“বিরহের সেতু”
|

“বিরহের সেতু”

দুই রাজ্যের শত্রুতা, দুই হৃদয়ের প্রেম

সুদূর অতীতের কথা। উত্তর দিকের পাহাড় আর দক্ষিণ দিকের সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল দুটি শক্তিশালী রাজ্য—অরুণেশ্বর আর চন্দ্রাভা। দুই রাজ্যের সীমানায় ছিল এক অদৃশ্য সেতু।
দুটি রাজ্য যেন জন্ম থেকেই শত্রু।
একদিকে ছিল অরুণেশ্বরের শক্তিশালী সৈন্যদল, অন্যদিকে চন্দ্রাভার বুদ্ধি ও জাদুমন্ত্রে পারদর্শী পুরোহিতরা।
শত বছর ধরে যুদ্ধ, রক্তপাত, প্রতিশোধ আর অভিমানেই তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সাধারণ মানুষরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
কারণ প্রতিটি প্রজন্মের গল্প শুরু হত যুদ্ধ দিয়ে আর শেষ হত হারানোর শোক দিয়ে।
কেউ ভাবতেও পারত না—এই দুই রাজ্যের মাঝখানে কোনোদিন প্রেম জন্ম নিতে পারে।

কিন্তু ভাগ্যের ইচ্ছা ভিন্ন ছিল।

অরুণেশ্বর রাজ্যের রাজপুত্র অভিলাষ—সে ছিল সাহসী, কিন্তু অস্থির হৃদয়ের এক তরুণ।
শিকার আর তলোয়ার চালনা তার নেশা হলেও, অন্তরের গভীরে সে খুঁজত কিছু ভিন্ন—
একটা ভালোবাসা, যা তাকে রাজকীয় প্রাচীরের বাইরে নিয়ে যাবে।

একদিন শিকারের অজুহাতে সীমান্ত নদীর ধারে চলে এল অভিলাষ।
সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক পুরনো সেতু, অর্ধেক ভাঙা, শ্যাওলায় ঢাকা।
রাজ্যের মানুষ বিশ্বাস করত—সেতুটি অভিশপ্ত।
পূর্ণিমার রাতে নাকি আত্মারা সেখানে ঘুরে বেড়ায়, আর যে-ই সেতু পাড়ি দিতে যায়, সে আর কোনোদিন ফিরে আসে না।

অভিলাষ কৌতূহলী হয়ে সেতুর ধারে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল এক অপরূপ দৃশ্য—
নদীর অপর প্রান্তে, চাঁদের আলোয় ভিজে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী।
সাদা পোশাক, চোখে যেন গভীর সমুদ্রের নীলাভ ছায়া।

সে আর কেউ নয়—চন্দ্রাভা রাজ্যের রাজকন্যা লাবন্যা
অভিশপ্ত সেতুর গল্পে ভয় না পেয়ে সে প্রায়ই এখানে আসে একা বসে থাকতে।
নদীর জলে নিজের ছায়া দেখে সে গান গাইত, যেন নিজের দুঃখ লুকোতে চাইত সুরের আড়ালে।

চোখে চোখ পড়তেই সময় যেন থেমে গেল।
এক রাজ্যের রাজপুত্র, অন্য রাজ্যের রাজকন্যা—
যাদের মিলনের কথা কেউ ভাবতেও পারে না, তাদের হৃদয়ে তখন অজান্তে বেজে উঠল প্রেমের প্রথম সুর।

মিলনের গোপন সেতু

প্রথম দেখার সেই মুহূর্ত থেকেই অভিলাষ আর লাবন্যার মধ্যে অদ্ভুত এক টান তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু তারা দু’জনেই জানত—এ প্রেম প্রকাশ পেলে দুই রাজ্যের মধ্যে আবার রক্তের ঝড় বইবে।
তাই চাঁদের আলোয় ঢাকা পুরনো সেতুই হয়ে উঠল তাদের গোপন আশ্রয়।

সেতুটি ছিল অনন্য।
লোককথা ছিল—প্রতি পূর্ণিমায় সেতুটি নতুন আলোয় ভেসে ওঠে।
তখন সেতুর পাথরে খোদাই করা পুরনো অক্ষরগুলো জ্বলে ওঠে যেন আগুনের মতো, আর নদীর জলে প্রতিফলিত হয় নীলাভ আভা।
মানুষ ভয় পেত, কিন্তু অভিলাষ আর লাবন্যা খুঁজে পেল ওখানেই মুক্তি।

প্রথম মিলন

অভিলাষ এক রাতে সাহস করে এগিয়ে গেল সেতুর মাঝামাঝি।
অপর প্রান্ত থেকে লাবন্যাও এল।
তাদের পায়ের শব্দে সেতুর অন্ধকার যেন কেঁপে উঠল, আর চাঁদের আলো গাঢ় হয়ে তাদের ঘিরে ধরল।

অভিলাষের কণ্ঠে ছিল দ্বিধা, তবু কোমল সুর—

“তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”

লাবন্যা মৃদু হেসে উত্তর দিল—

“ভয় আমি পাইনি, পাই শুধু আমার হৃদয়ের কাছে হেরে যাবার আশঙ্কা।”

সেই রাত থেকেই শুরু হল তাদের গোপন মিলন।
প্রতি পূর্ণিমায় তারা দেখা করত এই সেতুতে।
অভিলাষ নিয়ে আসত বাঁশি, বাজাত গভীর সুর, আর লাবন্যা গাইত মায়ের শেখানো গান।
সেতুর ওপরে ভেসে বেড়াত অদ্ভুত সুরের মায়া, যেন নদীর ঢেউও থেমে শুনত।

প্রেমের প্রথম প্রতিজ্ঞা

এক রাতে অভিলাষ লাবন্যার হাত ধরতে চাইল।
ঠাণ্ডা হাওয়ায় লাবন্যার আঙুল কেঁপে উঠল, কিন্তু সে হাত সরাল না।
চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে অভিলাষ বলল—

“এই সেতু আমাদের শত্রু রাজ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু যদি তুমি চাও, তবে এই সেতুই হবে আমাদের প্রেমের সেতু।”

লাবন্যা চোখ নামিয়ে মৃদু স্বরে ফিসফিস করে বলল—

“আমি চাই। তবে ভয় করি, এই প্রেমের মূল্য আমাদের জীবন দিয়ে না দিতে হয়।”

অভিলাষ হেসে উঠল,

“প্রেম যদি সত্যি হয়, তবে জীবনও তুচ্ছ।”

সেতুর বাতাস তখন যেন তাদের প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হয়ে বইছিল।

ধরা পড়া ও অভিশাপ

প্রেম যতই গোপন হোক, চিরকাল ঢাকা থাকে না।
অভিলাষ ও লাবন্যার সেতুর মিলনও অচিরেই পৌঁছে গেল রাজপ্রাসাদের কানে।
প্রথমে গুজব, পরে গুপ্তচরের চোখে ধরা পড়া।
অবশেষে দুই রাজ্যের রাজারা রুষ্ট হয়ে উঠলেন—
“শত্রুর রক্ত আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশতে পারে না!”

অরুণেশ্বর রাজ্যের সৈন্যরা এক রাতে অভিলাষকে ধরে নিয়ে এল প্রাসাদে।
তার চোখে তখনও লাবন্যার প্রতিচ্ছবি ভাসছিল।
রাজা তাকে ধমক দিলেন—

“শত্রুর রাজকন্যাকে ভালোবেসেছিস? এ আমাদের রাজবংশের অপমান!”

অভিলাষ মাথা উঁচু করে বলল—

“প্রেমের কোনো রাজ্য নেই, কোনো সীমানা নেই।
আমার অপরাধ একটাই—আমি সত্যিকারের ভালোবাসতে শিখেছি।”

কিন্তু রাজসিংহাসনের অহংকার তার এই উত্তর শুনতে চাইল না।

লাবন্যার অভিশাপ

অপরদিকে চন্দ্রাভার প্রাসাদে লাবন্যাকে ডেকে আনা হল।
সেখানে প্রবীণ পুরোহিতরা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ঘোষণা করল—

“তুমি শত্রুর রাজপুত্রকে ভালোবেসেছো!
এই অপরাধে তোমার জন্য থাকবে এক অভিশাপ।”

তারা মন্ত্র উচ্চারণ করল, আর লাবন্যার চারপাশে কালো ধোঁয়া ঘিরে ধরল।
অভিশাপ ঘোষণা হল—

“তুমি চিরকাল বিরহে দগ্ধ হবে।
প্রতি পূর্ণিমায় তুমি সেতুর ওপরে দাঁড়াতে পারবে,
তোমার প্রিয়জনকে দেখতে পাবে,
কিন্তু কোনোদিন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।”

লাবন্যা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
তার চোখে অশ্রু ঝরতে লাগল নদীর স্রোতের মতো।

এরপর থেকে শুরু হল এক অদ্ভুত দুঃখের জীবন।
পূর্ণিমার রাতে সেতুটি আলোয় ভেসে উঠত, অভিলাষ আসত বন্দি জীবন থেকে চুরি করে, আর লাবন্যা অভিশপ্ত হয়ে হাজির হত।
তারা দু’জনেই একে অপরকে চোখে চোখে দেখত, কথাও বলত,
কিন্তু মাঝখানে থাকত অদৃশ্য দেওয়াল—
হাত বাড়ালেই যেন কাঁচের দেয়ালে ঠেকে যেত আঙুল।

সেতুটি, যা একসময় প্রেমের আশ্রয় ছিল, এখন হয়ে উঠল বিরহের প্রতীক।
হাসি হারিয়ে গেল, রইল শুধু অপেক্ষা আর অশ্রু।

ত্যাগের সিদ্ধান্ত

পূর্ণিমার আলোয় সেতু তখনও দাঁড়িয়ে থাকে তাদের অপেক্ষায়।
লাবন্যা আসে অভিশপ্ত দেহ নিয়ে, অভিলাষ আসে বন্দিত্ব ভেঙে।
দু’জনের চোখে থাকে প্রেম, কিন্তু হাতে থাকে শূন্যতা।
প্রতি রাতের মতো সেই রাতেও তারা দু’জন একে অপরকে দেখতে পেল।

কিন্তু অভিলাষের মনে তখন তীব্র ঝড় বয়ে চলেছে।
কারণ কয়েক দিন আগে বন্দিশালায় এক বৃদ্ধ জ্যোতিষী তাকে একটি সত্যি বলে গিয়েছিল—

“এই অভিশাপ ভাঙবে না যতক্ষণ না কোনো প্রেমিক নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয়।
রক্তের বিনিময়েই মুক্তি আসবে।
একজনের মৃত্যুতে অন্যজনের স্বাধীনতা।”

অভিলাষ জানত, এই অভিশাপ ভাঙা না গেলে তারা চিরকাল সেতুর দুই পাশে বন্দি হয়ে যাবে।
ভালোবাসা থাকবে, কিন্তু মিলন হবে না।
সে নিজের হৃদয়ের ভেতর সিদ্ধান্ত নিল—এই অভিশাপ ভাঙতে হলে তাকে ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।

সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে অভিলাষ বলল—

“লাবন্যা, আমি তোমার চোখে প্রতিদিন কষ্ট দেখি।
আমি তোমার হাত ধরতে পারি না, কিন্তু আমি তোমাকে মুক্ত করতে পারি।”

লাবন্যা আতঙ্কে জিজ্ঞেস করল—

“তুমি কী বলতে চাইছো অভিলাষ? তুমি তো আমাকে ছেড়ে যাবে না, তাই তো?”

অভিলাষ মৃদু হেসে উত্তর দিল—

“আমার জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আমাদের প্রেম অমর।
যদি আমার মৃত্যু তোমার জন্য মুক্তি আনে, তবে সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় জয়।”

লাবন্যার আর্তি

লাবন্যা ভেঙে পড়ল।
তার অশ্রু ঝরে পড়ল সেতুর ঠাণ্ডা পাথরে।
সে চিৎকার করে বলল—

“না! আমি মুক্তি চাই না যদি তার মানে হয় তোমাকে হারানো।
আমাকে অভিশপ্ত থাকতে দাও, কিন্তু তোমাকে আমার পাশে থাকতে দাও।”

কিন্তু ভাগ্যের নিয়ম কারও কান্নায় থামে না।
অভিলাষ জানত, তাদের জন্য কেবল একটাই পথ খোলা আছে—ত্যাগ।

অভিলাষ হাত আকাশের দিকে তুলে প্রতিজ্ঞা করল—

“আজকের পূর্ণিমাই আমাদের জীবনের শেষ পূর্ণিমা।
আমার রক্তে যদি এই সেতু মুক্ত হয়, তবে আগামী প্রজন্মের প্রেমিকরা এখানে হাসিমুখে মিলতে পারবে।”

চাঁদের আলোয় তার চোখ ঝলমল করছিল,
আর লাবন্যা বুঝতে পারছিল—সে তার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে চলেছে।

অমর বিরহের আলো

সেই রাত, পূর্ণিমার চাঁদ আকাশ ভরিয়ে রেখেছে।
সেতুর দু’পাশে জমে আছে নীরবতা, কেবল বাতাসের হাহাকার আর দুই প্রেমিকের চোখের জল সাক্ষী হয়ে আছে।

অভিলাষের আত্মাহুতি

অভিলাষ লাবন্যার হাত ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু অদৃশ্য বাধা তখনও বিদ্যমান।
সে গভীর শ্বাস নিল, আর ধীরে ধীরে কোমর থেকে তলোয়ার বের করল।

লাবন্যা কেঁদে উঠল—

“না! অভিলাষ, তুমি এ কাজ করবে না… আমার জন্য তুমি মরবে না।”

অভিলাষ শান্ত কণ্ঠে বলল—

“প্রেম যদি কেবল বাঁধন হয়ে থাকে, তবে তা প্রেম নয়।
প্রেম তখনই অমর, যখন ত্যাগে তার পূর্ণতা আসে।”

এ কথা বলেই অভিলাষ নিজের বুক ভেদ করল তলোয়ারে।
লাবন্যার হাহাকার আকাশ বিদীর্ণ করল।

অভিশাপ ভাঙা

অভিলাষের রক্ত গড়িয়ে পড়তেই সেতুর অদৃশ্য দেওয়াল ভেঙে গেল।
হাজার বছরের অভিশাপ মুহূর্তেই ভস্মীভূত হলো।
লাবন্যা ছুটে গিয়ে প্রথমবারের মতো অভিলাষকে স্পর্শ করল।

কিন্তু সেই স্পর্শে প্রাণ নেই, কেবল নিস্তব্ধতা।
অভিলাষের ঠোঁটে তখনও একটুকরো শান্ত হাসি জমে আছে—
যেন সে চেয়েছিল ঠিক এভাবেই লাবন্যার হাত ধরে শেষ নিঃশ্বাস নিতে।

লাবন্যার প্রতিজ্ঞা

লাবন্যা তার প্রিয়জনের নিথর দেহ বুকে চেপে অশ্রুতে ভাসল।
সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল—

“তুমি গেলে অভিলাষ, কিন্তু তোমার প্রেম কখনো মরবে না।
আমি বাঁচব, কিন্তু তোমার নামের ছায়াতেই বাঁচব।
আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে থাকবে তোমার স্মৃতি, আমার প্রতিটি বিরহে থাকবে তোমার আলো।”

সেতুর নামকরণ

সেদিন থেকে রাজ্যের মানুষ সেই সেতুকে বলল— “বিরহের সেতু”
কেউ বলে সেখানে রাতে এখনো পূর্ণিমায় আলো ঝলমল করে,
আর নদীর ধারে শোনা যায় এক নারীর কান্না, যে আজীবন তার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছে।

biroher setu 2 pic

অভিলাষ নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেল—
প্রেম কেবল মিলনের আনন্দ নয়, প্রেম ত্যাগেও অমর হতে পারে।
লাবন্যা একা বেঁচে রইল, কিন্তু তার হৃদয়ে জ্বলতে থাকল সেই অমর বিরহের আলো

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *