলেছ… কিন্তু তুমি-ই তো এখন আমার গল্পের শেষ পাঠক।”
অনির্বাণ থমকে দাঁড়াল। বইটা তো বন্ধ হয়ে গেছে, তবু কি সত্যিই সব শেষ? নাকি সে-ই হতে চলেছে বইয়ের নতুন বন্দি?

 
		 
			 
			 
			 
			 
			