“পথরোধ”
|

“পথরোধ”

রাতের মাঠপথ

আষাঢ় মাসের কালো রাত। আকাশে চাঁদ নেই, মেঘে ঢাকা তারার আলোও ম্লান। চারপাশে নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক আর ব্যাঙের ডাক শুনে বুক কেঁপে ওঠে। বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ, যেন ঝড় আসার আগে এক অজানা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়েছে।

বিনয় ধানক্ষেতে কাজ শেষ করে ফিরছিল। শর্টকাট ধরেছিল মাঠের সরু পথ ধরে। গ্রামের প্রবীণরা বারবার নিষেধ করেছে—“ওই পথে রাতে যাস না, ভালো নয়।” কিন্তু বিনয় এসব কুসংস্কারে ভরসা করে না। হাতে কেরোসিনের লণ্ঠন, কাঁধে লাঙলের দড়ি নিয়ে নিশ্চিন্তে এগোচ্ছিল।

হঠাৎ কুয়াশা নেমে এলো। লণ্ঠনের আলো কাঁপতে কাঁপতে নিভে যাওয়ার মতো হলো। বাতাস এক অচেনা শীতলতা ছড়িয়ে দিল চারপাশে। বিনয়ের কানে যেন কারো ফিসফিসানি ভেসে এলো—অচেনা, কর্কশ, কিন্তু স্পষ্ট।

সে থমকে দাঁড়াল। দূরে, পথের মাঝখানে—এক নারী। কালো শাড়ি পরা, লম্বা খোলা চুল কাঁধ ছাপিয়ে নেমে এসেছে। শরীরটা যেন কুয়াশার সঙ্গে মিশে গেছে, অথচ চোখ দুটি লাল আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে।

বিনয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সে এক পা এগোতেই নারীটাও ধীরে ধীরে মাথা তুলল। সেই দৃষ্টিতে যেন মৃত্যু-শীতল এক হাসি।

পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে—সে যেন শুধু অপেক্ষা করছে, বিনয়কে থামানোর জন্য।

অস্বাভাবিক চিহ্ন

বিনয় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই অচেনা নারীটির দিকে। কুয়াশা ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে, লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় তার মুখটা অস্পষ্ট হলেও চোখের ভেতরের আগুনের মতো জ্বলজ্বলে লালচে আলো স্পষ্ট।

বিনয়ের শরীর ঠাণ্ডায় কাঁপছে, অথচ সে জানে এই শীত নয়—এ এক অন্যরকম ভয়
সে সাহস করে ডাকল—
“কে… কে আছেন সেখানে?”

pathrodh 3

নারী কোনো উত্তর দিল না। শুধু ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। তার প্রতিটি পায়ের আওয়াজ মাঠের নির্জনতায় কানে ভেসে উঠছে—কঠিন, ভারী, যেন মাটিকে চাপা দিচ্ছে।

বিনয় হঠাৎ খেয়াল করল—কিছু একটা অস্বাভাবিক।
আলোটা খানিকটা পরিষ্কার হতেই বুকের ভেতর হিম শীতল হয়ে উঠল।

নারীর পা উল্টো। গোড়ালি সামনের দিকে, আর আঙুলগুলো পিছনের দিকে বাঁকানো!
সে বুঝল, এ কোনো মানুষ নয়।

নারীর চুল এলোমেলোভাবে কাঁধে ঝুলছে, কপালের পাশ থেকে কাদামাটির মতো কালচে দাগ নেমে এসেছে গাল বেয়ে। ঠোঁটে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি—যেন ওর কষ্টে আনন্দ পাচ্ছে।

বিনয় স্থির দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বুক ধড়ফড় করছে। পা মাটি থেকে তুলতে পারছে না। মনে হলো চারপাশের হাওয়া ঘন হয়ে তার শরীর চেপে ধরেছে।

নারী এবার কর্কশ কণ্ঠে বলল—
“পথে দাঁড়িয়েছিস কেন? তুই কি আমাকে দেখছিস?”

