চৌধুরীবাড়ির রক্তচিহ্ন
নিষিদ্ধ বাড়ি
গ্রামের উত্তরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়াল ছায়া—
চৌধুরীবাড়ি।
ভাঙা দালান, কালচে শ্যাওলায় ঢেকে যাওয়া ইটের দেয়াল, কুঁজো হয়ে ঝুলে থাকা বিশাল লোহার ফটক।
দিনের বেলাতেও সেখানে একটা চাপা অন্ধকার ঘনীভূত থাকে।
গ্রামবাসীরা বলে—
“ওই বাড়ির ভেতরে এখনও জমিদারের পাপ ঘুমিয়ে আছে।
রাত নামলে শুনতে পাবে চিৎকার, শিকল টানার শব্দ…
কেউ যদি ওই আওয়াজ অনুসরণ করে ভেতরে যায়, আর ফেরে না।”
বছরের পর বছর ধরে চৌধুরীবাড়ি তালাবদ্ধ পড়ে আছে।
কেউ সাহস করে তার আশেপাশেও যায় না, বিশেষত অমাবস্যার রাতে।
কিন্তু এই গল্পেই ঢুকে পড়তে চলেছে তিনজন মানুষ—
- কলকাতা থেকে আসা কৌতূহলী সাংবাদিক অভিজিৎ,
- তার বেপরোয়া বন্ধু রুদ্র,
- আর গ্রামের অভিজ্ঞ তান্ত্রিক গিরিধর বাবু।
অভিজিৎ প্রথমেই বলল,
“লোককথা অনেক শুনলাম। এখন আমি সত্যিটা জানব। ভূত বলে কিছু নেই—কেবল ইতিহাস আর মানুষের ভয় আছে।”
গিরিধর বাবু ধীরে হেসে উত্তর দিলেন,
“ইতিহাস আছে, ভয়ও আছে… কিন্তু এই বাড়িতে যে শক্তি আছে, তা তোমার যুক্তিতে ধরা দেবে না। সতর্ক থেকো।”
রুদ্র হেসে উড়িয়ে দিল সব কথা।
“ভূতটুত কিছু নেই, দাদাবাবু। আজ রাতেই প্রমাণ হবে।”
তিনজনে ঠিক করল—
চৌধুরীবাড়ির ভেতরে ঢুকে রহস্য উন্মোচন করবে।
সন্ধ্যা নামতেই তারা হাতে লণ্ঠন নিয়ে এগিয়ে গেল ভাঙা ফটকের দিকে।
ফটক ঠেলে খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ভেতর থেকে ঠান্ডা বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল।
দূরে একদম নিস্তব্ধ রাত, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
আর সামনে অন্ধকারে ডুবে থাকা সেই বাড়ি—
যেন অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
রক্তের দেয়াল
ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তিনজনের চোখে পড়ল অদ্ভুত দৃশ্য।
চৌধুরীবাড়ির উঠোনে একসময়কার বাগানের চিহ্ন আজ শুধু শুকনো ঝোপঝাড়।
মাটির গায়ে কালচে দাগ, যেন এখানে বহু আগেই আগুন লেগেছিল।
অভিজিৎ টর্চ জ্বালিয়ে বলল,
“চলো, ভেতরে ঢুকি।”
ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে তারা পৌঁছাল মহলঘরের সামনে।
দরজাটা আধখোলা, বাতাসে কেঁপে কেঁপে কিঞ্চিৎ শব্দ করছে।
গিরিধর বাবু লণ্ঠন উঁচু করে ধরলেন—
অভ্যন্তরীণ অন্ধকারে যেন কিছু নড়েচড়ে উঠল এক মুহূর্তের জন্য।
ভেতরে ঢুকতেই রুদ্র হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—
“দেখো… দেয়ালে!”

টর্চের আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন স্তব্ধ হয়ে গেল।
সামনের বিশাল দেয়ালজুড়ে লালচে রক্তের দাগ ছড়িয়ে আছে।
দাগগুলো টলটল করছে, যেন এখনই ছিটকে পড়েছে কোনও উষ্ণ শরীর থেকে।
রুদ্র কাঁপা গলায় বলল,
“এগুলো… এতো আসল রক্তের মতো!”
অভিজিৎ এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াতেই,
দেখল দাগগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে,
মনে হলো দেয়ালটা নিজের ভেতরেই রক্ত শুষে নিচ্ছে!
ঠিক তখনই মহলঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে উঠল অসংখ্য কণ্ঠস্বরের গর্জনে—
“আমাদের রক্ত ফিরিয়ে দাও…!”
লণ্ঠনের আলো কেঁপে উঠলো।
দেয়ালের গা থেকে যেন হাত বেরোতে লাগলো—
অস্থির, রক্তমাখা, কঙ্কালসার হাত!
ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তিনজনের দিকে…
গিরিধর বাবু তড়িঘড়ি মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন,
কিন্তু অভিজিৎ আর রুদ্র স্থির দাঁড়িয়ে শুধু দেখল—
দেয়াল থেকে বেরোতে থাকা রক্তাক্ত মুখগুলো,
যারা ফিসফিস করে বলছে—
“আমরা বন্দি… আমরা বন্দি…”
হঠাৎ দরজাটা সজোরে বন্ধ হয়ে গেল।
তাদের ঘিরে ধরল অন্ধকার।
গোপন তোরণ
দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসা রক্তাক্ত হাতগুলো মন্ত্রের প্রভাবে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
ঘর আবার অন্ধকারে ডুবে গেল।
কিন্তু ভয়ের ঘন কুয়াশা যেন চারপাশে ছড়িয়ে রইল।
অভিজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“এগুলো… এসব সত্যি হতে পারে না! এগুলো কোনও মানসিক বিভ্রম।”

গিরিধর বাবু কঠিন গলায় উত্তর দিলেন,
“না বাবু, এই বাড়ির নিচে এমন কিছু আছে, যেটা ওদের শান্তি পেতে দিচ্ছে না।
আমাদের ওখানেই যেতে হবে।”
রুদ্র কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“তুমি কি বলছো— আরও ভেতরে নামতে হবে? এখানে দাঁড়িয়েই বুক ফেটে যাচ্ছে।”
গিরিধর বাবু লণ্ঠন মাটির ওপর নামিয়ে দিলেন।
ভাঙা মেঝের এক কোণে তিনি আঙুল দিয়ে দাগ টেনে দেখালেন—
“এই যে, এটাই সেই পথ।
চৌধুরীদের গোপন তোরণ।”
অন্ধকারের সিঁড়ি
তারা মেঝের ঢাকনা সরাতেই ভেতর থেকে ভেসে এল গুমোট পচা গন্ধ।
একটা সরু সিঁড়ি নেমে গেছে গভীর অন্ধকারে।
সাবধানে তিনজন নিচে নামতে শুরু করল।
প্রতিটি ধাপে নামার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল।
মনে হচ্ছিল, শত শত বছর ধরে জমে থাকা মৃত্যুর গন্ধ নাকে ঢুকে যাচ্ছে।
সিঁড়ির শেষে গিয়ে তারা পৌঁছাল এক বিশাল ভূগর্ভস্থ কুঠুরিতে।
সেখানে অগণিত মরচে পড়া লোহার শিকল ঝুলছে ছাদের সঙ্গে।
কোণায় ছড়ানো শুকনো হাড়গোড়, ভাঙা খুলি, আর ছেঁড়া ধুতি-শাড়ির টুকরো।
রুদ্র টর্চ ফেলতেই দেয়ালের ওপর অদ্ভুত খোদাই দেখা গেল—
অজস্র হাতের ছাপ!
যেন কেউ মরার আগে রক্ত মেখে দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে গেছে।
মৃতদের চিৎকার
হঠাৎই শিকলগুলো একসাথে ঝনঝন করে কেঁপে উঠল।
মনে হলো অদৃশ্য শরীরগুলো ঝুলছে তাতে।
এরপর চারদিক ভরে গেল বিকট আর্তনাদে—
কেউ চিৎকার করছে, কেউ কাঁদছে, কেউ বলছে—
“পানি… বাঁচাও… আমাদের ছেড়ে দাও…”
অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
হঠাৎ দেয়ালের এক কোণে ছায়া ঘন হতে লাগল,
এবং ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল এক ভয়ঙ্কর অবয়ব।
সে হল— জমিদার মহেন্দ্র চৌধুরীর প্রেত।
কালো পোশাকে, হাতে মরচে ধরা তরবারি, চোখে লাল আগুনের শিখা।
সে গর্জে উঠল—
“এরা আমার দাস ছিল! আমি এদের রক্ত দিয়েই শক্তি পেতাম।
তোমরা এখানে এসেছো?
তাহলে তোমাদেরও রক্ত মিশবে এই দেয়ালে!”
প্রেতের মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।
মেঝের ওপর জমে থাকা হাড়গোড়গুলো হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল,
কঙ্কালগুলো আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে গেল—
শূন্য চোখে তারা এগিয়ে আসছে তিনজনের দিকে।
মৃত্যুর ফাঁদ
রুদ্র আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল,
“ওরা… ওরা জীবন্ত হয়ে উঠছে!”
গিরিধর বাবু মরিয়া হয়ে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন,
কিন্তু চারদিকের অন্ধকারে মন্ত্র যেন গিলে যাচ্ছে।
লণ্ঠনের আলো নিভে গিয়ে কেবল লালচে ঝলকানি দেখা গেল প্রেতের চোখে।
অভিজিৎ ভয়ে জমে গেলেও হঠাৎই খেয়াল করল—
কুঠুরির এক দেয়ালের ভেতর থেকে আলো ঝলকাচ্ছে।
যেন ওখানে আরও গভীর কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে।
গিরিধর বাবু চিৎকার করে বললেন,
“ওই আলোই সত্যি! ওইখানেই এই অভিশাপের আসল উৎস!”
কিন্তু তারা এগোতেই কঙ্কালগুলো ছুটে এল,
তাদের হাড়ের আঙুল দিয়ে তিনজনকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে।
মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে…
আর দূরে দাঁড়িয়ে জমিদার প্রেত কর্কশ হেসে উঠছে—
“তোমরা আর ফিরতে পারবে না!”
অভিশাপের মুখোমুখি
ভূগর্ভস্থ কুঠুরির ভেতর রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে।
শুকনো কঙ্কালগুলো যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে—
একটার পর একটা দাঁড়িয়ে, খটখটে হাড়ের শব্দ তুলে ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছে অভিজিৎ, রুদ্র আর গিরিধর বাবুকে।
অভিজিৎ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করল,
“এগুলো… এরা সবাই তো গ্রামের মানুষ!”
গিরিধর বাবুর চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হলেও তিনি মন্ত্রপাঠ থামালেন না।
কণ্ঠ আরও জোরালো হয়ে উঠল, যেন মৃত্যুর অন্ধকারকে চিরে ফেলছে।
ঠিক তখনই এক বিকট গর্জনে অন্ধকার ভেদ করে সামনে এসে দাঁড়াল মহেন্দ্র চৌধুরীর প্রেত।
তার শরীর আধভূত, আধমানব—
মুখে রক্তের রেখা, চোখ দুটো লাল আগুনের মতো জ্বলছে।
হাতে মরচে পড়া এক ধারালো তরবারি, যেটা থেকে রক্ত টপটপ করে পড়ছে।
প্রেত গর্জে উঠল—
“কে সাহস করল আমার রাজ্যে ঢুকতে?
এই দেয়ালগুলো আমার দাসদের রক্তে ভিজে আছে।
তাদের কান্না আমাকে শক্তি দিয়েছে শত বছর ধরে।
আজ তোমাদের রক্তেই নবীন অর্ঘ্য হবে!”
কথা শেষ হতেই হাড়ের কঙ্কালগুলো এগিয়ে এল।
একটা কঙ্কাল রুদ্রের গলা আঁকড়ে ধরল—
ঠান্ডা হাড়ের স্পর্শে সে হাঁসফাঁস করতে লাগল।
অভিজিৎ প্রাণপণে ওকে টেনে ছাড়াতে গেল, কিন্তু কঙ্কালের শক্তি অদ্ভুতরকম ভয়ঙ্কর।
তাদের চারপাশের বাতাসে এক শীতলতা জমাট বেঁধে যাচ্ছিল, যেন প্রতিটি নিঃশ্বাস মৃত্যু ডেকে আনছে।
তান্ত্রিকের প্রতিরোধ
গিরিধর বাবু তীব্র কণ্ঠে মন্ত্রপাঠ করতে করতে কুঠুরির কোণে ছুঁড়ে দিলেন সিঁদুর আর গঙ্গাজল মেশানো ধূপ।
আলোর ঝলকে কয়েকটা কঙ্কাল ছাই হয়ে ভেঙে পড়ল মাটিতে।
কিন্তু মহেন্দ্র চৌধুরীর প্রেত হেসে উঠল—
একটা ভয়ঙ্কর কর্কশ হাসি।
“তান্ত্রিক! তোমার মন্ত্রে সাধারণ প্রেতরা পালাবে,
কিন্তু আমি নই।
আমি অভিশপ্ত, অশান্ত—
আমার শক্তি এই দেয়ালের রক্তে।
তোমরা যত লড়াই করবে, তত রক্ত ঝরবে, আর আমি তত শক্তিশালী হব!”
তারপর সে তরবারি উঁচিয়ে মেঝেতে আছাড় মারল।
মুহূর্তেই মেঝে কেঁপে উঠল, আর ভেতর থেকে নতুন করে রক্ত গড়িয়ে আসতে লাগল।
কুঠুরির দেয়ালে আবার দেখা গেল সেই হাতের ছাপ—
কিন্তু এবার তারা যেন নড়ছে!
প্রথম সংঘর্ষ
রুদ্র গলা ছুটে মুক্ত হয়ে অভিজিৎকে বলল,
“ওকে থামাতে হবে, নাহলে আমরা বাঁচব না!”
অভিজিৎ এক ঝলক দেখল দেয়ালের ভেতর থেকে জ্বলজ্বল করছে সেই অদ্ভুত আলো।
সে বুঝল—সত্যটা ওই দেয়ালের ওপারেই লুকানো।
কিন্তু মহেন্দ্র প্রেত যেন তার চিন্তা টের পেল।
সে চোখ রাঙিয়ে গর্জে উঠল,
“সত্য? সত্য জানার চেষ্টা করলে তোমাদের মৃত্যু অনিবার্য!”
অভিজিৎকে লক্ষ্য করে প্রেত তরবারি ঘুরিয়ে আঘাত করতেই চারপাশে বাতাস কেঁপে উঠল।
তরবারির ধার গায়ে লাগতে না লাগতেই তার টর্চ নিভে গেল—
অন্ধকারে ভেসে উঠল শুধু রক্তমাখা মুখ আর লালচে চোখ।
মৃত্যুর প্রান্তে
তাদের চারপাশে আবার কঙ্কালের ভিড় জমল।
হাড়গোড়গুলো যেন শ্বাস নিচ্ছে, তাদের ফাঁকা চোখ থেকে ঠান্ডা বাতাস বেরোচ্ছে।
রুদ্র চিৎকার করল,
“আমরা এভাবে পারব না! এর আগে কেউ পালাতে পারেনি কেন বুঝতে পারছি!”
গিরিধর বাবু তবুও দম ছাড়লেন না।
তিনি লণ্ঠন উঁচিয়ে অভিজিৎকে বললেন—
“ওই আলোর দিকে যা! ওটাই মুক্তির পথ।
তুমি যদি সত্যিটা উন্মোচন করতে পারো, এই অভিশাপ শেষ হবে।”
অভিজিৎ কাঁপা হাতে এগোতে লাগল দেয়ালের আলোর দিকে,
আর পিছনে দাঁড়িয়ে রুদ্র আর গিরিধর বাবু মরিয়া হয়ে প্রতিরোধ করতে লাগলেন অশরীরী সেনাদের বিরুদ্ধে।
তাদের চারদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল জমিদার প্রেতের ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর—
“এখান থেকে কেউ জীবিত ফিরবে না!”
মৃত্যুর করিডর
চৌধুরীবাড়ির সেই ভাঙা দেয়াল পেরিয়ে যখন অভিজিৎ, রুদ্র আর গিরিধর বাবু ঢুকল, তখনই যেন চারপাশের বাতাস হিম হয়ে গেল।
মশালের আলোয় দেখা গেল—লম্বা সরু করিডর, দেয়ালজুড়ে শুকনো রক্তের ছোপ, ঝুলে থাকা হাড়গোড় আর অদ্ভুত অন্ধকার।
প্রতিটি পদক্ষেপে যেন মেঝে গুঞ্জন তুলছিল, আর দূরে কারও ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল—
“ফিরে যা… ফিরে যা…”
কিন্তু ওরা ফিরল না।
রুদ্রের ভয়
রুদ্র হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
সে কাঁপতে কাঁপতে বলল—
“অভি… তুই কি শুনছিস?
কারা যেন… কারা যেন নাম ধরে ডাকছে!”
অভিজিৎ চারপাশে তাকাল।
মশালের আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পেল করিডরের দেয়ালে আঁকা শত শত নাম।
সেই নামগুলো ঠিক ওদের গ্রামবাসীদের নাম!
প্রতিটি নামের পাশে রক্তের দাগ, যেন মৃত্যুর সিলমোহর।
মৃত্যুর আসন
করিডরের শেষে পৌঁছে গেল তারা।
ওখানে বিশাল এক অন্ধকার ঘর।
ঘরের মাঝখানে ছিল কালো পাথরের সিংহাসন, যার ওপর বসে আছে অর্ধেক কঙ্কাল, অর্ধেক প্রেতাত্মা—
এটাই মহেন্দ্র চৌধুরীর আসল আত্মা।
সে গম্ভীর গলায় গর্জে উঠল—
“তোরা আমার অভিশপ্ত প্রাসাদ ভাঙতে এসেছিস?
শত বছর আগে এই রক্ত দিয়েই আমি সাম্রাজ্য গড়েছি।
আজ আবার সেই রক্ত দিয়েই তোদের শেষ করব!”
ঘরের চারপাশে একসঙ্গে জ্বলে উঠল শত শত অশরীরীর চোখ।
ঘরটা কেঁপে উঠল, যেন মৃত্যুর নাচ শুরু হলো।
শেষ লড়াই
অভিজিৎ সাহস করে তাবিজটা উঁচিয়ে ধরল।
কিন্তু মহেন্দ্র প্রেত হেসে উঠল—
“ওটা আমাকে ছুঁতে পারবে না, কারণ আমি এই মাটির সঙ্গেই মিশে আছি।
যতক্ষণ না এই বাড়ি ধ্বংস হয়, আমার আত্মাও অমর থাকবে!”
গিরিধর বাবু হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন—
“তাহলে বাড়িটাকেই ধ্বংস করতে হবে!”
রুদ্র মশাল দিয়ে দেয়ালের পুরোনো কাঠে আগুন ধরিয়ে দিল।
মুহূর্তেই শিখা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
অন্ধকার ঘর জ্বলতে শুরু করল আগুনে।
মহেন্দ্র প্রেত ভয়ংকর আর্তনাদে ছটফট করতে লাগল—
“না-আ-আ-আ!!! এই প্রাসাদ আমার রক্ত দিয়ে গড়া!
এটা ধ্বংস হলে আমিও শেষ হয়ে যাব!”
মুক্তি
আগুন বাড়তে বাড়তে কালো সিংহাসনটাও ভেঙে পড়ল।
মহেন্দ্র প্রেত ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল, অশরীরীরাও ছাই হয়ে ঝরে পড়ল।
ঘরের মধ্যে ভেসে এল অচেনা গ্রামবাসীদের আত্মা।
তাদের চোখে শান্তির ছাপ।
এক বৃদ্ধা আত্মা অভিজিৎ-এর সামনে এসে বলল—
“তুমি আমাদের মুক্তি দিয়েছ।
শত বছরের অভিশাপ আজ ভাঙল।
কিন্তু মনে রেখো—লোভ আর নিষ্ঠুরতা আবার যদি জন্ম নেয়, এই অন্ধকার আবার ফিরবে।”
কথা শেষ হতেই সব আত্মা মিলিয়ে গেল শূন্যে।
সমাপ্তি
অভিজিৎ, রুদ্র আর গিরিধর বাবু দৌড়ে বেরিয়ে এল জ্বলতে থাকা চৌধুরীবাড়ি থেকে।
বাইরে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা আতঙ্কে কাঁপছিল।
চোখের সামনে বিশাল অট্টালিকা আগুনে ভস্ম হয়ে গেল।
মাটির ভেতর গর্জন তুলে প্রাসাদটা ভেঙে পড়ল ধুলায়।
রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
“অভি… শেষমেশ আমরা পারলাম।
চৌধুরীর অভিশাপ শেষ।”
অভিজিৎ দূরের আকাশের দিকে তাকাল।
কালো মেঘ কেটে গিয়ে ফুটে উঠল ভোরের আলো।
সে শান্ত গলায় বলল—
“হ্যাঁ, অভিশাপ শেষ…
কিন্তু ইতিহাসের রক্তচিহ্ন কখনো মুছে যায় না