“আলিপুরের অট্টালিকায় খুন”
অট্টালিকায় খুনের রাত
কলকাতার অভিজাত অঞ্চল আলিপুরে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল সেন রেসিডেন্স। উঁচু গেট, ভেতরে ছায়াঘেরা বাগান, কাঁচের দেয়াল আর ইতালিয়ান মার্বেলের ঝলক—সবকিছুই যেন এই শহরে অর্থ ও ক্ষমতার প্রতীক।
অট্টালিকার মালিক ছিলেন অরিজিৎ সেন—শহরের নামকরা ব্যবসায়ী। রিয়েল এস্টেট ও নির্মাণ ব্যবসায় তাঁর প্রতাপ ছিল অপরিসীম। কঠোরতা, কূটবুদ্ধি আর নির্দয় সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি। পরিবারে ছিলেন স্ত্রী অনন্যা, ছেলে ইশান (২৫), আর মেয়ে ঈশিতা (২১, সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে)।
শনিবারের রাত। বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে, বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানিতে আকাশ বারবার বিদীর্ণ হচ্ছে।
সেন রেসিডেন্সের ডাইনিং হলে বসেছিল পুরো পরিবার, সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন ঘনিষ্ঠ অতিথি—
- ব্যবসায়িক অংশীদার রতন মালিক,
- পুরোনো বন্ধু বিক্রমজিত রায়,
- আর গৃহপরিচারক অজিত।
ডিনার টেবিলে হালকা কথাবার্তা দ্রুত তর্কে পরিণত হলো। রতন মালিকের চোখে ক্ষোভ, অরিজিৎ সেনের কণ্ঠ রূঢ়। ছেলে ইশান বাবার সঙ্গে খোলাখুলি ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ল। অনন্যার চোখে জমল বিরক্তি, আর মেয়ে ঈশিতা অস্বস্তি নিয়ে চুপ করে বসে রইল।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। বাড়ি কেঁপে উঠল ঝড়ের শব্দে। জেনারেটর কয়েক সেকেন্ড পরে চালু হলো, তবে সেই ফাঁকে নেমে এলো ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা।
কিছু মিনিট বাদে ভেসে এল ভয়ার্ত চিৎকার—
“বাঁচাও! কেউ এসো!”
সবাই ছুটে গেলেন অরিজিৎ সেনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরির দিকে। দরজা ভেতর থেকে আধখোলা। ভেতরে ঢুকেই দেখা গেল—অরিজিৎ সেন তাঁর মহগনি চেয়ারে নিথর হয়ে বসে আছেন। বুকের বাম পাশে রক্তের দাগ, মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে লাল স্রোত। চোখ ফাঁকা, প্রাণহীন।

ঘরে স্পষ্ট বারুদের গন্ধ। অর্থাৎ কাছ থেকে গুলি চালানো হয়েছে।
অনন্যা ভেঙে পড়লেন মেঝেতে। ইশান বাবাকে ঝাঁকাতে লাগল, ঈশিতার কান্না গোটা অট্টালিকা কাঁপিয়ে দিল। অতিথিরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
অদ্ভুত বিষয়—ঘরের জানালা ভেতর থেকে বন্ধ, দরজাটিও ভেতর থেকে আটকানো। তাহলে খুনি ঢুকল কীভাবে, আর বেরোলই বা কোন পথে?
খবর পেয়ে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলেন কলকাতা পুলিশের অভিজ্ঞ অফিসার ইন্সপেক্টর সুমিত রায়। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও ঠান্ডা মাথার জন্য তিনি পরিচিত।
ঘরে ঢুকেই চারপাশ একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি।
তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,
“এটা সাধারণ খুন নয়। ঘর বন্ধ, জানালা বন্ধ, অথচ একজন মানুষ খুন হয়েছে। খুনি এখানেই আছে—এই বাড়ির ভেতরে।”
সবার দৃষ্টি একে অপরের দিকে ফিরল। সন্দেহের ছায়া ছড়িয়ে পড়ল প্রতিটি চোখে।
ঝড়ো রাতের সেই অট্টালিকায় শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর খেলার প্রথম অধ্যায়।
সন্দেহভাজনেরা একে একে
আলিপুরের সেন রেসিডেন্সে গা ছমছমে আবহ। লাইব্রেরির ভেতরে অরিজিৎ সেনের নিথর দেহ শুয়ে আছে, আর বাইরে দাঁড়িয়ে পুলিশ টিম দ্রুত কাজ শুরু করেছে। ফটোগ্রাফি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ, চারপাশ ঘিরে ফেলা—সব চলছে।
ইন্সপেক্টর সুমিত রায় সবার আগে পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে এক ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলেন। তাঁর চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কণ্ঠস্বর শান্ত কিন্তু কঠোর।
তিনি বললেন,
“আজ রাতের ঘটনার সাক্ষী প্রত্যেকেই এই বাড়ির ভেতরে ছিলেন। খুনি বাইরে থেকে ঢুকতে পারেনি। তাই আপনাদের প্রত্যেকেই আমার কাছে সমান সন্দেহভাজন। একে একে আপনাদের সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
১. স্ত্রী – অনন্যা সেন
সুমিত প্রথমে অনন্যাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।
ফর্সা মুখ, চোখ লাল হয়ে আছে কান্নায়। কণ্ঠ কাঁপছিল।
“আপনার স্বামীকে শেষবার কখন দেখেছিলেন?”
অনন্যা নিস্তব্ধ গলায় বললেন,
“ডিনারের সময়… তারপর উনি লাইব্রেরিতে যান কিছু ফাইল দেখতে। আলো নিভে গেলে… আমি ভয় পেয়ে বসেছিলাম। এরপর… এরপর ওর চিৎকার।”
সুমিত খুঁটিয়ে তাকালেন। অনন্যার হাতে হালকা আঁচড়ের দাগ।
“আপনার হাতে এই দাগটা কোথা থেকে?”
অনন্যা এক মুহূর্ত থমকালেন, তারপর বললেন,
“রান্নাঘরে কাচ ভেঙেছিল কয়েকদিন আগে। ওটা তার দাগ।”
সুমিত মুখে কিছু না বললেও খাতায় টুকে নিলেন।
২. ছেলে – ইশান সেন
এরপর এলেন ইশান। উচ্ছল, কিন্তু মুখে ভয়ের ছায়া।
“আপনি আপনার বাবার সঙ্গে ডিনারের সময় ঝগড়া করছিলেন কেন?”
ইশান হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর ধীরে বলল,
“বাবা আমাকে ফ্যামিলি বিজনেসে জোর করে ঢোকাতে চাইছিলেন। আমি চাই না। আমি অন্য লাইনে ক্যারিয়ার বানাতে চাই। উনি সেটা মেনে নিতেন না। তাই ওখানে তর্ক হয়েছিল।”
“তাহলে কি আপনি বাবাকে সরাতে চাইছিলেন?”—সুমিত গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন।
ইশানের চোখ লাল হয়ে উঠল,
“না! ও আমার বাবা। ওঁর সঙ্গে আমার অমিল ছিল, কিন্তু খুন করার মতো কিছু নয়।”
৩. ব্যবসায়িক অংশীদার – রতন মালিক
রতন মালিকের বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। কণ্ঠস্বর চাপা, চোখে আতঙ্কের রেখা।
“আপনার আর অরিজিৎ সেনের মধ্যে ব্যবসায়িক বিবাদ নিয়ে শুনেছি। সত্যি?”
রতন গভীর শ্বাস ফেলল।
“হ্যাঁ… আমাদের এক প্রোজেক্টে বিরাট লোকসান হচ্ছিল। অরিজিৎ একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে চাপে ফেলেছিলেন। আমি রেগে গিয়েছিলাম, তর্কও হয়েছিল। কিন্তু আমি খুন করি নি।”
সুমিত ঠান্ডা গলায় বললেন,
“আপনার কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই লোকসানের কারণেই আপনার সবচেয়ে বড় মোটিভ ছিল।”
রতনের গলা শুকিয়ে গেল।
৪. বন্ধু – বিক্রমজিত রায়
বিক্রমজিত রায়—অরিজিৎ সেনের পুরোনো স্কুল–কলেজ বন্ধু। হাসিখুশি মানুষ বলে পরিচিত, কিন্তু আজকের রাতের পর মুখ ভার।
“আপনার সঙ্গে মৃত ব্যক্তির সম্পর্ক কেমন ছিল?”
বিক্রমজিত একটু ইতস্তত করে বলল,
“আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম একসময়। কিন্তু গত কয়েক বছরে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অরিজিৎ বদলে গিয়েছিল, খুব স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল।”
সুমিত একদৃষ্টিতে তাকালেন।
“আপনি কি জানতেন অরিজিৎ কোনো গোপন সম্পর্ক বা প্রতারণায় যুক্ত ছিলেন?”
বিক্রমজিত দম নিয়ে বলল,
“হয়তো… আমি নিশ্চিত নই। তবে শুনেছিলাম… ব্যবসার বাইরে আরেকটা জীবনে জড়িয়ে পড়েছিল।”
৫. চাকর – অজিত
সবশেষে এলেন অজিত। বয়স প্রায় চল্লিশ। চেহারায় ক্লান্তি, কিন্তু চোখে ভয়ের ঝলক।
“আপনি কোথায় ছিলেন যখন আলো নিভে যায়?”
অজিত মাথা নিচু করে বলল,
“আমি কিচেনে ছিলাম স্যার। আলো নিভে যাওয়ায় আমি মোমবাতি খুঁজছিলাম। তখনই শুনি… সবাই চিৎকার করছে।”
“আপনার কি কোনো অভিমান ছিল মালিকের ওপর?”
অজিত কেঁপে উঠল।
“স্যার, উনি আমাদের উপর মাঝে মাঝে চিৎকার করতেন, কিন্তু আমি… আমি খুন করতে পারব না।”
সবাইকে জেরা শেষ করে ইন্সপেক্টর সুমিত রায় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ঝড় এখনো চলছে।
তিনি খাতার পাতায় কিছু সূত্র টুকে নিলেন—
- অনন্যার হাতে আঁচড়ের দাগ।
- ইশানের সঙ্গে তীব্র ঝগড়া।
- রতন মালিকের ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণ।
- বিক্রমজিতের অজানা ইঙ্গিত।
- অজিতের ভীতসন্ত্রস্ত উত্তর।
সুমিত মৃদু হেসে মনে মনে বললেন—
“খুনির পদচিহ্ন এদের ভেতরেই লুকোনো আছে। শুধু সঠিক সূত্রটা জোড়া লাগানো বাকি।”
সূত্রের খেলা
আলিপুরের সেন রেসিডেন্স এখন যেন পুলিশ ক্যম্পে পরিণত হয়েছে। ভেতরে ক্রাইম টিম কাজ করছে, বাইরে সাংবাদিকদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। তবে ইন্সপেক্টর সুমিত রায় চুপচাপ, ঠান্ডা মাথায় সব পর্যবেক্ষণ করছেন।
তিনি জানেন—এ ধরনের কেসে খুনি সাধারণত অনেক কাছে থাকে। এবং সবচেয়ে ছোটো সূত্রটাই সত্যের দরজা খোলে।
লাইব্রেরির ভেতরে খোঁজ
অরিজিৎ সেনের লাইব্রেরি আবার ঘুরে দেখলেন সুমিত। ঘরের প্রতিটি শেলফে বইয়ের সারি, টেবিলে খোলা ফাইল, আর মেঝেতে গড়িয়ে পড়া এক গ্লাস ওয়াইন।
কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার—
চেয়ারের ঠিক পাশে পড়ে আছে একটি ভাঙা পকেট ঘড়ি। কাঁটা থেমে আছে রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে।
“অরিজিৎ সেনের মৃত্যুর সময় এটিই প্রমাণ করছে,” খাতায় নোট করলেন সুমিত।
ঘরে আরও একটি জিনিস চোখে পড়ল—টেবিলের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি ছেঁড়া কাগজের টুকরো। তাতে লেখা—
“…আজ রাতেই সব শেষ করে দেব।”
কার লেখা, বোঝা যাচ্ছে না।
অনন্যার ঘরে
সুমিত এবার গেলেন অনন্যার শোবার ঘরে। ঘরের ড্রয়ার খুলে দেখতে পেলেন—একটি ছোট্ট পিস্তল রাখা আছে, ঝকঝকে পরিষ্কার। তবে মজার বিষয়, এর মধ্যে এক রাউন্ড গুলি নেই।
অনন্যাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“এটা কি আপনার?”
অনন্যা শিউরে উঠে বললেন,
“হ্যাঁ… আমার বাবার থেকে পাওয়া। আত্মরক্ষার জন্য রেখেছিলাম। কিন্তু আমি কখনও ব্যবহার করি নি।”
সুমিত ঠান্ডা গলায় বললেন,
“তাহলে গুলি কোথায় গেল?”
অনন্যা কিছু উত্তর দিতে পারলেন না, শুধু কেঁপে উঠলেন।
ইশানের ঘরে
ইশানের ঘরে ঢুকেই এক নতুন রহস্যের খোঁজ মিলল। ডেস্কের ওপর একটি চিঠি—
“ড্যাড, আমি আপনার ছায়া হয়ে বাঁচতে চাই না। আমি নিজের পথ বেছে নেব।”
চিঠিটা আধখানা লেখা, মনে হলো শেষ করতে পারেনি। কলম শুকিয়ে আছে, কালি আধভাঙা।
ইশান যখন ঘরে এল, সুমিত সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন,
“তুমি বাবার জন্য এই চিঠি লিখছিলে?”
ইশান দ্বিধা নিয়ে মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ… কিন্তু এটা আমার রাগের লেখা, খুনের নয়।”
রতন মালিকের ব্যাগ
ব্যবসায়িক অংশীদার রতন মালিক তখন অতিথি কক্ষে ছিলেন। তাঁর ব্যাগ ঘেঁটে পুলিশ পায় কিছু নথি—অরিজিৎ সেনের স্বাক্ষর করা চুক্তি, যেখানে রতনের অংশীদারিত্ব বাতিল করা হয়েছে।
রতনের চোখ কপালে উঠে গেল।
“এগুলো এখানে কীভাবে এল? আমি… আমি জানি না।”
সুমিত মৃদু হেসে বললেন,
“আপনি জানেন না, নাকি জানাতে চাইছেন না?”
রতন মুখ শক্ত করে চুপ রইলেন।
বিক্রমজিতের ফোন
বিক্রমজিত রায়ের মোবাইল ফোন জব্দ করে দেখা গেল—রাত ১০টা ২০ মিনিটে একটি ইনকামিং কল এসেছে অজানা নম্বর থেকে। কলটি ছিল মাত্র ৩০ সেকেন্ডের।
সুমিত ফোনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“এই কল কার?”
বিক্রমজিত মুখ ঘুরিয়ে নিল।
“আমি… আমি চিনি না।”
কিন্তু চোখের ভেতরে কিছু একটা গোপন রেখে দিলেন সে।
চাকর অজিতের অস্বাভাবিকতা
অজিতকে আবার ডেকে আনা হলো। পুলিশ তাঁর হাতখানা পরীক্ষা করে দেখল—ডান হাতের আঙুলে হালকা বারুদের গন্ধ।
সুমিত কঠিন কণ্ঠে বললেন,
“তুমি বলেছিলে কিচেনে ছিলে। কিন্তু তোমার হাতে গানের পাউডারের চিহ্ন পাওয়া গেল কীভাবে?”
অজিত কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“আমি… আমি খুনি নই স্যার! আমি শুধু… আমি শুধু গুলি চলার পর বন্দুকটা তুলেছিলাম।”
“কোথায় বন্দুক?”
অজিত মাথা নিচু করল।
“খুঁজে পাইনি… মনে হয় কেউ নিয়ে গেছে।”
ইন্সপেক্টর সুমিত রায় এবার এক জায়গায় বসে সব সূত্র একত্র করলেন—
- ভাঙা পকেট ঘড়ি: রাত ১০টা ৩৫।
- ছেঁড়া কাগজ: “…আজ রাতেই সব শেষ করে দেব।”
- অনন্যার পিস্তল থেকে একটি গুলি নিখোঁজ।
- ইশানের লেখা অসম্পূর্ণ বিদ্রোহী চিঠি।
- রতনের ব্যাগে হঠাৎ পাওয়া বাতিল চুক্তি।
- বিক্রমজিতের অজানা ফোনকল।
- চাকর অজিতের হাতে গানপাউডারের চিহ্ন।
সবকিছু জটিলভাবে জড়িয়ে আছে। যেন প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু লুকোনো রহস্য রয়েছে।
সুমিত শান্তভাবে চোখ বন্ধ করে বললেন,
“খেলা শুরু হলো। খুনি বুদ্ধিমান, কিন্তু এক জায়গায় ভুল করে ফেলেছে। সেই ভুলটাই আমার হাতিয়ার হবে।”
প্রতারণার জাল
আলিপুরের সেন রেসিডেন্স তখন কড়া পুলিশের পাহারায় ঘেরা। রাতের অন্ধকারে ভিড় কমে এলেও ভেতরে উত্তেজনা থামছিল না। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী অরিজিৎ সেনের খুন যেন একে একে উন্মোচন করছিল পরিবারের অজানা মুখোশগুলো। ইন্সপেক্টর সুমিত রায় প্রতিটি সূত্র একত্র করে বসেছিলেন, কিন্তু টুকরো টুকরো ছবি মিলিয়ে একটি স্পষ্ট রূপ এখনও তৈরি হয়নি।
পারিবারিক হিসেবের অঙ্ক
সকালবেলায় সুমিত আবার বসলেন সেন পরিবারের আর্থিক কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে। আশ্চর্য হয়ে তিনি খুঁজে পেলেন, অরিজিৎ সেনের সাম্রাজ্যের ভেতরে বিশাল একটা ফাঁক লুকিয়ে আছে। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি থাকলেও একাধিক লেনদেন গোপনে অন্য কারও নামে চালানো হচ্ছিল।
সন্দেহভাজনের তালিকায় প্রথমেই উঠে এল রোহন সেনের নাম। অরিজিৎ সেনের একমাত্র ছেলে, বেপরোয়া আর ব্যবসায় অদক্ষ। খবর এল, গত মাসেই রোহন নাকি এক বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে গোপনে চুক্তি করতে চেয়েছিল—বাবার অনুমতি ছাড়াই। টাকা জোগাড়ের জন্য অরিজিৎ বাবাকে চাপ দিচ্ছিলেন, কিন্তু শেষমেশ সেই দাবি অমান্য করেন।
সুমিত রায় খাতার পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে মনে বললেন,
“যে ছেলেটি বাবার অবাধ্য হয়ে টাকা তুলতে চাইছিল, তার কাছে খুনের মোটিভ অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
গোপন সম্পর্কের আঁচ
তদন্তে আরও সামনে এল অদ্ভুত তথ্য। অরিজিৎ সেনের সেক্রেটারি মীনা দেবী পুলিশের জেরায় স্বীকার করলেন, তিনি বহুদিন ধরেই মালিকের কাছ থেকে কেবল কাজ নয়, ব্যক্তিগত দিক থেকেও বিশেষ মনোযোগ পেতেন। পারিবারিক বিবাদে বহুবার তিনি অরিজিৎকে শান্ত করতেন, আবার ব্যবসায়িক মিটিংয়েও তিনি সবটা সামলাতেন।
কিন্তু সুমিতের সন্দেহ বাড়ল অন্য খাতে—কিছুদিন ধরে মীনা দেবী নাকি পরিবারের বাইরে কারও সঙ্গে গোপনে দেখা করছিলেন। সেই ব্যক্তির পরিচয় প্রথমে ধরা যাচ্ছিল না।
প্রতারণার ফাঁস
ঠিক তখনই ফরেনসিক রিপোর্ট এসে পৌঁছাল। অরিজিৎ সেনের ল্যাপটপ থেকে মুছে ফেলা কয়েকটি ই-মেইল উদ্ধার হয়েছে। ই-মেইলগুলোতে লেখা—কেউ নাকি তাকে “চাঁদা” চাইছিল, না দিলে তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল।
সুমিত বুঝলেন, খুনটা হয়তো কেবল পারিবারিক বা সম্পত্তির কারণে নয়—বরং একটা বড়সড় প্রতারণা বা ব্ল্যাকমেলের জালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
আরও বিস্ময়কর হলো, ই-মেইলগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছিল ছদ্মনাম—“Karma29”। কিন্তু আইপি অ্যাড্রেস ঘেঁটে জানা গেল, এই মেইল করা হয়েছে সেন পরিবারের ভেতর থেকে—অর্থাৎ পরিবারের কেউ একজন বা খুব ঘনিষ্ঠ কেউ সেই ব্ল্যাকমেলের খেলা চালাচ্ছিল।
অদৃশ্য ছায়া
সেই রাতে আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটে সুমিত দেখতে পেলেন—খুনের আগের রাতে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে একজন অচেনা মানুষ ঢুকেছিল। মুখে হুড টানা, শরীর ঢাকা। কিন্তু ভেতরে ঢোকার পর আর কোনো ফুটেজে তাকে ধরা পড়েনি। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
তাহলে কি সে-ই আসল খুনি? নাকি পরিবারের কারও সহযোগিতায় সে ভেতরে ঢুকে নিঃশব্দে খুন করে পালিয়েছে?
রহস্য আরও গভীরে
পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে লাগল। সেন পরিবারের প্রতিটি মানুষই যেন একেকটা মুখোশ পরে আছে—
- ছেলে রোহন চাপে পড়ে বাবার বিরুদ্ধে যেতে চাইছিল।
- মীনা দেবীর সঙ্গে অরিজিতের গোপন সম্পর্ক।
- গোপন ই-মেইলের প্রতারণা।
- আর হঠাৎ করে দেখা দেওয়া হুড পরা অচেনা লোক।
ইন্সপেক্টর সুমিত অনুভব করলেন, যতটা সহজ ভেবেছিলেন, তার থেকেও অনেক গভীর এ রহস্যের জাল।
তিনি নিরব চালে বললেন—
“এখানে শুধু খুন হয়নি, এখানে প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতার অন্ধকার সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে। সত্যটা জানতে চাইলে আমাকে আরও গভীরে নামতেই হবে।”
অধ্যায় শেষ হয় ইন্সপেক্টরের অটল প্রতিজ্ঞার সঙ্গে—কোনো মুখোশই এবার তাকে আটকাতে পারবে না।
সত্য উন্মোচন
আলিপুর থানার ছোট্ট কনফারেন্স রুমে মৃদু আলো জ্বলছে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ঘরে বসে আছেন সেন পরিবারের সমস্ত সদস্য, তাদের উকিল, আর টেবিলের মাথায় ইন্সপেক্টর সুমিত রায়। জানলার বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, কাঁচে টুপটাপ শব্দ উঠছে। সবার মুখে ভয়, উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তা।
সুমিত রায় গলা খাঁকারি দিলেন।
— “আপনাদের সকলের ধৈর্যের জন্য ধন্যবাদ। এতদিন ধরে আমরা অরিজিৎ সেনের খুন নিয়ে তদন্ত চালালাম। এখন সময় এসেছে সত্যি কথা প্রকাশ করার।”
ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
সুমিত টেবিলে রাখা ফাইল খুললেন।
— “প্রথম থেকেই আমরা ভেবেছিলাম এটা নিছক চুরির ঘটনা। জানালা ভাঙা ছিল, আলমারির লকার খোলা। কিন্তু সেটি ছিল বিভ্রান্তি তৈরির ফাঁদ। আসল খুনির উদ্দেশ্য ছিল পারিবারিক।”
সেন পরিবারের ছোট ছেলে অর্ণব আঁতকে উঠল।
— “মানে? আমাদের ভেতর থেকে কেউ?”
সুমিত শান্ত স্বরে বললেন,
— “হ্যাঁ। আসল খুনি ছিল বাড়ির ভেতরের মানুষ।”
সবার শ্বাস আটকে গেল।
সুমিত ধীরে ধীরে বিশ্লেষণ শুরু করলেন—
— “অরিজিৎ সেনের ব্যবসা শেয়ার মার্কেটে ধ্বসে যাচ্ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বেশি লাভবান হতো কে? আমরা হিসেব করে দেখলাম—সবচেয়ে বেশি শেয়ারের অংশ পেতেন তাঁর স্ত্রী মালিনী দেবী।”
মালিনী তীব্র প্রতিবাদ করলেন।
— “কি বলছেন! আমি আমার স্বামীকে ভালবাসতাম।”
সুমিত মাথা নেড়ে বললেন,
— “ভালোবাসতেন, হয়তো তাই। কিন্তু প্রমাণ অন্য কথা বলছে। খুনের রাতের আগে আপনি ওষুধের দোকান থেকে ঘুমের ওষুধ কিনেছিলেন। আপনার শোবার ঘরের আলমারিতে সেই বোতল পাওয়া গেছে। অরিজিৎ সেনের শরীরে যে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ মেশানো হুইস্কি পাওয়া গেছে, সেটা আপনার হাত দিয়েই গিয়েছে।”
ঘরে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল।
সুমিত আবার বললেন—
— “কিন্তু এটিই শেষ নয়। মালিনী দেবী একা নন। তাঁকে সাহায্য করেছিল পরিবারের ভেতরের আরও একজন।”
এইবার সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল বড় ছেলে অমিতাভ সেন–এর দিকে।
সুমিত বললেন,
— “অমিতাভ, খুনের রাত আপনি বাড়ির বাইরে ছিলেন বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু আপনার গাড়ির জিপিএস দেখায় রাত ১০টায় গাড়ি ঢুকেছিল আলিপুরের গলিতে। আপনি বাবার ঘরে ঢুকেছিলেন, আর মিথ্যে প্রমাণ তৈরি করতে জানালা ভেঙেছিলেন।”
অমিতাভ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল—
— “না! আমি বাবাকে খুন করতে চাইনি। মা–ই পরিকল্পনা করেছিলেন… আমি শুধু সাহায্য করেছি।”
ঘরে একসাথে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল।
সুমিত গম্ভীর স্বরে বললেন—
— “হ্যাঁ, পরিকল্পনার মূল নকশা করেছিলেন মালিনী দেবী। কারণ তিনি জানতেন, অরিজিৎ সেন মৃত্যুর আগে উইল বদলে তাঁর ব্যবসার অর্ধেক সম্পত্তি দান করবেন ট্রাস্টে। সেই খবর মালিনী সহ্য করতে পারেননি। অমিতাভকে তিনি পাশে টেনে নেন। বাবার কাছে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনে অমিতাভও বিদ্বেষ পোষণ করত। দুজন মিলে সাজালো এই হত্যার ষড়যন্ত্র।”
মালিনী এবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
— “আমি চাইনি এমন হোক… আমি শুধু ভেবেছিলাম সম্পদ আমাদের পরিবারের হাতে থাকবে।”
সুমিত দৃঢ় গলায় বললেন—
— “কিন্তু খুন কোনোদিনই সমাধান নয়। আইন আপনাদের বিচার করবে।”
ঘর নিস্তব্ধ। রুদ্র, অর্ণব আর অনিন্দিতা—অন্য তিন সন্তান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। একজন মা আর বড় ভাই, নিজেদের লোভ আর হতাশার কারণে পুরো পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
সুমিত ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু বাতাসে চাপা ভার।
— “অরিজিৎ সেন হয়তো বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর সত্য আমরা উদ্ধার করেছি। এখন সময় ন্যায়বিচারের।”
পুলিশ মালিনী দেবী ও অমিতাভকে হাতকড়া পরাল। ফ্ল্যাশবাল্বের মতো বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল বাইরে। অট্টালিকার গম্ভীর পরিবেশ ভেঙে গেল সাইরেনের শব্দে।
সেন রেসিডেন্সের বিশাল দরজা বন্ধ হয়ে এলো। ভেতরে অন্ধকার, নীরবতা।
যেন সেই রাতের প্রতিধ্বনি এখনো বাতাসে ভাসছে—
লোভ, প্রতারণা আর রক্তের দাগ মিশে আছে সেই অট্টালিকার প্রতিটি দেওয়ালে।
আর ইন্সপেক্টর সুমিত রায়, একা দাঁড়িয়ে, মৃদু কণ্ঠে ফিসফিস করে বললেন—
— “শেষ পর্যন্ত সত্যিই কোনো প্রতারণা টিকে থাকে না।”
এভাবেই রহস্যের সব জট একে একে উন্মোচিত হলো।