বিনয়ের কানে শব্দ ঢুকল, কিন্তু গলা শুকিয়ে গেল। তার মনে হলো—এখন যদি এক পা এগোয়, তাহলে আর কোনোদিন সে ফিরতে পারবে না।

নারী ধীরে ধীরে হাত তুলল। লম্বা, অস্বাভাবিক সরু আঙুল। নখগুলো যেন শুকনো বাঁশের কঞ্চির মতো ধারালো। সে হাত বাড়াল বিনয়ের দিকে, আর পেছনে বাতাসে ভেসে এল এক অচেনা কান্নার আওয়াজ।

সেই মুহূর্তে বিনয় অনুভব করল—এ পথ আর কেবল মাঠের সরু রাস্তা নয়, এ যেন এক অভিশপ্ত সীমানা… যেখানে মানুষ আর অমানুষের মাঝের পর্দা ভেঙে গেছে।

মৃত্যুর স্মৃতি

নারীর হাত প্রায় বিনয়ের মুখের কাছে এসে গিয়েছিল। সে ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। বুকের ভেতর থেকে যেন একসাথে হাজারটা ঢাক বাজছে, তবু চোখ সরাতে পারছে না।

ঠিক তখনই তার মনের গভীরে ঠাকুমার পুরোনো কথা ভেসে উঠল।
“এই মাঠের ধারে কদিন আগেই এক নববধূর প্রাণ গেছিল রে বিনয়। তার স্বামী তাকে দিনরাত অত্যাচার করত। এক ঝড়ের রাতে সে আর সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দেয়। তখন থেকেই তার অশান্ত আত্মা এখানে ঘুরে বেড়ায়। ও আর মানুষ নেই, ও শাকচুনি হয়ে গেছে।”

বিনয়ের গা শিউরে উঠল।
হঠাৎই সে কানে পেল চাপা কান্নার শব্দ—অথচ সেটা যেন কাছেই, ঠিক নারীর বুকের ভেতর থেকে আসছে।

নারী মাথা নিচু করল, তার চুল মুখ ঢেকে দিল। সাদা চোখের ভেতর দিয়ে কালো জল গড়িয়ে পড়ছে, যেন রক্তমাখা অশ্রু।

এক ঝলকেই বিনয় দেখল—গলায় কালো দড়ির দাগ, ঠিক যেন ফাঁসির পর দেহে থেকে যাওয়া ক্ষত। সেই দাগ লালচে হয়ে কেঁপে উঠছে, আর নারীটির মুখ ধীরে ধীরে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।

নারী এক তীব্র চিৎকার করে উঠল। চারপাশের মাঠে যেন প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ করে লণ্ঠনের আলো নিভে গেল। পুরো চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল।

এখন বিনয় কেবল শুনতে পাচ্ছে—
মাঠের সব দিক থেকে আসা অসংখ্য মহিলার কান্না।
কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীর চোখ আরও লাল, আর তার দৃষ্টি যেন বিনয়ের বুক ভেদ করে যাচ্ছে।

ভয়াল মুখোমুখি

মাঠ জুড়ে নিস্তব্ধতা। লণ্ঠনের আলো নিভে যাওয়ায় চারপাশে শুধু ঘন কালো অন্ধকার। কুয়াশা এতটাই ঘন যে হাত বাড়ালেও আঙুল দেখা যায় না।

বিনয় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কেবল শুনতে পাচ্ছে সেই ভৌতিক নারীর শ্বাস-প্রশ্বাস—গভীর, কর্কশ, আর অস্বাভাবিক দীর্ঘ।
তারপর হঠাৎ কানে এলো গলার ভেতর থেকে ভেসে আসা এক অদ্ভুত হাসি—
কখনও খিলখিল, কখনও হাহাকার।

বিনয় বুঝল, তার সামনে থাকা নারী আর মানুষ নেই। এ এক মৃত আত্মা, এক শাকচুনি—যে অর্ধেক পৃথিবীর, অর্ধেক পাতালের।

নারী ধীরে ধীরে মাথা তুলল। চুল সরে গেল মুখ থেকে।
বিনয়ের চোখ ভয়ে স্থির হয়ে গেল—
তার মুখ এখন আর আগের মতো নয়। ঠোঁট ছিঁড়ে গিয়েছে, দাঁতগুলো অস্বাভাবিক বড়, কুকুরের দাঁতের মতো ধারালো। চোখ থেকে রক্ত টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু সেই রক্ত যেন মাটিতে পড়েই মিলিয়ে যাচ্ছে।

নারী এক পা এগোতেই জমি কেঁপে উঠল।
তার উল্টো পায়ের গোড়ালি থেকে হঠাৎ অদ্ভুত শব্দ বেরোল—যেন শুকনো বাঁশ ভাঙছে।

pathrodh 2

বিনয় দৌড়াতে চাইলো, কিন্তু শরীর নড়ছে না। বুকের ভেতর থেকে শ্বাস যেন আটকে আছে। মনে হলো তার শরীর শেকলে বাঁধা।

নারী এবার হাত তুলল।
লম্বা আঙুল, অস্বাভাবিক নখ। নখের মাথা থেকে হালকা ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আর সেই ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে গায়ে এসে লাগতেই বিনয়ের বুক হিম হয়ে গেল।

নারী ফিসফিস করে বলল—
“তোকে তো আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি… এবার যাবি আমার সঙ্গে।”

তারপর হঠাৎ কর্কশ হাসি—
“কেউ ফেরে না এ পথে… কেউ ফেরে না…”

বিনয়ের কানে বাজতে লাগল অসংখ্য ভাঙা গলার আওয়াজ—কান্না, চিৎকার, হাসি একসাথে মিশে গেছে। মনে হলো চারপাশের অন্ধকারই যেন জীবন্ত হয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

সে বুঝল—এ মুহূর্তে যদি কিছু না করে, তাহলে তার জীবন এখানেই শেষ।

মুক্তি না সর্বনাশ

নারীর কর্কশ হাসির প্রতিধ্বনি চারপাশের মাঠ ভরে তুলল। সেই হাসি এত ভয়ঙ্কর যে মনে হচ্ছিল মাটি ফেটে যাবে, আকাশ ভেঙে পড়বে। বিনয় শরীর নড়াতে পারছিল না, বুকের ভেতর শ্বাস আটকে আসছিল।

নারী ধীরে ধীরে তার দিকে ঝুঁকল। লম্বা আঙুলের ধারালো নখ তার গলার কাছে পৌঁছে গেল। চোখের ভেতরকার লালচে আগুন যেন বিনয়ের বুক বিদ্ধ করে দিচ্ছে।

বিনয়ের মনে পড়ল—দাদু একদিন বলেছিলেন,
“অশরীরীর হাত থেকে বাঁচতে হলে লোহা কাছে রাখতে হবে। লোহা তাদের দুর্বল করে।”

কিন্তু ভয়ের চাপে সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তখন হঠাৎ কোমরে হাত দিতেই টের পেল—তার লোহার চাবির গোছা এখনো আছে!

সর্বশক্তি দিয়ে সে হাত বাড়িয়ে চাবির গোছাটা টেনে বার করল। হাত কাঁপছিল, ঠান্ডা ঘামে ভিজে যাচ্ছিল শরীর।
নারী একেবারে গলার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল—
“এবার তুই আমার…”

তার আগেই বিনয় কাঁপতে কাঁপতে লোহার চাবিগুলো নারীর মুখের দিকে ছুঁড়ে দিল।

pathrodh 1

মুহূর্তের মধ্যে নারীর চোখ জ্বলে উঠল আগুনের মতো, তারপর এক ভয়ঙ্কর চিৎকার করে সে পিছিয়ে গেল। কানফাটানো সেই চিৎকারে চারপাশের কুয়াশা কেঁপে উঠল।

নারী কাঁপতে কাঁপতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তার শরীর ধীরে ধীরে কুয়াশায় গলে যেতে লাগল। চোখের আগুন নিভে গেল, নখগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

শেষ মুহূর্তে নারী এক ফোঁটা রক্তমাখা কান্নার ধ্বনি ফেলে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

চারপাশ আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
বিনয় হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। বুক ধড়ফড় করছে, শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কানে এখনো বাজছে সেই অদ্ভুত কান্না।

কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে কুয়াশা সরে গেল। মাঠ যেন আগের মতো শান্ত হয়ে গেল।

কিন্তু সেই দিনের পর বিনয় আর কখনো একা রাতে মাঠপথে যায়নি।
গ্রামবাসীরাও আজও বলে—
মাঠের সেই পথ এখনো অভিশপ্ত।
লোহার কিছু না থাকলে যে-ই যায়, তাকে এক কালো শাড়ি পরা নারী পথরোধ করে দাঁড়ায়।

এভাবেই শেষ হলো “পথরোধ” গল্প।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *